এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৫+৬

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৫+৬
লেখিকা মালিহা খান

চকচকে ঝকঝকে মেঝে।শাওয়ার নিয়ে টাওয়ালে মোড়ানো অর্ধআবৃত শরীরে বেরিয়ে এলো নিভ্রান।সাদা ফ্লোরে ভেজা পায়ের ছাপ।
শরীরে বিন্দু বিন্দু জলকণাদের রাজত্ব।উজ্জ্বল শ্যামলা রংয়ের বলিষ্ঠদেহ যেকোনো নারীকে কাবু করে ফেলতে শতভাগ সক্ষম।বয়স ত্রিশ ছুঁইবে ছ’মাস বাদে অথচ আজ অবধি ধারালো নখের আগ্রাসী আঘাত পরেনি এই পিঠে।ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।ভেজা গায়েই পাতলা টি-শার্ট জরিয়ে নিলো।সঙ্গে কালো ট্রাউজার।ফোন বাজছে।মার নামটা ভেসে উঠেছে।কালবিলম্ব না করে ফোনটা কানে তুলে নিলো নিভ্রান।
—“হ্যালো বাবা?কেমন আছিস?”
ফোনের এপাশেই মুচকি হাসলো নিভ্রান।উওর দিলো,”তোমার সাথে তো দুপুরেই কথা হলো মা।এইটুকু সময়ে আর কি খারাপ হবে বলোতো?”
মা ছেলের কথোপকোথন চললো কিছুক্ষণ।কথা শেষ হতেই ফোনটা নামিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নিভ্রান।চোখ বোজার পর কয়েকটা মূহুর্ত যেতেই বুঝতে পারলো ধীরে ধীরে চোখে ভর করছে এক সদ্যপরিচিত অন্তর্বাসিনীর হৃর্দয় শীতল করা সারল্যতা।

চাঁদটা বেঁকে আছে।তবুও তার সৌন্দর্যে কোনরকমের ঘাটতি নেই।এই একলা আকাশের চাঁদের বুড়িকে ঘিরে পাহারা দিচ্ছে মিটমিট করা তারকারাজি গুলো।ধুলোর পরতে ঢাকা জানালাটা আজ অনেকদিন পর খুলেছে রাত্রি।সেই জানালার ফাঁক গলিয়েই চাঁদের ঝলমলে আলোতে ছেঁয়ে গেছে তার বিছানা।জানালার গ্রিলে মাথা রেখে স্হির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো রাত্রি।মোহাচ্ছন্ন ধ্যানটা কেটে গেলো কলিংবেলের তিক্ত শব্দে।কপাল কুঁচকে এলো স্বাভাবিকতই।এত রাতে এখানে কার কি দরকার?আরো কয়েকবার নিরবিচ্ছিন্নভাবে আওয়াজ হতেই দ্রুত গায়ে ওড়না জড়িয়ে দরজার সামনে এলো রাত্রি।ভেতরের ভয়টাকে ভেতরেই চেপে জোরালো গলায় ডাকলো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“কে?”
ওপাশ থেকে মধ্যবয়স্ক এক পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
—“দরজা খুলো।আমি।”
লোকটার কর্কশ গলায় প্রথমে কেঁপে উঠলেও পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো রাত্রি।কন্ঠটা বাড়িওয়ালা চাচার।তার আসার কারণটাও স্পষ্ট।এ মাসের ভাড়া দেয়া হয়নি।আজকে মাসের পনেরো তারিখ।
দরজা না খুলেই একছুটে ব্যাগ থেকে আজকেই পাওয়া টি উশনির বেতনটা নিয়ে এলো রাত্রি।দরজায় তখন তুমুল কড়াঘাত চলছে।ভাড়া দিতে দেরি হলেই কুটু কথা শোনাতে ছাড় দেয়না এরা।বাসার ভাড়া তুলনামূলক একটু কম হওয়ায় কারণে ছেড়েও যেতে পারেনা।বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দরজা খুললো রাত্রি।
—“বাসায় কি আমি ফ্রি তে থাকতে..”তার বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ঝটপট হাতের টাকাটা এগিয়ে দিলো রাত্রি।ভদ্রতার সহিত নম্র কন্ঠে বললো,”টাকাটা আংকেল।”
ভদ্রলোক সরু চোখে তাকালো।টাকাটা ‘ছোঁ’ মেরে নিয়ে গমগমে গলায় বললো,”তুমি জানোনা মাসের পাঁচ তারিখে ভাড়া দেয়ার নিয়ম?”
রাত্রি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো।চাপা রাগটাকে সংবরণ করে আগের মতোই বিনীত কন্ঠে বললো,
—“টাকাটা হাতে আসতে একটু দেরি গেছে আংকেল।”
—“এরপর থেকে যেভাবেই হোক পাঁচতারিখের ভেতরে ভাড়া দিয়ে যাবে।মনে থাকে যেন।”বলেই গটগট শব্দ তুলে চলে গেলেন ভদ্রলোক।তার যাওয়ার পানে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে দরজা আটকে দিলো রাত্রি।এই টানাপোড়েন দিন দিন বেড়েই চলেছে।যেকরেই হোক পরের মাস থেকে আরেকটা টি উশনি ধরতে হবে।তিনটে তে কিছুতেই পোষাচ্ছেনা।

মেঘ জমে জমে মেঘের পাহাড় তৈরি করেছে।খানিকবাদেই পাহাড়ধস হবে।মেঘের পাহাড় বৃষ্টিরুপে ধসে পড়বে পৃথিবীর বুকে।
রাত ন’টা।ধীরগতিতে ড্রাইভ করছে নিভ্রান।রাস্তাটা অনেকটাই ফাঁকা।
নিভ্রানের পরিশ্রান্ত দৃষ্টি হঠাৎই আটকে গেলো রাস্তার ধারে।অবসন্ন চোখজোড়া ধাতস্থ হয়ে এলো।মুখ ফুটে অস্ফুস্টে বেরিয়ে এলো,”রাত”।
ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে আগাচ্ছে রাত্রি।পরণে গাঢ় বেগুনী রংয়ের সাদামাটা সুতি শাড়ি।আঁচলে পা জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।পিঠে চুল ছড়িয়ে আছে বিশৃঙ্খলভাবে।টাকার মায়া ত্যাগ করে রিকশা ডেকেছিলো কয়েকটা।কোনোটাই ওদিকে যাবেনা।আর গেলেও ভাড়া চাচ্ছে আকাশকুসুম।অসস্তিরা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
গতকাল একটা পরীক্ষা হয়েছে।আরেকটা হবে সামনের সপ্তাহে।এর মাঝেই একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিলো ভার্সিটিতে।সে যেহেতু সিনিয়র ব্যাচের এবং ক্লাস ভলেন্টিয়ার দের একজন তাই শাড়ি পরাটা একপ্রকার বাধ্যতামূলক।সবাই পরেছে সে না পরলে কেমন ছন্নছাড়া দেখায়।সেজন্যই মায়ের একটা পুরনো শাড়ি পরে গিয়েছিলো।শাড়ি সামলাতে অসুবিধা হয়না তার তবে পরপর তিনটা টি উশনির জন্য এখান থেকে ওখানে হেঁটে যাওয়া আসার কারনেই শাড়ি অনেকটা অগোছালো হয়ে গেছে।এখন তা পরে হাঁটতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাস্তার ধারেই গাড়ি পার্ক করে নেমে গেলো নিভ্রান।দ্রুত পা চালিয়ে উপস্থিত হলো রাত্রির কাছাকাছি।পেছন থেকেই ভরাট গলায় ডাকলো,”রাত।”

পদচারণ থেমে গেলো রাত্রির।দাড়িয়ে পরলো সে।মাঝরাস্তায় নিজের নাম শুনে হঠাৎ করে আৎকে উঠলেও গলাটা চিনে যেতেই আকস্মিক ভয়টা কেটে গেলো।ঘাড় বাকিয়ে পেছনে ঘুরার আগেই পাশাপাশি এসে দাড়ানো নিভ্রান।তার চোখ রাত্রির সর্বাঙ্গে ঘোরাফিরা করছে।চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি তবে এই মেয়েটাই?
রাত্রি সৌজন্যমূলক মুচকি হেসে বললো,
—“আপনি এখানে?”
রাত্রির ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলায় স্হির মনি সচল হলো নিভ্রানের।বারদুয়েক চোখ ঝাঁপটে সে দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
—“কিছু বললেন?”
রাত্রি বোকা বোকা কন্ঠে আবার বলল,”জি বললাম যে আপনি এসময় এখানে?”
নিভ্রান সময় না নিয়ে ঝটপট উওর দিলো,”অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।”
ভ্রুজোড়ায় তীক্ষ্ণ ভাঁজ পরলো রাত্রির।লোকটা যথেষ্ট বড়লোক।সে বুঝতে পারে।তার হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার বিষয়টা বড্ড বেমানান লাগলো।কোনরকম সংকোচ না নিয়ে সে স্পষ্টকন্ঠে বললো,
—“আপনি হেঁটে বাড়ি ফিরেন?”
এক ভ্রু উঁচালো নিভ্রান।রাত্রির কথাটার মানেটা বুঝে নিয়ে বাঁকা হেসে বললো,”গাড়িটা গতকাল সার্ভিসিং এ দিয়েছি।সেজন্যই আরকি।”
কপালের ভাঁজটা পুরোপুরি না গেলেও কিছুটা শিথিল হলো।মুখে কিছু না বললেও হাল্কা মাথা নাড়িয়ে কথায় সাড়া দিলো রাত্রি।বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কেটে যেতেই নিভ্রান বললো,

—“আপনার হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে?”
—“না তো।”
মুখে অস্বীকার করলেও রাত্রির এলোমেলো পদক্ষেপ জানান দিচ্ছিলো সে আসলেই হাঁটতে পারছেনা।শাড়ির কুঁচি নেমে গেছে পায়ের কাছে।কোনমতে তা আঁকড়ে ধরে জবুথবু হয়ে হাঁটছে।নিভ্রান এক কদম এগিয়ে যেয়ে গম্ভীর গলায় হাঁক ছাড়লো,”এই রিকশা।থামো।”
রিকশা থেমে গেলো।নিভ্রান জায়গার নাম না বলেই রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে বললো,”উঠুন,আপনাকে পৌছে দিয়ে আসি,রাত হয়েছে অনেক।”
—“প্রয়োজন নেই,আমার অভ্যাস আছে।আপনার দেরি হবে শুধু শুধু।”বলে আপত্তি করে উঠলো রাত্রি।
নিভ্রান শীতল চোখে চাইলো।কঠোর গলায় বললো,”উঠতে বলেছি উঠুন।আপনার বাসা থেকে আমার বাসার দুরত্ব খুব বেশি হলে বিশ মিনিটের।একই পথেই যাচ্ছি একসাথে গেলে এমন কোন ক্ষতি হয়ে যাবেনা।”
রাত্রি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই নিভ্রান শান্ত আদেশী স্বরে বললো,”উঠুন রাত।”
কেনো যেনো মিইয়ে গেলো রাত্রি।চুপচাপ উঠে বসলো রিকশার ডানপাশে।উঠলো নিভ্রানও।রিকশা চলতে শুরু করলো।রাত্রির কোলের উপর ব্যাগ রাখা।
আকাশে তখন গুরুর গুরুম হচ্ছে।হাল্কা বৃষ্টি শুরু হতেই রাত্রি রিনরিনে কন্ঠে বললো,”মামা,হুটটা তুলে দিন।”
রিকশাওয়ালা মামা ঘুরার আগেই একটানে হুট উঠিয়ে দিলো নিভ্রান।রাত্রি আমতাআমতা করে তাকালো।নিভ্রান সোজা তাকিয়ে আছে।লোকটার চেহারা এত থমথমে লাগছে কেনো?রাত্রি ইততস্ত করে জিজ্ঞেস বললো,

—“কি হলো আপনার?”
—“কি হবে?”
চোখ নামিয়ে নিলো রাত্রি।এলোমেলো চুল কানের পিছে গুঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো,”না কিছুনা।”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।গতকালকে ফিরিয়ে দেয়া হাতের রিচব্যান্ডটা খুলে নিলো।রাত্রির হাতের কাছে ধরে বললো,”চুল বেঁধে নিন।”
—“লাগবেনা।”একবার তাকিয়ে আলতো স্বরে উওর দিলো রাত্রি।
চোখ বন্ধ করে রাগ সামলালো নিভ্রান।অত:পর নিজেই অনেকটা ঝুঁকে গেলো রাত্রির দিকে।গলার দু’পাশ দিয়ে দুহাত গলিয়ে দিতেই চমকে উঠলো রাত্রি।বললো,”আপনি..”নিভ্রান তাকে থামিয়ে দিলো।চুলগুলো গুছিয়ে মুঠোয় আনতে আনতে আবিষ্টভাবে বললো,”চুপ।”ঠোঁট কামড়ে ধরলো রাত্রি।শরীরের রক্তে একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।নিভ্রানের মুখ তার ঘাড়ের খুব খুব ঘনিষ্ঠে।হাল্কা উঁচু করে ঝুটি বেঁধে দিলো নিভ্রান।সরে আসার আগে হাল্কা গলায় বললো,

—“এতো কড়া পারফিউম ব্যবহার করবেন না রাত।”
রাত্রি মিনমিনে কন্ঠে উওর দিলো,”আমি পারফিউম দেইনা।”
নিভ্রান অবিশ্বাস নিয়ে তাকালো।বললো,”মজা নিচ্ছেন?”
রাত্রি থতমত খেলো।চোখমুখ কুঁচকে বললো,”মজা নিবে কেনো?সত্যি বলছি।”
সামনে তাকিয়েই হাসলো নিভ্রান।চুলে মাঝে হাত চালিয়ে হঠাৎই মুখটা আবারো নিয়ে গেলো রাত্রির ঘাড়ের কাছে।বুক ভরে শ্বাস নিতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলো রাত্রি।থেমে থেমে বললো,
—“কি করছেন?”
নিভ্রান নাক সরিয়ে তৎক্ষনাত উওর দিলো,
—“আমি তীব্র ঘ্রান পাচ্ছি রাত।আর আপনি বলছেন আপনি পারফিউম দেননা।সিরিয়াসলি?”

—“আমি মিথ্যে কেন বলবো?”বাচ্চাসূলভ গলায় কাতর হয়ে বললো রাত্রি।কন্ঠে নিজেকে সঠিক প্রমান করার টান।নিভ্রান একআঙ্গুলে কপাল ঘষলো।রাত্রির অসহায় চাহনী দেখে মূহুর্তেই হেসে ফেললো।মেয়েটা অল্পতেই অস্থির হয়ে পরে।মুখের হাসি বজায় রেখেই ডানহাতে মাথার পিছের অংশে হাত বুলিয়ে দিলে সে।কোমল কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা,মানলাম পারফিউম দেননি।এটা আপনার নিজস্ব ঘ্রান।”
নতজানু হয়ে গেলো রাত্রি।মা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে এমন স্নেহ তার দীর্ঘদিনের অপরিচিত।মায়ের আদর ও তো সহসা তার কপালে জুটেনা।চট্রগ্রাম গেলে এক দুদিন তারপর আবার সেই নিসঙ্গতা,একাকিত্ব।কান্নাগুলো গিলে নিজেকে সামলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো রাত্রি।বললো,
—“আপনি কোথায় থাকেন?আমার বাসার কাছেই?”
—“হু”অন্যমনস্ক হয়ে উওর দিলো নিভ্রান।রাত্রি বুঝলোনা তার কথা।বৃষ্টি পরছে টুপটাপ।হাত পা আংশিক ভিজলেও ভিজার মতো ভিজছেনা।রাত্রির মনে হচ্ছে নিভ্রান আটকে গেছে।চোখের অপলক দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে লোকটার বৃষ্টি কতো পছন্দ।সশব্দে গলা ঝাড়লো সে।নিভ্রান সচকিত হয়ে তাকালো।অস্থির কন্ঠে বললো,
—“কি হলো?গলায় কিছু আটকেছে?পানি কিনে আনবো?।”
বিহ্বল চোখে চেয়ে রাত্রি এলোমেলো গলায় উওর দিলো,”কিছু হয়নি।শান্ত হন।”
—“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।”
—“কেনো?”

নিভ্রান হাসলো শুধু।উওর দিলোনা।রাত্রি গুমোট হয়ে গেছে আবারো।নিভ্রানের কথা,একটুতেই প্রবল অস্থিরতা,দায়িত্বশীল কাজকর্ম সবকিছুতেই কেন যেন ভয়ংকর কোনো অনুভূতির আভাস পাচ্ছে সে।
কিন্তু এসব তো তার জন্য নিষিদ্ধ।নিষিদ্ধ দিকে দৃষ্টি না দেয়াই শ্রেয়।
—“আমিও একাই থাকি রাত।ঠি ক আপনার মতো।একদম একা।”
—“কেনো?”ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে সন্ধিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো রাত্রি।একটা পূর্ণ গোলাকার বৃষ্টির ফোঁটা গালের মাঝ বরাবর এসে পড়েছে।নিভ্রান তার দিকে ফিরে মুচকি হাসলো।হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আলতো করে পানিটা মুছিয়ে দিয়ে ধীরস্হির কন্ঠে বললো,”বলবোনে একদিন।”
খানিকবাদে প্রশ্ন করলো রাত্রি,
—“কটা বাজে?”।কন্ঠে উৎকন্ঠা,ভীতভাব।নিভ্রান কপাল কুঁচকে ঘড়ি দেখলো।অন্ধকারেও তার সিলভার ঘড়িটা নতুনের মতো চকচক করছে।
—“ন’টা পয়তাল্লিশ।কেনো?কিছু হয়েছে?”
রাত্রি ধাতস্থ হলো।মুখের ভীতিভাবটা কিছুটা কমেছে।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁটের উপরের ঘামটুকু মুছে নিলো সে।বললো,
—“দশটার পর গেট বন্ধ করে দিবে।একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলুননা।”
—“চিন্তার কিছু নেই।দশটার আগেই পৌছে যাবো।”আশ্বস্ত করে বললো নিভ্রান।

একহাতে কুঁচি ধরে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে রাত্রি।চোখ মেঝের দিকে।সিড়িতেই দেখা হলো বাড়িওয়ালা চাচির সাথে।নাম রাহেলা।সালাম দিয়ে ভদ্রমহিলাকে যাওয়ার জায়গা দিয়ে সাইড হয়ে দাড়ালো রাত্রি।।ভদ্রমহিলা গেলো না।ছুকছুক চোখে আপাদমস্তক রাত্রিকে দেখে তীরের মতো তীক্ষ্ণ গলায় বললে,
—“মাইয়া মানুষ এতো রাতে আসো ক্যান?জানোনা দশটার পরে গেট বন্ধ।”ভদ্রমহিলার কন্ঠে গ্রাম্য টান আছে।
রাত্রির রাগ হলেও ভদ্রভাবেই বললো,
—“দশটার আগেই এসেছি আন্টি।”
রাহেলা যেন প্রস্তুত ছিলো পড়ের প্রশ্ন ছোঁড়ার জন্য।
—“তুমি এত রাতে আইবা কেনো?আগে আসতে পারোনা?মেয়েমানুষের এতো বাইরে বাইরে কি?”
—“আমার টি উশনি ছিলো।তাছাড়া নিয়ম সবার জন্য এক।আমিতো দশটার আগেই এসেছি।এত প্রশ্ন করছেন কেনো?”দাঁতে দাঁতে চেপে উওর দিয়ে পুনরায় সালাম দিয়ে “আসছি” বলে পাশ কাটিয়ে গটগট করে উপরে উঠে গেলো রাত্রি।এদেরকে মাঝেমধ্য উচিত কথাটা বলে দিতে হয়।নয়তো অবলা ভেবে অপদস্ত করার প্রভাব দিন দিন বেড়েই যাবে।
রাহেলা কটমটে দৃষ্টিতে রাত্রির যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।মেয়েটাকে তার সবদিক দিয়েই পছন্দ শুধু কটা কটা কথা ছাড়া।এই নজরকাড়া রুপে তার ভাইগ্না তো গতবার এবাসায় আসার পর পাগলই হয়ে গিয়েছিলো।যে করেই হোক এ মেয়েকে লাগবেই।মেয়ের বাবা নেই শুনেও ভাইগ্নার পাগলামিতে রাত্রিকে প্রস্তাব দিয়েছিলো সে।কিন্তু রাত্রি খুবই স্পষ্ট ভাষার তাকে না করে দিয়েছিলো।রুগ্ন শ্বাস ছাড়লো রাহেলা।মেয়েটার এই দেমাগ তার আর সহ্য হচ্ছেনা।

রাত গভীর হয়েছে।খাবার খেয়ে সব গুছিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো রাত্রি।ফোন লাগালো মায়ের নাম্বারে।ভেতরটা খুব স্বস্তিহীন লাগছে।বুক ধরফর করছে।ফোন রিসিভ হলো।রাত্রি মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“মা?”
ওপাশ থেকে মায়ের কন্ঠ শোনা গেলোনা।ভেসে আসলো একজন পুরুষের ভরাট গলা,”দিতেছি।”পাল্টা কিছু বললোনা রাত্রি।দরজা খোলার ক্যাড়ক্যাড় শব্দে বোঝা গেলো ফোনটা একটু পরে মায়ের কাছে পৌছে যাবে।লোকটা তার আপন মামা।তবুও লোকটার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাভক্তি নেই রাত্রির।ইনি হচ্ছে তার দেখা নিকৃষ্ট মানুষ জনদের মধ্য একজন।
একটু পরেই মায়ের স্নেহমাখা ডাক শোনা গেলো।
—“রাত।”
রাত্রি দাঁত বের করে হাসলো।প্রশান্তির হাসি।এই “রাত” ডাকটায় কি যেনো আছে।খুব শান্তি দেয়।আগে শুধু মা আর বাবা-ই তাকে এ নামে ডাকতো।বাবা চলে যাওয়ার পর শুধু মা একা ডাকতো এখন আবার নিভ্রানও যোগ হয়েছে।
—“তুমি ঠি ক আছো মা?পায়ের ব্যাথা কমেছে?”
রুবিনা বেগম জোরপূর্বক হেসে জবার দিলেন,”আমি ঠি ক আছি রে মা।”
—“ওই লোকটা আজ কোনো ঝামেলা করেছিলো?”রাত্রির সোজাসাপটা কঠিন গলার প্রশ্ন।
—“ধ্যাত্ ওই লোকটা ওই লোকটা বলিস কেনো?তোর মামা হয়না?গুরুজন দের এভাবে ডাকতে নেই।”
—“উনার গুরুজন হওয়ার যোগ্যতা নেই মা।”
—“আমাকে থাকতে দেয় এই তো বেশ।”

রাত্রি রাগ নামালো।মাকে এসব বলে লাভ নেই।সে খুব সহজ সরল মানুষ।গলার স্বর স্বাভাবিক করে সে বললো,
—“বাদ দাও।”
কিছুক্ষণ কথার পর ফোনের দিকে তাকালো রাত্রি।লেখা উঠেছে চৌদ্দ মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড।তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সে।মায়ের সাথেও মেপে মেপে কথা বলতে হয় আজকাল।ফোনটা আবারো কানে লাগিয়ে বিরস,বেজার কন্ঠে বললো,
—“আজ রাখছি মা।ফোনের টাকা শেষ হয়ে যাবে।”
রুবিনা বেগম সন্তষ্ট কন্ঠে বললেন,”আচ্ছা মা,তুই কেটে দে তাহলে।আমিতো পারিনা।”
—“তুমি পারোনা না।বলো তুমি ওই লোকের ফোনে চাপ দিতে ভয় পাও।”
মেয়ের স্পষ্টভাষী কথায় মিইয়ে গেলেন রুবিনা বেগম।বলার মতো কিছু পেলেন না।ফোন কাটার আগে রাত্রি গমগমে গলায় বলে উঠলো,
—“ওই লোকের বাসায় আর থাকতে হবেনা।অনার্সটা শুধু কম্প্লিট হোক।তোমাকে যেভাবেই হোক ঢাকায় নিয়ে আসবো আমি।দেখো।”
মেয়ে রেগে যাচ্ছে বুঝতেই রুবিনা বেগম পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য হাসলেন।বললেন,
—“হয়েছে এতো চাপ নিতে হবেনা।একটু দম নে এবার।”

পরেরদিন রাতেরবেলা।
টি উশনির বাসা থেকে নামতেই নিভ্রান কে দেখে অবাক হলোনা রাত্রি।কাল রিকশা থেকে নামার পড়ই নিভ্রান তাকে বলেছিলো আজকে তারা একসাথে ফিরবে।নিভ্রানের আবদার মাখা কন্ঠের বিপরীতে মানা করতে পারেনি সে।সম্মতি দিয়েছিলো।
তবে অবাক হলো নিভ্রানকে গাড়িতে বসা দেখে।তাকে দেখেই গাড়ির কাঁচ নামালো নিভ্রান।বললো,”এসেছেন তাহলে।”বলে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।তারপর ফিচেল গলায় বললো,আজকে বোধহয় একটু বেশি পড়িয়েছেন।”
রাত্রি অপ্রস্তুত হাসলো।বললো,
—“স্টুডেন্টের পরীক্ষা তো সামনে।তাই আরকি।”
নিভ্রান গাড়ির চাবি ঘুরাচ্ছে।রাত্রি তড়িঘড়ি করে বললো,”আমি গাড়িতে যেতে পারবোনা।দমবন্ধ লাগে এসব।”
নিভ্রান ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বললো,”আপনাকে যেতে বলেছে কে?নেমে যাচ্ছিতো”বলতে বলতেই নেমে এলো সে।গাড়ির দরজা লক করে অজান্তেই নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,”আসুন।”
একটু দ্বিধা করে হলেও পরম ভরসায় হাতটা ধরলো রাত্রি।নিভ্রান তা শক্ত করে আঁকড়ে নিলো।
শুরু হলো পাশাপাশি পদচারণ।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৩+৪

গলির মোড়ে প্রায় পৌঁছেই গেছে তারা।কথা বলায় মশগুল ছিলো তার মাঝেই ডাক পড়লো।
—“এই মেয়ে…।”
রাত্রি ফিরে তাকালো।মুদি দোকানদারওয়ালা ডাকছে তাকে।কারনটাও সে জানে।টাকা বাকী আছে।
নিভ্রানের ফোন বাজলো।সে ফোন কানে তুলে দোকানদারের দিকে তাকালো।রাত্রি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,”আপনি দাড়ান,আমি একটু আসছি।”বলেই দোকানের সামনে গেলো সে।নিভ্রান একটু দুরে গিয়ে দাড়ালো।জরুরি ফোন এসেছে।
—“তুমি তো দেখাই দাওনা।সেই যে বাকির সদাই নিলা।টাকা তো আর দিলানা।”পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বললো মতিন মিয়া।
রাত্রি বিনীত স্বরে বললো,”সামনের মাসেই দিয়ে দিবো চাচা।এ’কটা দিন একটু অপেক্ষা করেন।”
—“এখনো কও সামনের মাসে?হইবোনা।আমার এহনই লাগবো।কোনো ছাড়াছাড়ি নাই।আমার টাকা দিয়ে তারপর তুমি যাইবা।”
—“চাচা…”
মতিন মিয়া রাত্রির নরম স্বর শুনে আরো পেয়ে বসলো।বললো,

—“টাকা না থাকলে জিনিস নাও কেন?রাত বিরেতে প্রেমিক নিয়ে ঘুরো আর টাকা দিতে পারোনা তাইনা?তামাশা নাকি?”
রাত্রি নিমিষেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো।তেজি গলায় বললো,”মুখ সামলে কথা বলুন চাচা।আপনার টাকা…”
—“ওই মাইয়া,কারো রাগ দেখাও তুমি?টাকা না থাকলে…”এটুকু বলেই রাত্রির গায়ের ওড়না হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো মতিন মিয়া।
সাথেসাথেই সজোরে চিৎকার করে উঠলো রাত্রি।হিংস্র বাঘিনীর মতো বললো,”ওড়না ছাড়ুন।”

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৭+৮