কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১০

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১০
জাওয়াদ জামী

আজ শুক্রবার। আরমান বাড়িতেই আছে।
শহিদ আহমেদের ছোট ছেলে শুভ আজ বাড়িতে এসেছে। আরমানের বিয়ের পনেরদিন আগে সে ইউরোপে ট্যুরে গিয়েছিল। আরমানের বিয়ের আজ দশদিন পূর্ণ হয়েছে। দীর্ঘ পঁচিশ দিন পর শুভ বাড়ি ফিরেছে।
আকলিমা খানম ছেলেকে দেখে ভিষণ খুশি হয়েছে। ছেলেকে সে কাছ ছাড়া করছেনা।
এদিকে শুভ ড্রয়িংরুমে কান্তাকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে মায়ের দিকে তাকায়।

” মম, এই মেয়েটা কে? একে নতুন দেখছি বলে মনে হচ্ছে? নতুন মেইড রেখেছ? ”
” ও আরমানের বউ। ” এক কথায় জবাব দেয় আকলিমা খানম।
” ওহ। আমি ভেবেছিলাম নতুন মেইড রেখেছ বোধহয়। চেহারা দেখেতো মেইডের মতই মনে হচ্ছে। অবশ্য যার যেমন রুচি। সে তেমনই পছন্দ করবে। ” তাচ্ছিল্যের সাথে বলে শুভ।
ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল কান্তা। সেই সাথে রা’গে ওর মাথা গ’র’ম হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এসব কি বলছ, ভাইয়া! যাদের সম্পর্কে তুমি এসব বলছ, তারা তোমার ভাই-ভাবী। আর ভাবী নিজের সংসারে কাজ করছে। তাই বলে সে মেইড হয়ে গেল! তাছাড়া বড় ভাইয়ার রুচি কেমন, সেটা তুমিও জান আমরাও জানি। ” শ্রীজা শুভর কথার প্রতিবাদ করে বলে।
” এতদিন জানতাম তুই তোর বড় ভাইয়ের চা’ম’চা। এখন আবার নতুনভাবে তার বউয়েরও চা’ম’চা’মি’র চাকরি নিয়েছিস নাকি! দিনদিন তোর ভালোই উন্নতি হচ্ছে দেখছি! ” শুভ ব্যাঙ্গ করে বলে।

” শ্রীজাপু, যা করেছে তাকে চা’ম’চা’মি বলেনা, তাকে বলে শ্রদ্ধা করা। যা তোমার মোটা মাথায় ঢোকেনি, বুঝলে দেওরা? আমি দেখতে মেইডের মত তা মেনে নিলাম। আমি তোমার মত আলট্রা মর্ডান নই, পোশাকআশাকেও এতটা ঝাক্কাস নই। তাই আমি তোমার চোখে মেইডের মত। তোমার চেহারা তো দেখছি মাশাআল্লাহ। কিন্তু এতটা ফিটফাট, ঠাটবাটে থাকার পরেও তোমাকে আমার টো’কা’ই বলে মনে হচ্ছে। এক্কেবারে ইন্টারন্যাশনাল টো’কা’ই। অবশ্য চেহারা যা ঠিক আছে। কিন্তু ব্যবহার আর পোশাকআশাকে উ’ল্লু’ক বললেও ভুল হবেনা। একটা কথা মাথায় ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও, সম্পর্কে আমি তোমার বড় ভাবী। সে দেখতে যতই মেইডের মত হইনা কেন। আমাকে ভাবী বলেই ডাকবে। আর বড় ভাইকেও তার প্রাপ্য সম্মান দিবে। বুঝলে দেওরা? ”

কান্তার কথা শুনে আকলিমা খানম ও শুভ স্তব্ধ হয়ে গেছে।
” মম, এই মেয়েটা কি বলছে এসব! ও আমাকে টো’কা’ই বলছে!
ইউ ব্লা’ডি বি’চ তোমার সাহস তো কম নয়। তুমি আমাকে অপমান করছ? যতসব লো ক্লাসের মেয়ে। অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে পরলে এভাবেই রূপ বদলায়। ”
” এইযে, ইংরেজ ব’ল’দ, মুখ সামলে কথা বল।

ঐরকম দুই,চার,দশটা ইংরেজি আমিও জানি। তুমি ক্লাস সম্পর্কে কি জানো? খালি বাপের বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক, ব্যালেন্স থাকলেই সে আপার ক্লাস হয়ে যায়! ক্লাস মেনইটেইন হয় যোগ্যতায়। যেটা তোমার নেই। তুমিতো বাপের সম্পদের ফু’টা’নি মেরে বেড়াও। ক্লাসের তুমি বুঝবে কি! আর ঐ ব্লা’ডি বি’চে’র হিসেবটা তোলা রইল। প্রথমদিনেই বেশি কিছু বলতে চাইনা। এতে ওভার ডোজ হতে পারে। ”

” এই মেয়ে, তুমি চুপ করবে? আমার ছেলেটা কতদিন পর বাসায় এসেছে। কিন্তু তুমি তাকে যাচ্ছেতাই বলছ? কিসের এত বড়াই তোমার? শুভ তো সত্যিই বলেছে। তুমি তো লো ক্লাসের মেয়েই। আজ দশদিন হচ্ছে বিয়ের, অথচ এতদিনেও বাপের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে? নাকি আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করেছে?

নাকি আরমানকে জামাই আদর করেছে? বিয়ের একদিন পর যেখানে জামাইকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে হয়, সেখানে আজ দশদিন হচ্ছে। কিন্তু তোমার বাড়ির মানুষদের কোন খবর নেই। বিয়েতে কি দিয়েছে তোমাকে বাপের বাড়ি থেকে? আরমানকে কি দিয়েছে? একটা সুতাও তো আননি। যেই মেয়ের বাপের বাড়িতে কোন মূল্য নেই সে আবার বড়বড় কথা বলে! যে বাড়ি থেকে আমাদের কোন সম্মান করেনি, সেই বাড়ির মেয়ে হয়ে তুমি গলাবাজি করছ? ” আকলিমা খানম মনের যত রাগ সব উগরে দেয়।
কান্তা এবার যেন মিইয়ে যায়। ওর শ্বাশুড়ির কথায় কোন মিথ্যা নেই সেটা ও ভালো করেই জানে। এসব তিক্ত কথার কি জবাব দেবে ও?

” আমাকে নিয়ে আজকাল খুব বেশি চিন্তা করছেন বলে মনে হচ্ছে! তাহলে বলি, এত চিন্তা করার কিছুই নেই। আমি বিয়ে করে বউ এনেছি। শ্বশুর বাড়ি কিংবা তাদের থেকে কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার। আমার বউ বিয়ের পর বাপের বাড়ি যাবে কিনা সেটা আমি বুঝব। আর আমি চাইনা আমার বউ বাপের বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ রাখুক। আর একজন বিবাহিতা মেয়ের ক্লাস বিবেচিত হয় তার স্বামীর স্ট্যাটাস দেখে। আর আমার স্ট্যাটাস নিশ্চয়ই লো লেবেলের নয়। ভবিষ্যতে ওকে কিছু বলতে চাইলে দশবার ভেবে তারপর বলবেন। আজ এখানে বাড়ির সবাই উপস্থিত আছেন। সবাই কান খুলে শুনে রাখুন, কান্তা ওর বাবার বাড়িতে আর যাবেনা। এ নিয়ে ভবিষ্যতে তাকে কেউ কিছু বললে আমি মেনে নিবনা।

আসলে কি জানেন, আমি আপনার হাসবেন্ডের মতই বউ ছাড়া থাকতে পারিনা।
আর শুভ তোকে বলছি, কান্তাকে সম্মান করতে না চাইলে করবিনা। কিন্তু তার কোন অসম্মান আমি মানবনা। ও এ বাড়িতে আমার অধিকারে চলবে। তোর মা অথবা দাদিমার এ বাড়িতে যেমন অধিকার আছে, ঠিক সমঅধিকার কান্তারও এ বাড়িতে আছে। তাই সময়ে অসময়ে এমন কোন ইংরেজি বুলি আউড়াসনা যেটা শুনলে আমার মাথার তার ছিঁ’ড়ে যাবে।

ইজ ইট ক্লিয়ার? ” আরমান একবার শুভর দিকে আরেকবার আকলিমা খানমের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে।
কান্তা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আরমানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা ওকে কিভাবে অপমানের হাত থেকে বাঁচাল!
শহিদ আহমেদ ওপর থেকে সব কিছু দেখছিলেন। শুভর কথাবার্তা তার কাছে ভালো লাগেনি।
আবার আরমানের ওপরও একটু বিরক্ত হন। ছোট ভাইয়ের সাথে এত কঠোর হওয়ার দরকার কি ছিল!

আরমানের কথা শুনে রাজিয়া খানম চুপসে গেছে। সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, এই মেয়েটাকে কিছু বলে পার পাওয়া যাবেনা।
কান্তা রুমে বসে আছে। ওর এই মুহুর্তে পড়তে মোটেও ইচ্ছে করছেনা। এদিকে আরমানও বাসায় নেই। সে কখন আসবে কে জানে। একা একা ওর সময় কাটছেনা।
শ্রীজাপুও কোন বান্ধবীর বাসায় গেছে। তারও নাকি ফিরতে রাত হবে।
বসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল আর নানান কথা ভাবছে।
” বাসায় কোন খাবার নেই? ”

আরমানের গলা শুনে ভয় পায় কান্তা৷ ওর ভাবনার মাঝেই কখন যে সে রুমে এসেছে তা বুঝতে পারেনি বেচারি৷
ভয়ে কান্তার বুক ধুকপুক করছে। একটু থিতু হয়ে মুখ খোলে।
” আপনার ক্ষুধা লেগেছে? রাতের জন্য খাবার রান্না করেছি অনেকক্ষণ আগেই। আপনার জন্য নিয়ে আসব? ”
” আমি তোমার কথা বলছিলাম। ”

এবার ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে কান্তা। আরমানের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছেনা।
” আমি আবার কি করলাম! “বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল কান্তা।
” যেভাবে দাঁত দিয়ে নখ কা’ট’ছি’লে, আমি ভাবলাম ক্ষুধা লেগেছে তাই এমন করছ। ”
এবার বিষয়টা বোধগম্য হয়।
” একটা কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে এমনটা করেছি বুঝতেই পারিনি। ” ম্লানমুখে বলে কান্তা।
” কিসের এত চিন্তা তোমার? ”

” এই যে আপনি আমাকে বারবার অপমানিত হওয়ার থেকে বাঁচাচ্ছেন। সত্যিইতো আমার বাড়ি থেকে কেউ আপনার যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। কেউ একটাবার খোঁজ নেয়নি। তবুও আপনি আমাকে এ নিয়ে কিছু বলেননি। আবার এ বাড়িতে কেউ কিছু বললে আপনি তার প্রতিবাদ করছেন! ”

” এই মেয়ে, তোমার পড়াশোনা নেই? ইচ্ছে নেই জীবনে বড় কিছু হওয়ার? নাকি সত্যি সত্যিই মেইড হয়ে থাকতে চাও? তোমাকে যতটা অবলা ভেবেছিলাম ততটাও অবলা তুমি নও! শুভ বাসায় আসতে না আসতেই ওর চেহারা যে মাশাআল্লাহ তা বুঝে গেছ! দুই দুইবার তাকে চেহারার কথা বললে! এসব কুচিন্তা মনে ঢুকলে পড়াশোনায় মন বসবে কেমন করে। ”
” বলছি যে, একটা উট দিয়ে আমার আরেকবার আকিকা দেন। আর কান্তা নামটা পরিবর্তন করে ‘ এই মেয়ে ‘ রাখুন। আমি এই বাসায় আসার পর থেকে সবাই কারনে অকারণে এই মেয়ে, এই মেয়ে বলে ডেকে উঠে। যেন এটাই আমার জাতীয় নাম। কয়দিন পর দেখা যাবে বাবার দেয়া নামটাও ভুলে গেছি। কিন্তু এমনি এমনি নাম ভুলতে রাজি নই আমি। ”

” কিন্তু তাই বলে উট! গরু বা খাসি নয় কেন? ” আরমান বেশ মজা পাচ্ছে।
” বা রে। রাখবেন আনকমন নাম। আর তার বদলে উট দিবেননা! সারা দুনিয়া ঘুরলেও এই আনকমন নাম খুঁজে পাবেননা। তাই উটের কথা বলেছি। এখন দেশেও নাকি উট পাওয়া যায়। আমিতো আর ডায়নোসরের কথা বলিনি যে পাবেননা। ”
” তুমি যাবে এখান থেকে? যাও পড়তে বস। খালি ফাঁকি দেয়ার চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে? ” আরমানের রা’গী গলার স্বরে কান্তার পিলে চমকে যায়। তাই ও আর কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে বারান্দায় আসে।

কান্তার আজ সত্যিই পড়ায় মন বসছেনা। কিন্তু আরমান তা বুঝলে তো।
সে জোর করে কান্তাকে পড়াচ্ছে। ফাঁকি দেয়ার কোন রাস্তাই নেই কান্তার সামনে।
রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে আরমান। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।
কান্তাও বুঝতে পারে আরমানের কিছু একটা হয়েছে। ও উঠে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়।

” কি হয়েছে? এমন ছটফট করছেন কেন? ”
” কিছুনা। তুমি ঘুমাও। ”
” কিছুতো একটা অবশ্যই হয়েছে। প্লিজ বলুননা। আপনার কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। ” অনুনয় করে কান্তা।
” মাথাটা ভিষন ব্যথা করছে। ”
আরমানকে আর কিছুই বলতে হয়না। কান্তা বিছানা থেকে নেমে ওর তেলের কৌটা এনে আরমানের মাথায় তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর উঠে রান্নাঘরে যায়। নিয়ে আসে মসলা চা। আরমানকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে চায়ের কাপ তার হাতে ধরিয়ে দেয়।

প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত কান্তা আরমানের মাথা ম্যাসাজ করে। এরইমধ্যে আরমান ঘুমিয়ে গেছে।
তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কান্তা।
আজ দশদিন যাবৎ তার সাথে এক খাটে ঘুমায়। অথচ মানুষটা ওকে একটাবারের জন্যও ছুঁয়ে দেখেনি। কিন্তু ওর যথেষ্ট খেয়াল রাখছে ,আগলে রাখছে।

” আচ্ছা, ঐ উ’ল্লু’কে’র চেহারা দেখে মাশাআল্লাহ বলায় ইনি এত ক্ষেপলেন কেন? তবে কি মহাশয় জেলাস ফিল করছেন! কিন্তু প্রথমদিনই তো বলেছিলেন ভালো রেজাল্ট না করলে, পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স না পেলে আমাকে ভালোবাসবেনা? উহু, কান্তারে তুই ভুল ভাবছিস। মহাশয় তোকে ভালোবাসে কিন্তু ধরা দিচ্ছেনা। ভালো না বাসলে কেউ কি এভাবে আগলে রাখে? ” কান্তা নিজের সাথে কথা বলছে।

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৯

হঠাৎ আরমান পাশ ফিরে শুতেই কান্তার খেয়াল হয়, ও এতক্ষণ আরমানের হাত জড়িয়ে রেখেছিল। আরমান নড়ে উঠতেই ও হাত ছেড়ে দেয়।

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১১