এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৭+৮

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৭+৮
লেখিকা মালিহা খান

রাত্রির চিৎকারে বুকটা ‘ধক’ করে উঠলো নিভ্রানের।শান্ত নিউরণগুলো অশান্ত হয়ে উঠলো।ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটা গম্ভীর গলায় জরুরি কথা বলে যাচ্ছে।কর্ণপাত করলোনা নিভ্রান।চট করে ফোনটা কেটে দিয়ে হন হন করে এগিয়ে গেলো রাত্রির দিকে।কপালের রগগুলো স্পষ্ট নীল।
শক্ত করে ওড়না টেনে ধরেছে রাত্রি।মতিন মিয়া সজোরে টান দিতেই তা হাত থেকে কিছুটা ছুটে গেলেও গা থেকে সরে গেলোনা।যন্ত্রনায় চোখ বুজে ফেললো রাত্রি।জর্জেট কাপড়ে ঘষা লেগে হাতটা বোধহয় ছিঁলেই গেছে।তবুও দমে গেলোনা সে।গায়ের জোরে না পেরে জিহ্বা কে কাজে লাগালো।বললো,

—“লজ্জা করেনা?তোর সন্তানের বয়সি একটা মেয়ের ওড়না ধরোস।ছিহ্।নিজের মেয়েটাকে অন্তত রেহাই দিস।কাপুরুষ কোথাকার।”
মতিন মিয়া দাঁত কিড়মিড় করে।বিশ্রি নজরে রাত্রির শরীরে চোখ বুলিয়ে বলে,
—“টাকা দিতে পারোনা আবার বড় বড় নীতি ক..”কথার মাঝেই শার্টের কলার টেনে ধরলো নিভ্রান।সজোরে ঝাঁকিয়ে গর্জন করে বললো,”ছাড়।”নিমিষেই ভয়ে কেঁপে উঠলো মতিন মিয়া।হাতের ওড়নাটা আপনাআপনিই ছুটে গেলো।রাত্রি যেনো জান ফিরে পেলো।নিভ্রান চোখে আস্ত অগ্নিবলয় নিয়ে চেয়ে আছে।সেকেন্ড না গড়াতেই ঘুষি পড়লো মতিন মিয়ার নাক বরাবর।রক্ত এসে গেছে।এদিক ওদিক তাকালো রাত্রি।ভাগ্য সহায় যে রাস্তা ফাঁকা।নতুবা এতক্ষণে গোলযোগ বেঁধে যেতো।মতিন মিয়া কোনরকমে উচ্চারণ করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“আমি টাকা পা..”
নিভ্রান তৎক্ষণাৎ ছাড়লো তার কলার।পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগ বের করতে করতে বললো,
—“টাকা পাস তাইনা?কত টাকা বল?”
—“তিন হাজার পাঁচশো।”মতিন মিয়ার চটপট উওর।
রাত্রি তড়িঘড়ি করলো।অগোছালো কন্ঠে বললো,
—“দেখুন,আপনি..টাকা…আপনার দিতে হবেনা।”
নিভ্রান সজোরে ধমক দিলো,
—“চুপ করে থাকুন রাত।কোনো কথা বলবেন না।”
নিভ্রানের রাম ধমকে মূহুর্তেই চুপসে গেলো রাত্রি।আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারলোনা।নিভ্রান হাজার টাকার চারটে নোট বের করলো।মতিন মিয়ার মুখের উপর ছুঁড়ে মারতেই সেগুলো মেঝেতে পরে গেলো।মতিন মিয়া ব্যস্ত হাতে তুললো।যেন সাত রাজার ধন মাটিতে ছড়িয়ে গেছে।ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো রাত্রি।মানুষ টাকার জন্য এমন করে কেন?
নিভ্রান পকেটে মানিব্যাগটা ঢোকালো।রাত্রির হাত টেনে মুঠোয় নিলো।মতিনের দিকে চেয়ে বললো,
—“আমাদের ব্যাপারে কোন রকমের কুৎসা রটানোর আগে নিজের জিহ্বার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিবি।কেটে ফেলবো কিন্তু।”
—“কি যে বলেন স্যার,আমি তো শুধু টাকাটার জন্যই…।”নাকের রক্তটা মুছে টাকাগুলো ক্যাশবাক্সে রাখতে রাখতে বললো মতিন মিয়া।নিভ্রান আর একমূহুর্তের জন্যও দাড়ালোনা সেখানে।রাত্রিকে নিয়ে গটগট করে হেঁটে চললো উল্টোপথে।চোখভর্তি পানি নিয়ে মাথা নিচু করে থাকা অন্যমনস্ক রাত্রি খেয়াল করেনি তারা উল্টোপথে হাঁটছে।

ব্রিজটা সুনসান।রাস্তার ধারে দাড়ানো নিশ্চুপ নিয়ন বাতিগুলো মনে বচ্ছে মাথা ঝুঁকিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছে মানব-মানবী দুটোকে।রাত্রি কথা বলেনি।মাথা নিচু করে চুপচাপ হাঁটছে।কয়েক ফোঁটা জল ইতিমধ্যেই গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে।নিভ্রানের শক্ত গম্ভীর দৃষ্টি সামনের দিকে।ঘড়িতে বাজে দশটা বিশ।রাত্রির বাসার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে এতক্ষণে।সেদিকে যেয়ে লাভ নেই।
—“আপনার টাকাটা আমি আমি দ্রুতই ফেরত দিয়ে দিবো।”ভেজা গলায় যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলো রাত্রি।কিন্ত পারলোনা।নিভ্রান ধরে ফেললো সহজেই।হাতের বাঁধনে বল প্রয়োগ করে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো।সচকিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—“আপনি কাঁদছেন?”
রাত্রির সহ্যক্ষমতা যেন নিমিষেই ভেস্তে গেলো।উচিত-অনুচিতের হিসেবটা ভুলে গেলো তার ব্যাথাময় মস্তিষ্ক।উতলে উঠলো ভেতরের চাপা কষ্টটা।হুঁশ হারিয়ে ডুকড়ে কেঁদে উঠে নিভ্রানের দুহাতে জাপটে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিল সে।থমকে গেলো নিভ্রান।রাত্রি গলা কাঁপিয়ে কাঁদছে।সেই ধ্বনির হৃদয়বিদারক সুর যেন মনের পর্দায় চরমভাবে আঘাত হানছে।নিভ্রান নিজেকে সামলালো।দ্বিধাদন্ত ভুলে ঠি ক প্রথমদিনের মতোই প্রচন্ড স্নেহ নিয়ে রাত্রির চুলের ভাঁজে হাত বুলাল।নরম গলায় ডাকলো,

—“রাত।”
রাত্রির উওর এলোনা।বরং কান্নার গতি বেড়ে গেলো আরো।ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।পৃথিবীটা অসহ্য লাগছে।নিভ্রান শুকনো ঢোঁক গিললো।রাত্রির মাথাটা বুকের সাথে আরো একটু চেপে নিয়ে পুনরায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
—“কাঁদেনা।”
রাত্রি কাঁদতে কাঁদতেই আহাজারি করে উঠলো,
—“মানুষ এমন কেনো?এত খারাপ কেনো?”
—“আচ্ছা,এসব বাদ দিন।কান্না থামান।কিছু হয়নি।”
রাত্রির কান্না দুই সেকেন্ডের মতো থেমে গেলেও পরের সেকেন্ডেই তা দ্বিগুন বেঁধে আছরে পড়লো নিভ্রানের বুকে।দিশেহারা হয়ে উঠলো নিভ্রান।বললো,
—“আপনাকে কান্না মানায় না রাত।আপনি না কতো সাহসী।”
রাত্রি নাক টানলো।ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,”আমি আর পারছি না।সত্যি বলছি,একদম পারছিনা।”
—“আপনাকে পারতে হবে।দেখি।”বলে রাত্রিকে টেনে সরালো নিভ্রান।গালের পানি মুছিয়ে দিয়ে আচমকাই কোমড় ধরে বসিয়ে দিলো ব্রিজের রেলিংয়ে।রাত্রির মুখ এখন তার মুখ বরাবর।ভয়ে চমকে উঠলো রাত্রি।কান্নামিশ্রিত জড়ানো গলায় বললো,”পড়ে যাবো।নামিয়ে দিন।”

—“পরবেননা।”বলে একহাত আলতো করে কোমড়ে রেখে সযত্নে আগলে ধরলো নিভ্রান।চারচোখ এক করে নিতেই আবারো চোখভর্তি পানি নিয়ে মাথা নোয়ালো রাত্রি।নিভ্রান ঠোঁট কামড়ে ধরলো।মেয়েটার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।চোখ ফুলে গেছে।ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে রক্ত জমাটবাধা।
পানি গড়িয়ে পড়ার মাঝেই নরম স্পর্শে গালে হাত রাখলো নিভ্রান।বৃদ্ধাঙ্গুলের ছোঁয়ায় মাত্র বেরিয়ে পড়া ফোঁটার অস্তিত্ববিনাশ করে নম্র কন্ঠে বললো,
—“আবার কাঁদছেন কেনো?বললামনা আপনাকে কান্না মানায় না।আপনি তো এতো দুর্বল নন।”
জোরে একটা শ্বাস ছাড়লো রাত্রি।মাথাটা নুইয়েই রাখলো।নাক টেনে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বললো,
—“আপনার দেরি করিয়ে দিলাম।ক’টা বাজে?”
একনজর ঘড়ি দেখলো নিভ্রান।হতাশ গলায় বললো,
—“দেরি আপনার হয়েছে রাত।সাড়ে দশটার উপরে কাঁটা ঘুরছে।”
—“ও আল্লাহ।বলেই তড়িৎগতিতে নামতে গেলো রাত্রি।কিন্তু কোমড়ে রাখা হাতের মৃদু চাপ থামিয়ে দিলো তাকে।তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিভ্রান বললো,

—“রাখুনতো আপনার তাড়াহুড়ো।পানি আছে ব্যাগে?”
রাত্রি থামলো।বোকা কন্ঠে বললো,
—“আছে।আপনি খাবেন?”
—“বের করুন।”
পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ছিপি খুলে রেলিংয়ে রাখলো নিভ্রান।রাত্রি কোমড় থেকে হাত সরাতেই থতমত খেয়ে দ্রুত নিভ্রানের কাঁধে হাত রাখলো রাত্রি।খামছে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
—“পরে যাবোতো।”
—“শক্ত করে ধরে রাখুন।”বলে একহাতের তালুতে পানি ঢেলে বোতলটাও রেলিংয়ের উপর রাখলো নিভ্রান।
অতিরিক্ত পানিগুলো রাস্তায় ফেলে ভেজা হাত রাত্রির চোখের পাতায় ছোঁয়ালো।পরিষ্কার করে মুছে দিতে দিতে বললো,”কেঁদেকেটে কি করলেন রাত।”
রাত্রি লজ্জা পেলো।সে কখনো কারো সামনে কাঁদেনা।কখনো কাঁদেনা।শেষবার বাবা মারা যাওয়ার পর হাউমাউ করে কেঁদেছিলো।তারপর থেকে মায়ের কাছে গেলেও কান্না চেপে রাখে।পাছে মা কষ্ট পাবে।সেজন্য সে কাওকে দেখায় না নিজের কষ্ট গুলো।আজ কেন এমন হলো বুঝতে পারছেনা।কেন সে নিজের নিয়ন্ত্রন হারালো?নিভ্রানের সামনে বাচ্চাদের মতো কান্না জুড়ে দিলো?
সারামুখ ভালোকরে মুছিয়ে দিয়ে বোতলের ছিপি আটকে দিলো নিভ্রান।রাত্রি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছে।নিজের ঝুলন্ত পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে।চোখেমুখে বিষন্নভাব।খানিকবাদেই সে স্বগতোক্তি করলো,

—“পৃথিবীতে সবকিছুর উর্ধ্বে টাকা।”
নিভ্রান হাসলো।দু’পাশে হাত রেখে ঝুঁকে গিয়ে হাল্কা ফিসফিস করে বললো,
—“আর আপনি আমার কাছে পুরো পৃথিবীর উর্ধ্বে।”
কয়েকমূহর্ত চোখে চোখেই কেটে গেলো।রাত্রির আঁখিপল্লব থেমে গেছে।মায়াবী চোখজোড়া যেনো পলক ফেলতে ভুলে গেছে অকালেই।নিভ্রানের কালো চোখের মনিতে সম্মোহন লেগে যাচ্ছে।নিয়ন বাতির হলদে আলোতে মেয়েটার দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে।যেনো অসচ্ছ অনুভূতিদের আস্ত এক সাম্রাজ্য।নিভ্রান পলক ফেললো।একবার,দুইবার,পরপর তিনবার।রাত্রি মধ্যে কোন পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হলোনা।নিভ্রান হাসলো।কিন্তু নিশব্দে।সোজা হয়ে রাত্রির বামগালে হাল্কা চাপড় মেরে বললো,
—“আরে,পলক তো ফেলুন,চোখে পানি এসে যাচ্ছে আপনার।”
সম্ভিৎ ফিরলো রাত্রির।একাধারে এতক্ষণ চেয়ে ছিলো বলে চোখ জ্বালা করছে।পানিও এসে পরেছে অল্প।মাথা নামিয়ে পলক ঝাপটিয়ে পানিগুলো সামলে নিলো সে।নিভ্রানের দিকে চোখ পড়তে নিমিষেই গুমড়ে গেলো।গায়ের কাঁটা দিয়ে উঠলো।লজ্জায় দ্রুত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অস্থিরভাবে রাস্তায় চোখ বুলাতে লাগলো।লোকটা কিভাবে এত ভয়ংকর একটা কথা এতটা অকপটে বলে ফেললো?
নিভ্রান হাসলো।আবারো ঝুঁকে কন্ঠে হাসির রেশ টেনেই বললো,

—“এতক্ষণ তো চোখই ফেরাতে পারছিলেন না।এখন কি হলো?”
রাত্রি একপলক তাকালো।কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে যেতেই নিভ্রান বললো,
—“থামলেন কেনো?বলুন।”
আমতা আমতা করলো রাত্রি।একটু সহজ হয়ে যেতেই অসাবধানতায় নিভ্রানের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে বললো,”আপনি এটা কি বললেন?”
রাত্রির হাতের অবস্থানটা লক্ষ্য করতেই খুব সন্তর্পণে রাত্রির কোমড়ে হাত গলিয়ে একটু সামনের দিকে টেনে নিলো নিভ্রান।রেলিংটা অতোটাও মোটা না।বলতে গেলে বেশ সরুই।একটু বেসামাল হলেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা শতভাগ।রাত্রি উওরের আশায় চেয়ে আছে।নিভ্রান শ্বাস ফেলে বললো,
—“ভুল কিছুতো বলিনি।”
ফর্সা গালে টকটকে লালাভ আভা।রাত্রি ঠোঁট কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।বারবার চোখের পলক ফেলাটাই তার অনুভূতিগুলোর নিরব বহি:প্রকাশ।নিভ্রান কাছে আসলো আরো একটু।নিশ্বাসের বহর রাত্রির ছাড়ামুখে ছড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“আপনি লজ্জা পাচ্ছেন রাত।কেনো পাচ্ছেন জানেন?”
উওর দিলোনা রাত্রি।নিভ্রানের উষ্ণ নিশ্বাসের ঝড়ে ভেতরের উত্তাল তোলপাড়টা বেড়ে যাচ্ছে।রাত্রির উশখুশানি লক্ষ্য হতেই নিভ্রান সরে গেলো।রাত্রি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো।অত:পর
ঘাড় বাকিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কালো পানির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর সুরে বললো,

—“সত্যিকার অর্থে এসব কথার কোনো মানে নেই মিস্টার।এসব মানুষ শুধু বলার জন্যই বলে।বাস্তবতাটা একেবারে ভিন্ন।খুব কঠিন।সেখানে এসব আবেগি উক্তির মূল্য নেই।বুঝলেন?”
নিভ্রান চমকালো না।অপ্রতিভও হলোনা।খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাটা হজম করে নিলো।রাত্রির থেকে এমন কিছুই আশা করেছিলো।মেয়েটা অন্যরকম।ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে সে বললো,
—“আপনাকে একদিন এই উক্তির মূল্য বুঝিয়ে দিবো রাত।”
—“সেই একদিনের অপেক্ষায়…”মুচকি হেসে বললো রাত্রির কন্ঠে ছাড়া ছাড়া ভাব।
নদীর পানিতে রং নেই।আকাশে চাঁদ থাকলে হয়তোবা ঝলমল করতো।বেশ কিছুক্ষণ দুজনের দৃষ্টিই নিরবে সেই পানির দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইলো।মধ্যকার দুরত্ব খুব কম।পরিবেশটা আচ্ছন্ন হতেই ধ্যান ভেঙে গলা ঝাড়লো রাত্রি।ঘাড় ফিরাতেই নিভ্রানকে নিজের খুব কাছে পেলো।শুকনো একটা ঢোক গিললো সে।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
—“সরুন,নামি।বাসায় যেতে হবে।”
নিভ্রান সরে গেলো।রাত্রি হাল্কা লাফে রাস্তায় নেমে এলো।জামার ধুলো ঝাড়ছে তখনই নিভ্রান বললো,

—“আপনার বাসার না গেট আটকে দিয়েছে?”
রাত্রি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
—“সমস্যা নেই।একটু অনুরোধ করলেই ঢুকতে দিবে।বেশি হলে দু-চারটা কথা শোনাবে।এই আরকি।”
নিভ্রানকে অসন্তুষ্ট দেখালো।
—“আপনি অকারণে কথা শুনবেন কেনো?”
রাত্রি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
—“অকারণ কোথায়?এইযে দেরি করে ফেলেছি।এটাই তো মূল কারণ।”
—“আপনার কথা শুনতে হবেনা।আমার ফ্ল্যাটে চলুন।সকালে আপনাকে বাসায় পৌছে দিবোনে।”
—“পাগল হয়েছেন?”চমকানো গলায় প্রশ্ন করলো রাত্রি।
—“পাগল হওয়ার কি আছে?আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না রাত?”ব্যাথিত কন্ঠে বললো নিভ্রান।
—“বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে তো কিছু বলিনি।”
নিভ্রান রাত্রির হাত টেনে ধরলো।একরোখা গলায় বললো,
—“তবে চলুন।”
রাত্রি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।হতাশ গলায় বললো,
—“আপনি পাগলামো করছেন।”

অন্ধকার রুম।বিছানায় বসে আছে নিভ্রান।রাত্রি আসেনি সাথে।মেয়েটা খুবই সচেতন এসব ব্যাপারে।
হাজার বলেও সাথে আনতে পারেনি শেষমেষ বাড়িতে পৌছে দিয়ে ফিরে এসেছে।সে নিজেও খুবই একরোখা,জেদি স্বভাবের।যা একবার বলে তাই করে।সেই যে বাবার সাথে মনমালিন্যর জের ধরে বাড়ি ছেড়ে একা থাকতে শুরু করেছে তো করেছেই।এখন অবধি সে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল।মায়ের শতবার ফিরে যাওয়ার কথা বলাও তাকে বাড়ি ফেরাতে পারেনি।আজও ভেবেছিলো মেয়েটাকে সাথে নিয়েই ফিরবে।কিন্তু রাত্রি তার স্বভাব উল্টে দিলো।তার একরোখা আবেদনকে ছাপিয়ে দিয়ে নিজেকে জয়ী করে নিলো।এলোনা তার সাথে।
পড়ার টেবিলে বসে একদৃষ্টে স্টিলের গ্লাসটার দিকে চেয়ে রয়েছে রাত্রি।আজ আসার পথে না বলতেই তিনটে কদম ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে নিভ্রান।রাত্রি সযত্নে সেগুলো গ্লাসের পানিতে ভিজেয়ে রেখেছে।লোকটাকে আজ ভরপুর পাগলামিতে জেঁকে বসেছিলো।তাকে বেশ কষ্টের সাথেই সামাল দিতে হয়েছে।বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছে।
কদমগুলার উপর হাত বুলিয়ে টেবিলে হাত রেখে সেই হাতের উপর কাত করে মাথা রাখলো রাত্রি।উদাসমুখে কদমের দিকে মায়াভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবলো,যা হচ্ছে তা কি আদৌ ঠি ক হচ্ছে?তার কি নিজেকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত?নাকি এই উথালপাথালের জীবনে একটুখানি সুখের লোভটা সামলানো উচিত?
মাথায় আসছেনা।সবকিছুতেই এত প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেনো?

ঝকঝকে সকাল।ভার্সিটির জন্য বেরোচ্ছে রাত্রি।চোখেমুখে অস্থিরতা।আজ পরীক্ষা অথচ তার দেরি হয়ে গেলো।কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে যেইনা সিড়িভেঙে নিচে নামছে তখনই বাড়িওয়ালি রাহেলার ডাক।থেমে গেলো রাত্রি।সদর দরজা খোলা।রাহেলা দরজার সামনেই ছিলো বিধায় রাত্রিকে তার সহজেই চোখে পড়েছে।
রাত্রিকে কাছে এসে দাড়াতে বললেন উনি।উদ্দেশ্য কিছু কথা শোনানো।কালরাতে বেশ রাত হওয়ার কিছু বলতে পারেনি।তারউপর তার স্বামীও থামিয়ে দিয়েছিলো।মেয়েটা নিয়ম ভেঙেও খুব সহজেই পার পেয়ে গেছে।
রাত্রি দরজার সামনে দাড়াতেই সে কন্ঠে হাল্কা ঢং ঢেলে বললো,
—“তুমি যে কাইল এতো রাইতে ফিরলা আমাদের মান সম্মানের তো একটা ব্যাপার আছে।তাইনা?”
রাত্রি রাগে কটমট করলেও দোষটা নিজের হওয়ার দমে গিয়ে বললো,

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৫+৬

—“ক্ষমা করবেন আন্টি।”
—“এই রাত বিরেতে গেছিলা কই?খোজখবর তো নেয়া লাগবে তাইনা?একা থাকো।একাই যাও,একাই আসো।কোথায় কি করে বেড়াও তারপর শেষমেষ আমার বাড়ির বদনাম হইবো।”
প্রচন্ড বিরক্ত হলো রাত্রি।এই মহিলার কথাবার্তা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।রাগ উতলে আসে।তবু চাপে পরে চুপ থাকে।এই ভাড়ায় এমন বাসা আর পাওয়া মুশকিল।তাই সে যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলার চেষ্টা করলো,
—“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?আমি বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করি?আমি সারাটা দিন টিউশনি করি আন্টি।”
—“এত কথা কও কেন মুখে মুখে?মাইয়া মানুষ নরম কইরা কথা বলবা।”
—“আমি এমনই আন্টি।শক্তের ভক্ত,নরমের জম।যাই হোক,আর কখনো দেরি হবেনা।আসছি তবে।আমার পরীক্ষা আছে আজ।দেয়া করবেন।”বলে স্হান ত্যাগ করে রাত্রি।রাহেলার ভেতরের চাপা রাগটা বাড়লো আরো খানিকটা।

রাস্তায় জ্যাম।রিকশা নিলে আরো দেরি হবে বিধায় হেঁটেই যাত্রা শুরু করেছে রাত্রি।হাঁটতে হাঁটতে গলির মোড়ে এসেই থমকে দাড়ালো সে।বাঁক ঘুরে একটু সামনে আগালেই মতিন মিয়ার দোকান পড়বে।কালরাতের ঘটনার পর ওই লোকটা কি এখনো তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবে?হয়তো কিছু করার সাহস পাবেনা কিন্তু নিরবে তাকে চোখ দিয়ে গিলে তো ঠি কই নিবে।হয়তো এতোদিনও একই কাজ করেছে কিন্তু সে তো আর জানতোনা।কয়েকমূহুর্ত থম ধরে দাড়িয়ে থেকে চোখ বুজে জোরে একটা শ্বাস নিলো রাত্রি।কানে বাজলো নিভ্রানের কালরাতের বলা একটি কথা”আপনিতো এতো দুর্বল নন”।চোখ খুললো রাত্রি।বুকের কোনো এককোঁণে যত্নে বেড়ে উঠা ভয়টাকে নিশ্বাসের সাথেই নির্গত করে দিয়ে হনহন করে হেঁটে পাশ কাটিয়ে গেলো মতিন মিয়ার দোকান।

এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব ৯+১০