কাঞ্চাসোনা ২ পর্ব ১৫

কাঞ্চাসোনা ২ পর্ব ১৫
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

পরপর এমন বিশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার কারণে সকাল একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো।পরের কয়েকটা দিন কারো সাথেই তেমন কোনো কথা বললো না,সারাক্ষণ চুপচাপ থেকেছে।ধ্রুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে চাইলেও সকাল তার কথায় সাড়া দিলো না,ধ্রুবও আর জোর করেনি,থাকুক কিছুটা নিজের মতো কিন্তু তার মনের ভেতরে অসস্থিটা সুইয়ের মতো খুচিয়ে যাচ্ছিলো,সে বাসায় থেকেও শাহীনের বি/ষাক্ত ছো/বল থেকে রক্ষা করতে পারেনি।

সকালের এই নিশ্চুপতা,প্রাণহীন আচরণ ধ্রুবকে শান্তি দেয়না,সকালের এই বিষন্নতা দেখে ধ্রুবর মনের কিনারা ঘেষে মন খারাপ তেড়ে আসে কিন্তু সে যথাসম্ভব চাইছে সবার সামনে নিজের মন খারাপ না দেখাতে,যে বুঝার সে যদি না বুঝে অন্যকেউ বুঝে কি লাভ?
সকালের মা সাহানা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে হতবাক হয়ে যায়।আরেকটু দেরী হলে কি হতো ভেবেই উনার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পরিস্থিতি বিবেচনা করে মেয়েকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে ধ্রুব না করে।উনার ধারণা গ্রামে গেলে সকালের মন ভালো হবে কিন্তু ধ্রুবর মন বলে ধ্রুবর সানিধ্যে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি সকাল স্বাভাবিক হবে,তাই সে সকালকে নিজের কাছেই রাখতে চায়।মনোয়ারাও ধ্রুবর কথায় সায় দেয়,উনার দৃঢ় বিশ্বাস ধ্রুব সকালের মন ভালো করে রাখতে পারবে।অগ্যতা কোনো উপায় না পেয়ে সাহানা স্বামীকে নিয়ে গ্রামের উদ্যেশে চলে যায়,মেয়ের যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে সুতরাং মেয়ে জামাইর কথাও তো রাখতে হবে।

বিকালে মিতু সকালের কাছে যায়।সকাল বিছানায় কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে কিন্তু চোখ খোলা।মিতু কাছে গিয়ে বসে আলতো করে হাসে,মিতুকে দেখে সকাল উঠে বসে।মিতু বললো,
“অবেলায় শুয়ে আছো যে!শরীর খারাপ নাকি?”
সকাল মাথা নেড়ে বললো,
“না আপু।এমনি ভালো লাগছিলো না।”

মিতু সকালের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।সকালের মুখটা শুকিয়ে আছে।কথায় আছেনা মানুষের মন খারাপ থাকলে সবার আগে মুখেই তার ছাপ পড়ে।মিতু সকালের হাত ধরে বললো,
“যা হয়েছে ভূলে যাও না।মনে করো এটা একটা দূ/র্ঘটনা।”
সকালের মন কেঁপে ওঠে।মিতুকে বলে,
“ভুলতে পারছিনা।সারাক্ষণ মনে এসব ঘুরছে।”
“এসব বাজে লোকের স্মৃতি মনে রেখে বর্তমান নষ্ট করার কোনো মানে হয়?”
সকাল কিছুই বুঝলো না।মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“মানে?”

“তোমার এমন নিশ্চুপতা দেখে ভাইয়া যে চুপচাপ হয়ে গেছে তা কি চোখে পড়ছে না? আর কেউ না জানুক বা বুঝুক তুমি তো বুঝো যে ভাইয়া কতোটা চঞ্চল।”
সকাল নিজেও এটা লক্ষ করেছে,তার সাথে অনেকবার স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার কথা বলতে ইচ্ছে করেনি তাই কথা বলেনি।

ধ্রুবও আর জোড় করেনি।তারপর থেকে চঞ্চল ধ্রব চুপচাপ হয়ে গেছে,সারামুখে হাসি লেপ্টানোর নিচে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট।সকাল দেখেছে,স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে উঠা হয়নি,সারাক্ষণ শাহীনের করা কাজের কথা মনে পড়ে।মিতুর কথায় যেনো কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।মুখে আলতো হাসি ফুটিয়ে বললো,

“জানি।”
মিতু উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি চাই তোমরা দুজনে ভালো থাকো।”
মিতুর কথায় সকাল মুচকি হাসে।
“কিন্তু এর জন্য কি করতে পারি?”
মিতু চলে যেতে যেতে বললো,
“তোমার মন যা সায় দেয় তাই করো কিন্তু খেয়াল রেখো ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক ঠিক করা চাই।”

মিতু চলে গেলে সকাল আশেপাশে চোখ ভুলায়।ধ্রুব এখন অফিসে,সকালে গোসল করে তোয়ালেটা চেয়ারে মেলে দিয়ে গেছে যেটা এখনো আগের মতোই আছে।সকাল তোয়ালেটার দিকে তাকিয়ে ধ্রুবর দুষ্টুমিমাখা চেহারাটা মনে করে;এই কয়দিন এই দুষ্টু চেহারা আর দেখা হয়নি সকাল চুপ থেকেছে বিধায় ধ্রুবও রুমে টু শব্দও করেনি।সকালের মন খারাপ হয় তার কারণেই ধ্রুবও কষ্ট পাচ্ছে।বেডসাইড টেবিল থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সকাল এই প্রথম ধ্রুবকে ফোন দেয়।দুরুদুরু বুকে ফোন রিসিভ হওয়ার অপেক্ষা করে।

কিছুক্ষণ পরেই অফিস টাইম শেষ,ধ্রুব দ্রুত গতীতে হাতের কাজ শেষ করতে চাইছে।কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে তখনি তীব্র কম্পন অনুভব করে টেবিলের ড্রয়ারে।বিরক্তিতে ধ্রুবর ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়,মুখে বিরক্তির আভাস ফুটে উঠে।ব্যস্ত হাতে ড্রয়ার থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে ‘মিষ্টিপাখি’ নামটা জ্বলজ্বল করছে।মূহুর্তের মাঝে তার সকল ক্লান্তি,বিরক্তি উধাও হয়ে যায়।মুখে ফুটে উঠে মুচকি হাসি।সকাল!তার পিচ্ছি আদুরে বউ!তাকে ফোন দিয়েছে?ধ্রুব স্বাভাবিক ভাবেই ফোনটা রিসিভ করে।তারপর খুবই সাবলীল গলায় বললো,

“হ্যাঁ;সকাল বলো।”
ধ্রুবর কথা শুনে সকালের মন দুলে উঠে মুখে লজ্জার আভা দেখা দেয়।ধ্রুব এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে যেনো সকাল আর দশটা বউয়ের মতো রোজ অফিসে বরের খোঁজ নিতে ফোন করে।ধ্রুব সকালের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখলো লাইন কেটে গেলো কিনা।কিন্তু এখনো যে সংযুক্ত দেখাচ্ছে তাহলে কথা বলছেনা কেনো?ধ্রুব আবার বললো,

“হ্যালো!সকাল;শুনতে পাচ্ছো?”
সকাল বিব্রত গলায় বললো,
“হ্যাঁ!ভালো আছেন?”
এমন প্রশ্ন করে সকাল নিজেই বিরক্ত হয়,দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরে।ধ্রুব সকালের প্রশ্নে মুচকি হাসে।হাত দিয়ে ঘাড় ম্যাসাজ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।সকাল যে এমন প্রশ্নে বিব্রতবোধ করছে এটা
বেশ বেশ বুঝতে পারছে সে চাইলেই আরো লজ্জা দিতে পারে কিন্তু পাখির ডানা এতোদিন লুকিয়ে রেখেছিলো আজকে হালকা ঝাপটাচ্ছে ধ্রুব চায়না তার কথায় সকাল আরো লজ্জা পাক তাই আশকারা দেয়া গলায় বললো,

“ভালো আছি।আমার বউ কেমন আছে?”
ধ্রুবর স্বাভাবিক কথায় সকাল মুচকি হাসে।বউ শব্দটা কর্ণগোচর হতেই মুখে হাজারো লজ্জার প্রজাপ্রতি উড়ে যায়।হাতের আঙুল খুটে বললো,
“ভালো।আপনি কি করেন?”
“কিছুক্ষণ পরে ছুটি তো তাই হাতের কাজ সেরে নিচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
“ফোন দিলে যে!”
সকাল ভাবলো বলবে কিনা।
“আপনার কি খুব ক্লান্ত লাগছে?”

সকালের প্রশ্নে ধ্রুব বলে,
“না তো ক্লান্ত লাগছে না।কি হয়েছে বলো।”
সকাল অমতা আমতা করে বললো,
“আমার না আপনার সাথে ঘুরতে মন চেয়েছে।তাই!”
ধ্রুবর মনে যেনো আচমকা বৃষ্টি হয়।কড়া বর্ষনে অন্তর আত্মা কেমন নেচে উঠে।দম আটকে বললো,

“আমি আসছি তুমি রেডি হয়ে থাকো।বাসার নিচে এসে ফোন দেবো।”
সকাল কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আয়নার সামনে গিতে দাঁড়ায়।চোখ মেলে নিজের লজ্জাবতীর মতো নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে।পরের সময়টা খুব দ্রুত কেঁটে যায়।মনোয়ারার কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে দ্বিধার দোটানায় হালকা ছাই রঙা শাড়ী গায়ে জড়ায়,ফর্সা শরীরে ছাই রংটা বেশ মানিয়েছে।ধ্রুবর পছন্দ অনুযায়ী লম্বা চুলগুলো বেনী করে নেয়।

মুখে হালকা সাজ দেয়।তারপর ধ্রুবর ফোন পেয়ে নিচে নেমে যায়।ধ্রুব একটা রিক্সায় বসে ছিলো সকালকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে,তারপর আশেপাশে তাকিয়ে সকালের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।সকাল ধ্রুবর হাত ধরে রিক্সায় উঠে বসে।রিক্সা চলতে শুরু করলে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দুজনের বাহু,পা স্পর্শ করে যায়।সকালের মনটা নেচে উঠে,ধ্রুবর গায়ের পারফিউমের ঘ্রানে তার কেমন বিবস লাগে।ধ্রুবর থেকে সকাল কিছুটা চেপে বসে।ধ্রুব ব্যাপারটা খেয়াল করে বললো,

“ঠিক হয়ে বসো।”
“আমি ঠিক আছি।”
ধ্রুব সকালের দিকে তাকিয়ে দেখে আরেকটু হলেই সকাল রিক্সা থেকে পড়ে যাবে।
“সকাল তুমি কি রিক্সা থেকে পড়ে কোমড় ভাঙ্গার পায়তারা করছো?”
ধ্রুবর কথায় সকাল মাথা নেড়ে বললো,
“না তো!”
“তাহলে এভাবে বসেছো কেনো?”
“আমি ঠিক আছি।”

ঠিক আছ বলার সাথে সাথে রিক্সা রাস্তার এক ভাঙ্গা জায়গায় এসে প্রচন্ড ঝাকুনি খেলে সকাল পড়ে যেতে নেয়।ধ্রুব বিরক্তিকর কন্ঠে রিক্সাওয়ালাকে বললো,
“মামা আস্তে যান,আরেকটু হলেই তো ফেলে দিতেন।”

তারপর সকালের কোমড় ধরে টেনে ধ্রুবর সাথে চেপে বসালো।ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যে সকাল হতভম্ব হয়ে গেলো।চোখ বড়ো বড়ো করে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে ধ্রুব অবশ্য এসবে খেয়াল নেই সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।সকালের কোমড়ে তখনো ধ্রুবর হাত,সকাল নতজানু হয়ে যায়,বুকে অসামান্য কাঁপন অনুভব করে।সকাল ফিসফিস করে বললো,

“হাতটা সরান,প্লিজ।”
“কেনো?”
“নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।”
ধ্রুব মুচকি হাসে।সামান্য কোমড় ধরাতে এই অবস্থা এই বাচ্চার সাথে ইন্টিমেন্ট হবে কিভাবে?ধ্রুব হাত সরিয়ে সামনে তাকায়।সকালের হঠাৎ খুবই মন খারাপ হয়;সে ধ্রুবর জন্য সাজলো কই ধ্রুব তো একবারো তার প্রশংসা করলো না কিন্তু সকালের মন যে ধ্রুবর প্রশংসা শুনতে চাইছে।তার ভাব বেশীক্ষণ চেপে রাখতে পারলো না আস্তে করে বললো,
“বললেন না তো!”

ধ্রুব মাথা ঘুরিয়ে সকালের দিকে তাকায়।সকাল তার কাছে হওয়াতে দুজনের মুখ খুল কাছাকাছি।
“কি?”
সকাল লজ্জায় ফিসফিস করে বললো,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
ধ্রুবর চোখ তখন সকালের দিকে নিবন্ধ।সেও সকালের মতো ফিসফিস করে বললো,
“খুব সুন্দর লাগছে ইচ্ছে করছে টুপটাপ চুমু খেয়ে ফেলতে।”

ধ্রুবর উত্তর শুনে সকালের বুকে কেমন শিরশিরানো বাতাস বয়ে যায়।ঠোঁটের কোলে লাজুক হাসির রেশ।মাথা নত করে ভাবে ধ্রুব বেশ ঠোঁটকাঁটা মানুষ,মুখে কিচ্ছু আটকায় না।ধ্রুব বুক পকেট থেকে বেলীফুলের মালা বের করে আনে।তখন আসার পথে কিনেছিলো।সকালের হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

“তুমি লজ্জা পেওনা সকাল তুমি লজ্জা পেলে আমার আরো লজ্জাহীন হতে ইচ্ছা করে।”
মিতু মাত্র এক বান্ধুবীর বাসা থেকে বের হয়েছে।চেহারায় বিষাদের ছায়া ফুটে আছে।মনে ব্যাথা রেখেও বাসায় সারাদিন হাসিমুখে থাকে অথচ তার মন মুটেই ভালো নেই।মন ভালো না থাকার মূলে আছে সামির।কয়েকদিন ধরে ফোন ধরছে না,আর না দেখা করছে।সামিরকে না দেখলে মিতুর যে ছটফটানি অনুভব হয় তা যদি সামির বুঝতো।ধীর পায়ে সে সামনে এগিয়ে যায়।

তখনি দেখে সামির একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।সামিরের মুখে উচ্ছল হাসি আর মেয়েটা বিনীত ভাবে কিছু বলছে তারপর হেসে বাসার ভেতরে চলে যায়।মিতুর চোখ মূহুর্তের মাঝে পানিতে ভরে যায়।এই বুঝি কারণ?এর জন্যই কি তার সাথে না ফোন না দেখা!সামির সামনে তাকিয়ে মিতুকে দেখে না দেখার মতো করে চলে যেতে চায়।মিতু পথ আগলে দাঁড়ায়।রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

“এই মেয়ে টা কে?”
সামির কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।মিতু সামিরের নিশ্চুপতা সইতে পারে না।গলা উঁচিয়ে বললো,
“এটা কি আপনার গালফ্রেন্ড?”
মিতুর গলার স্বর খুবই উচ্চ ছিলো আশেপাশের সবাই তাদের দিকে তাকায়।সামির বিরক্ত হয়।স্টুডেন্টের বাসার সামনে এমন চেচামেচি অশোভন।চাপা ক্রোধের সাথে বললো,
“এটা আমার স্টুডেন্ট।গলা নামিয়ে কথা বলো,এমন চেচামেচির কি আছে?”
মিতু থমকে বললো,

“আপনাকে না মেয়ে ছাত্রী পডাতে না করলাম।”
সামির যেনো খুব বিরক্ত হয়।
“তোমার কথা শুনতে হবে?”
“হ্যাঁ।আর মেয়ে ছাত্রী পড়াতে আসবেন না।”
সামির রেগে যায়।কর্কশ গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

কাঞ্চাসোনা ২ পর্ব ১৪

“একশো বার পড়াবো দরকার পড়লে বিছানায় শুয়ে পড়বো।তোমার কোনো সমস্যা?”
সামিরের কথায় মিতু হতভম্ব হয়ে যায়।সামির এসবের তোয়াক্কা করে না হতভম্ব মিতুকে পেছনে রেখে সে হনহন করে সামনে এগিয়ে যায়।

কাঞ্চাসোনা ২ পর্ব ১৬