প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৩

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৩
Writer Mahfuza Akter

সন্ধ্যার পর সৌহার্দ্যের জ্বরের মাত্রা বেশ বেড়েছে। তাই প্রহর সৌহার্দ্যকে একা ছাড়ার সাহস পাচ্ছে না। এদিকে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য সৌহার্দ্য ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গাড়িতে গেলে অন্তত চার ঘন্টা লাগবেই! কিন্তু ট্রেনে গেলে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছানো সম্ভব। সৌহার্দ্যের যুক্তিটা যথার্থই মনে হলো প্রহরের। কিন্তু সৌহার্দ্যের শরীরের বেহাল দশা দেখে অগত্যা নিজেও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

রেলস্টেশনে পৌঁছে টিকেট কেটে প্রহর সৌহার্দ্যকে নিয়ে ট্রেনে বসেছে কিছুক্ষণ আগে। সৌহার্দ্য চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। দূর্বলতা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে! প্রহর একহাতে সৌহার্দ্যকে ধরে আরেক হাতে ভেজা কাপড় দিয়ে বারবার সৌহার্দ্যের কপাল মুছে দিচ্ছে। কিন্তু শরীরের তাপমাত্রা যেন হুড়হুড় করে বেড়ে চলেছে! সৌহার্দ্যের অস্পষ্ট বিড়বিড় শোনা যাচ্ছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“চাঁদ কি অনেক কষ্ট পাচ্ছে? কান্নাকাটি করছে না তো? আমার চাঁদ আজ অন্য একটা পুরুষের বিরহে কষ্ট পেলে সেটা কীভাবে মেনে নিবো আমি?”
প্রহর কথাটা শুনলো। বুকের ভেতর কেমন যেন মুচড়ে উঠলো তার! নিজে একটা পুরুষ হয়ে পাশের মানুষটার মনের অবস্থা বুঝতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না প্রহরের। এতো গভীর ক্ষত নিজের বুকের ভেতর কীভাবে সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছে সৌহার্দ্য? ভেবে পায় না প্রহর!

সৌহার্দ্য আর প্রহর গ্রামে পৌছালো রাত একটায়। রাতের নীরবতা যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে প্রহরের! শেষ বারের মতো এই গ্রামে এসেছিলো সে আট বছর আগে। এখন বেশ পরিবর্তন এসেছে এখানকার পরিবেশে। আগের মূল মাটির রাস্তাটায় এখন শান বাঁধানো হয়েছে। রেলস্টেশনের পাশেই তিনগুণ ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি নিয়ে তরীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে তারা। সৌহার্দ্য আপাতত তেমন দূর্বল নয়। ট্রেনে কোনোরকমে খাইয়ে ওষুধ খাওয়ানোর পর জ্বর নেমে গিয়েছে অনেকটাই। তাই নিজ দায়িত্বেই শক্ত শরীরে বসে আছে গাড়িতে।

তরীর বিয়ে ভাঙার খবর পাশের গ্রামে পৌঁছাতে তেমন সময় লাগেনি। তাই মধুও খবরটা পেয়ে ছুটে এসেছে। স্বচক্ষে না দেখে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে ঘটনাটা। এখন উপস্থিত সবার মতো নিজেও তরীদের বাড়ির উঠানে থম মেরে বসে আছে মধু। বেশ কয়েক বার নিজের মাকে জিজ্ঞেস করেছে সে,
“মা, দু’দিন আগেও তো সব ঠিক ছিল! তরী পড়াশোনা করছিল মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য। এরই মধ্যে এসব কী হয়ে গেল? সব কিছু এলোমেলো কীভাবে হয়ে গেল, মা?”

সুজাতা কোনো জবাব দিতে পারে নি। কোনো উত্তর তো নেই তার কাছে! সবার চোখ ঘুরে ঘুরে শুধু মালিহার দিকে যাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত নীরবতায় ছেয়ে আছে মালিহার সত্তা! নিষ্পলক, নিস্তব্ধ হয়ে কী এমন ভাবছে সে? কেউ কিছু বলার বা প্রশ্ন করার সাহসও পাচ্ছে না। বাড়িটা আপাতত কোনো নিস্তব্ধপুরীর মতো মনে হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে সবার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কানে লাগছে। গ্রামের মানুষের আনাগোনা ক্রমেই কমে এসেছে। তরীর খোঁজে এদিক-সেদিক সবাই ছুটোছুটি শুরু করেছে। সকল নীরবতা শেষে আফনা বেগম মুখ খুললেন,

“নাহ! এভাবে আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যাইতাছে না। মানসম্মান যা যাওয়ার, গেছে। এখন তরীরে আমার চোখের সামনে সুস্থসবল ভাবে নিয়া আয় তোরা!”
রায়হান সাহেব ফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে বললেন,
“মা ঠিকই বলেছে! পুলিশে খবর দিচ্ছি আমি। অনেক তো খোঁজাখুঁজি হলো! এখন আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।”
বলেই অন্য দিকে চলে গেলেন রায়হান সাহেব।

আফনাদ হক বিমর্ষ ভঙ্গিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। চোখ দুটো ছলছল করছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। তরী তো তার প্রাণ ছিল! সেই প্রাণপাখির দায়িত্বটা তিনি যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি! নিজের মুখ নিজে আয়নার সামনে কীভাবে দেখবেন তিনি?
সবাই যখন বিষাদের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, ঠিক তখনই আগমন ঘটলো সৌহার্দ্যের। বেশ হুড়মুড় করে সে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,

“চাঁদ! চাঁদ কোথায়?”
সবাই সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। চোখ দু’টো নিষ্প্রাণ, কোনো গর্তে তলিয়ে গেছে যেন! মুখটা লালচে, মলিন, ফ্যাকাসে। একদিনের ব্যবধানে এ কি অবস্থা ছেলেটার? সুজাতা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন নিজের একমাত্র ছেলের দিকে।
রাশহান সাহেব ফোন কান থেকে নামাতে নামতে এগিয়ে আসছেন আর বলছেন,
“পুলিশের সাথে কথা হয়েছে। তারা আসছে আর আ…..”

কথা আর শেষ করতে পারলেন না রায়হান সাহেব। চোখ গিয়ে পড়লো সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্যের এমন বিধ্বস্ত রূপের সাথে তিনি পরিচিত নন। তাই চোখে অবিশ্বাসেরা এসে জড়ো হলো। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি নিজের ছেলের দিকে। অস্ফুটস্বরে বললেন,
“সৌহার্দ্য! এই অবস্থা কেন তোমার?”
সৌহার্দ্য শুনলো কি শুনলো না কে জানে? সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলো সবার দিকে। তার চোখ দুটো শুধু তরীকে খুঁজছে। সৌহার্দ্যের পাশে দাঁড়িয়ে হাসফাস করছে প্রহর। রায়হান সাহেব প্রশ্নোক্ত চোখে তাকালেন প্রহরের দিকে। প্রহর ইতস্তত করে বললো,

“আসলে আঙ্কেল! সৌহার্দ্যের অনেক জ্বর আজ সকাল থেকেই। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে ওকে একা ছাড়ার সাহস পাইনি। তাই আমিও এসেছি সাথে।”
“প্রশ্নটা তোমার আসা নিয়ে না। সৌহার্দ্য এতো অসুস্থ হলো কীভাবে, সেটাই জানার বিষয় আমার।”
রায়হান সাহেবের প্রশ্নের তীরে প্রহর হকচকিয়ে গেল। কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না! তাদের প্রশ্নোত্তরের মাঝেই সৌহার্দ্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো। হুট করেই মোহনার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। মোহনা এতোক্ষণ বেশ ভীত চোখেই সবটা পর্যবেক্ষণ করছিল। কিন্তু এই মুহুর্তে সৌহার্দ্যের সন্দিগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তার। মোহনা কিছু বলার আগেই সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সংবরণ করে বললো,

“আপনিই তরীকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছেন, তাই না?”
মোহনার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সে তড়িৎ গতিতে বললো,
“না! না!! আমি কিছু করিনি। তরী কোথায় গেছে আমি কিছু জানি না।”
মোহনার দিকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে সৌহার্দ্য বললো,
“তরীকে খুঁজে বের করি আগে। আপনার ব্যবস্থা তারপর করছি আমি।”

সৌহার্দ্য আর কালক্ষেপ না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কেউ কিছু বলার সুযোগও পেল না। উপায় না পেয়ে প্রহরও সৌহার্দ্যের পিছু পিছু ছুট লাগালো। রায়হান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার ছেলের এসব কার্যকলাপের পেছনের কারণ তার অজানা নয়। কিন্তু পরিস্থিতি এতোটা জটিল হয়ে যাবে কে জানতো? কীভাবে সবটা ঠিকঠাক করবেন ভেবে পাচ্ছেন না রায়হান সাহেব!

রাতে আঁধার কাটিয়ে সূর্যের দেখা মিলেছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশে হালকা লালচে আভা বিদ্যমান। উঠানের আঙিনায় এখনো প্রতিটা মানুষ নির্ঘুম, চিন্তিত মুখে বসে আছে। পুলিশ এসেছিল মধ্যরাতে। ইতোমধ্যে খোজাখুজিও শুরু করে দিয়েছে হয়তো! কাল রাতের পর থেকে প্রহর আর সৌহার্দ্যেরও কোনো খোঁজ নেই। তরীকে খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত সৌহার্দ্য ফিরবে না, এটা রায়হান সাহেব বেশ ভালো করেই জানেন। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে কোথায় হুট করে গায়েব হয়ে যেতে পারে, ভেবে পাচ্ছে না কেউ! যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া হয়তো এরকমই দুঃসাধ্য!

সকাল হতে না হতেই দলে দলে মানুষের আগমন ঘটছে। সবাই সমবেদনা জানানোর ভঙ্গিতে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে যেন! মুখ খোলার ইচ্ছে নেই বলে কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
রায়হান সাহেবের ফোনটা থেমে থেমে বেজে উঠছে। ফোনের স্ক্রিনে প্রহরের নামটা ভেসে উঠেছে। রায়হান সাহেব দ্রুত ফোনটা কানে লাগালেন,

“প্রহর! কোথায় তোমরা?”
“আঙ্কেল, তরীকে পাওয়া গেছে!”
প্রহরের এই একটা কথা শুনে রায়হান সাহেব বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“সত্যি? কোথায়? কীভাবে? তোমরা কোথায় এখন?”
প্রহর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
“আমরা হসপিটালে। কাল রাতেই তরীকে গ্রামের অদূরে থাকা হাইয়ের পাশে সেন্সলেস অবস্থায় পেয়েছি আমরা।”
রায়হান সাহেব যেন দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন! উত্তেজিত হয়ে বললেন,

“সেন্সলেস! মানে? কী বলছো তুমি এসব?”
প্রহর আগের মতোই বললো,
“এখনি কিছু নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না, আঙ্কেল! তরীর গায়ে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল ও। আপাতত সৌহার্দ্য আর ডক্টরেরা ওর ট্রিটমেন্ট করছে। ডক্টরদের ধারণা তরীর সাথে খারাপ কিছু হয়েছে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১২

(দেরী করে পোস্ট করায় দুঃখিত। আগামীকাল পর্যন্ত রাতে অনলাইন ক্লাস থাকায় লিখার সময় পাচ্ছি না তেমন। আবার ফাইনাল পরীক্ষারও মাত্র দশদিন বাকি। সব প্রেশারের মাঝেও আমি চেষ্টা করবো একদিন পরপর রেগুলার গল্প দেওয়ার। আর আজকের পর্ব একটু ছোট হয়েছে জানি। পরবর্তী পর্বগুলো একটু বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবার মন্তব্য পড়ার অপেক্ষায় রইলাম )

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৪