সূর্যশিশির পর্ব ৩৫

সূর্যশিশির পর্ব ৩৫
ইলমা বেহরোজ

রূপা ভেবেছিল, পারভেজের ঘটনাটি অনেক দূর পর্যন্ত এগোবে। কিন্তু পরদিনই এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ক্ষ ত-বিক্ষ ত অবস্থায় পারভেজের লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাকে কেউ বা কারা নৃ শংসভাবে হ’ত্যা করেছে। বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য৷ পারভেজের আসল নাম বশির। পৃথিবীতে আপন বলতে তার কেউ নেই৷ চোরাচালান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে৷ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে সে জড়িত৷ মিথ্যে পরিচয়ে সুন্দরী মেয়েদের ফাঁসিয়ে নিজের শয্যাসঙ্গী বানানো তার অন্যতম নেশা। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, দ্ব ন্দ্ব থেকে দলের কেউ বশিরকে খু ন করেছে৷

ফাইয়াজের থেকে সংবাদটি পাওয়ার পর বিশ্বাস করেনি রুমি। টিভির পর্দায় যখন বশিরের লাশ দেখল তখন বিশ্বাস হলো, ছদ্মবেশী পারভেজ সত্যি খু ন হয়েছে৷ খুশির ঝিলিক ছুটে যায় তার চোখেমুখে। যে উদ্বেগ, মনঃকষ্ট ছিল তা কিছুটা লাঘব হয়ে আসে। সুমনা উচ্ছ্বাসে বিড়বিড় করেন, “আল্লাহ বিচার করছে! আল্লাহ আছে!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পারভেজ নামধারী বশিরকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি রসন ভিলাতে। রূপার সাহায্যে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেয় রুমি; বেরিয়ে আসে সেই কালো দিনগুলো থেকে। আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। সে এখন রূপার নেওটা। আপা, আপা ডেকে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। ঘরের কাজকর্মে সুমনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে।
দুপুর বারোটা৷ রুমি ঘরদোর গোছাচ্ছে। রূপা আর সুমনা ডাইনিং রুমে বসে আছে। তারা রুমির পরিবর্তন নিয়ে আলাপ করছিল। হঠাৎ রূপা প্রশ্ন করল, “আমার খালা কয়জন আম্মা?”

সুমনা হাত থামিয়ে রূপার দিকে চেয়ে বললেন, “কেন?”
রূপা হাসল।
“কেন মানে? এমনি জানতে চাইছি।”
“একজন।” তিনি কাঁথা সেলাই করছেন।
“উনি কোথায় থাকেন? নাম কী?”
সুমনা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “তাহমিনা। মারা গেছে।”

সেদিন রাতে সুমনার হাত থেকে রুমিকে বাঁচাতে গিয়ে তাকেও মার খেতে হয়েছিল। সুমনা কাঁদছিলেন আর বার বার বলছিলেন, আমার আপার গহনা! আমার আপার গহনা! কী করলি তুই? কী করলি তুই? আমার আপার শেষ স্মৃতি…
সেদিন থেকে রূপা তার খালা সম্পর্কে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। নানাবাড়ি অথবা দাদাবাড়ি সম্পর্কে তারা কোনো ভাইবোনই কিছু জানে না। ছোট থেকে শুনে এসেছে, তাদের আপনজন বলতে কেউ নেই।
কেন নেই?

রূপা প্রশ্ন করতে গিয়েও দমে গেল। তার দৃষ্টি পড়ে সুমনার রুমে থাকা পুরনো স্টিলের আলমারিটির ওপর। কখনো এই আলমারির ভেতরটা দেখার সুযোগ হয়নি তার। প্রয়োজন পড়েনি, আগ্রহও জমেনি। একদিন কী দেখা উচিত?
নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে গেল রূপা। আলমারির ভেতরে কী আছে সেটা দেখে তার কী লাভ? কেনই বা হঠাৎ এটা মাথায় এলো? রূপা ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়ার জন্য অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে সুমনাকে বলল, “আজ তো ও বাড়ির সবাই আসবে৷ আমি কি থাকব?”

“তুই থাকলে হোটেলের রান্নাবান্নার কী হবে? আমি ওদের দেখব। তুই মাগরিবের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসিস।”
“সেহেরির দাওয়াতও দিয়েছ?”
“হু।”
ইফতারে ফাইয়াজ আসেনি। সে কোনো এক জরুরি কাজে নাকি বেরিয়ে গেছে৷ এ কথা শুনে সুমনার কণ্ঠ থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ে, “ছেলেটার এখনই কাজ পড়তে হলো!”
জেসমিন বলল, “পাশাপাশি বাড়ি। যেকোনো সময় আসতে পারবে। আপনি এ নিয়ে মন খারাপ করবেন না।”
“সে তো আসতেই হবে। ইশতেহার, তুমি খাচ্ছ না কেন?”

ইশতেহার জোরপূর্বক হেসে বলল, “এতোকিছু আয়োজন করেছেন, সব কি খাওয়া সম্ভব? রূপা কোথায়? ”
“ও তো হোটেলে৷”
এ কথা শুনে ইশতেহারের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল৷ সে এক পলক জেসমিনকে দেখল।
সারাদিন রোজা রাখার পর শরীর আর চলতে চায় না! ক্লান্তি এসে ভর করে শরীরে। একদমই শক্তি মেলে না। তবুও রূপাকে তারাবির নামাযের পর থেকেই কাজ শুরু করতে হয়৷ রমজান মাসে বাজারের প্রায় সকল দোকানপাট খোলা থাকে। কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীরা, আশেপাশের বিভিন্ন কোম্পানি, ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা সেহেরির সময় খেতে আসে। তাই চাপ বেশি। রান্না শেষ করেই রুপা বাজার থেকে প্রস্থান করল। কাজের চাপে দিনে গোসল করাও হয়নি। গা চুলকাচ্ছে।

প্রেশার ল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। চারপাশ কেমন ঘোলা হয়ে আসছে। রূপা মাথা ঝাঁকায়, দুই হাতে চোখ ঘষে।
গলির মুখে আসতেই কিছু কথা তার কানে আসে৷ সে আগ্রহবশত পাশের গলিতে উঁকি দিয়ে দেখে একপাশে বসে তাস খেলছে এলাকার মুরব্বি কয়জন। যিনি উচ্চস্বরে কথা বলছেন, তিনি কলির বাপ নামে এই এলাকায় পরিচিত৷
তিনি বলছেন, “আসিদপুরের হুজুররে চিনেন? তারে ডাইকা আনেন, আমি যেইডা কইলাম চোক্ষের পলকে প্রমাণ কইরা দিব।”

তমরুজ চাচা জবাবে বললেন, “তাইলে আপনে নিশ্চিত হইয়া কইতাছেন, রূপা আর হের বাপে ফাইয়াজরে জাদুটোটকা করছে?”
কলির বাপ বিদ্রুপ করে বললেন, “আপনেরার কী বিবেক নাই? আমার কলির মতো সুন্দর মাইয়ারে ফাইয়াজ বিয়ে করল না, করল কারে? রূপার মতো ছেড়িরে। ফাইয়াজের লগে মানায় এই ছেড়িরে? কি দেইখা বিয়ে করল ওরে? আমি লেইখা দিতাছি, বাপ-ছেড়ি একযোগ হইয়া ফাইয়াজরে জাদু করছে।”
আরেকজন তাল দিলেন, “ঠিকই কইছেন৷”

কলির বাপ মাঝের দিনগুলো বড় ছেলের বাড়িতে ছিলেন। আজই নিজের বাড়ি ফিরেছেন। ফাইয়াজ-রূপার বিয়ের খবর শুনে তার আঁতে ঘা পড়ে। কিছুতেই মানতে পারছেন না, তার অনার্স পাস সুন্দরী মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে ফাইয়াজ রূপার মতো রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে পড়ে থাকা, ছেলেদের বেশভূষা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, অ’ভদ্র, উশৃং খল, কু’ৎসিত মেয়েকে বিয়ে করেছে!
এই কানাঘুঁষা যে শুধু মুরব্বিদের তা নয়, বিয়ের পর থেকে এলাকার আনাচে কানাচে রূপার অযোগ্যতা নিয়ে রমরমা সমালোচনা চলছে।

ছোট থেকে সে বিভিন্ন কটু কথা, মিথ্যে অপবাদ শুনে বড় হয়েছে। সব কথাই তার চরিত্র নিয়ে, তার বেশভূষা নিয়ে, তার চালচলন নিয়ে হতো। এতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে কারোর জন্য অযোগ্য — এই কথাটি এই প্রথম শুনছে। বুকের ভেতর খুব যন্ত্রণা হয়। ফাইয়াজের সঙ্গে মিশতে পারে না। সবসময় হীনমন্যতায় ভুগে সে। নিজের প্রতি থাকা আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। খুব রাগ হয়, জিদ উঠে।

সদ্য আঘাতপ্রাপ্ত ক্ষতে মরিচ লাগালে যেরকম অনুভূতি হয় এখন ঠিক সেরকম জ্বালাপোড়াই হচ্ছে বক্ষস্থলে। সে তো চায়নি তার থেকে সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা জীবনসঙ্গী। তিনটে প্রেম করেছিল, তিনজনই ছিল ক্রুটিযুক্ত। একজন উচ্চতায় ছোট, একজন খোঁড়া, একজন বধির।

হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি ফেরার পথে এরকম কথা শোনার পর রূপার জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা বেড়ে যায়। বিয়ের প্রতি, ফাইয়াজের প্রতি এক আকাশ রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ নিয়ে সে বাড়ি ফিরে৷ তার চোখেমুখে অমাবস্যার কালো ছায়া।
দ্বিতীয় তলায় উঠেই বুঝতে পারল, রুমে কেউ আছে। এই অসময়ে তার রুমে কে থাকবে! রুমি নাকি?
রূপা সাবধানে দরজা ঠেলে দেখে, ফাইয়াজ বিছানা ঝাড়ছে।
দরজা খোলার শব্দ শুনে ফাইয়াজ পিছনে ফিরে রূপাকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল, “আম্মা বললেন, তোমার রুমে বসতে৷ এসে দেখি এই অবস্থা! এখানে গরুছাগলও থাকবে না৷”

রূপা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “তাহলে চলে যান।”
ফাইয়াজের দৃষ্টি থমকে গেল। রূপা এভাবে জবাব দিল কেন?
রূপা চোখ সরিয়ে নিল। তার নিজেকে খুব বেপরোয়া মনে হচ্ছে৷ আর ফাইয়াজকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র খারাপ লোক। সে তোয়ালে, ট্রাউজার, গেঞ্জি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
ফাইয়াজ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ কেমন আচরণ? রূপা সবসময় তার সামনে নিভে থাকে৷ উঁচু গলায় কখনো কথা বলে না৷ আজ কী হলো? মুখের উপর কেউ কথা বললে মেজাজ চড়ে যায়। আজ সে রাগ করতে চায় না। নিশ্চয়ই রূপার কোনো সমস্যা হয়েছে। জানতে হবে।

বাহিরে বাতাস বইছে৷ জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঢুকছে বাতাস। ফাইয়াজ পিঠের নিচে বালিশ রেখে পালঙে হেলান দিয়ে বসল। শেষরাতে বৃষ্টি হবে৷ তারই পূর্বাভাস পরিবেশে৷
ফ্যানের ঘ্যারঘ্যার শব্দ কানে লাগছে খুব। অনেক পুরনো ফ্যান। গায়ে তেমন বাতাস লাগে না৷ রূপা কী করে যে ঘুমায়! অবশ্য একসময় সে ফ্যান ছাড়াও ঘুমাত৷ পরিস্থিতি সবকিছু পারে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে ফাইয়াজকে দেখে রূপা বিরক্তবোধ করল৷
রূপাকে বের হতে দেখে ফাইয়াজ ফোন রেখে সোজা হয়ে বসে বলল, “তোমার ইতিহাস এসেছে। ছয় তারিখের মধ্যে ভর্তি হতে হবে।”

রূপা চুল মুছতে মুছতে দায়সারাভাবে বলল, “ঠিক আছে।”
“কিছুদিন বাড়িতে থাকব না।”
রূপা ড্রয়ার থেকে চার্জার বের করে।
ফাইয়াজ গলার স্বর উঁচু করে বলল, “কী সমস্যা তোমার?”

রূপা ভয় তো দূরে থাক, জবাবও দিল না৷ ফোন চার্জে লাগিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফাইয়াজ বিস্ময়ে হতভম্ব! মেয়েরা বউ হলে কি সাহসী হয়ে যায়? সে তরতর করে বিছানা থেকে নামে। রূপা তার সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি। বিয়ের এতগুলো দিন পার হলে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অন্তত হয়৷ তাদের মধ্যে কিছুই নেই!
ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্কের রেশ, জড়তা এখনো রয়ে গেছে৷ ফাইয়াজ নিজেকে দায়ী করল, দোষটা হয়তো তারই। সবসময় শিক্ষকের মতো ধমকে-ধমকে কথা বলেছে, তাই হয়তো সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে না৷ ফাইয়াজ রুম থেকে বের হয়।
উল্টোদিক থেকে বাতাস আসছে। রূপা ছাদের এক কোণে বুকের কাছে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার ভেজা চুল পিঠজুড়ে ছড়িয়ে।

বিদ্যুৎ চলে যায়। বৃষ্টির আগমনী বুঝতে পারলেই বিদ্যুৎ চলে যায়, দেশে এ নতুন নয়। রাতের মৃদু আলোয় রূপাকে একটা কালো আবছায়ার মতো দেখাচ্ছে৷ ফাইয়াজ কাছে গিয়ে বুঝতে পারল, রূপা কাঁদছে।
উৎকন্ঠা নিয়ে বলল, “রূপা, কাঁদছ কেন?”
রূপা দ্রুত চোখের পানি মুছল৷ ফাইয়াজ তার কাঁধে এক হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে? আমাকে শেয়ার করতে পারো।”
কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে অভিযোগের সুরে রুপা বলল, “আপনি কেন আমাকে বিয়ে করেছেন?”
ফাইয়াজ থতমত খেয়ে বলল, “তুমি করতে চাওনি?”

“না, চাইনি।”
“কিন্তু করেছ তো।”
“পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তাই রাজি হয়েছি। ভেবেছিলাম, সাধারণ বিষয়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সম্পর্কটা বোঝা মনে হচ্ছে। আমি অন্যরকম কাউকে চেয়েছিলাম। আপনার মতো না।”
ফাইয়াজ যেন আকস্মিক গুলিবিদ্ধে আহত হলো মাত্র! তাকে রূপার পছন্দ নয়! এজন্যই কি রূপা সবসময় পালিয়ে বেড়ায়? দূরে দূরে থাকে? অথচ সে ভেবেছিল, পূর্বের শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কই তাদের দূরত্বের একমাত্র কারণ।
ফাইয়াজ নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘এজন্য কাঁদছ?’

রূপা জবাব দিল না। চাহনি ঘুরিয়ে নিল। যখনই ফাইয়াজকে সে দেখে, হীনমন্যতায় গা গুলিয়ে ওঠে। মানুষের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে।
‘তুমি যোগ্য নও….
‘ফাইয়াজের পোড়া কপাল…
‘কোন হুজুর দিয়ে জাদু করেছিস রে রূপা?…
‘তোদের মানায় না…
এমন কত কত কথা মস্তিষ্কে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।

এই কথাগুলো কখনো ফাইয়াজের সঙ্গে তার সম্পর্ক সহজ হতে দিবে না৷ ফাইয়াজের সামনে এলেই তার সংকোচ বেড়ে যায়। পীড়া লাগে বুকে।
ফাইয়াজ কিছু না বলে দ্রুত পদে জায়গা ত্যাগ করে।
বরাবরই তার অহংবোধ বেশি৷ যে তাকে এক হাত দূরে সরিয়ে দেয়, তাকে সে একশো হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে৷ সে যে ই হোক।

ফাইয়াজ চলে যেতেই রূপার বুকের চর ভাঙতে শুরু করে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে।
ফাইয়াজ প্রথমে নিজের বাড়িতে ঢুকল, রুম থেকে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে গলির পথ ধরে মিশে গেল অন্ধকারে।
রূপার অসহায়বোধ করে। কী করেছে, কী বলেছে, নিজেও বুঝতে পারছে না৷ ফাইয়াজ তার কাছে সূর্য। যার আলো দূর থেকে উপভোগ্য, কাছে যেতে চাইলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে হয়।

আজিজুর বাড়ি ছাড়ার দুইদিনের মাথায় অরুনিকা তার নিজের রুমে চলে এসেছে। হিরণের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে৷ এই যে হিরণ তার একটু সাক্ষাতের আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, ডেলিভারি ম্যান সেজে দুই দিন পর পর এটা-ওটা নিয়ে আসে, ব্যাপারটা উপভোগ করে অরুনিকা। দূর্ভাগ্যবশত, হিরণ প্রতিবার ডেলিভারি ম্যান সেজে এসে সেলিনার মুখোমুখি হয়৷
কখনো অরুনিকা পার্সেল রিসিভ করতে আসে না।

বার বার পার্সেল আসায় মায়ের প্রশ্নের তোপে পড়তে হয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, “এতোকিছু অর্ডার করছ কেন?”
অরুনিকা নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছিল, “খারাপ কিছু তো অর্ডার করি না। বই, চুড়ি, পায়েল, ডায়েরি, ফুল এসবই তো।”

সেলিনা আরো কিছু প্রশ্ন করে থেমে যান। বড় ছেলেকে অতিরিক্ত শাসন করে হারিয়েছেন, তাই মেয়েকে অবাধ স্বাধীনতা দিচ্ছেন। আগের পদক্ষেপ ভুল ছিল তা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেকে হারিয়ে। এখনের পদক্ষেপও যে ভুল তা প্রমাণ হতে বেশিদিন লাগেনি।
আজ মাসের সাতাশ তারিখ। মা-মেয়ে ঈদের শপিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অরুনিকা আগে আগে নেমে পড়ে। গ্যারেজের কাছাকাছি আসতেই হিরণ কোথা থেকে এসে তাকে জাপটে ধরে গাড়ির পিছনে নিয়ে যায়। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও, হিরণকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে সে।

হিরণকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সে দ্রুত বলে, “কেন এমন করছ? ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম কোথাও তোমাকে পাই না৷ ইমেইলেও মেসেজ করেছি, উত্তর করোনি। ফোনের সিম বন্ধ রেখেছ। আমাকে কেন পাগল করছ?”
অরুনিকা হিরণকে ঠেলে সরাতে চাইলে, হিরণ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার স্পর্ধা দেখে অরুনিকা অবাক হচ্ছে!
কীসের অধিকার খাটাচ্ছে হিরণ?
“দোহাই লাগে, ব্লক খুলো। আমার সাথে কথা বলো। তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।” উদ্ভ্রান্তের মতো বলল সে।

অরুনিকার খুব মায়া হয়। কবেই সে হিরণের অতীত মেনে নিয়েছে৷ এবার সামনাসামনি বলতে হবে।
পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেলিনা আসছে।
অরুনিকা চাপাস্বরে বলল, “ছাড়ো।”
“ছাড়ব না।”
“মা আসছে।”
“আসুক।”

অরুনিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, “কী বলছ!”
পায়ের শব্দ নিকটে চলে এসেছে। অরুনিকা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে হিরণকে সরিয়ে দিল।
তাকে গ্যারেজ থেকে বের হতে দেখে সেলিনা ভ্রুবক্র করে বললেন, “গ্যারেজে কী করছিলে?”
অরুনিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কিছু না৷ এমনি গিয়েছিলাম।”

সূর্যশিশির পর্ব ৩৪

“চলো। দ্রুত ফিরতে হবে।”
সে আড়চোখে গ্যারেজে তাকায়। গাড়ির পিছন থেকে হিরণ কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে।
“আরেকটু অপেক্ষা করো। দ্রুত তোমার কাছে আমি ধরা দেব।” মনে মনে বলল অরুনিকা।

সূর্যশিশির পর্ব ৩৬