প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (৩)

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (৩)
Writer Mahfuza Akter

আফনা বেগম ভ*য়ং*কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ওনার আকস্মিক গর্জনে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশটা মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল। উপস্থিত নারী-পুরুষ সবাই ভীত দৃষ্টিতে আফনা বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। গ্রামের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জমিদার আহমেদ সাহেবের স্ত্রী হিসেবে এই গ্রামে আফনা বেগমের সম্মানের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।

মূলত গ্রামের সবচেয়ে মান্য ব্যক্তি হিসেবে আফনা বেগমকেই দেখা হয়।
আফনা বেগম বাড়ির উঠানে উপস্থিত সবার দিকে একপলক তাকালেন। তাঁর দৃষ্টির মর্মার্থ হয়তো সবাই বুঝতে পারলো! বারকয়েক একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একে একে সকলে বেরিয়ে গেল বাড়ির আঙিনা থেকে। কিন্তু সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কানাঘুষা করা থামালো না কেউ। আফনা বেগম সেদিকে নজর না দিয়ে মোহনার দিকে দৃষ্টি তাক করলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মোহনার আতঙ্কিত চোখ দুটো বারবার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। আফনা বেগম লাঠি ভর করে কয়েক পা এগিয়ে মোহনার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মোহনার ভীত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কার সাথে বিয়ে দিতাছিলি আমাগো চাঁদের?”
মোহনা শুকনো ঢোক গিললো। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করেও কোনো উত্তর না পেয়ে আফনা বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কিছু জিজ্ঞেস করছি তোরে, মোহনা! সোজাভাবে বল কী অঘটন ঘটাইছোস তুই?”
উপায় না পেয়ে মোহনা মুখ খুললো। আমতা আমতা করে বললো,
“তরী আমার মেয়ে। আমি যা ইচ্ছে, তা-ই করবো আমার মেয়ের সাথে। আমার মেয়েকে নিজের ইচ্ছে মতো বিয়ে দেওয়ার শখ কি আমার নেই?”
আফনা বেগম চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। উপায়ন্তর না দেখে বললেন,
“দেখি! চাঁদরে ডাক। ওর মুখ থেইকাই শুনমু সব! এরপরে তোর শখ আমি বাইর করতাছি।”
মোহনা ঘনঘন পলক ফেলে বললো,
“তরী তো ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে!”

আফনা বেগম বিরস মুখে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন তরীকে ডাকতে। সুজাতাও আফনা বেগমের পিছু পিছু গেলেন।
মোহনা ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ বাকিয়ে “আদিখ্যেতা!” শব্দটা বিরবির করে বললো। বিরস মুখে আবার ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই মালিহাকে নিজের মুখোমুখি দেখে চমকে দু’পা পিছিয়ে গেল সে। মালিহার জ*ল*ন্ত চোখ দুটো দেখে মোহনার আত্মা কেঁপে উঠল। ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই মালিহা মোহনার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। মোহনা মালিহার চোখ দুটো দেখেই ভয়ে জমে গেছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর পিছিয়ে যেতে না পেরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মালিহা মোহনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,

“আজকে আমার চাঁদের চোখের প্রতিটা অশ্রুকণার হিসাব রক্তের বিনিময়ে নেবো! প্রস্তুত থেকো।”
ফিসফিসানো কন্ঠে বলা কথাগুলোতে কিছু একটা ছিল, যা মেহনার গা হিম করে দিয়েছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে মুহুর্তেই! মালিহা তার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু তার কথাটা মোহনার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলো।
আফনা বেগম ঘরের দরজায় অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলেন। তরীকে অনেকবার ডাকাডাকি করলেন। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে কেউ খুললো না। কোনো সাড়াশব্দও দিলো না। আফনা বেগম হতাশ গলায় সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বড় বউ! ঐ জানালাটা খোলা যায় কিনা দেখো তো! খুইলা দেখো চাঁদ ঘরের ভিতরে কী করতাছে!”

সুজাতা চিন্তিত মুখে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালাটা আলগাভাবে চাপানো ছিল, কিন্তু লক করা ছিল না। সুজাতা সহজেই জানালাটা খুলতে পারলো। ঘরের ভেতরে ভালো মতো চোখ বুলানোর চেষ্টা করলো। রাত হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই! কিন্তু ঘরের ভেতরে কেউ আলো জ্বালায়নি। তবে বাইরে আলো ঘরে প্রবেশ করায় আবছা আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছুটা। সুজাতা ঘরের ভেতরে যতটা পারছেন, তরীকে দেখার চেষ্টা করছেন। আফনা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কী হইলো? জানালা খুইলা এতোক্ষণ কী দেখতাছো? তরী আছে ঘরে?”
সুজাতা হতাশ গলায় বললো,

“ঘরে তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, মা! বুঝতে পারছি না তরী ঘরের ভেতর আছে নাকি নেই!”
এতোক্ষণে মালিহাও চলে এসেছে। সুজাতার কথা শুনে মালিহা দ্রুত পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“দেখি! আমি চাঁদকে দেখতে পাই কিনা!”
টর্চের আলো জ্বালিয়ে মালিহা ঘরের ভেতর ভালোভাবে দেখলো। কিন্তু তরীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাই চিন্তিত ভঙ্গিতে আফনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মা, ঘরের দরজা ভাঙতে হবে। জানালা দিয়ে পুরো ঘর দেখা যাচ্ছে না। তাই বোঝা যাচ্ছে না যে, চাঁদ ঘরের ভেতর আছে নাকি নেই!”

আফনা বেগম মাথা নাড়িয়ে উঠানের দিকে চলে গেলেন। সুজাতা আর মালিহাও এলো। মোহনা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আফনা বেগম তার দিকে একবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আজাদ কই রে? ভেতরে আয়!’
আফনা বেগমের ডাকের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আধপাকা চুল ও বিবর্ণ পাঞ্জাবি পরিহিত মধ্য বয়সী এক লোক সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আফনা বেগমের দিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“জ্বী আম্মা!”
“রায়হান আর আফনাদরে জানাইছোস এইখানের খবর?”
“জ্বী!”
“কতদূর ওরা?”
“রওনা দিছে অনেকক্ষণ আগেই! কথা হইসে। গ্রামে ঢুকে পড়ছে প্রায়।”
আফনা বেগম থমথমে গলায় বললেন,
“একটা কাম করা লাগবো, আজাদ!”
“কী কাম, আম্মা?”

আফনা বেগম নিচের কোণের একটা ঘরের বদ্ধ দরজা দেখিয়ে বললেন,
“ঐ ঘরের দরজাটা ভাঙ্গা লাগবো। তাড়াতাড়ি ভাঙার ব্যবস্থা কর!”
আজাদ মাথা হেলিয়ে বললো
“ঠিক আছে, আম্মা।”
আজাদ আরো দুজন লোককে সাথে নিয়ে দরজা ভাঙার কাজে লেগে পড়লো। মিনিট দশেকের মধ্যেই খট করে দরজা ভাঙার আওয়াজ এলো।

মালিহা যেন ছুটে চলে গেলেন সেদিকে। পেছন পেছন সুজাতা, মোহনা আর আফনা বেগমও গেল। ঘরের ভেতর ঢুকে সবার চক্ষু চড়কগাছ। ভেতরে কেউ নেই। পুরো ঘর খালি। মালিহা পুরোঘর খুঁজলেন, তরীকে বারবার ডাকলেন, কিন্তু তরীর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আফনা বেগম চিন্তিত গলায় বললেন,
“দরজা ভেতর থেইকা বন্ধ কইরা কেমনে গায়েব হইলো?”
মোহনা এগিয়ে গিয়ে পর্দার আড়ালে থাকা সরু গোপন দরজাটা দেখিয়ে বললো,
“এই দরজাটা খোলা! তার মানে তরী এইখান দিয়েই বেরিয়ে গেছে।”

মালিহা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো দরজাটার দিকে। ক্ষুব্ধ চোখ গিয়ে ঠেকলো মোহনার মুখের ওপর। মোহনা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। মালিহা মোহনার দিকে এগোতেই রায়হান আর আফনাদ প্রবেশ করলো ঘরে। আফনা বেগম তাদের দেখেই বললেন,

“আসছো তোমরা? তরীকে পাওয়া যাইতাছে না রে! ওরে খুইজা বাইর কর! কই গেল আমার চাঁদের টুকরা নাতনিটা?”
আফনা বেগমের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আফনাদ। রায়হান সাহেব মাকে শান্ত হতে বলে একটা চেয়ারে বসালেন। আফনাদ মোহনার দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“কী করেছো তুমি তরীর সাথে? কার সাথে বিয়ে দিচ্ছিলে? আমাকে না জানিয়ে এতোবড় পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস কে দিলো তোমাকে?”

মোহনা বিপাকে ফেঁসে হাসফাস করতে লাগলো। মনের ভেতর একটা উত্তর গুছিয়ে সেটাই ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“আমার কোনো উপায় ছিল না। তরী বেশ কয়েকদিন যাবৎ অর্ণবের সাথে বেশ মেলামেশা করতো। অর্ণব তো ছেলে মানুষ! তরীকে অনেক বার বলেছি, ছেলেদের সাথে এমন মাখামাখি করতে নেই! কিন্তু ও তো শোনেই না আমার কথা! ছেলেটাকে নিজের রূপে পাগল বানিয়ে এখন আমাকে বিপদে ফেলেছে। তরীই আমাকে জোর করেছিল যেন তোমাকে না জানিয়ে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করি। তোমাকে জানালে নাকি তুমি বাঁধা দেবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অর্ণবই বিয়েটা না করে ফিরে যাবে, এটা কি আমি জানতাম নাকি! তরী নিজের দোষেই নিজের কপালটা খেলো। আসলে আমিই মেয়েটাকে ঠিক মতো মানুষ করতে পারিনি! এখন দুশ্চরিত্রের মতো রাত-বিরেতে কার হাত ধরে পালিয়ে যে গেল, কে জা……..”

মোহনার কথা শেষ হওয়ার আগেই মালিহা গর্জে উঠে বললো,
“আমার চাঁদের নামে আরেকটা বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁ*ড়ে ফেলবো!”
মোহনা আঁতকে উঠে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। আফনাদ হতাশ গলায় বললো,
“তোমার এসব আষাঢ়ে গল্প আমি বিশ্বাস করবো ভেবেছো? আমার মেয়েকে এতো বছর নিজ হাতে মানুষ করেছি আমি। ও এমনটা করবে না কোনোদিন!”

রায়হান সাহেব এতোক্ষণে মুখ খুললেন,
“যা হয়েছে, সেটা নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। আগে তরীকে খুঁজে বের করতে হবে। আর তোমরা এখানে আছো! সৌহার্দ্য আর মধু কোথায়?”
সুজাতা বললো,
“মধু তো পাশের গ্রামে ওর নানাবাড়িতে গেছে কয়েকদিনের জন্য। আর সৌহার্দ্য তো গত রাতেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গুলশানে চলে গেছে! সারাদিন যোগাযোগ করে আমার সাথে।”
রায়হান সাহেব চরম বিরক্তি নিয়ে বললেন,

“এই ছেলেটা এতোটা অবাধ্য আমার! বললাম সামনের মাসে ঢাকা শিফট হতে, আর ও গতকালই চলে গেল! আশ্চর্য!”
রায়হান সাহেব হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে সৌহার্দ্যের নম্বরে কল দিলেন। যথারীতি রিং হলো, কিন্তু সৌহার্দ্য রিসিভ করলো না। রায়হান সাহেব এবার প্রহরের নাম্বারে কল দিলেন। প্রহর রিসিভ করে সালাম দিয়ে বললো,
“কেমন আছেন, আঙ্কেল?”
“তোমার প্রাণের বন্ধু আমায় ভালো থাকতে দিয়েছে কবে?”
প্রহর অবুঝের মতো বললো, “মানে?”

“মানে বোঝার আগে বলো, তোমার গুণধর বিদেশি ডাক্তার বন্ধুটি কোথায়? দেশে আছে? নাকি ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছে?”
প্রহর চোখ ঘুরিয়ে একবার বিছানার দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। সব শুনছে ঠিকই, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। প্রহর ইতস্তত করে বললো,
“আমার পাশেই আছে, আঙ্কেল!”
“ওকে বলো, এখনই গ্রামে ফিরতে। তরীকে পাওয়া যাচ্ছে না!”
প্রহর হতভম্ব হয়ে বললো,

“তরীকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? আজ না ওর বিয়ে?”
প্রহরের মুখে এমন কথা শুনে সৌহার্দ্য চোখ খুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
রায়হান সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তরীর বিয়ে, সেটা তুমি জানলে কীভাবে?”
প্রহর জিভ কেটে আমতাআমতা করে বললো,
“না, মানে…. সৌহার্দ্য আমাকে বলেছে।”

রায়হান সাহেব বার কয়েক পলক ফেলে প্রহরের কথা বোঝার চেষ্টা করলেন। পরবর্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“সৌহার্দ্যকে বলবে, এখনি গ্রামে ফিরতে। তরীর বিয়ে ভেঙে গেছে। এখন তরীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাখছি।”
প্রহর ফোন লান থেকে নামিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য উৎসুক চোখে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চাঁদ ঠিক আছে তো?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২ (২)

প্রহর ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, তরী ঠিক নেই। সৌহার্দ্য বিরবির করে বললো,
“আমার সকল সুখ তোমার হোক, চাঁদ! তোমার সকল বেদনা আমার আমার হোক।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৩