এ শহরে বৃষ্টি নামুক শেষ পর্ব 

এ শহরে বৃষ্টি নামুক শেষ পর্ব 
লেখিকা মালিহা খান

ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে আলোর পোকা ঝাঁক বেঁধেছে। হলুদ আভার নিচে অনবরত উড়ে যাচ্ছে বিশৃঙ্খলভাবে। অতিশয় জটিল, বিদঘুটে, কুৎসিত লাগছে দৃশ্যটা। নিভ্রান চোখ সরিয়ে নিলো। বাহুতে কপাল মুছে শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুললো। ঘেমে গেছে। বুকের শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। রাস্তায় জ্যাম। চৌরাস্তার মোড়ে প্রাইভেট কারের জটলা। এসি ছেড়েও জানলা খুলে বসে আছে সে। অসহনীয় গরম পড়েছে আজ।
পাশের সিটে হলুদ রংয়ের প্যাকেট। ভিতরে আল্ট্রার রিপোর্ট। আসার সময় নিয়ে এসেছে হসপিটাল থেকে। জ্যাম থাকায় গাড়ি আগে বাড়ছেনা। হাত বাড়িয়ে কাগজটা বের করলো সে। সাদা কাগজের উপরের দিকে স্ট্যাপলার দিয়ে পিন করা ছোট্ট কালো রংয়ের কাগজটা। স্পষ্ট একটা অবয়ব। আবছা আকৃতি। তার রাজকন্যার। তার ছোট্ট পরীর।

নিভ্রান রিপোর্টের উপরেই চুমু খেলো। খুব আদরে ভরা চুমু। মেয়েটা জন্মানোর পরে কপালে প্রথম চুমুটা সে-ই খাবে।
ফোন বাজলো। নিভ্রান ধরলোনা প্রথমবারে। লাইট কেটে গেলো। সেকেন্ড বাদেই আবার বাজতে শুরু করলো।
রিপোর্টটা যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখলো সে। একটু ভাঁজ পরলে অনর্থ ঘটে যাবে যেনো। নিশাদ ফোন করেছে।
ভ্রু কুচকে ফোন ধরলো সে। ওপাশ থেকে ঠাট্টাপূর্ণ কথা আশা করলেও শোনা গেলো তার বিপরীত। অভিসঙ্কিত কন্ঠস্বর,
—“হ্যালো? হ্যালো ভাইয়া? কোথায় তুই? কতক্ষণ লাগবে আসতে?”
নিভ্রান বাঁকানো গলায় বললো,”তুই বাসায়? কিছু হয়েছে? রাত? রাত ঠি ক আছেতো?”
নিশাদ রুদ্ধ স্বরেই বললো,”ভাবির খারাপ লাগছে খুব। আমরা বসে আছি কাছে তবু তোকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা মেয়ে। জলদি আয় প্লিজ। ড.নিকিতাকে বাসায় আসতে বলেছি। হসপিটাল তো দূর হয়ে যায়। তাছাড়া ভাবি এতো নড়াচড়া করতে পারবেনা। গুটিশুটি হয়ে বসে আছে আমার সাথে।”
নিভ্রান খেই হারানো বেগতিক গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“হসপিটাল? কেনো? ওর কি বেশি খারাপ লাগছে? মাথায় হাত বুলিয়ে দে। ভয় পেয়ে যায়তো তাই ওমন করে।”
নিশাদ নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,”উনার তোকে লাগবে ভাই।”
নিভ্রান আস্তে করে উওর দিলো,
—“আসছি, আসছি।”
নিশাদ ফোন কাটতে কাটতেই খেয়াল করলো রাত্রির নাকের পাশ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। নি:শব্দে কাঁদছে ।
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে পকেট থেকে রুমাল বের করলো সে। পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,”ভাবি? কাঁদছেন কেনো? ভাইয়া আসছে তো। একটু পরেই চলে আসবে।”
ঘরে ঢোকা মাত্রই নিভ্রান খেয়াল করলো সোফায় বাবা বসে আছে। নওশাদ সাহেব। একটু আগেই এসেছেন তিনি। খবর পেয়ে বাসায় থাকতে পারেননি আর। মুখে প্রখর দুশ্চিন্তার ছাপ। চোখাচোখি হলো। নওশাদ সাহেব অষ্পষ্ট স্বরে বললেন,”এসেছো তবে।”
রাত্রি তখনো নিশাদের কাছেই। চোখ বন্ধ বিধায় সে এসেছে বুঝতে পারেনি। স্নেহপূর্ণ হাতে তাকে আগলে রেখেছে নিশাদ। রক্তের সম্পর্ক না হলেও দায়িত্বশীল বড়ভাই যেনো। নিভ্রান হাসলো। কাছে যেতেই উঠে দাড়াতে গেলো নিশাদ। নিভ্রান থামালো। রাত্রির মাথায় হাত রেখে নরম গলায় ডাকলো,”রাত?”

রাত্রি নিভন্ত চোখে তাকালো। প্রাণহীন নয়ন। ফ্যাকাশে চেহারা। হৃদযন্ত্রে কেও যেনো পাথর দিয়ে আঘাত করলো নিভ্রানের। যন্ত্রনায় থেতলে গেলো প্রেমপূর্ণ অভ্যন্তর। এতোক্ষণ পর ভরসার মানুষটার দেখা পেয়ে নরম হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে দিলো রাত্রি। নিরুপদ্রব বুকে টেনে নেয়ার আদুরে আঁকুতি। নিভ্রান আশেপাশে তাকালো। নিশাদ উঠে দাড়ালো তাড়াতাড়িই।
নিভ্রান চোখেমুখে আংশিক লজ্জা নিয়েই বুকে টেনে নিলো স্ত্রীকে। গোপনে ছোট্ট একটা চুমুও খেয়ে নিলো চুলের ভাঁজে। রাত্রি আধো আধো কন্ঠে বুলি ছাড়লো,”আপনি কোথাও যাবেননা আর।”
নিভ্রান তর্কে গেলোনা। কোমল কন্ঠে সম্মতি দিলো,”আচ্ছা, ঠি কাছে।”
নওশাদ সাহেব ধীরগলায় বললেন,”অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি আসবা। মেয়েটা থাকতে পারেনা। দেখোইতো।”
নিভ্রান গলা ঝেড়ে বললো,”ও একটু ভয় পায় আসলে।”
—“কই এখন তো পাচ্ছেনা। এতক্ষণ কেমন করছিলো জানো? উনি উনি করে পাগল হয়ে গেছিলো। এখন দেখো, চুপ হয়ে বসে আছে।”
নিভ্রান লজ্জা পেলো। মৃদু গতিতে মাথা নাড়ালো শুধু। তার সাথে থাকতে থাকতে মেয়েটাও পাগল হয়ে গেছে।

রিপোর্ট দেখে, রাত্রিকে দেখে মিস.নিকিতা হেসে বললেন,”ইটস্ ভেরি নরমাল। মাশআল্লাহ, বাচ্চা হেলদিভাবে বড় হচ্ছে। আকৃতি বৃদ্ধির সাথে সাথে জরায়ুতে প্রভাব পড়ে। তখন ব্যাথা হয়। তাছাড়া উনার ব্লিডিংও হয়নি। হলে তবে হয়তো মিসক্যারেজের সম্ভাবনা ছিলো। আসলে প্রথমবার তো। সেজন্ইয পেইনটা সহ্য করতে কষ্ট হয়।”
নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,”বুঝেছো? বাচ্চার কিছু হয়নি।”
রাত্রি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁটের উপরে জমে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে ঘাম মুছলো। ব্যাথায় কেমন লাগে শুধু সে আর তার আল্লাহ জানে। খালি মনে হয় এই বুঝি সময় শেষ। সে বুঝি তার মানুষটার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। আর দেখতে পাবেনা সুদর্শন মুখটা। এত ব্যাকুল লাগে। একটু দেখার জন্য ছটফট করে প্রাণপাখি।

নিভ্রান আলতো করে কপালের চুল কানের পিছে গুঁজতে গুঁজতে বললো,”এতো ভয় পাও কেনো রাত?”
রাত্রি না তাকিয়েই বিরবির করলো,”আপনি সাথে থাকেন না যে।”
মিস.নিকিতা মুখোমুখি বসলেন। রাত্রির একহাত মুঠোয় টেনে বললেন,”আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা মেয়ে। তবে ব্যাথা উঠলে এতো ঘাবড়ে যান কেনো? ভয়ের তো কিছু নেই। ব্যাথা হলে উঠে দাড়াবেন। আস্তে আস্তে হাঁটবেন। না পারলে শুয়ে পড়বেন। রেস্ট করবেন। বাচ্চা আরো বড় হবে। মুভমেন্ট করবে। আপনি বুঝতে পারবেন। সে নড়ছে। হ্যাঁ, ব্যাথা করবে। কিন্তু এটাই তো মাতৃত্ব। এটাই মাতৃত্বের স্বাদ। শত রাতের কষ্টের পর যখন বাচ্চাকে কোলে নিবেন মনে হবে এসব কিছুই ছিলোনা। একেবারেই কিছু ছিলো না। কিসের কষ্ট? এতেই তো সব সুখ।”
নিভ্রান হাসলো। রাত্রি হা করে তার কথা গিলছে। চোখে জমেছে অশ্রু। নিভ্রান চোখ মুছিয়ে ম্লান গলায় বললো,
—“খালি কেঁদে দেয়। আমি কই যাবো ওকে নিয়ে, বলেন?”
মিস.নিকিতা হেসে বললেন,”আপনি আপাতত উনার সাথে থাকেন। কোথাও গেলেই বিপদ।”

অসুস্থ শরীর নিয়েই পরীক্ষা দিলো রাত্রি। এক পরীক্ষায় তো লিখতে লিখতে হলেই ঘুমিয়ে পরেছিলো। নিভ্রান প্রিন্সিপালকে বলে তার নির্ধারিত সময় বাড়িয়েছিলো। তার অসুস্থতা দেখে অনুমতিও দিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল।
ছোটখাটো ঝড়- ঝাপটা সাথে নিয়েই পরীক্ষা শেষ হলো। রাত্রি কে আনা-নেয়া, দেখে রাখা সবই নিভ্রানের উপর দিয়ে। মেয়েটা যে তাকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। পরীক্ষার সময়টুকু সে ভার্সিটির ওয়েটিং রুমেই কাটাতো। যদি কিছু হয়ে যায়? হয়নি অবশ্য।
তারপরের দিনগুলো পেরোলো ঘরে বসে বসেই। কতশত মধ্যরাতে রাত্রি চোখ মেলে দেখতো নিভ্রান আগে থেকেই উঠে বসে আছে। মগ্ন চোখে কি যেনো দেখছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। জিজ্ঞেস করলেই শুধু বলতো,”তুমি ভীষণ সুন্দর রাত। এতো সুন্দর রাত গোটা পৃথিবীতেও নামে না।”

পশ্চিমাকাশের মনচিত্ত উদাসীন হয়ে আছে ভোর থেকেই। একগুচ্ছ কৃষ্ণবর্ণীয় কাদম্বিনী ছেঁয়ে আছে সেখানটায়। খুব মন্থরগতিতে বিস্তার লাভ করেছে তার প্রান্তর। আধিপত্য বাড়ছে গুমোট কালোর।
অন্তরীক্ষের গাঢ় ছাই রঙা বেশভূষা সহজেই জানান দিচ্ছে ভয়ানক বর্ষণ নামবে আজ।
রিক্ত কাঙাল প্রেমিকটাও হয়তো খোঁজ পেয়ে যাবে সিক্ত অনুভূতির। ভিজে উঠবে পাহাড়, রাজপথ, প্রকৃতি আর রুক্ষ্ন হৃদপিন্ড।
রাত্রি অসন্ধিত, অনন্বিত, নিস্পৃহ চেয়ে আছে শুন্য গগনে। বামকাঁধের আঁচলটা যত্নহীন উড়ছে শিশির সমীরনে। আঁধখোলা খোঁপাটা যেন পুর্ণতা দিয়েছে তার অমিত্রাক্ষর সন্ন্যাসী ভাবাবেশ। আদিত্য উত্তাপরাজা এখনো পদার্পণ করতে পারেননি। মেঘেদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। আকাশ আজ তাদের দখলে। শীতলস্নিগ্ধ মেঘমালার রাজ্যে আজ উত্তাপের প্রবেশ বারণ। হাল্কা হাল্কা ময়ুখের ঝলকানি অবশ্য বারণ অমান্য করেই মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। রাত্রি হাসলো হঠাৎই। আকাশেও কি যুদ্ধ হয়? ওখানেও কি মতবিরোধ লাগে?
পেছন থেকে একটা ঘুমে অসাড় হয়ে আসা উচ্চডাক,”রাত? ওখানে কি করছো? একা একা উঠেছো কেনো? সকাল হয়নি এখনো। ঘুমাতে এসো।”

রাত্রি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। নিভ্রানের উদাম গা। বালিশ থেকে মাথা খানিকটা উঠিয়ে নিদ্রাভারে চোখের পাতা কুঁচকে হাঁক ছাড়ছে সে। কি সুন্দর লাগে মানুষটাকে। এক্কেবারে রক্ত জমানো সুপুরুষ যেনো। মিষ্টি রিনঝিনে গলায় সে উওর দিলো,
—“একটু দাড়াই? ভালোলাগছে খুব। আপনি ঘুমান।”
নিভ্রানের কপালে দুই ভ্রুর মাঝবরাবর একটা ভাঁজ পরলো। সৌন্দর্য্য বাড়লো আরো। রাত্রি যেনো মরে গিয়েও বেঁচে উঠলো সেই রুপে। তাকে অকপট চেয়ে থাকতে দেখে ঘুমে বিবশ নিভ্রান কাতর, টলমলে, নিশ্চল পায়েই উঠে দাড়ালো। ডানহাতে দু’বার চোখমুখ ডলে তন্দ্রাঘোর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলো। রাত্রির কাছাকাছি যেতে যেতে বললো,”তুমি চরম অবাধ্য হয়েছো রাত। আমার একটা কথাও শুনোনা।’
রাত্রি অসহায় গলায় প্রতিবাদ করলো,
—“আহ্, আপনি উঠলেন কেনো? আমার ঘুম হয়ে গেছে তো। আর ঘুমাবোনা।”
নিভ্রান রুগ্ন গলায় বললো,
—“ঘুম হয়ে গেছে না? তুমি ঘুমিয়েছো কখন? ঠি ক চারটা বাইশে। আযানের পর। আমি নামায পড়ে শুলাম, তখন মাত্র তোমার ঘুম গভীর হয়েছে। আর এখন ক’টা বাজে? সাড়ে ছয়টা। সারাদিনে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমালে কিভাবে হবে?”
রাত্রি মুখ ছোট করলো। অকস্সাৎ প্রভন্জনে শাড়ির আচঁল খসে পরলো কাঁধ থেকে। নিভ্রানে তীক্ষ্ণ চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত তুলে দিলো। কব্জি চেপে বললো,

—“আমি এসি বন্ধ করে ঘুমাই তোমার শীত করে বলে আর তুমি সকাল সকাল গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছো? চলো রুমে, আমার মেয়েটাও বিরক্ত হয় পেটের ভিতর। কই মা একটু চুপচাপ থাকবে। ঘুমাবে, খাবে। না! তা না! এসো।’
রাত্রি গেলোনা। ঠাঁট মেরে দাড়িয়ে রইলো। নিভ্রান রক্তগরম চোখে তাকাতেই সে পায়ের পাঁচআঙ্গুলে ভর দিয়ে একটু লম্বা হলো। হাত ছাড়িয়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজলো। নিভ্রান নিজ থেকেই ঝুঁকে গেলো অনেকটা। রাত্রির আঙ্গুল ফ্লোরে নেমে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো সে। পরমূহুর্তেই প্রেয়সীর বিচিত্র কর্মকান্ডে ভ্রযুগল স্হির হয়ে গেলো। মাথার পিছে হাত রেখে হতভম্ব গলায় বললো,
—“কামড়াচ্ছো কেনো?”
রাত্রি আবার কামড় বসালো একই জায়গায়। নিভ্রান স্বর টেনে বললো,
—“রাত!”
রাত্রি দুষ্টু কন্ঠে বললো,”ব্যাথা পান?”
নিভ্রান হাসলো। চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শান্ত গলায় বললো,”তোমার দাঁতের এতো ক্ষমতা নেই বিড়ালিনী।”
রাত্রি হাল ছাড়লো। মুখ তুলে চোখে চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিভ্রান দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
—“হয়েছে চলো, ঘুমাবে।”
রাত্রি গলা ছাড়লো ঠি ক তবে পরমূহুর্তেই গালে হাত রেখে ত্রস্ত, ভীত গলায় বললো,”আপনি আবার গাল কেটেছেন?”
নিভ্রান প্রত্যুওর করলোনা। পলকশূণ্য, নিমেষহীন চেয়ে রইলো সামনের বিচলিত, ব্যাথাতুর নয়নজোড়ায়।
এই চোখের চেয়েও বেশি মায়া ধারণ করার মতো বস্তু আছে এ ধরণীতে? নেই বোধহয়। অন্তত তার জন্যে?
রাত্রি আবার বললো,”এটা কাটলো কখন? রাতেও আপনার দাঁড়ি ছিলো।”
নিভ্রান ভাবলেশহীন বললো,
—“তুমি ঘুমানোর পর শেভ করেছিলাম রাত। এখন চলোতো। ঠান্ডায় তোমার লোম দাড়িয়ে গেছে।”

মেঘলা মধ্যান্হ।
নাহিদা ইলিশ মাছের লেজের কাঁটা বাঁছতে ব্যস্ত। তার একনিষ্ঠ ভাব দেখে রুবিনা মলিন গলায় বললো,” এত কষ্ট করছেন কেনো আপা? লেজে কাঁটা বেশি। আমি টুকরো বেঁছে দেই।”
নাহিদা হাসলেন। চোখের ইশারায় মানা করে আল্হাদি কন্ঠে বললেন,
—“উহুম! মেয়ে আমার হরিণের মাংস খাবে। ওটাই নাকি মজা লাগে। কাল জানেন, পুরো সাত টুকরো মাছের সাইডের ওইটুকু খয়েরি রংয়ের মানে তার হরিণের মাংস দিয়ে ভাত খাইয়েছি। মাছ খাবেনা। লেজে এই মাংস বেশি থাকে। তাই ওর জন্য লেজই করেছি আলাদা করে।”
রুবিনা হাঁফ ছেড়ে বললেন,
—“মেয়েটা এতো কষ্ট করায়। আর আপনিও কিছু বলেন না।”
নাহিদা যেনো একমূহুর্তের জন্য অতীতে ফিরে গেলেন। বিশীর্ণ কণ্ঠে বিরবির করলেন,”আমি ওকে কম বলিনি আপা।”
রুবিনা থেমে গেলেন। তার জানা আছে সবই। যদিও সেসব নিয়ে আফসোস নেই বিন্দুমাত্র। এই পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য এখন যেভাবে তার মেয়েকে নি:স্বার্থ ভালোবাসে এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়া যায়না।
রাত্রির বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন মেয়েই ছিলো তার সব। অঢেল টাকা পয়সা না থাকলেও একমাত্র মেয়েকে রাজকুমারীর মতোই রাখতেন তিনি। একটা বকা পর্যন্ত দিতেন না কখনো। রুবিনা বকলে উল্টো তাকেই ধমক লাগাতেন। ছোট্ট রাত্রিকে কোলে নিয়েই বলতেন,”তুমি দেখো রুবি, আমার মেয়ের জন্য একটা সত্যিকারের রাজকুমার রেখে দিয়েছে বিধাতা।” রুবিনা তখন হেসে বলতেন,”এই যুগে রাজকুমার পাওয়া যায়না।” তিনি বিশ্বাস করতেন না। মেয়ের দিকে এক আকাশ মুগ্ধতায় ঘেরা স্বপ্ন নিয়ে চেয়ে থাকতেন শুধু। রুবিনা মনে মনেই স্বগতোক্তি করলেন,”আচ্ছা, আপনি কি দেখতে পারছেন আপনার মেয়ের জন্য সত্যিই সত্যিই রাজকুমার এসেছে?”
চোখের জ্বলনে ভাবনার সুঁতো ছিঁড়লো। নাহিদার মাছ বাঁছা শেষ। তিনি উঠে দাড়িয়েছেন প্লেট হাতে। রুবিনা চোখের জল লুকালেন অতি সন্তর্পনে। এতো সুখে আজ কাঁদার সময় কোথায়?

নীলিমা আকাশ কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। খোঁজ করার কেউ নেই। প্রকৃতি ব্যস্ত বর্ষণ বরণে।
খেলনার দোকান থেকে নওশাদ সাহেবকে একপ্রকার টেনেহিঁচরে নিয়ে এলো নিভ্রান। নওশাদ সাহেব তিক্ত গলায় বললেন,”কি সমস্যা? তোমার টাকা দিয়েতো আর কিনছিনা।”
নিভ্রান বিস্মিত কন্ঠে বললো,
—“আপনি এতো কিছু কেনো কিনছেন বাবা? একই পুতুল কিনেছেন, তাও আবার তিনটা তিন রংয়ের।”
নওশাদ সাহেব সাথেসাথেই বললেন,
—“তোহ? আমার নাতনীর কোন রং পছন্দ হবে তা তো আর আমি জানিনা।”
নিভ্রান অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। পরিশ্রান্ত স্বরে বললো,”এই দানবাকৃতির পুতুল আমি কোথায় রাখবো বাবা? ঘরে এতো জায়গা নেই। সব আগেই ভরে গেছে।”
নওশাদ সাহেব বিরক্ত হলেন,

—“বাবা হয়ে মেয়ের খেলনাপুতুল নিয়ে কিপ্টামি করছো তুমি। আমার মতো হও। তোমার জন্মের সময় গাড়িটাড়ি দিয়ে পুরো বাড়িকেই আস্ত টয়স্টোর বানিয়ে ফেলেছিলাম। আর আমার ছেলে হয়ে তুমি মেয়ের পুতুলের পিছে হাত ধুঁয়ে নেমেছো?”
নিভ্রান গোলমেলে শ্বাস ছাড়লো। এদেরকে বোঝানোই বেকার। সব গুলো গেছে।
—“আচ্ছা ঠি কাছে। যা কিনেছেন, কিনেছেন। আর কিছু লাগবে না। উঠুন গাড়িতে উঠুন।”
নওশাদ সাহেব উঠলেন। ফোন বাঁজলো নিভ্রানের। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে সে কল রিসিভ করলো। ওপাশের কথাগুলো শুনে বললো,”হ্যাঁ, বাবা আমার সাথেই আছে। আসছি বাসায়।”
ফোন রাখতেই নওশাদ সাহেব হাল্কা গলায় বললেন,
—“তুমি আসলেই আমাকে ‘বাবা’ ডাকো, আমার মাঝেমধ্য বিশ্বাস হয়না।”
নিভ্রান উওর দিলোনা। একবার রাত্রি খুব অসুস্থ হলো। অসহ্য ব্যাথায় মেয়েটার জান যায় যায় অবস্থা।হসপিটালে নেয়া লাগলো। তখন পাঁচমাস চলছে। ভারি শরীর তারউপর ব্যাথায় দাড়ানোর শক্তি নেই। নিভ্রান কোলে করে নামাতে যেয়েও কি একটা খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো। ডক্টর চেহারা দেখেই
এডমিট করালো দ্রুত। সেইবার, সেইবার নিভ্রান নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। করিডোরে দাড়িয়ে নওশাদ সাহেবকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠেছিলো। এই লোহার মতো কঠিন ছেলের চোখের জ্বল যখন কাঁধে পড়ছিলো, গলা ধরে এসেছিলো নওশাদ সাহেবের। আলতো করে ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি বলেছিলেন,”কিছু হবেনা বাবা।”
ব্যস! সেই থেকে আর বাবা ছেলের দুরত্ব ঘুঁচে গেলো। অভিমানের পাহাড় গুঁড়িয়ে গেলো নিমিষেই। ‘রাত্রি’,
মেয়েটা যেনো সব পারে।

ঘরে বাতি জ্বলছে। বাইরে ঘনালি সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবছে জগৎ। নিভ্রান দরজা খুলে রুমে ঢুকলো। রাত্রি শুয়ে আছে। ঘুমাচ্ছে। কাছে গেলো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ফর্সা চেহারাটা মলিন হয়ে আছে। গত পরশু ভাতের সাথে বেগুনভাজা খেয়ে ফেলেছিলো। এলার্জির ফলে গলার কিছু কিছু অংশ লালবর্ণ ধারণ করেছে। সকালে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। আবার রাতে লাগিয়ে দিবে। কমে যাবে। স্বাস্হ্য হয়েছে অল্প একটু। সাতমাসের উঁচু পেট। এতো সুন্দর লাগে মেয়েটাকে। বুঝিয়ে কুল পায়না।
মাথা থেকে হাত সরাতেই পিটপিট করে চোখ খুললো রাত্রি। নিভু নিভু তাকাতে তাকাতে ভালো করে চোখ মেললো। নিভ্রানকে দেখতেই মিষ্টি করে হাসলো। হাসলো নিভ্রানও। নরম গলায় বললো,”শুয়ে থাকো। উঠতে হবেনা।”
রাত্রি শুনলোনা। নিভ্রানের বাহু আঁকড়ে, একহাতে পেট চেপে ধরে উঠে বসলো। নিভ্রান পিঠের পিছে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসালো। রাত্রি ভ্রু কুঁচকে বললো,”আজকে না ভাইয়াদের আসার কথা ছিলো? আসেননি?”
নিভ্রান শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,”বাবা এসেছে। নিশাদ আসবে একটু পরে। কাজে আটকে গেছে।”
—“বাবা এসেছে?”
—“হুম। ব্যস্ত হয়োনা। মাত্রই আসলাম আমরা। একটুপরে দেখা করলেও হবে। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি তারপর একসাথে চলো।”
রাত্রি মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। নিভ্রান ওয়াশরুমে ঢুকলো। সে বসে রইলো চুপচাপ। অনার্সের রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। সার্টিফিটেক পেয়ে গেছে। বেশ ভালো হওয়ায় জব নিতে সমস্যা হবেনা। নিভ্রান শুধু বলেছে,”বাচ্চাটা হোক। তারপর জব নিও।” রাত্রি আপত্তি করেনি। আপত্তি করার মতো কিছু নেইও। এই অবস্থায় তার পক্ষেও সম্ভব না কিছু করা।

ঝলমলে ঝাড়বাতিটা ড্রইংরুমের মাঝখান থেকে জ্যোতি ছড়াচ্ছে।
নওশাদ সাহেবের কাছে বসে আছে রাত্রি। তিনি তুমুল উৎসাহে প্যাকেট থেকে পুতুল বের করছেন। বড় বড় দুটো টেডিবিয়ার বসে আছে সামনের সোফা দুটোয়। বাকিগুলো ছোটখাটো জিনিস দিয়ে ভর্তি। নিভ্রানের বসার জায়গা নেই। সে দাড়িয়ে আছে। অদ্ভুতচোখে চেয়ে আছে রাত্রির ঠোঁটভর্তি হাসিতে। মেয়েটা এতো খুশি হয়ে যায় অল্পতেই। নওশাদ সাহেব বিশাল আকৃতির পলিথিন ছিঁড়ে তৃতীয় টেডিটা বের করতে করতে বললেন,”তোমার কি মনে হয় মা? ওর কোনটা পছন্দ হবে?”
রাত্রি বিস্তৃত হাসলো। মিনমিন করে বললো,”আমার মনে হয় সবই পছন্দ হবে বাবা।”
নওশাদ সাহেব উওর দিলেননা। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন পুতুলগুলোর দিকে। এতবড় পুতুল দেখে আবার ভয় পাবেনাতো তার নাতনীটা। আচ্ছা থাক! এরপর নাহয় ছোটগুলো কিনে আনবেন।

দরজা দিয়ে নিশাদ কে ঢুকতে দেখামাত্রই হাসি থামিয়ে নড়েচড়ে বসলো রাত্রি। নিশাদ এগিয়ে আসলো দ্রুত। নিভ্রানের দিকে একপলক চেয়ে ঝুঁকে গিয়ে আলতো করে রাত্রির মাথাটা কাঁধের কাছে চেপে ধরলো। সে এ বাড়িতে আসেনা দেড়মাসের উপরে হয়তো। এত ব্যস্ততা ছিলো একয়দিন। এখনো আছে অবশ্য। ঢাকার বাইরেই তো কাটিয়েছে অনেকদিন। বাবার পুরো ব্যবসাটা তাকে সামলাতে হয়। নওশাদ সাহেবের বয়স হয়েছে। ব্যাবসাবিষয়ক কোন কারনে বাবার উপর চাপ পড়ুক, সে চায়না। হিমশিম খেতে হলেও একাই সব সামলে নেয়। একয়দিনে রাত্রি হাজারবার তাকে আসতে বলেছে। সে আসতে পারেনি কাজের চাপে। এইযে ক’দিন আগে রাত্রি অসুস্থ হলো। হসপিটালে রইলো একসপ্তাহ। তখনো সে রাজশাহীতে। একটাবার দেখতে পর্যন্ত আসতে পারেনি মেয়েটাকে। অথচ ভাতিজির চিন্তায় মন ছটফট করতো সারাক্ষণ। আগত পিচ্চিটাকে ঘিরেই পুরো পরিবারের সব।
রাত্রি আর তার সম্পর্কটা একেবারেই অন্যরকম। বড়ভাবি হলেও বয়সে রাত্রি অনেক ছোট। বোনের মতো কি, সে বোনই ভাবে তাকে। মেয়েটা যখন ‘ভাইয়া’ বলে ডাকে তখন তাকে একমূহুর্তও ভাবি মনে হয়না। ছোটবোনই মনে হয়।
রাত্রি অভিমানি স্বরে বললো,

—“আপনি কতদিন আসেননা ভাইয়া।”
নিশাদ হেসে ফেললো। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—“ব্যস্ত ছিলাম ভাবি। সময় করে উঠতে পারিনি।”পরপরই তাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে রসালো গলায় বললো,”দেখেছেন, আমি যে আসলেই জ্যোতিষবিদ। ভবিষ্যত বলতে পারি। আপনিতো বিশ্বাসই করতে চাইতেন না। মিললো না? মিললো তো। আপনার মেয়ে হবে। ডাক্তার বললো, আমি তখনই শুনেছি।”
রাত্রির চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। ব্যঙ্গ করে বললো,”হুহ! ‘আমি তখনই শুনেছি’। আপনি ছিলেন ওখানে যে শুনবেন?”
নিশাদ ভ্র নাচিয়ে কন্ঠে রহস্য মেখে বললো,
—“আমার শোনার জন্য সেখানে থাকা লাগেনা ভাবি। আমি হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও শুনতে পারি। ইউ নো? আধ্যাত্বিক ক্ষমতা। অলৌকিক ব্যাপার- স্যাপার। আপনি বুঝবেননা।”
রাত্রি ভাবলেশহীন তাকালো। নিভ্রানের দিকে চেয়ে বললো,
—“ধুর! আপনি বলেছেন তাইনা? আপনাকে না বলেছিলাম ভাইয়াকে জানাতে না?”
—“আমাকে ভাইয়া বলেনি ভাবি। আমি নিজেই শুনেছি। তোর বউ আমাকে কখনো বিশ্বাস করেনা ভাইয়া।”
নিভ্রান কাঁধে চাপড় মেরে বললো,
—“তোকে বিশ্বাস করা উচিত ও না অসভ্য।”
নিশাদ পাশের সোফার দিকে তাকালো। একটা টেডি সরিয়ে মাটিতে রেখে নিজের বসার জায়গা করলো।আশেপাশে তাকিয়ে সন্দেহজনক কন্ঠে নিভ্রানকে বললো,”এসব কবে পয়দা হলো? কে জন্ম দিলো ওদের? তুই?”
নিভ্রান হতভম্ব চোখে তাকাতেই সে ফিচেল গলায় বললো,”না মানে, হতেও তো পারে। ভাবির সংস্পর্শে তুইও প্রেগনেন্ট হয়ে গিয়েছিস। ইট ক্যান হ্যাপেন্ড।”
—“নিশাদ, চড় খাবি কিন্তু।”
—“চড় খায় কেমনে? তুই কি আমার মুখের ভিতর থাপ্পড় দিবি? ছিহ্! থুতু থাকে ভাই। তুই বরং গালেই মার।”
নিভ্রান চোখ গরম করে তাকালো। নিশাদ থেমে গেলো। রাত্রিকে ইশারা করে ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে করে বললো,”এইটার সাথে থাকেন কেম্নে?”
রাত্রি অমায়িক হাসলো। বলতে তো পারে না,”একে ছাড়া যে সে থাকতেই পারেনা।”
রাতের খাবারটা একসাথেই খেলো সবাই। নিশাদ আর নওশাদ সাহেব চলে গেলো এগারোটার দিকে। সকালে কাজ আছে তাদের। এত ব্যাস্ততায়ও এসেছে এই তো বেশি। কতদিন পর পুরো পরিবার একসাথে হলো।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে রাত্রি। ফুঁটে উঠা স্বীয় প্রতিবিম্বটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তার বিষাদিনী চোখজোড়া। হাতে ধরা চিরুনিটা ধীরগতিতে চলছে চুলের ভাঁজে ভাঁজে। কথায় আছে,”সৌন্দর্য নারীর অহংকার”। এইযে তার চোখের নিচে কালি জমেছে। রাতে ঘুম আসেনা। বামগালের পাশটায় কয়েকটা ব্রন। চেহারা নিষ্প্রান, ম্লান হয়ে থাকে সারাক্ষণ। শুয়ে বসে কাটাতে কাটাতে শরীরেও পরিবর্তন এসেছে। অতিভাবনায় মাথায় এক উদ্ভট চিন্তা এলো হঠাৎই। আয়না দিয়েই তাকালো সে। নিভ্রান খাটে বসে ফোন স্ক্রল করছে। দৃষ্টি সেখানেই নিবেশিত। নিরুদ্যম গলায় ডাকলো,
—“শুনেন?”
নিভ্রান তাকালো। দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললো,”হুম?”
রাত্রি চিরুনিটা নামিয়ে রাখলো। কেমন একটা পীড়াদায়ক অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে ধরা গলায় বললো,
—“আচ্ছা, আমি যদি কখনো কুৎসিত হয়ে যাই? আপনি কি তখনো আমাকে ভালোবাসবেন? ধরেন, আগুনে যদি আমার চামড়া ঝলসে যায় বা…”
নিভ্রান হতভম্ব। চোখের দৃষ্টি বজ্রহত। মেয়েটা কি সব বলছে? কখনো কিছু বলেনা দেখে যা ইচ্ছা তাই বলে যাবে নাকি? রাগ দমাতে না পেরে কথা শেষ না করতে দিয়েই সজোরে ধমকে উঠলো সে। বাঘের মতো গর্জে বললো,
—“রাত! গাল বরাবর ঠাঁটিয়ে দিবো কিন্তু একটা।”

রাত্রি থেমে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেললো। টপটপ করে পানি পড়লো। ফোঁটাগুলো জমা হলো পায়ের কাছটায়। নিভ্রান উঠে দাড়ালো। কাছে যেতেই এককদম পিছিয়ে গেলো রাত্রি। লোকটা তাকে চড় দিবে বললো? কেনো বললো? তার খারাপ লাগলো না? খুব খুব খারাপ লাগলো তো।
নিভ্রান শক্তহাতে বাহু খামছে কাছে টেনে নিলো তাকে। একহাতে গাল মুছিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বললো,”কেনো বলো এসব? আর হয়ে গেলে হয়ে যাবে। ঝলসে যাক চামড়া। পুড়ে যাক সৌন্দর্য। ভস্ম হোক সব। শুধু তুমি থাকলেই হবে। কি মনে করেছো? এতোটা ঠুনকো আমার ভালোবাসা? সামান্য ঝলসানো চামড়ার কাছেই হেরে যাবে? এতো তুচ্ছ?”
—“আমি সেটা বলিনি।” মিনমিন করলো রাত্রি।
নিভ্রান আগের মতোই প্রকান্ড স্বরে বললো,
—“তবে? কি বললে? “আপনি আমাকে তখনো ভালোবাসবেন?” এটাই তো বললে। আমার পক্ষে অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অসম্ভব রাত।”
রাত্রি নতজানুই হয়ে রইলো। বাহুতে ব্যাথা পাচ্ছে। এতো জোরে ধরেছে। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না। নিভ্রান যদি আরো রেগে যায়? লোকটা রাগলে প্রচন্ড ভয় পায় সে। সেই প্রথম থেকেই। নিভ্রানের এক ধমকে হৃদস্পন্দন থেমে যায় যেন। এতো ভালোবাসে তবু তো কম ধমকায়নি এ পর্যন্ত। সে’বার যে গাড়ির মধ্যে। কি রাগটাই না দেখালো। বেচারী সে তো ভয়েই শেষ।
তার উসখুসানী আর ভয়ে সংকুচিত চোখের কোঁণ দেখে নিভ্রান নিজেই বাহু ছেড়ে দিলো। খানিকটা সময় নিরব থেকে দু’গালে হাত রাখলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে খুব নরম কন্ঠে বললো,
—“এই ধূলিমলিন চেহারায়ও আমি এক বিশ্বসুন্দরীকে দেখি।”

আকাশ ভয়াবহ সাদা। অরন্জিত সরল মেঘেরা প্রস্তুত জলরূপে বাহিত হবার জন্য। হিমঠান্ডা অনিল ইতিমধ্য তার পালকহীন অদৃশ্যডানা ঝাঁপটে দিয়েছে। গাছের পাতা দুলছে জোরালো গতিতে। সাঁই সাঁই শব্দটা স্পষ্ট চড়া। রাত্রি গোসল করে বেরোলো মাত্র। খুব গরম লাগছিলো। চুলের পানিতে আধভেজা কাঁধ-পিঠ। আলগা শাড়ি কোনরকমে জড়ানো। নিভ্রান কতো বলেছে এখন শাড়ি পরার দরকার নেই। ঢিলেঢালা জামা দিয়ে আলমারি ভর্তি করেছে। তবু সে নাছোরবান্দা। শাড়ি ছাড়া ভালোলাগেনা একদম। ব্যালকনির দরজা আটকানো। সচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়েই দেখা যাচ্ছে রেলিংয়ে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে চওড়া কাঁধের দীর্ঘকায় মানুষটা। গায়ে একটা সাদা হাফহাতা টি-শার্ট। ফুঁলে ফেপে উঠা শক্তপোক্ত বাহু নজর কাড়ছে খুব। কালো ট্রাউজার। চুলগুলো উড়ছে প্রচন্ড অনিয়মে।
ভেজা চুলে তোয়ালে না পেচিয়েই স্লাইডিং ডোরটা একটুখানি সরালো রাত্রি। ধুলোঝড়ে সব লন্ডভন্ড। অবচেতন চোখ চট করে ফুলগাছের দিকে তাকালো। বেশ শখ করে লাগিয়েছিলো সন্ধ্যামালতি গাছটা। তিনটা নতুন ফুল ফুটেছে গতকালই। ঝড়ে ভেঙে গেলো নাতো? নাহ্, গাছটা তো নেই এখানে। রাত্রি শূন্যচোখে চেয়ে রইলো।

ঘর থেকে আসা আলোতে লম্বাটে একটা ছায়া দৃষ্টিগোচর হতেই দ্রুত পেছনে ফিরলো নিভ্রান। অর্ধভেজা সিক্ত প্রেয়সী। গলায় লেপ্টে থাকা ভেজা চুলের গোছায় আজন্মের উত্তপ্ত অভিলাষ। একটা ফাঁকা ঢোক গোপনে নেমে গেলো কন্ঠনালি বেয়ে। রাত্রির দৃষ্টি অনুসরণ করে সে হাল্কা গলায় বললো,
—“ঘরে রেখে এসেছি, ভাঙেনি তোমার গাছ।”
রাত্রি তাকালো। বুঝতে অসুবিধা হয়না, লোকটা চেয়ে আছে অন্যনজরে। সেই গভীর দৃষ্টির বিপরীতে লজ্জায় আড়ষ্ট হয় শরীর। থমকে যায় উপশিরা পর্যন্ত। চলে যাবার আগেই নিভ্রান এগিয়ে আসে। গলার পাশে হাত দিয়ে নত মুখ উপরে তুলে। বাতাসে তখন সব এলোমেলো। চুল, শাড়ি, মন, অনুভূতি। নিভ্রান আসক্তের মতো শ্বাস টানে কাঁধের কাছটায়। চুলের পানিতে ভিজে উঠে গাল- ঠোঁট। মাদকীয় ঘ্রাণে বুজে যায় চোখের পাতা। দূবর্ল গলায় প্রশ্ন করে সে,
—“চুল মোছোনি কেনো? জ্বর বাঁধবে তো।”
রাত্রি অবশ স্বরে উওর দেয়,”মুছবো।”

নিভ্রান শুনতে পেলোনা বোধহয়। সব কেমন অন্ধকার লাগছে। ঘোর ঘোর আশপাশ। একটা কাঁপানো ছোঁয়া দিতে দিতে সে অস্ফুট স্বরে বললো,
—“হুম?”
গালজোড়া মনে হচ্ছে রক্তশোভিত। একটু ছুঁলেই লহুরন্জিত হবে। ঝিরিঝিরি মেঘ নেমেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টটায় কি যেনো হয়েছে। একবার জ্বলছে, একবার নিভছে। নিভ্রান মুখ তুললো। অবিন্যস্ত চেয়ে চেয়ে বললো,
—“এই রাঙা গালেই তো মরেছিলাম আমি।”
বর্ষন তখন জোরেই নেমেছে। খুব জোরে। ঝিম ঝিম শব্দে কর্ণকুহর ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। নিভ্রান আচমকাই বললো,”চলো, তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেই।”
রাত্রি মৃদু অষ্পষ্ট স্বরে বললো,”শাড়িই তো পরে আছি।”
—“এটা না, বিয়ের শাড়ি।”
নিভ্রান আবার পাগলামি করলো। সারা আলমারি ঘেঁটেঘুটে এককোণে চাপা পড়ে থাকা বেনারসিটা বের করলো। রাত্রি থামালোনা। যে সেচ্ছায় পাগলামি করে তাকে কি থামানো যায়? উহু!
নিভ্রান নিজহাতে তাকে পরিয়ে দিলো শাড়িটা। মেয়েটার শাড়ি পরা দেখতে দেখতে এই পোশাকের আদ্যপান্ত মুখস্ত হয়ে গেছে।
বিয়ের পর থেকে আজপর্যন্ত রাত্রি এটা গায়ে জড়ায়নি। কেনো? জানেনা। হয়তো ব্যস্ততায়, হয়তোবা সুপ্ত অবহেলায় অথবা আজকের দিনের অপেক্ষায়।

পিচঢালা মসৃন পথ। বৃষ্টিভেজা জলে তার রূপ বেড়েছে শত শত গুন। বর্ণণা করা অতিদুষ্কর। আশেপাশে নাম না জানা বহু গাছগাছালির ভীড়। সবুজপাতা গুলো যেনো এক একটা প্রেমপত্র। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁপছে সব। কাঁপছে তাদের অনুভূতি। ঝড়ো হাওয়ায় উঁচু মগডালগুলো যেনো মাথা নুইয়ে নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে এই বৃষ্টিবিলাসী যুগল কে। ফাঁকা রাস্তায় শুধু তারাই যে এই ভিন্ন প্রেমের সাক্ষী।
রাত্রিকে দু’হাতে ধরে খুব সাবধানে নামিয়ে দিলো নিভ্রান। গাড়ির দরজা আটকে পিছনে তাকাতে তাকাতেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে তার অঙ্গনা। ভিজেছে সে নিজেও।
এতদিন বাদে আকাশ ছুঁয়ে আসা শীতল পানি শরীর স্পর্শ করতেই মন ভালো হয়ে গেলো রাত্রির। ঠোঁটে ফুটলো এক আশ্চর্য সুন্দর হাসি। দু’বাহু দু’দিকে মেলে দিয়ে চিবুক উঁচু করলো সে। বেশিক্ষণ স্হায়ী হলোনা অবশ্য। বৃষ্টির ফোঁটার অসহ্য রুগ্নতায় চোখমুখ কুঁচকে মাথা সোজা করে নিলো। শেষবার বৃষ্টিবিলাস এই মানুষটার সাথেই করেছিলো। আজ আবার। তবে মূহুর্তটা ভিন্ন। সেদিন দুজনের কাছে আসায় ছিলো বিরাট বাধা। আর আজ তার সবচেয়ে কাছের মানুষটাই ইনি।
নিভ্রান দূর্বোধ্য হাসছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটাই বোধহয় প্রেয়সীর অসংকোচ বৃষ্টিবিলাস। কোন জড়তা নেই। সে জানে সামনের মানুষটা তার খুব ভরসার।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৪১+৪২

বেহিসেবী অঝোর ধারায় স্পষ্ট দেখতে পারছেনা রাত্রি। এতো তেজ বর্ষণে। হাত দিয়ে চোখের উপর ছাউনির মতো করে পানি থেকে চোখদুটো আড়াল করলো সে। ঈষৎ কম্পিত কন্ঠে বললো,
—“আপনার হঠাৎ কি হলো আজ? আমি একটু রাত করে গোসল করলেই তো চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেন। আর আজকে সোজা ভিজতে নিয়ে এলেন?”
নিভ্রান পলক ফেললোনা। একই দৃষ্টি চেয়ে থেকে আচ্ছন্নের মতো বললো,”হুম?”
রাত্রি এককদম আগালো। গায়ের বেনারসি ভিজে শেষ। কালো চুলের গোছা পিঠজুড়ে। নিভ্রান হাত বাড়িয়ে খুব কাছে টেনে নিলো তাকে। চোখে দূর্দমনীয় প্রেম নিয়ে বললো,
—“বর্ষণমন্দ্রিত এক নিকষ রজনীর হঠাৎ যাত্রাপথের সঙ্গীনী। এই বুকে মাথা রাখা প্রথম এবং সর্বশেষ রমণী। আমার ভালোবাসা। আমার আঁধার কাটানোর রাত। আমার জীবন সঙ্গীনী। যার ছোট্ট আতর্নাদেও ঘাবড়ে যায় আমার প্রতিটি রক্তবাহিকা। অস্থিরচিত্ত নিংড়ে উঠে সর্বাঙ্গে। আমার রাণী, আমার প্রেমিকা, আমার অর্ধাঙ্গীনী। আমার সব।”
রাত্রি লাজুক হাসলো। চোখ নামিয়ে ছোট্ট করে বললো,”বুঝেছি।”
নিভ্রান বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনীর সাহায্য থুতনি ধরে মুখ তুললো। চোখের দিকে চেয়ে খুব ধীরে ধীরে বললো,
—“একদিন এই বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে বলেছিলাম ‘আপনি আমার হবেন’। আর আজ, তুমি আমার হয়ে গেছো। আমি কিন্তু কথা রেখেছি। বৃষ্টি কিন্তু আজও সাক্ষী।”

রাত্রি কোনরকমে সাড়া দিলো,”হু।” সেদিনতো সে-ও প্রার্থনা করেছিলো,”আমি যেনো এই মানুষটারই হই।” তার প্রার্থনাটাও তো কবুল হয়েছে। কিন্তু বলতে পারছেনা। গোপনে করেছিলো যে!
নিভ্রান দুরত্ব কমালো। ঠোঁটের কাছাকাছি আসতেই রাত্রি ভীত কন্ঠে বললো,”এটা রাস্তা।”
ওপাশ থেকে একরোখা উওর এলো,”হোক।”
শহরজুড়ে তখন প্রবল বৃষ্টি। পৃথিবীর আনাচে কানাচে হয়তোবা আজও কতোশত নতুন গল্পের সূচনা হচ্ছে খুব গোপনে। এই প্রেমধারা কে সাক্ষী রেখে, প্রেমিকার চোখে তাকিয়ে সহস্র কাঙাল প্রেমিকরা বোধহয় আজও প্রতিজ্ঞা করছে এক হয়ে যাবার। বৃষ্টি প্রেমের জন্ম দেয়। সাদা কালোর এই বিবর্ণ পৃথিবীতে রঙিন প্রেমের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও এ শহরে বৃষ্টি নামুক। এ শহরে সময় অসময়ে বৃষ্টি নামুক।

( লেখাঃমালিহা খান ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন