প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৫

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৫
Writer Mahfuza Akter

তরীর নিস্তেজ, ক্ষতপূর্ণ দেহ বড্ড দুঃসহনীয় ঠেকছে সৌহার্দ্যের দৃষ্টিতে। লালাভ চোখ জোড়া লুকিয়ে, হৃদয়পূর্ণ অসহনীয় বেদনার ভার চেপে নিয়ে সৌহার্দ্য সন্তর্পণে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

সৌহার্দ্যের যাওয়ার সাথে সাথেই তরী ফট করে চোখ খুলে ফেললো। চোখের কোণে অতি কষ্টে এতক্ষণ জমিয়ে রাখা অশ্রুটুকু আপন গতিতে বেয়ে পড়লো। তরীর জ্ঞান বেশ কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। এতক্ষণ নিস্তেজ ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল সে। সৌহার্দ্য হয়তো বুঝতে পারেনি যে, তরী জেগে আছে। তাই নির্দ্বিধায় এই কথা বলে গেল। তরীর কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কথাটা,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“চাঁদ হয়ে সূর্যের চেয়েও এতো তীব্র উত্তাপ ছড়ালে! আমার পৃথিবী এভাবে ঝলসে দিলে! এখন আমি এই দগ্ধ ধরণীতে কীভাবে বাঁচবো, চাঁদ?”
সৌহার্দ্য কি জানে, তার মুখে এমন কথা শুনে তরীর সর্বাঙ্গ শিউরে উঠেছিল? জানে না বোধ হয়!

তরীকে দ্বিতীয় দিনই বাড়ি নিয়ে এসেছে সবাই। রায়হান সাহেব অনেকটা জোর দেখিয়েই বলেছিলেন তরীকে আহমেদ ভবনে উঠতে। আফনাদ হকও এ ব্যাপারে দ্বিমত করেননি। কীভাবে দ্বিমত করবেন তিনি? মোহনার কারণে নিজের মানটুকু তিনি রক্ষা করতে পারেননি।
সবাই রাজি হলেও শেষ মুহুর্তে তরীই নিজের বাড়িতে থাকার মনস্থির করে। নিস্প্রভ গলায় বলে,
“আমি কেন আহমেদ ভবনে থাকবো? কী পরিচয়ে থাকবো? আমি আমার নিজের বাড়িতে উঠবো!”

আফনা বেগম তরীর এমন কথায় কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেননি। চুপচাপ মেনে নিয়েছে সবাই তরীর ইচ্ছা। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে তরীর জীবন এতোটা দুর্বিষহ হয়ে পড়বে, সেটা কেউ আন্দাজও করতে পারেনি হয়তো!
তরী বাড়ি ফেরার পর থেকে মোহনাকে তরীর ঘরের আশেপাশেও না যাওয়ার আদেশ দিয়েছে আফনাদ। তরীর ঘরটা দোতলায়। মোহনা একারণে উঠানের এক কোণে থাকা সিঁড়িটার ধারেকাছেও ঘেঁষে না। তবে বাড়িতে দু’বেলা গ্রামের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। তরী ঘর থেকে বের হয় না এখন আর। হাঁটুতে আঘাতের কারণে হাঁটাচলা করতে পারে না সে তেমন।সুজাতা অথবা মালিহা সারাক্ষণ তরীর সাথেই থাকে। কিন্তু কতদিনই বা এভাবে ঘরবন্দী হয়ে থাকা যায়?

মালিহা বেশ শান্ত ও স্বাভাবিক আচরণ সেদিনের পর থেকে। ডক্টর সামিয়ার সাথে সেদিন তার কী কথা হয়েছিল, সেটা আজও কেউ জানে না। মালিহা কাউকে কিছু বলেনি। ইদানীং সে বেশ নীরব হয়ে গেছে। এই নীরবতা-ই আফনা বেগমের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
সৌহার্দ্য দিনে তিন-চারবার তরীর চেক-আপ করে যায়। তরী জহুরি চোখে তাকিয়ে থাকে সৌহার্দ্যের মুখের দিকে। কিন্তু সৌহার্দ্য তরীর দিকে একবারও তাকায় না। বিষয়টা তরীকে বেশ ভাবায়!

“শুনুন!”
সৌহার্দ্য তরীর প্রেশার চেক করছিল। হঠাৎ তরীর ডাক শুনে তার হাত থেমে গেল। কিছু মুহুর্ত থেমে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, ঘরে কেউ নেই। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তরীর কনুইয়ের ব্যান্ডেজ খুলতে খুলতে বললো,
“বলো!”

“আপনি আমার দিকে তাকান না কেন?” প্রশ্ন করে তরী নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দিকে।
সৌহার্দ্য মাথা নিচু করেই ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করে দিলো। নীরবে ঘর ত্যাগ করলো সে। তরী মলিন মুখে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। হয়তো তার মুখ দেখতেও ঘৃণা হয় সৌহার্দ্যের!
সপ্তাহ খানেক পর তরী বেশ সুস্থ হয়ে গেছে। আজ অনেক দিন পর ঘর থেকে বের হলো সে। কেন যেন আজ তার ইচ্ছে করছে মধুর সাথে দেখা করতে যেতে! তাই কাউকে কিছু না বলেই আহমেদ ভবনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল সে।

সব ব্যাচের একসাথে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ায় মেডিকেল কলেজের সবাই-ই এতো দিন বইয়ে মুখ গুজে ছিল সারা দিন-রাত। পড়াশোনার বাইরে কিছু বলার বা করার সুযোগই মেলেনি। আজ শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল মুগ্ধ! দ্রুত নিজের ফোন অন করে অরুণীকে কল দিলো। কিন্তু অরুণীর ফোনটা বন্ধ। হতাশ হলো মুগ্ধ! গোমড়া মুখে হাঁটা দিলো অরুণীর হোস্টেলের দিকে।
অরুণী পরীক্ষা শেষে দ্রুত হোস্টেলে ফিরেছে। লাগেজ সে গত রাতেই গুছিয়ে রেখেছিল যেন তাড়াতাড়ি রওনা দিতে পারে।

মুগ্ধ অরুণীর হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলো, অরুণী গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। হাতে বড় একটা লাগেজ। মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
অরুণীর চোখ মুগ্ধর দিকে পড়তেই চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“তুমি? এক্স্যাম শেষ হতে না হতেই আবার আমার পিছে পড়তে চলে এসেছো?”
মুগ্ধ অরুণীর কথা শুনলো কি শুনলো না কে জানে! সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ, এই দিনটার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি, জানো? সৌহার্দ্য দেশে ফিরেছে কতদিন হয়ে গেল! আর আমি এখনো ওর সাথে দেখাই করতে পারিনি শুধুমাত্র এই পরীক্ষার জন্য! আজ পরীক্ষা শেষ। এখন আমি নিশ্চিন্তে গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবো কয়েকদিন। শুধু থাকবো-ই না! আমি গিয়েই বড়আব্বুর সাথে কথা বলবো, যেন সৌহার্দ্যের সাথে আমার বিয়ে নিয়ে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্যই তোমাকে বলছি! আমার পেছনে ঘোরা বাদ দিয়ে নিজের জন্য নিজের চেয়ে কম বয়সী কোনো মেয়ে খুঁজে নাও। বুঝলে?”

অরুণীর কথা শেষ হতে না হতে মুগ্ধ অরুণীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য! দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ হাত উঠিয়ে অরুণীর মুখের ওপর পড়ে থাকা অবাধ্য চুলের গোছা কানে গুঁজে দিয়ে মলিন হেসে বললো,

“যা করার, করে নিন! তবে একটা কথা মনে রাখবেন! আপনি যদি আমার না হন, তাহলে বুঝবো যে আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল।”
মুগ্ধ আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে চলে। অরুণী থমকে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ ওকে ছুঁয়ে দিলো? ওর সামনে প্রথমবারের মতো ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিলো? অরুণীর অবিশ্বাস্য চোখ দুটো পলক ফেলতেই ভুলে গেছে যেন!

“এই ন*ষ্টা মেয়ে কীভাবে ঘর থেকে বের হইলো? হায়া-শরম কি কিছু আছে নাকি সবই উচ্ছন্নে গেছে?”
“ঠিকই কইছো! প্রথমে বিয়েটা ভাঙলো, তারপর আবার বাড়ি থেইকা সেই রাতেই পালাইলো। কার হাত ধইরা ভাগছিলো কে জানে? নিজের তো সব শেষ হইলোই! সাথে মা-বাপেরও নাককাটা গেল!”

রাস্তার আশেপাশে দাঁড়ানো লোকজন যে-ই তরীকে দেখছে, সে-ই এসব মন্তব্য করছো। তাদের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তরী। সবাই যেন তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই এসব কটূক্তি করছে! কান দুটো ভো ভো করছে। এসব কী হয়ে গেল তার সাথে? গায়ে এমন কলঙ্কের দাগ লেগে গেল! আবার সেটা সারা গ্রামে ছড়িয়েও গেল। ক্ষিপ্র গতিতে তরী পা চালিয়ে সকলের দৃষ্টির আড়াল হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই বিষাক্ত বাক্যস্রোত যেন তার কানের দিকে ধেয়ে আসছে!
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। তরী পুকুর পাড়ে এসে বসেছে সন্ধ্যার আগেই। নীরব, নির্জন এই জায়গাটায় বসে কতই না প্রেমালাপ করেছিল অর্ণব তার সাথে! কিন্তু সবই মিথ্যে ছিল। মানুষ কীভাবে এমন ছলনা করতে পারে? ভেবে পায় না তরী!

“আমি জানতাম, তুমি এখানেই থাকবে!”
থমথমে পুরুষালি কন্ঠটা কানে পৌঁছাতেই তরী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আজ ভরা পূর্ণিমা! চারপাশ চাঁদের আলোয় একদম স্পষ্ট। সৌহার্দ্যের ম্লান মুখটাও চাঁদের আলোয় অনেকটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে তরী। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরপায়ে সৌহার্দ্যের সামনে এসে দাঁড়ালো। সৌহার্দ্য আজ চোখ সরায়নি। এক দৃষ্টিতে তরীর দিকেই তাকিয়ে আছে। তরী নিস্পৃহ গলায় বললো,

“আপনি? এখানে কেন এসেছেন?”
“তুমি এখানে কেন এসেছো, চাঁদ? জানো, সবাই তোমায় খুঁজে না পেয়ে কত চিন্তা করছে?”
সৌহার্দ্যের রাশভারি গলায় বলা কথাগুলো তরীর কানে পৌছাতেই সে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আজ কতদিন পর সৌহার্দ্য তাকে ‘চাঁদ’ বলে সম্বোধন করলো!
“চলো তাড়াতাড়ি! রাত হয়ে গেছে। এই অসুস্থ শরীরে বাড়ির বাইরে এতক্ষণ থাকে কেউ?”
বলেই সৌহার্দ্য রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। তরী স্থির দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
“আমাকে দেখলে এখন বড্ড ঘৃণা হয় আপনার, তাই না?”

সৌহার্দ্য থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পা দু’টো আপনা-আপনিই থেমে গেল। রাতের নীরবতায় সৌহার্দ্যের ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ মিশে যাচ্ছে। তরী অনেকক্ষণ ধরে সৌহার্দ্যের উত্তরের আশায় চেয়ে রইলো। সৌহার্দ্য সময় নিয়ে তরীর দিকে ঘুরে তাকায়। চাঁদের আলোয় নিজের চাঁদের মুখটা মন ভরে দেখে। নীরবতা ভেঙে সৌহার্দ্য হঠাৎ বললো,
“আমার হৃদয়ে তোমার জন্য ঘৃণা রাখার বিন্দুমাত্র জায়গা নেই, চাঁদ!”
তরী শুকনো হেসে বললো,

“ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিতে ভয় পান?”
“ভালোবাসা মুখে প্রকাশের চেয়ে অনুভব করানোতে বিশ্বাসী আমি।”
“আমাকে কেন অনুভব করালেন না?”
“করিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি মোহগ্রস্ত ছিলে। অন্যের মোহে ডুবে গিয়েছিলে।”
সৌহার্দ্য খেয়াল করলো, তরীর চোখ দুটো পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো বেয়ে পড়ায় বাঁধা দিচ্ছে তরী। সৌহার্দ্য বললো,

“আমার সামনে কেঁদো না!”
তরী নাক টানলো। ধরা গলায় বললো,
“আপনি অন্যায় করেছেন, চাঁদের প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ না করে।”
সৌহার্দ্য আনমনে বললো,
“হয়তো!”
“আজও ভালোবাসেন?”

“হৃদয়ের পুরোটা জুড়েই যার বিচরণ, তাকে তো ভোলা যায় না কখনো!”
তরী ঢোক গিললো। মনে মনে বেশ কঠিন কিছু ভাবলো। সময় নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,
“যদি বলি আমি আপনাকে কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবো না! যদি বলি আমি নিজের সকল সম্মান ও পবিত্রতা হারিয়ে ফেলেছি! তবুও কি আপনি একই কথা বলবেন?”
তরীর কথা শুনে সৌহার্দ্য তার দিকে গভীর চোখে তাকালো। তরীর বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউ জেগে উঠছে। সৌহার্দ্যও নিশ্চয়ই এবার তরীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে! কে চাইবে এমন একটা মেয়েকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যেতে।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো। সৌহার্দ্যের শীতল চোখ জোড়া এখনো পলক ফেলছে না। পুকুরের পানির ঢেউয়ের কলকল শব্দ তরীর কানে বাজছে। সৌহার্দ্য কোনো কথা না বলায় তরীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সৌহার্দ্য হয়তো মুখের ওপর তরীকে কোনো নেতিবাচক কথা বলতে চাইছে না। এজন্য এমন চুপ করে আছে।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৪

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরী সৌহার্দ্যকে পাশ কাটিয়ে কয়েক পা এগোতেই সৌহার্দ্যের গলা শুনতে পেল,
“যেই সম্মান ও পবিত্রতা হারিয়ে ফেলেছো, সেই সম্মান ও পবিত্রতা ফিরিয়ে দেওয়ার অধিকার তবুও চাই। সকল তিক্ত সত্যির উর্ধ্বে গিয়ে তোমায় নিজের অস্তিত্বে ধারণ করতে চাই। আমি আমার চাঁদকে চাই। যত যা-ই হয়ে যাক! আমার ‘তুমি’ হলেই চলবে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৬