এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৪১+৪২

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৪১+৪২
লেখিকা মালিহা খান

নদীর পানি ঠান্ডা। পায়ের আঙ্গুল ডুবানো হিমজলের অতলে। বাতাসে গা শিরশির করছে। চোখের মনিতে ভাসছে স্রোতের প্রতিচ্ছবি। পেট থেকে মুখ সরিয়ে মাথা সোজা করলো নিভ্রান, একাধারে চোখ ডুবালো প্রিয়তমার অবাধ্য চুলে, মায়াবী মুখশ্রীতে, হৃদয় কাঁপানো চোখের মনিতে।
নওশাদ সাহেবের কানে খবরটা পৌছালো নিশাদের মাধ্যমে। রাত্রির প্রেগনেন্সি সিম্টমস্ দেখা দিয়েছে অথচ তার ছেলে একবার জানালোনা পর্যন্ত। তাকে জানায়নি ঠি ক আছে কিন্তু নাহিদাকে তো অন্তত জানাতে পারতো। রিপোর্টে কি এসেছে তাও জানালোনা। আর সেই খবর নিশাদও জানেনা। শুধু বললো, টেস্ট করতে দিয়েছে।

সাতপাঁচ না ভেবে তিনি আচমকাই ফোন লাগালেন নিভ্রানের নাম্বারে। বিগত কয়বছরে প্রথমবারের মতো।
শেষ কললিস্ট টা নেই। তারিখ টাও নেই। কতআগে কথা হয়েছিলো এই নাম্বারে তা যন্ত্রটাও ভুলে গেছে। তিনি তো মানুষ। তবু ভুলেননি। দিনটা ছিলো নিভ্রান বাড়ি ছেড়ে যাবার তিনদিন আগে। রাতে ফিরতে খুব দেরি করেছিলো ছেলে। নাহিদা কেঁদেকেটে অস্থির। তখন বাসায় আসার জন্য ফোন করেছিলেন তিনি।
ধ্যান ভাঙলো। রিং হচ্ছে। এক একটা শব্দতরঙ্গ যেনো অভিমান ধুলিস্যাৎ করার ধারালো ফলা। সব কাঁটাতার, বাধাবিগ্রহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিবে।
নিমগ্ন প্রণয়বিলাসের মাঝে হঠাৎ শব্দটা একেবারেই সহ্য হলোনা নিভ্রানের। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কপালে ভাঁজ পরলো। রাত্রি আস্তে করে বললো,
—“ফোন বাজছে আপনার।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। পকেট হাতরালো। ফোন বের করে স্ক্রীনের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ইংরেজি অক্ষরে “Baba” দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা। সে তো অন্য কোনো নাম্বার সেভ করেনি এই নামে। তবে? ফোনটা কি তারই? অবিশ্বাস নিয়ে হাত উল্টে ব্যাককভার দেখলো। হ্যাঁ, তারইতো। রাত্রি তাড়া দিলো,”ধরুন।”
নিভ্রান একপলক তাকিয়ে বললো,”তোমার ফোন কোথায়?”
রাত্রি এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো। সাথে ব্যাগ নেই। গাড়িতেই রয়ে গেছে। ফোন ব্যাগের ভিতরেই। নিভ্রানের প্রশ্নাত্বক চাহনীর বিপরীতে শূন্য মস্তিষ্কে সে বললো,
—“আমার ফোন? গাড়িতে মনেহয়।”
নিভ্রানের জট পাকানো চাহনী ধাতস্থ হলো এতক্ষণে,

—“তোমার সাথেই কথা বলতে চাইছে তাহলে। ফোনে পায়নি তাই আমাকে দিয়েছে। ধরো।”
—“উফফো, নাহ।” বলে নিজেই হাত বাড়িয়ে স্লাইড করে রিসিভ করে দিলো রাত্রি। শক্ত করে হাতটা টেনে নিভ্রানের কানে চেপে ধরলো ফোনটা। ওপাশ থেকে চেনা গলার স্বর,”হ্যালো”। নিভ্রান অপ্রস্তুত বোধ করলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চেয়ে থেকে কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসতে বসতে বললো,”জি…বলেন।”
নওশাদ সাহেব এদিক ওদিক গেলেন না। সোজা প্রশ্ন করলেন,”রিপোর্ট হাতে পেয়েছো?”
নিভ্রান আবারো বিব্রত হলো। উনি জানেন বিষয়টা? অগোছালো স্বরে বললো,”পেয়েছি।”
নওশাদ সাহেবের তৎক্ষনাত পাল্টা প্রশ্ন,
—“কি এসেছে?”
এবার যেনো লজ্জার অথৈ সাগরে ডুবে গেলো নিভ্রান। শব্দভান্ডার ফুরিয়ে গেলো। কন্ঠনালি তে অপরাধবোধের বিদ্রোহ। তার আগেই জানানো উচিত ছিলোনা? প্রথমবার বাবা হবে। বাবাকেই জানানো হয়নি? ধুর, তাকে কেনো ফোন দিলো? রাত্রিকে দিলেইতো পারতো। নওশাদ সাহেব উওর না পেয়ে বললেন,”হ্যালো?”

নিভ্রান নিচু গলায় উওর দিলো,
—“জি, পজিটিভ।”
ওপাশে নিরবতা। তারপর খুব নরম গলার অতিপ্রসন্ন স্বর,”আগে জানাবেনা?”
নিভ্রানে চাঁপা হাসলো। মনে মনে হয়তো বিস্তর হাসলো। খুব গোপনে হাসি লুকিয়ে অন্যপাশের তুলনায় আরো কোমল গলায় বললো,
—“এখনো বাসায় পৌঁছিনিতো, পৌঁছেই জানাতাম।”
কথা শেষ হলো ভালোভাবেই। তার সাথে কথা বলে রাত্রির সাথেও কথা হলো। এতদিনে এই প্রথম বোধহয় কোনরকম আগ্রাসী, বাকবিতন্ডতাহীন কথোপকোথন হলো বাবা-ছেলের।

নিভ্রান মিষ্টি নিয়ে গেলো ব্যাকসিট পুরো ভর্তি করে। নিশাদ নওশাদ সাহেবের কাছ থেকে খবর পেয়ে আগে থেকেই দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে মিষ্টি দিয়ে বাসাভর্তি করে রেখেছে। শেষমেষ মিষ্টিতে মিষ্টিতে টি কতে না পেরে রাতেই পুরো বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ঘরে ঘরে দেয়া হলো। আশেপাশের পরিচিতদের বাসায় বিতরণ করা হলো। রাত্রি বসে বসে আগাগোড়া তব্দা মেরে দেখেই গেলো দুই ভাইয়ের পাগলামি।
সেখানে থেমে গেলেও হতো। পরেরদিন নাহিদা, নওশাদ সাহেব দুজনই এলেন। তাদের আরেকদফা পাগলামি। নাহিদা হাতের চুড়ি খুলে রাত্রিকে পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। নওশাদ সাহেব হাতে উপহার গুঁজে দিয়ে গেলেন। নিভ্রান মানা করলোনা কোনোকিছুতেই। প্রথমবার মা- বাবা হবার অনুভূতি তবে এতোই সুখের, আনন্দে ঠাসা?
সময় পেরোলো নিয়ম মেনেই। দিনের পর রাত। রাতের পর দিন। পেরিয়ে গেলো মাস। বদলে গেলো ঋতু, প্রকৃতি, জীবনধারা।

দিনটা মঙ্গলবার। রাত্রির শরীরটা ভালো থাকেনা ইদানীং। তিনমাসে পেট উঁচু হয়েছে খানিকটা। শাড়ির উপর থেকে অবশ্য বোঝা যায়না তেমন। বারান্দার সন্ধ্যামালতী গাছে নতুন দুটো ফুল ফুটেছে। সাদা রং। সূর্যের আলোয় কী রুপ তাদের।
বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে পড়া রাত্রির হাত থেকে বইটা ছাড়িয়ে নিলেন নাহিদা। পাশে রেখে গায়ে চাদর টেনে দিলেন। আগামী সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায় খালি। মেয়েটা ঘেমে গেছে এসির মধ্যেও। শাড়ির আচঁল দিয়ে গলা মুছিয়ে দিলেন তিনি। শেষমেষ ফুলগাছে পানি দিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। এখানে এসেছে দু’সপ্তাহ হলো। রুবিনা নিজেই অসুস্থ। চাইলেও মেয়ের খেয়াল রাখাটা হয়ে উঠেনা তার। ওষুধের ডোজে বিছানায়ই পড়ে থাকেন সারাদিন। নিভ্রান অফিসে থাকে। ক’দিকে খেয়াল রাখবে সে?

রাত্রি উঠলো বিকেলের দিকে। চোখে তখনো ঘুমের রেশ। ক্লান্তি কাটেনি। ভার্সিটি বন্ধ এ সপ্তাহে। এতেই যেনো একটু স্বস্তি। টি উশনি ছেড়েছে আজ একমাস। আস্তেধীরে উঠে বাইরে গেলো সে। নাহিদা তখন রুবিনার রুমে বসা। গল্প করছে দুজনে। ঘরের দরজা খোলা বিধায় সহজেই রাত্রিকে চোখে পড়লো। নাহিদা তড়িঘড়ি করে এগোতে এগোতে চেঁচিয়ে উঠলো,”আহা! একা একা আসলে কেনো? ধুরো! মেয়ে আমার কথা শোনেনা একদম। দাড়াও, দাড়াও ওখানেই।”
রাত্রি চেয়ার ধরে দাড়িয়ে গেলো। মাথাটা আসলেই ঘুরাচ্ছে। দুপুরে যা খেয়েছিলো তা সঙ্গেসঙ্গেই বমি করে ফেলে দিয়েছে। তারপর আর পেটে কিছু পরেনি। নাহিদা এসে ধরলেন। চেয়ার টেনে বসালেন। পানি খাওয়াতে গেলেই রাত্রি বললো,”না না, বমি হয়ে যাবে। খাবোনা।”
নাহিদা গ্লাসটা ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে একরোখা কন্ঠে বললেন,”এটা পানি। পানি খেলে বমি হয়না।”
—“হবে মা, বিশ্বাস করেন।”
তার কাতর কন্ঠে হেরে গেলেন নাহিদা। পানিটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বমির জন্য না খেয়ে থাকবে?”
রাত্রি ছোট্ট গলায় উওর দিলো,”নাহ্, খাবোতো। পরে।”
আটটা দশ।

কোলের উপর বালিশ রেখে খাতায় কি যেনো লিখছে রাত্রি। সামনে পড়ার বই খোলা। সেখান থেকে দেখে দেখেই কিছু একটা লিখছে সে। নাহিদা ঢুকলেন। ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল নিলেন। বিছানায় উঠে পিছে বসে তালুতে ঘঁষতে গেলেই রাত্রি আৎকে বললো,”না, তেল না। মা, কেমন চটচটে লাগে, প্লিজ।”
নাহিদা শুনলেন না। এত্তগুলো ঢেলে দিয়ে হাত দিয়ে ঘঁষে দিয়ে বললেন,
—“চুপ, পাজি মেয়ে। মাথাব্যাথা করবে খালি। তেল দেয়না একটু। এতসুন্দর চুলগুলো সারাক্ষণ জট পাকিয়ে রাখে। চুপ করে লিখো। আমি তেল দিবোই।”
রাত্রি চোখমুখ কুঁচকে বসে রইলো। নাহিদা তেল মাখালেন আচ্ছামতো। বিলি কেটে কেটে গোড়ায় গোড়ায় ডলে দিলেন। রাত্রি মাথা পিছে ঠেলে নাহিদার পেটে ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইলো। হাল্কা গলায় বললো,
—“আপনার ছেলে কখন আসবে মা? আমার ভালো লাগছেনা।”
নাহিদা ভেতরে ভেতরে হেসে ফেললেও মুখে রাগ দেখিয়ে বললেন,
—“খাবেনা দাবেনা। ছেলে আসলেই ভালো লাগবে নাকি?”
—“লাগেতো। আপনার ছেলে আসলে আমার খুব ভালোলাগে।”
—“আসবে মা, ওরোতো কাজ থাকে তাইনা?”

রাত্রি উওর দিলোনা সাথেসাথেই। তবে কিছুক্ষণ পেরোতেই অবুঝের মতো কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—“ফোন দিননা মা। আসছেনা কেনো? এতক্ষণে তো চলে আসেন উনি।”
নাহিদা উপায় না পেয়ে ফোন দিলেন। মেয়েটা যখন তখন মন খারাপ করে ফেলে আজকাল। নিভ্রান ধরলো প্রথমবারেই। অস্থির গলায় বললো,”কি হয়েছে মা? রাত ঠি ক আছে?”
নাহিদা ফোঁস করে বললেন,
—“তুই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারিসনা? জানিসইতো দেরি হলে কান্নাকাটি করে। এত দেরি হয় কেনো তোর? ফাজিল ছেলে।”
নিভ্রান স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,”আবার কান্নাকাটি করছে? আচ্ছা, দাও ওকে। আমি বুঝাই। দাও।”
নিকশকৃষ্ণ ঘরে একটু জ্যোতি নেই। কিরণ নেই। ঘটা করে রাত নামলো যেন সর্ব ধূলিকণায়। রুপালি চাঁদ ছুঁতে পারছেনা ভয়ংকর প্রেমিকের ঘুমন্ত মেঘরাণীকে। নিভ্রানের ফিরতে দেরি হলো বেশ।

দেহভরা ক্লান্তি নিয়েই ঘরে ঢুকলো সে। বিছানার দিকে চোখ পড়তে মনটাও ক্লান্ত হয়ে গেলো। রাত্রি ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা অপেক্ষা করছিলো। প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমায়নি। গায়ে ব্লাঙ্কেট নেই। শাড়ির আচঁল খসে পড়েছে এলোমেলো। হাতদুটো অগোছালো নিস্তেজ। মাথাটা হেলে পড়েছে ডানপাশে।
নিভ্রান নিশব্দে ঢুকলো। খুক খুক করে কাঁশতে যেয়েও থেমে গেলো। গলা ব্যাথা করছে খুব। আজ অফিসে এতো ধমকাধমকি করেছে সবাইকে। এখন মনে হচ্ছে কন্ঠনালি জ্বলে যাচ্ছে। নিশব্দেই হাঁটলো সে। গায়ের শার্ট ছাড়িয়ে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে এলো। পর্দা সরিয়ে দিতেই চাঁদের আলোয় পূর্ণ হলো ঘর। আঁধার কেটে গেলো। রাত্রি দেহভঙ্গি বদলেছে। কাত হওয়াতে অনাবৃত হয়েছে দেহ।
নারীময়ী আকর্ষণ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে সর্বাঙ্গে। নিভ্রান হাসলো। শব্দ নেই সেই হাসিতে। আছে শুধু দূর্বার অনুভূতি। কাছে যেয়ে ঝুঁকে গেলো সে। এত অসুস্থতায়ও মেয়েটার সৌন্দর্য কমেনি বিন্দুপরিমানও। বক্ষ পিন্জিরায় ঝংকার তুলে প্রতিটি উষ্ণ প্রশ্বাস। লহু জমে যায় যেনো রুপের শীতলতায়। নিভ্রান গভীর দাগ বসালো গলদেশের নিম্নাংশে। ঘুমের মাঝেই হাল্কা হাল্কা কম্পিত হলো রাত্রি। কোমলাঙ্গ দেহ নেতিয়ে গেলো।

কাঙ্খিত স্পর্শ আরো প্রগাঢ় হতেই সজাগ হলো অপ্রকৃতিস্হ গা। অপ্রতিরোধ্য হাতদুটো দিয়ে অযথাই হাল্কা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো রাত্রি। নিভ্রান মুখ তুলে উন্মত্ত শ্লেষ মাখানো স্বরে বললো,”কি হয়েছে?”
রাত্রি উওর দিলোনা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হলো তার সুপ্ত অভিমান। নিভ্রান কাতর স্হানে নাক ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,”রাগ করেছো রাত?”। তীক্ষ্ণ মাতাল গন্ধে ঘোর জাগলো। একটু ডুবে যেতেই রাত্রি শক্ত গলায় বললো,
—“দূরে যান। আমি ঘুমাবো। কাছে এসেছেন কেনো? আমিতো আপনার এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নই।”
নিরবতা! নিষ্কম্প অভিমানিনী, নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে চেয়ে চেয়ে নিভ্রান মোহকন্ঠে বললো,
—“আমার প্রাণনাশকারিনী, আমার নির্মোহ হৃদয়ের একমাত্র মোহ, আমার নির্মেঘ আকাশের শুভ্রতম মেঘ, আমার বৃষ্টিহীন বর্ষার এক পশলা বর্ষণ। যার পদ্মলোচন চোখে আমার দাম্ভিকতার মৃত্যু, কোমলতার আবির্ভাব। আমার নিশীথিনী, আমার বিভাবরী, আমার রাত তুমি।”

চোখের কোঁণে বিন্দুকণা জমা হয়েছে। মানের সিক্ত বহি:প্রকাশ। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অনবরত। নিভ্রান হতাশ চোখে চাইলো। রাত্রি শ্বাস চেপে বললো,
—“আপনি এসব বলে বেঁচে যেতে চাচ্ছেন?”
—“তোমার এই রুদ্ধ স্বরে কতবার মরছি জানো?”
রাত্রি চুপচাপ। নিভ্রানের ঠোঁট অঘোষিত বাঁরণ মানলোনা। আদরে আদরে অভিমান গলে পানি হলো কোমল নারীমনের। হার মানলো রুষ্ট হৃদয়। তুষ্ট হলো সব। রাত্রি ধীর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“খেয়েছেন?”
—“উহুম।”
—“খেয়ে আসেন, যান।”
—“কাজ ছিলো রাত।”
রাত্রি মৃদু স্বরে বললো,
—“ঠিকাছে।”
নিভ্রান উঠে গেলো। উঠার আগে একবার উঁচু পেটে কান পেতে কি যেনো শুনলো। বিরবির করে বললো,”তুমি খেয়েছো আম্মু?”
—“ও আম্মু না আব্বু আপনি কিভাবে জানলেন?”
—“জানি। খেয়েছো তুমি?”
—“হু।”
চাঁদের আলো তখন তেরছাভাবে পড়ছিলো নিভ্রানের মুখের অর্ধাংশে। একপাশ উজ্জ্বল, একপাশ অন্ধকার।
কি নরম সেই চাহনী! কি কোমল সে অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি!

নাহিদা ভাত বেড়ে দিলেন প্লেটে। নিভ্রান চেয়ারে বসতে বসতে বলল,”ওকে তো আজ ভালোই দেখলাম।”
—“আর ভালো! দুপুরে সব বমি করে দিয়েছে। রাতে জোর করে একটু খাইয়েছি। এভাবে না খেলে হয় বল?” ওইটুকু বলে থামলো নাহিদা। পরমূহুর্তেই ভ্রু ভাঁজ করে বললো,”ভালো দেখলি মানে? ঘুমিয়েছিলো না? উঠিয়েছিস কেনো?”
নিভ্রান নামানো কন্ঠে উওর দিলো,
—“উঠে গিয়েছে।”
নাহিদা কথা বাড়ালেন না। পাশে বসতে বসতে বললেন,
—“আগামী সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা। শরীরের যা অবস্থা। মেয়েটা কিভাবে লিখবে, পড়বে?”
নিভ্রান চোখে একসমুদ্র আশঙ্কা, চিন্তায় কাবু অস্থিরতা নিয়েই বললো,
—“পারবে মা। চিন্তা করোনা।”
—“পরের বছর দেয়া যায়না?”
—“ওর এতদিনের প্রিপারেশন বৃথা যাবে মা। শুধু শুধু একটা বছর গ্যাপ পড়বে। পড়াশোনা নিয়ে অনেক সপ্ন ওর। আমি কি করে মানা করবো বলো?”
নাহিদা উওর দিলেননা। নিভ্রানের কথাও ঠি ক। আবার মেয়েটার জন্য দুশ্চিন্তা হয় খুব।

দীর্ঘ রজনীর মধ্যপ্রহর!
শক্ত নিরপদ্রব বুকটা থেকে মাথা তুলে উঠে বসলো রাত্রি। ব্যাকসাইডে কোথায় একটা ব্যাথা হচ্ছে।
ভেতরটা কেমন যেনো লাগছে। নিভ্রান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। খুব ক্লান্ত মানুষটা। রাত্রি একা একাই বসে রইলো কিছুক্ষণ। চোখ বুজে নিভ্রানের হাত ধরে রইলো। ব্যাথার সাথে বাড়লো নখের গাঁথুনির ধার। হাতে শাণিত চাপ লাগতেই নিভ্রানের তন্দ্রা কেটে গেলো। ঘুমে মোড়ানো নিভু নিভু কন্ঠে সে বললো,
—“কি হয়েছে রাত?”
রাত্রি একবার তাকালো। নিরুত্তর ব্যাথাযুক্ত চাহনী দেখে সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসলো নিভ্রান। একহাতে অপরপাশের বাহু জড়িয়ে কাছে টেনে বললো,”কি হলো? খারাপ লাগছে?”
রাত্রি আবারো অসহায় চোখে চাইলো। মাথা ঝুঁকিয়ে চাপা স্বরে বললো,”কোমড় ব্যাথা করছে খুব।”
শরীর ঘেমে উঠেছে তার। নিভ্রান কপাল ছুঁয়ে দেখলো গা হাল্কা গরম। সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে পুরো একগ্লাস খাইয়ে দিলো। অস্থির ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”কমে যাবে, কমে যাবে। ভয় পেয়োনা।”
সময় কাটলো আধঘন্টার মতো। ঘড়ির কাঁটা তখন চারটায়। রাত্রি আস্তে করে বললো,
—“ব্যাথা আমার হচ্ছে, আপনি কাঁপছেন কেনো?”
—“কই কাঁপছি?”
—“এইযে আপনার হাত…যতবার বুলাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি তো।”
—“সে তো এসিতে.. ঠান্ডা লাগছে বলে। ব্যাথা কমেছে একটু?”
—“কমেছে।”
নিভ্রান যেনো এতক্ষণে ঠি ক ঠাক শ্বাস নিলো। চোখের পাতা শান্ত হলো। রাত্রি ঝিঁমাতে ঝিঁমাতে বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। নিভ্রান বাকিরাত আর ঘুমোতে পারলোনা। রাত্রির স্লান চেহারা দেখতে দেখতেই নির্ঘুমতায় জর্জরিত হলো আঁখিপল্লব।

পরের দিনটা স্বাভাবিকই কাটলো। সন্ধ্যার দিকে নিশাদ এলো দেখতে। রাত্রি তখন উবু হয়ে নোটস লিখছে।
রুমের দরজা খোলা। নিশাদ ড্রইংরুম থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো,
—“ভাবি, সোজা হন। আপনিতো বাচ্চাটাকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলবেন।”
রাত্রি দ্রুত মাথা তুললো। বিমূঢ় চোখে যেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বামহাতটা আপনাআপনিই চলে গেলো পেটে। বাচ্চা আসলেই চ্যাপ্টা হয়ে যায়? নিশাদ কাছে এগিয়ে এসেছে। রাত্রি পেটে হাত রেখেই নির্বোধের মতো প্রশ্ন করলো,”উবু হলে সত্যি চ্যাপ্টা হয়ে যায় ভাইয়া?”
নিশাদ ফিচেল হেসে উওর দিলো,”হয়তো, আমার এক বন্ধুর হয়েছিলো।”
রাত্রি একমূহুর্তের জন্য বিশ্বাসও করে ফেললো কথাটা। ভয়ার্ত চাহনীতে পেট অনুভব করার চেষ্টা করলো। পরমূহুর্তেই বিশ্রিভাবে মুখ কুঁচকে বললো,
—“আপনার বন্ধু? আপনার বন্ধু কিভাবে মা হবে?”
নিশাদ কথার প্রেক্ষিতে উওর দিলোনা। পাশ থেকে মাথার বালিশ তুলে নিয়ে কোলের উপর দিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“এখানে বালিশ রেখে লিখতে পারেন না? দেখি, কি লিখেন এতো। সারাদিন পড়াশোনা। বাচ্চাকেতো পেটেই আলবার্ট আইনস্টাইন বানিয়ে ফেলছেন। আপনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী না। এইতো খাপে খাপ।”
—“ধুর, চুপ করেনতো ভাইয়া।”
নিশাদ জোর গলায় বললো,
—“কি লিখছেন? আহা! দেখি না। আমি লিখে দেই, দেন।”
—“উহু! লাগবেনা। আমি পারবো, শেষই প্রায়।”
—“আপনি আমার ভাতিজিকে খেতে দেননা কেনো? ও জন্ম হয়ে তো সোজা আমাকে চড় লাগাবে। ভাববে চাচ্চু কিপ্টামি করে খেতে দেয়নি।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩৯+৪০

রাত্রি একঝাঁক বিস্ময় নিয়ে বললো,”আপনারা দু’ভাই জানলেন কিভাবে ও মেয়ে হবে? উনি আম্মু, আম্মু ডেকে অস্থির, আবার আপনি ভাতিজি ভাতিজি করছেন?”
নিশাদ মুচকি হেসে বললো,”জানি জানি।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো। রাত্রি লিখছে তখনো। নিশাদ একধ্যানে চেয়ে রইলো খাতার দিকে। কি মনোযোগ মেয়েটার। একটু বিরতি নেই লিখার মাঝে। লেখা শেষ হলো নাকি না জানেনা তবে মাঝপথে হঠাৎই কলম থামালো রাত্রি। নিশ্চল বসে রইলো কতক্ষণ। নিশাদ হাল্কা গলায় বললো,”কি হয়েছে? শেষ লেখা। কই? আরো বাকি আছেতো। নিচেরটুকু লিখবেন না।”

রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা। আচমকাই নিশাদের কব্জি খামছে ধরলো। অদ্ভুত কন্ঠে বললো,”আপনার ভাইয়াকে একটু ফোন করেন প্লিজ।”
—“ভাইয়াকে? কেনো? নিশাদ বলতে বলতেই শরীরের ভারটা পিছের দিকে ছেড়ে দিলো রাত্রি। নিশাদ দ্রুত ধরলো। বুকের পাশে আগলে নিয়ে অধৈর্য কন্ঠে বললো,”ভাবি? ভাবি কি হলো?…মা, আই মা এদিকে আসো। ভাবির খারাপ লাগছে মনেহয়।”
রাত্রি বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে তখনো বলেই যাচ্ছে,”আপনার ভাইয়াকে আসতে বলেন। উনাকে আসতে বলেন প্লিজ।”
নিশাদ অবিন্যস্ত কন্ঠে বললো,
—“আসবে আসবে, আপনি শান্ত হন। কিছু হবেনা। কি হয়েছে বলবেন তো। কোথায় খারাপ লাগছে? পেটে ব্যাথা?”
রাত্রি ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
—“উনাকে ফোন দিননা।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক শেষ পর্ব