প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২
Writer Mahfuza Akter

প্রহর গালে হাত দিয়ে সোফার একপ্রান্তে বসে আছে। সামনের সৌহার্দ্যের নির্জীব মুখশ্রী দৃশ্যমান। সোফায় গা এলিয়ে প্রাণহীন দৃষ্টি মেলে রেখেছে সিলিংয়ের দিকে। এলোমেলো চুল, নির্জীব চাহনি ও মূর্তিবৎ অবয়বে সৌহার্দ্যকে বোধ হয় এই প্রথম দেখছে প্রহর। ভাবছে কিছু মুহুর্ত আগের ঘটনাটা।
ভোরের আলো ফুটেছে কিছুক্ষণ আগেই। প্রহর জগিং করতে বেরিয়েছে। পার্কের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ট্রাউজারের পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করতে লাগলো।

প্রহর পা থামিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। রায়হান সাহেবের ডুপ্লেক্স বাড়ির দারোয়ান কল দিয়েছে। এই নাম্বারটা রায়হান সাহেব দারোয়ান নিয়োগ করার সময়ই প্রহরকে দিয়েছিল। প্রহরের বাসাও কাছেই, মিনিট দশেকের পথ হবে। তাই সেই ডুপ্লেক্সের দারোয়ান ও কেয়ারটেকার কোনো সমস্যা হলে প্রহরকেই কল দিয়ে জানায়।
নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে প্রহর কল রিসিভ করে কানে লাগালো,
“হ্যাঁ, চাচা! বলো! সব ঠিকঠাক?”
“অনেক বড় বিপদ হইয়া গেছে, বাপ!” দারোয়ান আতঙ্কিত গলায় বললো।
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কী হয়েছে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বৃষ্টি থামার পর ফজরের নামাজ পড়তে বাইর হইছিলাম। বাগানের কাছ দিয়া যাওয়ার সময় দেখি একটা বড় কালো গাড়ি বাগানের মাঝামাঝি। পরে আমি আগাইয়া গিয়া দেখছি গাড়ির ভিতরে কেউ আছে কিনা! কেউ ছিল না গাড়ির ভিতরে। কিন্তু বাইরে গাড়ির চাকার সাথে হেলান দিয়া এক জোয়ান ছোকরা বসা ছিল। সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে আর গা কাদামাটিতে একাকার। আমি ডাকাডাকি করার পরও সাড়া দেয় নাই। তাই আমি বাধ্য হইয়া হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিতেই সে ঢলে পড়ে গেল।”
প্রহর সবটা শুনে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

“বলো কী? তারপর?”
“তারপর আর কী? ভাবছিলাম অজ্ঞান হইয়া গেছে! আমি অনেকক্ষণ চেষ্টা করছি জ্ঞান ফেরানোর। কিন্তু এ তো নড়েও না, চোখও খুলে না। বুঝতেছি না বাইচা আছে নাকি মইরা গেছে। ছেলেটার সারা মুখ, হাত-পা লাল হইয়া যাইতাছে। দেখলে বুঝতা! পুরাই বিদেশীদের মতো ফর্সা দেখতে। আর লম্বাও ঢের!”
প্রহরের এইবার টনক নড়লো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ। পরপরই হতভম্ব হয়ে বললো,

“হোয়াট? এটা সৌহার্দ্য নয় তো? আ…. আমি এখনি আসছি। তুমি ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।”
প্রহর দ্রুত রাস্তা থেকে রিকশা নিয়ে ডুপ্লেক্সে চলে আসে। সৌহার্দ্যকে দেখে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি ওর। তাই দ্রুত ভেতরে নিয়ে গিয়ে ডক্টর কল করে। জ্বরে হাত-পা পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার! প্রহর সৌহার্দ্যের ভেজা কাপড় বদলে হাত-পা মুছিয়ে দেয়। ডক্টর দেখে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর সৌহার্দ্য চোখ মেলে তাকিয়েছিল।
সবটা ভাবতেও প্রহরের গা শিউরে উঠলো। এমন দিন দেখতে হবে, সে কোনো দিন কল্পনাও করেনি। সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

“বৃষ্টির পানিতে কতক্ষণ ভিজেছিস?”
সৌহার্দ্য নিরুত্তর। একটু নড়লোও না। প্রহরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালোও না। প্রহর মুখ ঘুচিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
“নিজে নিজে এতো কষ্ট পাচ্ছিস যখন, তখন বিয়েটা আটকালি না কেন? তুই চাইলেই বিয়েটা আটকাতে পারিস! ইন ফ্যাক্ট, এখনো সময় আছে।”
সৌহার্দ্য প্রহরের দিকে শান্ত চোখে তাকালো। পুনরায় মুখ ফিরিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

“যেখানে তরী আর অর্ণব দু’জনেই দু’জনকে চায়, সেখানে আমি ওদের মাঝে কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো। তরী ভালো থাকুক, এটাই আমি চাই! অর্ণব ওকে ভালো রাখবে।”
“তোর থেকে বেশি তো ভালোবাসতে পারবে না!”
সৌহার্দ্য থমথমে গলায় বললো,
“আমি ভালোবাসি না তরীকে!”
প্রহর মুখ বাঁকালো। সৌহার্দ্যকে মুখ ভেঙিয়ে বললো,
“আমি ভালোবাসি না তরীকে!”
পরপরই রাগী কন্ঠে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তাহলে এতো কষ্ট পাচ্ছিস কেন ছ্যাঁকা-খোরদের মতো? নরমাল থাক! তরীর বিয়ে হয়ে গেলে তোর কী? ওর বিয়ে হবে, অর্ণবের সাথে সংসার করবে, বাচ্চা পয়দা করবে! আর তুই? বিরহী মানবের মতো তাকিয়ে থাকবি। হোয়াই? তোর তো কিছু যায় আসার কথা না।”
সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“ইউ আর রাইট! আমার কিছু যায়-আসে না।”

প্রহরকে অবাক করে দিয়ে সৌহার্দ্য সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। প্রহর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। ছেলেটা এতো অদ্ভুত কেন? ভেতরে ভেতরে কষ্টে পুড়ে ম*রছে! অথচ মুখ ফুটে একবারের জন্যও ভালোবাসার কথা স্বীকার করতে নারাজ।

দুপুরের দিকে অর্ণব শাড়ি ও গহনা পাঠিয়েছে তরীর জন্য। বাড়ির সদর দরজার সামনে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার দরজায় কড়া নাড়লো। মোহনা দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভার বড়বড় দু’টো ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এগুলো বউ সাজানোর জন্য পাঠানো হয়েছে। সন্ধ্যায় বিয়ের কার্য সম্পাদনের জন্য বরপক্ষই কাজী নিয়ে আসবে!”

মোহনা খুশি মনে ব্যাগগুলো হাতে নিলো। সদর দরজার সামনের মাটির রাস্তা দিয়ে দু’জন মহিলা পা থামিয়ে মোহনার দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। ড্রাইভারের বলা কথাটা তারা শুনে ফেলপছে কিনা বোঝার উপায় নেই। মোহনা হকচকিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো দ্রুত।

সন্ধ্যার আগেই তরীকে বধূ বেশে সজ্জিত করে ফেললো মোহনা। তরীকে বধূ বেশে দেখে মোহনার চোখে তাক লেগে গেল। এই মেয়ের এতো নিখুঁত সৌন্দর্যের রহস্য ভেদ করতে পারে না মোহনা। মোহনা তো মুখে কোনো প্রসাধনীও লাগিয়ে দেয়নি তরীর! লাল বেনারসি, গলায় অর্ণবের পাঠানো মোটা গহনা, কপালে বড় একটা টিকলি, হাতে দুটো মোটা বালার সাথে লাল রেশমি চুড়ি আর চোখে হালকা কাজল ও ঠোঁটে লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়েছে মোহনা। তরীর লম্বা চুলগুলো একত্রিত করে একটা বড় খোপা হয়েছে, আর তার ওপর লাল ওড়না দিয়ে মাথার অর্ধেকটা ঢেকে দিতেই তরীর সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে! মোহনা এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

“এই রূপ দিয়েই অর্ণবের মতো ছেলেকে বশ করে ফেলেছিস, না?”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো মোহনার দিকে। মোহনা তরীর এমন দৃষ্টি দেখে হকচকিয়ে গেল। ঘোরের বশে কী বলতে কী বলে ফেলেছেন ভেবে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলেন,
“সময় তো অনেকক্ষণ হয়ে গেল! আমি যাই। আপাকে ফোন দিয়ে দেখি কতদূর এসেছে!”
তরীর মনটা উশখুশ করে উঠলো। ইতস্তত করে হাতে হাত মুচড়ে মোহনাকে পেছন থেকে ডাক দিলো,

“মা, শোনো!”
মোহনা ঘাড় ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বল!”
তরী মিনতির গলায় বললো,
“বিয়েটা তো হয়েই যাবে! এই মুহুর্তে বিয়ে আটকানোর কোনো সুযোগ নেই। বাবাকে এই বার অন্তত একটু ফোন দিয়ে জানাও বিয়ের খবরটা। বাবা কোনো আপত্তি করবে না, দেখে নিও!”
তরীর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। মোহনা বিরক্তি নিয়ে বললো,

“একদম না! বিয়ের আগে কাউকে কিছু জানাতে হবে না। নির্বিঘ্নে বিয়েটা হয়ে যাক! তারপরই আমি সবাইকে জানাবো।”
বলেই মোহনা হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তরী অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো মোহনার যাওয়ার দিকে। এই বিয়েতে তার আপত্তি না থাকলেও বাবাকে না জানিয়ে বিয়েটা করায় মন একটুও সায় দিচ্ছে না। যেই মানুষটা ওকে এতো ভালোবাসে, তার অগোচরে বিয়েটা করতে বড্ড বিবেকে বাঁধছে!

বাইরে থেকে মোহনা আর আসমা বেগমের আমোদিত গলার স্বর ভেসে আসছে। তার মানে অর্ণব অর্থাৎ বরপক্ষ চলে এসেছে? বিয়ে হতে আর কিছু মুহুর্ত বাকি! আর কিছুক্ষণ পরেই তরীর নামের সাথে আজীবনের মতো অর্ণবের নাম জুড়ে যাবে। চোখ দুটো বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তরী। কিন্তু চোখ খোলার আগেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখ ভেসে উঠলো তরীর দৃশ্যপটে। সেই রাগী চোখ, শাসন, অত্যাচার, যত্ন আর সবশেষে গাল ছুঁয়ে দিয়ে অধিকার না থাকার আক্ষেপ প্রকাশ! সবটাই ক্রমাগত তরীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। শিউরে উঠে চোখ খুলে ফেললো তরী।

অর্ণবের আগমনের কিছু সময় পরেই মোহনা এসে তরীকে নিয়ে গেল। বসার ঘরে কাজী, অর্ণব, অর্ণবের মা, তরীর ছোট ভাই আফিফ আর অর্ণবের ড্রাইভার বসে আছে। তরী মাথা নুইয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। তরীকে বধূ বেশে দেখে অর্ণবের দৃষ্টি থমকালো। আপনাআপনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। সবাই অর্ণবকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে অবাক চোখে তাকালো। অর্ণব সেটা বুঝতে পেরে আবার বসে পড়লো। তরীকে অর্ণবের পাশে বসানো হলো।
কাজী সাহেব অনুমতি চেয়ে বললেন,

“আপনারা অনুমতি দিলে বিয়ে পড়ানো শুরু করি?”
অর্ণবের মা কিছু বলতে যাবে, এর আগেই তার হাতে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। অর্ণবের বাবা রাশেদ সাহেব কল দিয়েছেন। অর্ণব ভয় পেল। রাশেদ সাহেব কি বিয়েটার ব্যাপারে জেনে গেলেন? তাই অর্ণব বাঁধা দিয়ে বললো,
“এখন কারো ফোন রিসিভ করার দরকার নেই। বিয়েটা আগে হয়ে যাক!”
আসমা বেগম কল রিসিভ করলেন না। রাশেদ সাহেব একনাগাড়ে তিনবার কল দিলেন। এরপর বাধ্য হয়ে আসমা বেগমের ফোনে মেসেজ পাঠালেন,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১১

“আমি তোমাকে বলে রাখছি, আসমা! তোমার ছেলে যদি আজ মোহনার মেয়েকে বিয়ে করে, তবে আমি ওকে ত্যাজ্যপুত্র করবো আর তোমাকেও তালাক দেবো।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (২)