সূর্যশিশির পর্ব ৩৭

সূর্যশিশির পর্ব ৩৭
ইলমা বেহরোজ

উনত্রিশ তারিখের আতঙ্ক দেশজুড়ে। স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটির প্রাঙ্গণ শূন্য। পথেঘাটে কোনো মেয়েকে দেখা যাচ্ছে না। আবহ দেখে মনে হচ্ছে, যেন আচম্বিত পৃথিবী থেকে নারী জাতি বিলীন হয়ে গেছে।
ঘরের বাহিরে বলতে শুধু রূপা। সে কাঁচাবাজারে মুরগি কিনতে এসেছে। মুরগিওয়ালা বয়স্ক মানুষ।
যখন তার বয়স নয় তখন থেকে এই বাজারে মুরগি বিক্রি করছে। এখন তার বয়স পঞ্চান্ন।
মুরগিওয়ালা বলল, “তোরে এহন অনেক সুন্দর লাগেরে রুপা।”
রূপা লজ্জা পেল, ভেতরে ভেতরে মিইয়ে গেল।

“সাবধানে চলাফেরা করিস। দোকান থাইক্যা বাইর হইস না। আইজকের দিনডা কিন্তু ভালা না।”
রূপা জবাবে চুপ রইল।
“পাহাড়ের সবগুলা মানুষ কি মইরা গেছে? খবরটবর দেহার সময় পাইতাছি না ”
“অনেকে জীবিত।’
” পুলিশ সন্ত্রাসদের ধরে নাই?”
” শুনছি, চারজনকে ধরছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“পুলিশগুলা যদি আরেকটু আগে যাইত তাইলে এতগুলো লাশ দেখতে হইত না৷ এই ল তোর দশ কেজি মুরগি।”
সুজন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রুপা হাতে ইশারা করতেই সে দৌড়ে আসে। দুজন মুরগি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে। মুরগি কাটার আগে একবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল , ফাইয়াজ কল করল কি না!
রূপা গতকাল সারারাত ফাইয়াজকে কল করেছে।
প্রতিবারই ওপাশ থেকে একটা গলা শোনা গেছে — দুঃখিত, এই মূহর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।

দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে সকালে জেসমিনের কাছে গিয়েছিল। জেসমিন জানিয়েছে, ফাইয়াজের ফোনটা পানিতে পড়ে গেছে। আর পাওয়া যায়নি।
মুরগি কাটার মুহূর্তে হঠাৎ রূপার মনে হয় জানালা দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই কেউ একজন সরে যায়। রান্নাঘরের জানালা থেকে একটা সাদা রঙের এক তলা বিল্ডিং দেখা যায়। ছাদের রেলিঙ ধরেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল! রুপা পুনরায় নিজ কর্মে মনোযোগী হয়।

চোখের কোণ দিয়ে স্পষ্ট টের পায়, কেউ তাকিয়ে আছে! ডান পাশের দেয়ালে একটা ছোট আয়না টাঙানো। সে আয়নায় তাকাল। দেখল, কোঁকড়া চুলের একটা লোক তাকিয়ে আছে৷ গলায় চেইন, ভ্রু কাটা, কানে দুল৷ পিছনে তাকাতেই লোকটা আড়ালে চলে যায়। সমস্যা কী? লোকটা অনুসরণ করছে কেন? এরকম তো আগে হয়নি।
বেশ কিছুক্ষণ ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। আছরের আযান পড়তেই লোকটি চলে যায়। রূপা মনে খচখচানি নিয়ে ইফতারের প্রস্তুতি নেয়।

বিকেলবেলা ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। দিনটা বড় অশুভ!
সন্ধ্যা হতেই শুরু হয় বজ্রপাত, তীব্র বাতাসের তাণ্ডব। রেস্টুরেন্টে জ্বালানো হয় ব্যাটারিচালিত বাতি। ইফতারে অন্যদিনের তুলনায় খুব কম খরিদ্দার আসে।
যারা আসে তাদের ইফতার করার মতো ঘর নেই বলেই এই ঝড়ের মাঝেও এসেছে।
ঝড় থামতেই রূপা বাসায় চলে যায়। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে। হৃদয়ে একটা অস্থিরতা। মনে শান্তি না থাকলে কি গায়ে শক্তি থাকে?

রুমে গিয়েই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। এর মধ্যে অরুনিকা কল করল। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রূপা বলল, ” রমজানে আমি অনেক ব্যস্ত থাকি। প্রতি রোজায় তুই দেখা করতে আসিস। এক সপ্তাহ আগে দেখা করেছি, এখনো আসছিস না কেন?”
অরুনিকা বলল, “মা আসতে দেয় না। তবে আগামীকাল আসব৷ যেভাবে হোক আসব।”
” হিরণ ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেছিস?”
অরুনিকা কিছু বলল না। হিরণের যে প্রেমিকা ছিল ব্যাপারটা সে রূপার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। রুপা তার ব্যাপারে পজেসিভ। সাধারণ বিষয়কেও গুরুতরভাবে নেয়৷ তাই এই কথাটা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে৷ কী দরকার রূপাকে চাপ দেয়ার।

পরমুহূর্তেই অরুনিকা ভাবল, রূপা চাপ নিবে তাই কথাটি লুকিয়েছি নাকি রুপা জানলে হিরণের সঙ্গে কখনো মেনে নেবে না, মিশতে দিবে না সেই ভয়ে লুকিয়েছি?
জবাব না পেয়ে রূপা বলল, ” অরুনিকা?’
অরুনিকা চট করে জবাব দিল, ” না, বলিনি। ও প্রতিদিন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ছাদেও হয়তো যায়, আমি যাই না৷ মা আর আমি বের হলে পিছু নেয়।”

অরুনিকা রূপাকে বলেছে, হিরণকে পরীক্ষা করতে কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ বন্ধ রেখেছি।
রুপা হেসে বলল, “তোর জন্য পাগল হয়ে গেছে৷ আর কত ঘুরাবি?”
“আর ঘুরাব না। আজই বলে দেব।”
“আজ বলার দরকার নেই। ভাইয়ার স্থায়ী ঠিকানা দিতে বলেছিলাম, এখনো দিলি না৷”
”আমার কাছে তো নেই।”
”নিয়ে দে। আমি বের হওয়ার সময়ই পাচ্ছি না, নয়তো যোগাড় করে নিতাম।”
“আচ্ছা, দেব।” অরুনিকার গলা নিভে আসে।
রুপা বলবে তো হিরণের সঙ্গে তার সম্পর্কের শুরু হবে, ব্যাপারটা ভালো লাগছে না৷ মনের ভেতর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
রুপা বলল, “অনেক ক্লান্ত লাগছে, ঘুমাব।”

“স্যারের কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”
“ফোন বন্ধ। আপা বলল, উনার ফোন নাকি পানিতে পড়ে গেছে।”
“চিন্তা করিস না। কাজে গেছে চলে আসবে।”
কিছুক্ষণ পর সেহেরির প্রস্তুতি নিতে হবে এই দুশ্চিন্তায় ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমানো গেল না। বেশ কয়েকবার সুমনা এসে ডাকাডাকি করেছেন, “ঘুমিয়ে যাস না যেন দোকানে যেতে হবে।”
রুপা চোখ বোজা অবস্থায় প্রতিবার বলেছে, “ঘুমাচ্ছি না।”

বারোতম সময়ে রুপা চিৎকার করে উঠল, “একটু চুপচাপ শুয়ে থাকতে তো দিবে। দিন রাত শুধু কাজ করব? তোমাদের এই অত্যাচার আমার আর ভালো লাগছে না। যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে মনে চায়।”
সুমনা বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলেন। রুপা ওড়না আর ফোন নিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে যায়।
রাস্তায় কাঁদা। সেই কর্দমাক্ত জায়গা মাড়িয়েই রেস্টুরেন্টে গেল।

বাজারে প্রবেশ করতেই এশারের আযান ভেসে আসে। অন্য আট-দশটা মেয়ের মতো রুপাও মাথায় ওড়না টেনে নিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেই সে অবাক হয়ে যায়, চমকে যায়। সামনের বেঞ্চিতে হীরা বসে আছে! দেখতে ভীষণ গুছানো ও পরিপাটি লাগছে। তাকে ঘিরে বসে আছে আরো অনেকে। সামনে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগি কষার প্লেট রাখা। সে এখানে কী করে? এতদিন কোথায় ছিল? হুট করে কোথায় চলে গিয়েছিল?

রূপা, হীরার চোখাচোখি হয়। না চাইতেও রুপার ভ্রু দুটি কুঁচকে গেল। চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের রাগ, বিরক্তি।
ক্যাশ কাউন্টার খালি! সুজন, বারেক কেউ নেই৷ রূপা ক্যাশ কাউন্টারে বসল। ও ভাবছে, কী তাণ্ডব নিয়ে এসেছে হীরা? এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে কোনো নোংরা মন্তব্য করলে আমি ছেড়ে দেব না।
হীরা চোখ ফিরিয়ে নিয়েও আবার তাকাল৷ রূপাকে অন্যরকম লাগছে। এতোটাই অন্যরকম যে বার বার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে৷ রূপার রাগী দৃষ্টি, সিঁথি, মাথার অর্ধেক ঘোমটা ; সব মিলিয়ে একটা ব্যাতিক্রম চিত্রের রূপ দিয়েছে — হীরা চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।

সুজন বাহির থেকে দৌড়ে এসে দোকানে ঢুকে। রূপা চাপাস্বরে ধমকে উঠল, “দোকান রেখে কোথায় ছিলি?”
“আহুরদ্দিন চাচারে চা দিয়া আইছি।”
” হীরা কখন আসল?”
“তুমি যাওয়ার পরেই।”
“চাঁদার জন্য?”
“এখনো তো কিছু চায় নাই। তহন থাইকা আড্ডাই দিতাছে।”
রুপা দেখে, হীরা স্বাভাবিকভাবেই হাসি-তামাশা করছে। সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ যেভাবে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, ঠিক সেভাবে।

রাত নয়টার দিকে তাদের অবাক করে দিয়ে খাবারের বিল মেটাল হীরা।
যখন সে ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বলল, “চাচা, বিল কত আসল?”
বারেকের চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে যায়৷ সুজন নিশ্চুপে রান্নাঘরে গিয়ে রুপাকে কথাটি জানায়। রুপা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে হীরা বিল দিচ্ছে!
হীরার আকস্মিক আগমন এবং স্বাভাবিক আচরণ তার মোটেও ভালো লাগছে না। মনের কোথাও যেন কু গাইছে।
তার কিছুক্ষণ পরই জেসমিনের গলার স্বর শোনা যায়। কান্না করতে করতে রূপা, রূপা বলে ডাকছে।
রূপার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। হুড়মুড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়।

সূর্যশিশির পর্ব ৩৬

(অনেক গ্যাপ থাকায় গল্পের তাল ধরতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। যতটা সময় নিয়ে এই পর্ব লিখেছি, ততটুকু সময় নিয়ে এর থেকে দ্বিগুণ পর্ব লিখতে পারতাম। আশা করি আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে।)

সূর্যশিশির পর্ব ৩৮