অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৫

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৫
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বারান্দার নিস্তব্ধ পরিবেশে একা দাঁড়িয়ে আছে রামি। কাল আবিরের বাসায় যাবে সবাই। এরপর দিনই তাকে ডিউটিতে ব্যাক করতে হবে। মনের ব্যাপারটাকে সে আপাতত প্রশ্রয় দিতে চায়না। থাকুক কিছু অনুভূতি মন গোপনে। তবুও কীসের একটা টা*ন তাকে আঁকড়ে ধরে। অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। রামি অনেকক্ষণ পায়চারি করে। তার অস্থিরতা কমেনা। বারবার মানসপটে ছোট্ট থেকে হুট করে বড়ো হয়ে যাওয়া মেয়েটি ঘুরে বেড়ায়। তাকে কল্পনা করতেও ভীষণ ভালোলাগে। তবুও একটা বাঁধা এসে সামনে পড়ে। সেটা কি বয়সের পার্থক্য? কম হলেও তাদের বয়সের পার্থক্য ৯ বছরের।

সকাল সকাল বাসার ভেতর তোড়জোড় চলছে। পুরুষ সকলেই আবিরের বাসায় যাচ্ছে। সাথে ছোট্ট অমিও বাদ যায়নি। রামি নিজেও তৈরি হয়ে নিয়েছে। মিঠুও যাচ্ছে। গাড়িতে বসে মিঠু জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। কোন সমস্যা হয়েছে?”
রামি নিজেকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলো। মৃদু হেসে বলল,
“কোথায় নার্ভাস?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিঠুর তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে রামির কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেনি। বয়সের সাথে সাথে ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন এসেছে বেশখানিকটা। আগের মতো যখন যা ইচ্ছে হলো বলে দিলাম টাইপ স্বভাবটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন একটা কদম ফেলতেও মিঠু বেশ ভাবে। আলতো হেসে বলল,
“সেটা তোর কথা বলার ধরণই প্রকাশ করছে।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো রামি। মিঠুর কাছে অন্তত কিছু লুকানো যায় না। বলল,
“একটা ব্যাপার নিয়ে আমি খুব দ্বিধায় আছি।”

“হাতে সময় থাকলে আরেকটু ভাবা উচিত। আর সময় না থাকলে দ্বিধা কাটিয়ে যেকোন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”
রামি আপাতত এটাই করছে। সময় দিচ্ছে নিজেকে।
আবিরের বাসায় বেশ আপ্যায়ন হলো সকলের। অপছন্দ হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলেন না তরীর বাবা। রামি নিজেও কোন খুঁত দেখতে পেলনা। আপাতত এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা চললো। রামি তরীর বাবাকে বলল,
“আঙ্কেল আজই এনগেজমেন্ট নিয়ে কথা না তুললে হয়না? অরুর সাথে আরেকবার কথা বলা উচিত।”
তরীর বাবা বললেন,

“বিয়ে তো এখনই হচ্ছে না। শুধু এনগেজমেন্ট হয়ে থাকবে। অরুর পছন্দ বলেই তো আমরা এতদূর এগিয়েছি।”
রামি আর কথা বাড়ানোর মতো কিছু খুঁজে পেলনা। কথা হলো সামনের সপ্তাহে এনগেজমেন্ট হয়ে যাবে।
বাসায় এসে বিষয়টা অরুকে জানাতেই সে বাবাকে ফোনে জানিয়ে দিল,
“আমার এই সপ্তাহে কেন, এই মাসেও সময় হবে না। একদিনের জন্যেও সময় ম্যানেজ করা যাবেনা। এখন আমার পড়াশোনায় একটু চাপ আছে। তাছাড়া এনগেজমেন্ট বললেই তো হয়ে যাচ্ছে না। শপিং, প্রোগ্রাম এর জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া সব মিলিয়ে আমি এখন সময় পাবো না বাবা।”

বাবা অরুকে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। ফোন করলেন আবিরের বাসায়। তারা মানতে নারাজ। সামনের সপ্তাহে মানে সামনের সপ্তাহেই এনগেজমেন্ট হবে। অরুকে একদিনের সময় ম্যানেজ করে নিতে বললেন তারা। এবার তরী কথা বললো অরুর সাথে। অরুর বারবার একই কথা ‘সে এত তাড়াতাড়ি এনগেজমেন্ট করতে চায়না।’

অরু যতই মানুষটাকে বাইরে থেকে চিনুক, খুব কাছ থেকে কখনো চেনাজানা হয়নি আবিরকে। পূর্ব থেকে তার ভালো-মন্দ সব গুণ জানা প্রয়োজন। একটা মানুষের কখনোই সবগুলো ভালো গুণ থাকেনা। তবে আমরা যখন তাদের খা*রা*প অভ্যাস সম্পর্কে অবগত থাকিনা, তখন হুট করে তার খা*রা*প সত্তা সামনে এলে কষ্ট পাই। সাময়িক কিংবা দীর্ঘসময়ের জন্য মানুষটির প্রতি আমাদের মনে ঘৃ*ণা জন্মে। অরু চায়না তেমনটা হোক। সময় নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নিতে চায়।
পরদিন ক্যাম্পাসে আবিরের সাথে দেখা। বলল,

“তোমার সাথে কথা আছে অরু। সময় হবে?”
অরু বলল,
“আপনি কী নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি। আমার মনে হয় আমাদের দুজনেরই সময় নেওয়া উচিত। আমার একটা বা*জে অভ্যাস আছে। আমি প্রথমদিকে যাদের সাথে খুব সখ্যতা গড়ে তুলতে পারি, ঠিক মাসখানেকের মাথাতেই তাদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। প্রথম প্রথম আগ্রহ থাকলেও চিন্তাভাবনা পার্থক্যের কারণে আমার মনে বিরক্ত ঝেঁকে ধরে। এদের মধ্যে যে-কজন এই সময়ের মধ্যেও তাদের প্রতি আমার আগ্রহকে শক্ত হাতে ধরে রাখতে পারে, তাদের প্রতি আমার আসক্তি আজীবনের জন্য জন্ম নেয়। এতে দুজনের একে অপরের প্রতি জানাশোনাটাও হয়ে গেল৷ আশা করি বুঝতে পেরেছেন!”

আবির স্পষ্ট ভাষায় বলল,
“তুমি কি আমায় ওয়েটিং এ রাখতে চাচ্ছো? যদি তোমার সাথে আমার চিন্তাভাবনা না মিলে বা কোন কারণে আমার প্রতি তোমার আগ্রহ হারিয়ে যায়, তখন তুমি বিয়ে করবে না? জানাশোনার জন্য এনগেজমেন্ট থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত প্রচুর সময় আছে। এতটা দূর্বল লজিকের মানে বুঝলামনা।”
অরু খানিক হেসে বলল,

“দূর্বল লজিক কোথায়? এনগেজমেন্টের পর যদি আমাদের দুজনের যেকোন একজনের প্রতি বিরক্তি চলে আসে? যদি আমরা বিয়ে করতে না চাই? ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভেঙে যাওয়ার চেয়ে আমার মতামত কি ভালো না? আমরা আগে একে অপরকে ভালোভাবে জানি, তারপর সিদ্ধান্ত নিই!”
আবির বলল,

“তোমার সমস্যা আমি বুঝলাম না অরু। আমি অনেক কষ্ট করে পরিবারকে ম্যানেজ করেছি। তোমার বাসায় পাঠিয়েছি। এখন তুমি যদি আমায় রিজেক্ট করে দাও, তখন আমার সম্মানটা কোথায় থাকবে? তাছাড়া তুমি নিজেই আমাকে বিয়ের কথা বলেছিলে।”

“আমি একটা কথা বলেছি আর আপনি যাচাই না করে আমার সাথে কথা না বলেই বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেবেন? আচ্ছা সেটাও আমি মানলাম। আমি বিয়ের কথা বলায় আপনি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, তাই বলে আমাকে আপনার, সকলের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে? দুদিন পর যে আমার উপর আপনি বিরক্ত হবেন না তার কী নিশ্চয়তা আছে? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় কি?”
আবির উত্তেজিত হয়ে পড়লো।

“তোমার কথা শুনে আমার এখনই বিরক্ত লাগছে অরু। কথাটাকে সহজভাবে না নিয়ে কেন শুধু শুধু প্যাঁচাচ্ছো?”
অরু হাসলো। বলল,
“আমি এখনো কিছুই করলাম না। এতেই আপনি বিরক্ত। আমার বিশ্বাস, আপনি যখন আমায় পুরোপুরি জানবেন তখন এরচেয়ে বেশি বিরক্ত হবেন। ফিরতে হবে আমায়।”

অরু আবিরের প্রতুত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল। রা*গ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে আবির। তার যুক্তিটাও ফেলে দেওয়ার মতো না। অরুর কথাতেই সে পরিবারকে ম্যানেজ করেছে। এখন রিজেক্ট শব্দটা শুনলে পরিবারের কাছে তার ইমেজ খা*রা*প হবে। তবে অরু বিয়ের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস ছিল, সেটা অন্তত খতিয়ে দেখা উচিত ছিলো তার। নিজের এই ভুলটুকু চোখে পড়েছে তার।

ইদানীং সুহার সাথে একটু বেশিই দেখা হচ্ছে মিঠুর। হুটহাট দেখা। মেয়েটার চুল ঘন নয় আবার খুব পাতলাও নয়। কাঁধ ছাড়িয়ে তিন-চার ইঞ্চি নিচে ছড়িয়ে আছে সিল্কি চুল। রোজ শাড়ি পরে বের হতে দেখা যায়। সেদিনের পর আরও একদিন কথা হলো সুহার সাথে। কথায় কথায় জানতে পারলো মেয়েটা বিবাহিত। এর বাইরে পরিবার সম্পর্কে আর কিছুই জানেনা মিঠু। চলতি পথে দেখা হলেও কথা হয়না তাদের। মিঠু নিজের কাজ নিয়ে দৌড়ঝাঁপের উপর থাকে। আজও দেখা হলো। এ যেন নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্লিন শেভ শেষে মসৃণ গালে হাত ছুঁইয়ে দিলো রামি।
গোসল নিয়ে সাদা রঙের শার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। গলায় টাই। অফিশিয়াল ড্রেসে নিজেকে পরিপাটি করে হাতে ঘড়ি পরতে পরতে আয়নার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখেমুখে গম্ভীরতার ছাপ। বাড়িতে থাকা রামির সাথে এই রামির বিন্দুমাত্র মিল নেই। সম্পূর্ণ বিপরীত সত্তা। পরিপূর্ণ তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো। মা, ভাই-ভাবি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যে। অফিশিয়াল ছুটি শেষ। আগামীদিন থেকেই তার ফ্লাইং শুরু।

যাওয়ার আগে রামি অরুর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে বাড়িতেই রেখে গেল। জানেনা সে কতটা সফল হতে পারবে। তবে গতকাল বেশ ভেবেছে রামি। তার একপাক্ষিক একটা নড়বড়ে অনুভূতি দুটো পরিবারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নিজেকে দমিয়ে রাখলো।

ফ্লাইং এ সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে। সামান্যতম ভুল চোখে পড়লেই তার কাছে ওয়ার্নিং লেটার চলে আসবে। পরপর একই ভুল দুই থেকে তিনবার হলেই চাকরি থেকে বিনা নোটিশে বরখাস্ত হবে। অরুকে নিয়ে ভাবতে গেলেই কোন একটা অনর্থক হয়ে যাবে। রামি ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েও গভীরভাবে অরুকে মনে পড়লো।
আবিরের পরিবার মেয়ে চান শান্ত-ভদ্র। বিয়ের মতো এমন একটা ব্যাপারে মেয়ে লজ্জা না পেয়ে নিজের সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিচ্ছে। এ যেন সর্ব*নাশা কান্ড! বাবা-মা হম্বিতম্বি করছেন। আবির চুপচাপ সবকিছু হজম করে নিচ্ছে।

এখন মনে হচ্ছে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো ছিল। অরু সবকিছুতেই উদাসীন। তাকে একমাস সময় দেবে বলেও সে সময় দিচ্ছে না। প্রথম কয়েকটা দিন মোটামুটি সব ঠিক ছিল। ইদানীং দেখা করতে চাইলে তার ব্যস্ততা। রাতে ফোনে কথা বলতে চাইলে তার পড়াশোনা। গুণে গুণে বিশ দিন এভাবেই কে*টে গেল। ধৈর্যহারা হয়ে পড়লো
আবির। পরদিন অরুর ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় তার ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। অরু বের হতেই বলল,

“কথা আছে অরু। আজ অন্তত বাহানা দিও না।”
অরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“চলুন কোথাও বসি।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৪

আবির মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। একটা কফিশপে বসলো দুজন। আবির বলল,
“কী সিদ্ধান্ত নিলে? দেখ অরু, আমি কিন্তু হ্যাঁ শুনতে চাই।”
“আপনি একটা মি*থ্যা*বা*দী আবির।”

অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন ২ পর্ব ৬