প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৪

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৪
Writer Mahfuza Akter

তরীর র*ক্তা*ক্ত মুখটা দেখে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছে সৌহার্দ্যের। হৃদয়ের ভেতরটাও র*ক্তা*ক্ত হয়েছে হয়তো! তরীকে ছুঁয়ে দিতেও হাত কাঁপছে। তার স্পর্শে যদি তরী ব্যথায় শিউরে ওঠে! মেয়েটার মনের যন্ত্রণা কি কম পড়ে গিয়েছিল যে, ওকে এই মরণ যন্ত্রণাও সহ্য করতে হচ্ছে?

চিকিৎসা পেশার এতো বছরের অভিজ্ঞতায় এর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি আহত ও বী*ভ*ৎ*স জ’খ’মে’র রোগীর চিকিৎসা করেছে সৌহার্দ্য। নিজ হাতে ছুঁয়েছে তাদের; সূঁচ ও ছু*রি চালিয়েছে নির্দ্বিধায়। তাহলে আজ কী হলো? এতো ভয় আজ কেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে?
“স্যার, মেয়েটার ট্রিটমেন্ট কি শুরু করবো?”
পাশের নার্সের হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠলো সৌহার্দ্য। আড়ালে চোখের কোণের জলটুকু মুছে বললো,
“হ্যাঁ, ওনার গহনাগুলো খুলে শাড়িটা চেঞ্জ করে দিন। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
“ওকে, স্যার!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৌহার্দ্য বেরিয়ে এলো। কেবিনের সামনের চেয়ারে প্রহর চিন্তিত মুখে বসে আছে। সৌহার্দ্যকে বেরিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। সৌহার্দ্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে তার চোখমুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সৌহার্দ্যের লালচে চোখ দুটো দেখে প্রহর বললো,
“তুই কাঁদছিস? ইজ দেয়ার এনিথিং সিরিয়াস? আই মিন…….”
সৌহার্দ্য নিস্তেজ কন্ঠে বললো,

“জানি না এখনো। ওর দিকে তাকানোর সাহসও পাচ্ছি না আমি। ওর ট্রিটমেন্ট কীভাবে করবো আমি?”
প্রহর ঢোক গিলে গলার পরিষ্কার করে বললো,
“কিন্তু তুই না করলে কে করবে? এভাবে ভেঙে পড়াটা তোকে মানায় না একদমই!”
সৌহার্দ্য নাক টেনে বললো,
“বাবাকে জানিয়েছিস?”
“হ্যাঁ, অনেকক্ষণ আগেই বলেছি। আসছেন ওনারা!”

সৌহার্দ্য কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। এরই মধ্যে মধ্য বয়সী একজন মহিলা ডক্টর সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
“ইয়েস, সৌহার্দ্য! কী হয়েছে? তুমি এতো তাড়া দিয়ে আসতে বললে যে!”
সৌহার্দ্য গলা ঝেড়ে শান্তভাবে বললো,
“একটা পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে হবে, ডক্টর সামিয়া! এই কেবিনেই এডমিট করা হয়েছে।”
ডক্টর সামিয়া বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

“ডক্টর সৌহার্দ্য আমাকে বলছে পেশেন্ট হ্যান্ডেল করতে? আমার জানামতে, তোমার মতো প্রফেশনাল ট্রিটমেন্টের হাত এই মফস্বলের হসপিটালের কারো নেই! তাহলে নিজে না করে আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছো কেন?”
সৌহার্দ্য শীতল গলায় বললো,
“কিছু কিছু জায়গায় মানুষ বেশ দূর্বল হয়ে পড়ে, ডক্টর সামিয়া! ধরে নিন, আজ ডক্টর সৌহার্দ্য রায়হায় দূর্বল হয়ে গেছে; প্রিয় কিছু হারানোর ভয়ের সামনে পরাজিত হয়ে গেছে।”

ডক্টর সামিয়া সৌহার্দ্যের কথার মানে বুঝতে পারলেন হয়তো! হালকা হেসে মাথা নাড়ালেন। দ্রুত পায়ে কেবিনের ভেতরে চলে গেলেন। সৌহার্দ্য চেয়ারে বসে দুই হাত দু’পাশে ভর দিয়ে ঝুঁকে রইলো। প্রহর তার পাশে বসেছে। দুশ্চিন্তা চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে যেন! সৌহার্দ্যের কাঁধে হাত রেখে বসে আছে প্রহর। কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতেও পারছে না। কী বলবে সে? সৌহার্দ্যও শক্ত পাথরের মতো বসে আছে। সৌহার্দ্যকে দেখে অবাক হয় মাঝে মাঝে সে। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেলেও ছেলেটার মুখে তার বিন্দুমাত্র আভাস দেখা যায় না।

হঠাৎ রায়হান সাহেব আর আফনাদ হক সামনে এসে দাঁড়ালো প্রহরের। প্রহর মুখ তুলে তাকাতেই রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“কী অবস্থা এখন তরীর?”

রায়হান সাহেবের গলা শুনে সৌহার্দ্যও নড়ে উঠলো যেন! মুখ তুলে তাকালো তাদের দিকে। পেছনে সুজাতা আর মালিহা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্রই! সৌহার্দ্য দাঁড়াতেই মালিহা এগিয়ে এসে সৌহার্দ্যের বাহুতে হাত রেখে ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় আমার চাঁদ? আমার চাঁদ কি বেঁচে আছে?”
মালিহাকে উদ্ভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সৌহার্দ্য মালিহাকে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসলো। এতক্ষণে একটা ভরসার স্থান পেয়ে মালিহার শক্ত খোলসটা ঝরে পড়লো যেন! দু’চোখ সিক্ত হলো। ঝরঝরিয়ে বেয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা। মাথা এলিয়ে ঢলে পড়লো সৌহার্দ্যের বুকে,

“আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণই হলো আমার চাঁদ! ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো কী নিয়ে? আমায় কেন এতো অভাগী করে পাঠালে, আল্লাহ? যাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাই, তাকেই তুমি কেঁড়ে নাও কেন?”
সৌহার্দ্য মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। সে তো নিজেই নিজেকে বলিষ্ঠ আবরণে মুড়িয়ে রেখেছে! যেখানে নিজেকে সামলানো-ই দুঃসাধ্য, সেখানে আরেকজনকে কী বলে-ই বা সান্ত্বনা দেওয়া যায়!!
আফনাদ হক নিস্তেজ হয়ে বসে পড়লেন। নিজেকে একজন অযোগ্য পিতা, দায়িত্বজ্ঞানহীন পুরুষ বলে মনে হচ্ছে তার।
ঘন্টা দেড়েক পর ডক্টর সামিয়া বের হয়ে এলেন। তার বেশ চিন্তিত মুখ দেখে সকলে খানিকটা ভড়কে গেল। সৌহার্দ্য উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,

“চাঁদ! চাঁদ ঠিক আছে তো?”
প্রশ্নটা করার সময় সৌহার্দ্যের গলা কেঁপে উঠছিল। সে অনুভব করছিল, তার পৃথিবী কয়েক মুহূর্তের জন্য নড়ে উঠছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব দুলছে! শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। তরীর ব্যাপারে কোনো অপ্রত্যাশিত সত্য কি সে সহ্য করতে পারবে? সৌহার্দ্যের এই মুহুর্তে নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে।
ডক্টর সামিয়া সৌহার্দ্যের মুখ দেখে পরিস্থিতি কিছুটা অনুমান করতে পেরেছেন হয়তো! তাই কালক্ষেপ না করে মুখ খুললেন তিনি,

“ওর জ্ঞান ফিরেছে। আপাতত ঠিক আছে মেয়েটা!”
সৌহার্দ্য এতক্ষণে একটা লম্বা শ্বাস ফেললো। দেহে প্রাণ ফিরে পাওয়ার ভঙ্গিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সকলে কিছুটা স্বস্তি পেলেও শান্ত হতে পারলো না মালিহা। সে এখনো বিধ্বস্ত, নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে আছে, যেন ডক্টর সামিয়ার কাছ থেকে এটুকু তথ্য জানাটা তার জন্য যথেষ্ট নয়।
ডক্টর সামিয়া পুনরায় সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন,

“মেয়েটা এরকম শারীরিক ও মানসিক অবস্থার সম্মুখীন হয়েও বেঁচে ফিরেছে। এটাই আপনাদের জন্য অনেক।”
মালিহা নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো দু’হাতে ঘষে মুছলো। ঢোক গিলে বললো,
“ওর সাথে কী হয়েছিল আসলে? সত্যি করে বলুন, ডাক্তার সাহেবা!”
ডক্টর সামিয়া চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
“আমি নিশ্চিত বলতে পারছি না। কিছু টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া যেত! কিন্তু গ্রামের এই হাসপাতালে সেরকম ব্যবস্থার বড্ড অভাব!”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ডক্টর সামিয়া ঠিক কী বলতে চাইছেন, সেটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু মালিহা হঠাৎ এক অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে বসলো। তেড়ে এসে ডক্টর সামিয়ার হাত খাবলে ধরে টেনে নিয়ে তার চেম্বারের দিকে চলে গেল। খট করে দরজা লাগিয়ে নিজেকে আর ডক্টর সামিয়াকে চেম্বারের ভেতর আবদ্ধ করে ফেললো। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। প্রহর চোখ কপালে তুলে বললো,

“এই মালিহা আন্টি তরীর ব্যাপারে এতো পজেসিভ কেন বল তো, সৌহার্দ্য?”
সৌহার্দ্য হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে বললো,
“আমি নিজেও জানি না!”
রায়হান সাহেব বললেন,
“তরীর কোনো কষ্ট বা ক্ষতি দেখলে মালিহার আচরণ কেমন অদ্ভুত হয়ে যায়! ওকে দেখলে ভয় হয় আমার তখন।”
আফনাদ হক চিন্তিত মুখে বললেন,

“না জানি চেম্বারের ভেতরে ডক্টর সামিয়ার সাথে কী এমন কথা বলছে!”
সৌহার্দ্য নিস্প্রভ চোখ সরিয়ে তরীর কেবিনের দিকে তাকালো। চোখ দুটো মুষড়ে পড়লো মুহুর্তেই! বুজে এলো নেত্রপল্লব। ডক্টর সামিয়া কিছু লুকাচ্ছে, সেটা সৌহার্দ্য বেশ বুঝতে পারছে। হয়তো মালিহাও বুঝেছেয় সেই লুকায়িত সত্যটা জানার জন্যই মালিহা ডক্টর সামিয়াকে জেরা করছে এখন!

শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো সৌহার্দ্য। খুবই ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তরীর কেবিনের দিকে। কাচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। তরীর কেবিনের কাঠের দরজাটায় হাত স্পর্শ করাতে গিয়ে সৌহার্দ্য উপলব্ধি করলো, তার হাত থরথর করে কাঁপছে। বলিষ্ঠ হাতটা বোধ হয় এই জীবনে প্রথম কম্পিত অবস্থায় দেখলো সৌহার্দ্য। সেই কাঁপা হাতেই দরজার নব মোচড় দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে দৃষ্টি মেললো একপলক। একজন নার্স ছাড়া কেবিনে আর তৃতীয় কেউ নেই। সৌহার্দ্যকে ঢুকতে দেখেই নার্সটা হাতের ফাইল গুছিয়ে বেরিয়ে গেল।

সৌহার্দ্য এগিয়ে গিয়ে তরীর বেডের পাশে থাকা টুলটায় বসলো। তরীর মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। নিবিড় চোখে পরখ করলো সুপ্ত মলিন মুখশ্রীটা! কপালে বেশ মোটা করে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে, ঠোঁটের কোণে রক্তের ছাপ আর চোখের নিচের কোণে চামড়া ছিঁলে গিয়েছে অনেকটা। হাতের কনুই আর পায়ের হাঁটুতেও ব্যান্ডেজ করা। সৌহার্দ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তরীর ঘুমন্ত মুখটার দিকে। বাঁ চোখ দিয়ে অজান্তেই বেয়ে পড়লো নোনাজলের রেখা। হঠাৎই আনমনে বিড়বিড় করে ধরা গলায় সৌহার্দ্য বলে উঠলো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৩

“চাঁদ হয়ে সূর্যের চেয়েও এতো তীব্র উত্তাপ ছড়ালে! আমার পৃথিবী এভাবে ঝলসে দিলে! এখন আমি এই দগ্ধ ধরণীতে কীভাবে বাঁচবো, চাঁদ?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৫