প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৬

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৬
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্য আর তরীর দিকে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে প্রহর। তার পাশে বসেই মনের ভেতর একরাশ উচ্ছ্বাস চেপে রেখেছে মুগ্ধ। মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে প্রহরের। কয়েক ঘন্টা আগের ঘটনাগুলো ভাবতে পারছে না সে!
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল প্রহর। তিনদিন আগে গ্রাম থেকে ফিরে আবার ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা শুরু করেছে সে। ব্যস্ততাও বেড়েছে কিছুটা।

গত কয়েকরাত নির্ঘুম কাটছে। হাতে একমগ গরম গরম কফি নিয়ে বিছানায় আরাম করে বসে ছিল প্রহর। এরই মধ্যে মুগ্ধ কয়েকবার ঢু মেরে গেছে ঘরে। মুগ্ধর চিন্তিত ভঙ্গি, ফ্যাকাসে মুখ ও ইতস্ততবোধ, সবটাই খেয়াল করেছে প্রহর। কিছু বলতে চাইছে মুগ্ধ, কিন্তু বলতে গেলে কোথাও আঁটকে যাচ্ছে। প্রহর আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। সে চাইছে, মুগ্ধ নিজে থেকে তার সাথে শেয়ার করুক।
ফোনটা থেমে থেমে বেজে উঠছে। ঘরে আবারো মুগ্ধর আগমন ঘটলো। সে একবার বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে, পুনরায় প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ভাইয়া! ফোন বাজছে তোমার!”
প্রহর ভাবনায় বিভোর থাকা অবস্থায়-ই বললো, “হু?”
“ফোন বাজছে তোমার!”
প্রহর প্রকৃতস্থ হয়ে নড়েচড়ে বসলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, সৌহার্দ্য কল দিয়েছে। প্রহর চটপট কল রিসিভ করে কানে লাগালো। ওপাশ থেকে সৌহার্দ্য তিক্ত গলায় বললো,

“কতগুলো কল দিয়েছি?”
“আরে ইয়ার! খেয়াল করিনি আমি। যা, সরি!”
“গ্রামে আয়। এক ঘন্টার মধ্যে।”
প্রহর হতভম্ব হয়ে বললো,
“আমার বাড়ি থেকে রেলস্টেশনে পৌঁছাতেই এক ঘন্টা লাগবে। আর এই সময়ে কী হয়েছে আবার?”
“সব ঠিক আছে। তুই আয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
প্রহর চিন্তিত মুখে ফোন কান থেকে নামাতেই মুগ্ধ ভ্রু নাচিয়ে বললো,

“তুমি গ্রামে যাচ্ছো?”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হ্যাঁ। এখনই বের হতে হবে।”
মুগ্ধ অকস্মাৎ বলে উঠলো,
“আমিও যাবো তোমার সাথে।”
প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধর উৎসাহী মুখটার দিকে।

ট্রেনে এসেও গ্রামে পৌঁছাতে দু’ঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেল প্রহর আর মুগ্ধর। পুকুরপাড়ের কাছাকাছি আসতেই সৌহার্দ্যকে দেখা গেল। সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে প্রহরের পাশে মুগ্ধকে দেখলো। কিন্তু তেমন ভাবাবেগ দেখালো না। এখন তার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে।
প্রহর কিছু বলবে এমনসময় সৌহার্দ্যের পেছনে তরীকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। একবার সৌহার্দ্য, আরেকবার তরীর দিকে বারবার চোখ বুলালো সে। নিজের কাধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে নিয়ে অবাক গলায় বললো,
“তোরা দু’জন এতো রাতে এখানে একসাথে কী করছিস?”
সৌহার্দ্য নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,

“তোর সাহায্য লাগবে একটু। এজন্য এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।”
তরী ভ্রু কুঁচকে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“অপেক্ষা? আমরা এতক্ষণ অপেক্ষা করেছি? আপনি তো বললেন…… ”
কিছু একটা বলতে গিয়েও তরী থেমে গেল। প্রহর সরু চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্যের মাথায় কী চলছে, সেটা সে জানে না। বুঝতেও পারছে না। তরীকেও কিছু বুঝতে দেয়নি এতক্ষণে সৌহার্দ্য। ঘনঘন পলক ফেলে শুধু এটাই ভাবছে প্রহর যে, সৌহার্দ্য তাকে কেন ডেকে আনলো?

অরুণী আহমেদ ভবনে পৌঁছেছে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। অরুণীকে এতোদিন পর দেখে শুধুমাত্র রায়হান সাহেব-ই খুশি হয়েছেন। সুজাতা আর আফনা বেগমের মুখে তেমন আনন্দের আভাস নেই।
অরুণী বাড়িতে প্রবেশ করতেই রায়হান সাহেবের সাথে সবার প্রথমে দেখা হয়। রায়হান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে অরুণী বললো,

“কেমন আছো, বড়আব্বু?”
“ভালো। কতদিন পর গ্রামে এলি! মাঝে মাঝে এসে দেখা করে গেলেও তো পারিস নাকি!”
“মধু রে! তেল কি গরম করছোস? আমার কোমর ব্যথায় যে নড়াচড়াও করতে পারতাছি না!” বলতে বলতে আফনা বেগম নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বৈঠক ঘরে উপস্থিত হলেন। তার চোখ গিয়ে পড়ে অরুণীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটার ওপর। অরুণী রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলছে,

“সৌহার্দ্য বাসায় নেই?”
আফনা বেগম মুখ ঘুচিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,
“কিসের সৌহার্দ্য? তোর থেকে বয়সে কম বড় সৌহার্দ্য? ভাই কইতে পারোস না?”
অরুণী চমকে আফনা বেগমের দিকে তাকালো। ইতোমধ্যে মধু আর সুজাতাও চলে এসে বৈঠক ঘরে। মধু অরুণীকে দেখেই মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তাকিয়ে রইলো। সুজাতা অরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“এতো দিনে মনে পড়লো! আমরা না-হয় তোমার তেমন আপন কেউ নই! কিন্তু তোমার নিজের মা-ও কি তোমার আপন কেউ না? আমার তো মনে হয় তোমার মা ম*রে-মিটে গেলেও কখনো খোজ নিয়ে দেখবে না! কেমন সন্তান তুমি?”
অরুণী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না সুজাতার কথায়। কিছু বললোও না। চুপচাপ নিজের লাগেজ নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

সৌহার্দ্য তরীর হাত ধরে সামনে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে প্রহর আর মুগ্ধও আসছে। তরী বুঝতে পারছে না, তারা কোথায় যাচ্ছে। এটা তো তাদের বাড়ির রাস্তা নয়! তাহলে?
সৌহার্দ্য একটা গেইটের সামনে এসে থামলো। গেইটের ওপর লাগানো নিয়নের আবছা আলোয় তরী বুঝতে পারলো, এটা মসজিদ। তরী হতভম্ব হয়ে বললো,

“ম….মসজিদ! এখানে কেন এসেছি আমরা?”
প্রহর আর মুগ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। সৌহার্দ্য এখানে কেন এসেছে?
সৌহার্দ্য তরীর দিকে নিবিড় চোখে তাকালো। হাত বাড়িয়ে তরীর কাঁধে ঝুলে থাকা ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে দিলো, ওড়নার একপ্রান্ত মাথায় টেনে দিয়ে বললো,
“তোমার হারিয়ে যাওয়া সম্মান আবার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে এসেছি।”
“মানে?”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“আমি জানি না তুমি কীভাবে আজ গ্রামের মানুষের ঐসব নোং*রা কথা সহ্য করেছো! আমি তো পারবো না তোমায় এসব সহ্য করতে দেখতে! আমার প্রিয় জিনিসে কেউ বারবার আঘাত করতে, অপমান করবে, অসম্মান করবে, আর আমি চুপচাপ দেখবো, এমনটা তো হয় না, তরী! তাই এখনই যথার্থ সময় তোমার প্রাপ্য সম্মান তোমায় ফিরিয়ে দেওয়ার। তরী নামের সাধারণ মেয়েটাকে অসম্মান করাতে মানুষকে তেমন বেগ পেতে হবে না, কিন্তু মিসেস সৌহার্দ্য রায়হানের দিকে তাকানোর আগেও কয়েকবার ভাবতে হবে সবাইকে!”

তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দিকে। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“নাহ্! এসব কী বলছেন আপনি? আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি যোগ্য নই আপনার!”
তরী দূরত্ব তৈরির আগেই সৌহার্দ্য দূরত্ব মিটিয়ে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে তরীর হাতটা চেপে ধরে বললো,

“আমার জন্য তুমি কী, সেটা নিয়ে তোমার কোনো ধারণা নেই, চাঁদ! নিজের সবটুকু আলো নিয়ে আমার দুনিয়া আঁধার করে দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি। এখন যখন তোমাকে আল্লাহ আবার আমার জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছে, তখন আল্লাহ’র দরবারেই তোমায় আজীবনের জন্য নিজের সাথে আবদ্ধ করবো আমি আজ। আমার পরিচয় তোমার হবে, আমার সম্মান তোমার হবে, আমার জীবনটাও তোমায় দিয়ে দেবো।”
বলেই সৌহার্দ্য তরীকে টেনে মসজিদের ভেতরে নিয়ে গেল। আঙিনায় বসে ইমাম সাহেব তসবিহ পড়ছিলেন। সৌহার্দ্যকে দেখে হাসি মুখে বললেন,

“চলে এসেছো! তোমার জন্যই এখনো গেইটে তালা ঝুলাইনি!”
ইমামের কথা শুনে সবাই বুঝতে পারলো, সৌহার্দ্য আগে থেকেই তাঁর সাথে কথা বলে রেখেছিলো। প্রহর সবটা হজম করতে হিমশিম খাচ্ছে। সৌহার্দ্য এমন কিছু করবে, সে কল্পনাও করতে পারেনি। প্রহরের পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ আপনমনে হাসছে। তার এই মুহুর্তে নাচতে ইচ্ছে করছে। সৌহার্দ্য আর তরীর বিয়েটা হয়ে গেলে, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে খুশি হয়তো মুগ্ধ-ই হবে!

ইমাম সাহেব এগিয়ে এসে তরী আর সৌহার্দ্যের গলায় দু’টো কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দিলো। পুরো মসজিদে কোনো মানুষ নেই। সৌহার্দ্য আর তরী বারান্দার মেঝেতে বসতে ইমাম সাহেব ধর্মীয়ভাবে বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিলেন। প্রহর আর মুগ্ধকে সাক্ষী হিসেবে রেখে সৌহার্দ্য আর তরী ধর্মীয় রীতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো।

সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। তরী সৌহার্দ্যের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। অর্ণব বলেছিল, তরী তার হাত ধরলে নাকি সেই হাত অর্ণব কখনো ছাড়বে না! কিন্তু জীবনের সবচেয়ে দূর্বিষহ মুহুর্তেই অর্ণব তার হাতটা ছেড়ে চলে গেল। এখন এই অসম্মানিত হাতটা কি সৌহার্দ্যের স্পর্শে পবিত্র হয়ে যাবে? বিক্ষিপ্ত জীবনটা কি কখনো সুন্দর হবে আর? তরী ভাবতেও পারছে না, এই অতিমাত্রায় সুদর্শন ও সুযোগ্য মানুষটা শুধুমাত্র তার। তাদের নাম আজ এক পবিত্র সম্পর্কে একত্রিত হয়ে গেল।

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৫

তরীর মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য বললো,
“আমার জীবনের সবটুকু সুখ তোমার হোক! আমার অস্তিত্ব তোমাতে বিলীন হোক!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৭