সূর্যশিশির পর্ব ৩৬

সূর্যশিশির পর্ব ৩৬
ইলমা বেহরোজ

সেহেরির প্রহর দ্রুত পার হচ্ছে; ত্রিশ মিনিট পর ফজরের আযান। এখনো ফাইয়াজ এসে উপস্থিত হয়নি। বারেক-সুমনার প্রশ্নবোধক চাহনিতে ইশতেহার, জেসমিন বিব্রতবোধ করছে। এক পর্যায়ে জেসমিন টেবিল ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে গেল। কল করল ফাইয়াজকে৷ প্রথম তিনটি কল রিসিভ হলো না! জেসমিন দমে না গিয়ে তীব্র রাগ নিয়ে অনবরত কল করতে থাকল।

“হ্যালো, আপা?” ওপাশ থেকে বলল ফাইয়াজ।
সঙ্গে সঙ্গে জেসমিন গর্জে উঠল, “থাপ্পড় মে রে সবকটা দাঁত ফেলে দেব। তোমার কি সময়-জ্ঞান নেই? আজ আসো, তোমার হা ড্ডি ভা ঙ ব আমি।”
জেসমিনের মুখে এমন হুমকি-ধমকি শুনে ডাইনিংরুমের মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করল। ইশতেহার পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে খ্যাঁক করে কেশে বলল, “ছোট ভাই যতই বড় হোক, সে বোনের কাছে ছোটই।”
রূপা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তার পরনে সালোয়ার-কামিজ, মাথা ঢেকে রাখা দোপাট্টায়৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফাইয়াজ চলে যাওয়ার পর রূপা স্তব্ধ নয়নে অনেকক্ষণ ছাদের ঈশান কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। বিদ্যুৎ আসতেই রুমে গিয়ে দেখে ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা শপিং ব্যাগ রাখা। রূপা ব্যাগটা নিয়ে দেখে ভেতরে দুটো কটনের থ্রি পিস আর একটা চিরকুট। সে পালঙ্কে বসে চিঠি খুলে পড়া শুরু করে
রূপা,
তুমি কি জানো মেয়েদের সৌন্দর্য কিসে?
নারীত্বে।
ইতি,
তোমার ফাইয়াজ।

তোমার ফাইয়াজ — মাত্র দুটো শব্দ অথচ রূপার পুরো পৃথিবী নড়ে উঠে। বুকের সর্বত্র জুড়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে থাকে৷
রূপা বেশ কয়েকবার আওড়াল, “তোমার ফাইয়াজ, তোমার ফাইয়াজ, তোমার ফাইয়াজ।”
একটি প্রশ্ন আর একটি উত্তর! এতেই যেন ফাইয়াজের কত কথা লুকায়িত! রূপা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুল খোঁপা করা ;
ভেজা চুল অভ্যাসবশত কখন যে খোঁপা করে ফেলেছে সেই মুহূর্তটিও স্মৃতিতে নেই।
বাইরে টিপটপ বৃষ্টি পড়ছে৷ শীতল বাতাস বইছে৷

স্পর্শকাতর অন্তস্থলের টানাপোড়েনে রূপা মোহগ্রস্তের মতো নিজের খোঁপা খুলল৷ শপিং ব্যাগ থেকে গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ বের করে পরল। আয়নায় তাকাল। অদ্ভুতভাবে, সে পোশাক পরিবর্তন করলেই তাকে অন্যরকম লাগে; যেন অন্য কেউ! রূপা অপলক চেয়ে রইল নিজের দিকে।
“আপা…আপা।” ডাকতে ডাকতে রুমি এসে রুমে প্রবেশ করে।
হঠাৎ কারো আগমনে রূপা লজ্জা পায়, গুটিয়ে যায়৷
“কী সুন্দর লাগছে!” রুমি উচ্ছ্বসিত হয়ে এগিয়ে আসে।
রূপা নিজের ভাবমূর্তি লুকোতে বলল, “আম্মা ডাকছে?”

রুমি রূপার প্রশ্ন উপেক্ষা করে রসিকতা করে বলল, “যার জন্য সালোয়ার কামিজ সে তো নেই! এখন কী হবে?”
রূপা কিছু বলল না।
“জামাটা কী সুন্দররে আপা! কবে কিনেছিস?”
“তোর ভাইয়া দিয়েছে।” নির্বিকার কণ্ঠে বলল রূপা।
“ভাইয়ার পছন্দ দারুণ। ঈদের শপিং ভাইয়াকে নিয়ে করব!”
“আচ্ছা করিস৷ এবার চল খেতে যাই।”
জেসমিন ফোনে কথা শেষ করে এসে বলল, “আজ দুপুরে ফাইয়াজের অফিস থেকে রাজশাহী যাওয়ার কথা ছিল। জরুরি কাজ পড়ায় নাকি এখনই যেতে হয়েছে।”

সুমনা বললেন, “রোজার মাসে মধ্যরাতেও কাজ!”
জেসমিন জবাবে কিছু বলল না৷ ফাইয়াজের আজ কিছুতেই বেরোনোর কথা না৷ নিশ্চিত ফাইয়াজ মিথ্যে বলছে। রূপার রুমে গিয়েছিল তারপর কী হলো?
সন্দিগ্ধ নয়নে জেসমিন রূপার দিকে তাকাল।
রূপা অপ্রতিভ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
দুপুর বারোটা।

রূপা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে৷ আজ আর শার্ট-প্যান্ট পরেনি। সালোয়ার কামিজ পরে শরীর কেমন নিশপিশ করছে৷ এখুনি রুমে গিয়ে খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু তার অনড় সিদ্ধান্ত, সে এবার নিজের বেশভূষা পরিবর্তন করবে।
তাকে এভাবে বের হতে দেখে সুমনা, রুমি হতভম্ব। রাতে ভেবেছিল, শ্বশুরবাড়ির মানুষ আসায় পোশাক পরিবর্তন করেছে৷
হঠাৎ কী হলো? প্রশ্নটি করার পূর্বেই রূপা চলে গেছে।
এ গলি, ও গলির মানুষজন বার বার নজর ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে রূপাকে। অনেকে কথা বলতে এগিয়ে এলেও রুপা গ্রাহ্য করল না৷ কলির বাপের মুদির দোকান আছে৷ রূপা প্রথমে তার দোকানে গেল।
কলির বাপ হুক্কা টানছে।

রুপাকে দেখে চিনতে পারলেন না প্রথমে। যখন ঠাওর হলো, কিছু বলার আগেই রূপা নিজের চুলের বেণি সামনে এনে বলল, “আপনার মেয়ের এরকম লম্বা চুল আছে? আমার মতো লম্বা সে? আমার মতো ভালো রাঁধতে পারে? সব উত্তর হচ্ছে, না৷ আমি আমার জায়গায় ঠিক আছি বরং হিসেব করলে আপনার মেয়ের থেকেও বেশি এগিয়ে আছি।”
কথা শেষ করেই রূপা জায়গা ছাড়ল। বাজারের সব মানুষের নজর তার দিকে আটকে যায়। যেদিন শাড়ি পরেছিল বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় বাইকে ছিল ;তখন অনেকেই ভালো করে দেখতে পারেনি আবার অনেকে অন্য মেয়ে ভেবেও এড়িয়ে গেছে। আজ সবাই কাছ থেকে দেখছে। নানাজনের নানা কথা, প্রশ্ন –

“রূপা না?”
……….
“তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।”
……….
“জামাই বলছে নাকি পরতে? ”
……….
“এইবার চেহারাটার একটু যত্ন নে।”
……….
“ব্যবসা কি চলছে না? বারেক মিয়া মেয়ের জামাকাপড় পরিবর্তন করে কাস্টমার বাড়ানোর চিন্তা করছে?”
শেষ কথাটি মিথ্যা এবং অপবাদ হলেও সত্যিকার অর্থে সেদিন কাস্টমার বেড়ে গেল। মেয়ে দেখলেই চুকচুক করা পুরুষদে ভীড় জমে গেল। তাদের আগ্রহের মধ্যবিন্দু হয়ে উঠেছে রূপা৷ বারেককে প্রশ্ন করে,

“আপনার মেয়ের কী হলো?”
…………
“সে কী এখন থেকে মেয়েদের মতো থাকবে?”
…………
“বিয়েটা দিয়ে ভালোই করেছেন।”
………..
“রূপাকে একটু ডাকেন তো কথা বলি।”

বারেক কাউকেই কোনো জবাব দিলেন না। রূপা রান্নাঘরে গিয়ে নিশ্চুপে নিজের কাজ করতে শুরু করে।
সুজন, বারেক বিভিন্ন কাজের জন্য নানারকম প্রশ্ন করেছিল, রুপা কারোরই কথার উত্তর দিল না।
দুপুর তিনটে বাজতেই সে বার বার নিজের অজান্তে তৃষ্ণার্থ কাকের মতো দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, প্রতিদিনের মতো যদি আজও ফাইয়াজ আসে।
ফাইয়াজ প্রতিদিন দুপুরে অফিস থেকে ফেরার পথে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যেত। কী রান্না করছ? কীভাবে করে? এটা কী দিচ্ছ?… নানা প্রশ্ন করত।
আজ কেউ আসল না, প্রশ্নে প্রশ্নে বিরক্ত করল না!

ইফতারের মুহূর্তেও খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে যাচ্ছিল। বিগত দিনগুলোতে ফাইয়াজ তার সঙ্গে, এই রান্নাঘরে, তার পাশে বসে ইফতার করেছে! আজ জায়গাটা খালি! চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি অথচ সে এমনভাবে কাতর হয়ে উঠেছে যেন বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। রূপা ইফতার সম্পন্ন করতে পারল না। হাত ধুয়ে উঠে পড়ল। কল করল ফাইয়াজকে। বেশ কয়েকবার কল করেও পেল না।
মে। ২৮ তারিখ।

সামাং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে একদল আদিবাসী। সংখ্যায় ছয়শতেরও অধিক। প্রধান পেশা কামার৷ শহরে তাদের তৈরিকৃত লোহার বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার্য লৌহজাত সামগ্রী, কৃষি-যন্ত্রপাতি ইত্যাদির কদর অনেক। তারা কম মজুরিতে দিনরাত খেটে কাজ করে। এতে তাদের দুঃখ নেই। পুরো সম্প্রদায় মিলেমিশে বসবাস করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খোলা মাঠে র‍ঙিন প্রজাপতির মতো সর্বক্ষণ ছুটে বেড়ায়৷
মে। ২৯ তারিখ।
পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে দুটি হেডলাইন,

সূর্যশিশির পর্ব ৩৫

“সামাং পাহাড়ের আদিবাসীদের উপর
স ন্ত্রা স দের আক্রমণ।”
“আজ কার পালা?”

সূর্যশিশির পর্ব ৩৭