প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (২)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (২)
Writer Mahfuza Akter

“এই বিয়ে সম্ভব নয়!”
কথাটা বলে তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন আসমা বেগম।
বিয়ের ঠিক আগ মুহুর্তে হবু শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তরী। অর্ণব হতবিহ্বল হয়ে বললো,
“এসব তুমি কী বলছো, মা? বিয়ে সম্ভব নয় মানে?”

আসমা বেগম বিভ্রান্ত হয়ে নিজের ফোন অর্ণবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“দেখ, তোর বাবা কী বলছে দেখ! এই বিয়ের কারণে তোর বাবা তোকে আর আমাকে ত্যাগ করলে আমরা কোথায় যাবো একবার ভেবে দেখেছিস?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অর্ণব ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফোনের স্ক্রিনে। “আমি তোমাকে বলে রাখছি, আসমা! তোমার ছেলে যদি আজ মোহনার মেয়েকে বিয়ে করে, তবে আমি ওকে ত্যাজ্যপুত্র করবো আর তোমাকেও তালাক দেবো।” বাংলা হরফে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হুমকিটা দেখে থমকে গেল অর্ণব। দ্রুত হাতে ফোন লাগালো রাশেদ সাহেবের নম্বরে। রাশেদ সাহেব যেন অর্ণবের কলের-ই অপেক্ষা করছিলেন। কালক্ষেপ না করে মুহূর্তেই কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে গুঁজলেন,

“বিয়েটা কি করে ফেলেছো? করে ফেললে আর কথা বাড়িয়ো না! রাখছি।”
অর্ণব তিক্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“এমন কেন করছো, বাবা? ছেলের সুখের পথে বাবা হয়ে কিভাবে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছো তুমি?”
“আমি তোমার সুখের পথে বাঁধা দেবো কেন? আমার সব সিদ্ধান্ত-ই তোমার ভালোর জন্য নেওয়া!”
অর্ণব হতাশ হয়ে বললো,

“তাহলে এমন করছো কেন? বিয়েটা হলে সমস্যা কোথায়?”
“সেটা আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার আগে মনে ছিল না তোমার? কীভাবে পারলে তুমি আমার থেকে লুকিয়ে বিয়ের কথা ভাবতে? কী ভেবেছিলে? আমি কিচ্ছু টের পাবো না? আমাকে না জানালেও আমার বাড়ির ড্রাইভারকে জানিয়ে ফেলেছো! আমার থেকে আমার বেতনভুক্ত ড্রাইভারের মূল্য তোমার কাছে বেশী?”
অর্ণব বিরস মুখে বললো,

“তোমাকে জানাইনি বলেই বিয়েতে বাঁধা দিচ্ছো?”
“না।”
অর্ণব ভ্রু কুঁচকালো। চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,
“তাহলে?”
রাশেদ সাহেব থমথমে গলায় বললেন,
“তোমার স্কলারশিপের কাগজ আমার হাতে।”

অর্ণব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। কাগজটা রাশেদ সাহেবের হাতে পড়ে গেল? এখন এই বিয়ে তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না! বিমূঢ় অর্ণব কী বলবে ভেবে পেল না। রাশেদ সাহেব দ্বিতীয় বার অর্ণবকে শাসিয়ে বললেন,
“পরশু তোমার ফ্লাইট। কিন্তু আমি একদিন এগিয়ে কালকের টিকেট কেটে ফেলেছি তোমার জন্য। সুতরাং বিয়ের ভূত মাথা থেকে ফেলে দাও।

নিজের ক্যারিয়ার জলে ভাসিয়ে বিয়ে করতে হবে না। বিয়ের জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। কিন্তু এই স্কলারশিপের সুযোগ জীবনে বারবার আসবে না। আমার কথা বুঝে থাকলে মাকে নিয়ে ফিরে এসো। আর বোকার মতো বিয়ের জেদ ধরে থাকলে সেটা পূরণ করে মা আর বউকে নিজের কাছেই রেখে দাও। তাদের দায়িত্ব নিজেই নাও। আমার বাড়ির দরজা তোমাদের জন্য আজীবন বন্ধ থাকবে।”

অর্ণব বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাশেদ সাহেব ইতোমধ্যে ফোন কেটে দিয়েছেন। অর্ণব মূর্তির মতো তাকিয়ে থেকে ফোন কান থেকে নামালো। মোহনা এগিয়ে এসে ভয়ার্ত গলায় বললো,
“কী বললো দুলাভাই? বিয়েতে কী রাজি হয়েছেন উনি?”
অর্ণব পাথুরে চোখে তাকিয়ে আছে। নীরব, নির্বিকার অর্ণবকে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না মোহনা। উপায় না পেয়ে তরী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেল অর্ণবের সামনে। মলিন গলায় ডাকলো,

“অর্ণব ভাই!”
তরীর গলায় পাথুরে অর্ণব কিছুটা নড়ে উঠলো। দৃষ্টি মেলালো তরীর মায়বী চোখের সাথে। তরী কিছুক্ষণ নীরব থেকে প্রশ্ন করলো,
“খালুর কথা মেনে নেবে, অর্ণব ভাই? আমায় বিয়ে করবে না? স্বার্থপরের মতো চলে যাবে?”

অর্ণব অসহায় চোখে তাকালো তরীর ছলছল চোখ দুটোর দিকে। কোন দিকে যাবে সে? বাবার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া নিজের সামনে আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছে না। তাহলে তরীর কী হবে? এই মেয়েটাকে যে সে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছে! সারাজীবন হাতে হাত রাখার প্রতিজ্ঞা করেছে! এখন নিজের স্বার্থের জন্য এই মেয়েটার হাত ছেড়ে দেবে? প্রতারণা হবে না? তরীকে ভরসা দিয়ে সেই ভরসা একদিব ভাঙতে হবে, এমনটা কল্পনাও করেনি অর্ণব। কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় এক থাকে না। ভাগ্যও মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর খেলা দেখায়, নিকৃষ্টতর কাজগুলো করতে বাধ্য করে।

অর্ণব লম্বা করে শ্বাস নিলো। চিন্তাগুলো এতো ভারি লাগছে এখন যে, গলা আঁটকে আসছে। কোনোরকমে ঢোক গিলে অর্ণব তরীর দিকে পুনরায় তাকালো। কেমন আদুরে চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা! দেখলেই বুকের ভেতর তোলপাড় অনুভব করে অর্ণব। কিন্তু এখন তো দূর্বল হওয়ার সময় নয়! আজ কঠিন হতে হবে তাকে! কঠোর হবে সে। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে সাবলীল কন্ঠে বললো,

“বিয়েটা করা সম্ভব নয়, তরী! আপাতত আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না।”
তরী থমকালো। অর্ণব তাকে এমনটা বললো? কিন্তু অর্ণব কীভাবে এটা বলতে পারে? সে তো তরীকে কথা দিয়েছিল! সে তো বলেছিল সারা জীবন তরীর পাশে থাকবে! তাহলে? অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুমিহ্… তুমি মজা করছো আমার সাথে, তাই না? এরকম মজা একদম করো না আমার সাথে, অর্ণব ভাই! ‘প্রতারণা’ জিনিসটা একদম সহ্য হয় না আমার! প্রিয় মানুষগুলোর প্রতারণা কতটা বিষাক্ত হয় জানো তুমি? মরে যেতে ইচ্ছে করে প্রতারিত হলে!”

অর্ণব আহত চোখে তাকালো। অসহায় গলায় বললো,
“আমি তোকে ঠকাচ্ছি না, তরী! আমি তোকে ঠকাতে চাই না।”
“তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। আজীবনের সঙ্গী হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলে!”
কথাটা বলে তরী অর্ণবের ডান হাত নিজের দু’হাতের মাঝে পুরে নিয়ে আবার বললো,

“এই যে! এই ভাবে আমার হাত ধরে কথা দিয়েছিলে তুমি। আমায় কথা দিয়েছিলে যে, আমার হাত তুমি কোনোদিনও ছাড়বে না! তাহলে আজ কেন সেই হাত ছেড়ে দিতে চাইছো? কথা দিয়ে কথা না রাখা প্রতারণা নয়? প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাকে কি ঠকানো বলে না?”

“পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা কর, তরী। আমি নিরুপায়!”
বলেই অর্ণব তরীর হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চলো, মা! বাবা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

কাজী সাহেব সবার আগেই বেরিয়ে গেছেন। তরীকে অবাক করে দিয়ে অর্ণব নিজের মাকে সাথে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো। তরীর পৃথিবী নড়ে উঠলো যেন! দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে তরী ছুটে গিয়ে অর্ণবের হাত টেনে ধরলো। অর্ণব পেছন ফিরে তাকালো। তরীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা! কাজল লেপ্টে গেছে দুই চোখের-ই! তরী হেঁচকি তুলে বললো,

“অর্ণব ভাই! এমনটা করো না! এভাবে আমায় ঠকিয়ো না। তুমি জানো না এই গ্রামে মেয়েদের একবার বিয়ে ভেঙে গেলে কী হয়! আমার জীবনটা ন*র*ক হয়ে যাবে, অর্ণব ভাই। বেঁচে থাকার অধিকার থাকবে না আমার। জীবনটা অ*ভি*শ*প্ত হয়ে যাবে! ম*রণ ছাড়া গতি থাকবে না আমার। আমার জীবনটা এভাবে ন*ষ্ট করে দিও না!”
অর্ণব আহত কন্ঠে বললো,

“চিন্তা করিস না! এই গ্রামের কেউ তো আর জানে না আজ আমাদের বিয়ের কথা! তাহলে বিয়ে ভাঙার কথাও কেউ জানবে না।”
অর্ণব তরীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। তরী থমকে তাকিয়ে রইলো অর্ণবের যাওয়ার দিকে। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। দৃষ্টি হয়ে গেল নির্জীব, নিশ্চল, নিষ্প্রাণ! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্ণবের গাড়িটা যতদূর দেখা যায়, ততদূর!

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মুখ গোমড়া করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঠিক সেই সময় দু’টো মহিলা সদরদরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তাদের চোখ সর্বপ্রথম বধূ বেশে সজ্জিত তরীর দিকে পড়লো। কিন্তু তরী নির্বিকার, মূর্তির মতো একভাবে বসে আছে ফ্লোরে। কারো দিকে তাকাচ্ছে না।
দুই মহিলার মাঝে একজন আরেকজনকে বললো,

“তুই তো ঠিকই কইছিলি রে! মোহনা কাউরে না জানাইয়া তরীর বিয়া দিতে চাইছিলো তাইলে!”
অপর জন মুখ বাকিয়ে বললো,
“এখন বিশ্বাস হইছে তোর? কইলাম না! দুপুরে মোহনারে ঐ বড় গাড়ির ড্রাইভারের কাছে থেইকা জিনিসপত্র নিতে দেইখা সন্দেহ হইসিল আমার। পরে ওদের কথা শুইনা আমি নিশ্চিত ছিলাম, আজকে তরীর বিয়া!”
মোহনা ওদের কথা শুনে চমকে তাকালো। ভয়ার্ত গলায় বললো,

“তোমরা এখানে?”
এক মহিলা হেসে বললো,
“আমরা না আইলে বিয়ে হইবো কেমনে? তরীর বিয়েতে না আমরা ছাড়া নাচবো কেডা?”
মোহনা ঢোক গিলে তরীর দিকে তাকালো। কর্কশ গলায় বললো,
“এখানে বসে আছিস কেন? যা! ঘরে যা!”
মহিলা দু’জন অবাক চোখে তাকালো। একজন বললো,

“ও মা! তরীর এই অবস্থা ক্যান? জামাই কি বিয়া না কইরা চইলা গেছে? বিয়া কি ভাইঙ্গা গেছে?”
তরী হালকা নড়ে উঠলো। কোনোরকমে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পা টেনে টেনে ঘরের ভেতরে চলে গেল। মহিলা দু’টো যা বুঝার, তা বুঝে গিয়েছে এতোক্ষণে। মুহূর্তেই সদরদরজা দিয়ে গ্রামের মানুষের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। দুঃসংবাদ বাতাসের চেয়েও দ্রুত বেগে ছড়ায়- কথাটার প্রমাণ আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মোহনা। কিন্তু কীভাবে কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। কাউকে উত্তর দিতে পারছে না! সারাগ্রামে ছড়িয়ে পড়লো তরীর বিয়ে ভাঙার কথা। তরী নিজের ঘরের দোরে আবদ্ধ হয়ে আছে। দরজা বন্ধ করে রেখেছে ভেতর থেকে।

আহমেদ ভবনে খবর পৌঁছাতে দেরি হলো না। আফনা বেগমকে সাথে নিয়ে সুজাতা ও মালিহা ছুটে এলো। তরীদের বাড়িতে প্রবেশ করে এতো মানুষ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল তারা। উঠানের এক কোণে মোহনা বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আফনা বেগম লাঠি ভর দিয়ে ভালো করে দাড়ানোর চেষ্টা করলেন যেন! মোহনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুংকার ছাড়লেন,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২

“আমাগো কলিজার টুকরা, আমাগো বংশের ধনের সাথে কী করছোস তুই? আমাগো চাঁদের গায়ে কলঙ্ক লাগানোর সাহস কেমনে হইলো তো?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (৩)