তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৮

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৮
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

পরের দিন আফিয়া বেগম কিছুক্ষণ পরে পরে নিচতলায় উঁকিঝুঁকি মেরে দেখেছেন বন্যারা বাসা ছাড়লো কিনা কিন্তু রাত দশটার পরেও যখন বাসার সামনে কোনো ট্রাক এসে থামলো না তখন উনি আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না।স্বামীর কাছে ছুটে গিয়ে বললো,
“ওরা তো বাসা ছাড়লো না।এখন কি করবো?”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।তারপর রয়েসয়ে বললো,

“বললেই তো বাসা ছাড়া যায় না।সময় লাগে।”
“এই সময় লাগার মাঝে যদি আবার কিছু হয়ে যায়?”
“তুমি এতো জাজমেন্টাল কেনো?ভালো কিছু ভাবতে পারো না?তাহসান তার পছন্দের কথা আমাদের জানিয়েছে এখন যদি এমন হতো যে না জানিয়ে একেবারে বিয়ে করে এসে জানাতো তখন কি করতে?”
আফিয়া বেগম মুখ অন্ধকার করে বললো,
“তুমি বন্যার পক্ষ নিচ্ছো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“নিচ্ছি।বন্যা ভালো মেয়ে আমার সমস্যা নেই।তাছাড়া মেয়ে যেহেতু ছেলে পছন্দ করে ফেলেছে কোনো আপত্তি থাকার কথাও না।”
“আমার আপত্তি আছে।”
তাহসান পিছন থেকে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে।আজ সারাদিন বন্যা তার সাথে কথা বলেনি।এইটুকুন সময়েই বুকে কেমন অশান্তির মাতাল বাতাস ছুটোছুটি শুরু হয়েছে সারাজীবন থাকবেনা ভাবলেই কেমন লাগে।যেভাবেই হোক মাকে মানাতে হবে।আফিয়া বেগম ছেলের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়ায় না।গাল ফুলিয়ে বললো,

“আহ্লাদ করছিস কেনো?মায়ের কথার দাম আছে নাকি?”
তাহসান নরম স্বরে বললো,
“তোমাকে আমি কতোটা ভালোবাসি তোমার ধারনা আছে?”
“ভালোবাসলে মায়ের কথা মেনে চলতি।”
“আম্মু।বন্যা ভালো মেয়ে।তুমি দেখো ওর মতো করে আমাকে আর কেউ ভালো রাখতে পারবে না।”
আফিয়া বেগমের মন নরম হয় না।উনি কঠিন গলায় বললো,

“এতো কথা জানি না।ওরা বাসা ছেড়ে যাওয়ার পরেই আমি তোর বিয়ে দিয়ে দেবো।এরপর দেখবি সব ভুলে যাবি।”
তাহসান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।তার কি একটুও মায়া লাগছে না?তাহসানের আবদার,ভালোলাগার কি কোনো দাম নেই?সে তারা মাকে ছেড়ে দেয়।গলার স্বর হয় রুক্ষ।
“বাসা ছেড়ে দিলে আমিও থাকবোনা এই বাসায়।”
আফিয়া বেগম ত্যাড়া গলায় বললো,
“না থাকলে বেরিয়ে যাবি।তোর মতো ছেলে লাগবে না।”
তাহসান তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

“আব্বু আপনি কিছু বলবেন না?”
মোবারক সাহেব ঠান্ডা গলায় বললো,
“তোমরা এমন পাগলামি করছো কেনো?”
আফিয়া বেগম খনখন করে বললো,
“পাগলামি করছি?এই বেয়াদব মেয়েটার জন্য তোমার ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুম কি দেয়।”
তাহসান মাথা নেড়ে বললো,

“হুম কি না সত্যিই আমি এই বাসায় থাকবো না।”
আফিয়া বেগম মাথা নেড়ে ইশারা করে বললো,
“যা এখনি বেরিয়ে যা।”
তাহসান হনহন করে নিজের রুমের দিকে যায় আর বলে,
“আচ্ছা।”
তাহসান ঠিক ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।নিঃশব্দে সব গুছিয়ে বেরিয়ে দেখে আফিয়া বেগম দাঁড়িয়ে কাঁদছে।তাহসান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“যাচ্ছি।”
আফিয়া বেগম ছুটে এসে বললো,
“কই যাচ্ছিস?”

তাহসান কথা বলেনা।আফিয়া বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।উনার একটামাত্র ছেলে।এই ছেলে যদি চলে যায় উনি নির্ঘাত ম,রে যাবেন রাগের মাথায় বাড়ি ছাড়তে বললেও আসলে আফিয়া বেগম কখনোই চায় না ছেলে বাড়ি ছাড়ুক।তাহসান মায়ের কান্নার সুযোগ বুঝে নরম গলায় বললো,
“বন্যা ভালো মেয়ে আম্মু।মেয়েটাকে আপন করতে দাও। প্লিজ। ”
এতোকিছুর পরেও যখন ছেলের মুখ থেকে বন্যার নাম সরলো না আফিয়া বেগম চুপ করে থাকে।তাহসান মায়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,

“ও দেখতে রাগী মনে হলেও আদতে মেয়েটা লক্ষী একটা মেয়ে।প্লিজ আম্মু রাজী হয়ে যাও।”
আফিয়া বেগম মাথা নেড়ে সায় দেয়।কিন্তু গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললো,
“রুমে যা।সকালে কথা বলবো।”
এটা বলে উনি রুমে চলে যায়।যদিও আফিয়া বেগম সরাসরি কিছু বলেনি তারপরও তাহসানের বুকে খুশীর লাড্ডু ফুটে।সে মনে মনে আরো কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।মাকে ইমোশনাল ভাবে আটকিয়ে কোনোভাবে বিয়েটা করতে পারলেই হলো,কেল্লাফতে।সে রুমে গিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়ে,মনে মনে ভাবে ইশ এই কোলবালিশটা কয়দিন পরে বন্যা হয়ে যাবে।ভাবতেই মাথা যন্ত্রনা করার মতো সুখ অনুভূত হচ্ছে।

ভোর সকালেই মোবারক সাহেব নিচতলায় গিয়ে বন্যার বাবার সাথে কথা বলতে গেলো।উনার কাছে বন্যাকে খারাপ লাগে না।ছেলে যদি পছন্দ করে থাকে তাহলে এতো কথার প্রয়োজন মনে করেন না।ছেলে সংসার করবে সেই যদি অতীত না ঘাটতে চায় তাহলে উনারা আগবাড়িয়ে কিছু করতে যাবেন কেনো?সেদিন আফিয়া বেগম বন্যার ফ্যামিলির সাথে যা আচরণ করেছে তাতে করে উনারা আর এই বাসায় থাকবে বলে মনে হয় না।এই মূহুর্তে উনারা যদি বাসা ছেড়ে দেয় তাহলে আগুন আরো লাগবে বৈ কমবে না।তাই উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাহসান আর বন্যার মতামতের গুরুত্ব দেবেন,তাদের ভালোলাগাকে সম্মান দিয়ে স্বীকৃতি দেবেন।মহিলাদের কথায় না নেচে উনি ভোর হতেই নিচে চলে গেছে।কলিংবেল দিয়ে মনের কথাগুলো আরেকবার ঝটপট সাজিয়ে ফেলেন।

দরজা খুলে মোবারক সাহেবকে দেখে রেনু বেগম চুপসে যায়।উনার মনের ভাব মোবারক সাহেব আবারো কথা শোনাতে এসেছে।
“ভাইসাহেব।আপনার ভাই এখনি বাসা খুজতে যাবে,কালকে সারাদিন খুঁজেও মনমতো হয়নি।একটা দিন সময় দিন।এতো আসবাবপত্র নিয়ে যেতে একটু টাইম লাগবে।”
রেনু বেগমের কাচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে মোবারক সাহেব মুচকি হাসেন তারপর আস্তে করে রেনু বেগমকে পাশ কাটিয়ে বাসায় ঢুকে পড়েন।বন্যা এতোক্ষণ ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে মোবারক সাহেবের কথা শুনছিলো।উনাকে ভেতরে আসতে দেখে সে রুমে চলে যায়।মোবারক সাহেব সোফায় বসতে বসতে বললেন,

“বাসা ছেড়ে দেবেন নাকি?”
রেনু বেগম কিছু বলার আগে শফিক ইসলাম আসে।আয়েস করে বসতে বসতে বললেন,
“না ছেড়ে উপায় কি?আপনারাই তো ছাড়তে বলে গেলেন।”
মোবারক সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“ওর কথা ধরে লাভ নেই।
আমাদের উচিত ছেলেমেয়ের সুখের কথা ভাবা।তারা যেহেতু নিজেরা পছন্দ করেই ফেলেছে আমাদের উচিত মান সম্মান রেখে মিল করিয়ে দেয়া।”

রেনু বেগম বললো,
“ভাবীর যা মনোভাব দেখলাম।আমি চাই না আমার মেয়ে শাশুড়ির অমতে তার সংসারে যাক।”
মোবারক সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বললো,
“তা ঠিক।কিন্তু আমার মনে হয় আফিয়াও মেনে নিবে।একটু সময় লাগবে এই যা।”
রেনু গম্ভীর গলায় বললো,
“মানবে! মানলে তো আপনার সাথে আসতো আসেনি যে।”
মোবারক সাহেব শান্ত গলায় বললো,
“আসবে।একদিন আয়োজন করে এসে বন্যাকে নিয়ে যাবো।”

সারাটা দিন আফিয়া বেগম তাহসানের সাথে কথা বললো না এমনকি দেখেও চোখ তুলে তাকালো না।তাহসান মায়ের এই নিশ্চুপতা দেখেও গম্ভীর হয়ে চলাফেরা করলো,সারাদিন কিছু খেলো না।ছেলে যে উপোস সেটা আফিয়া বেগমের দৃষ্টি এড়ায়নি।সারাদিন কিছু না বললেও রাতে আর চুপ করে থাকতে পারলো না।তাহসানের রুমে গিয়ে গম্ভীর গলায় তাহসানকে ডাকে।
“সারাদিন না খেয়ে অনশন করে কি বিয়ে করতে চাস?”
তাহসান মায়ের হাটুতে মাথা রেখে গলার স্বর যথাসম্ভব কান্নাকান্না ভাব এনে বললো,
“বন্যাকে বিয়ে না করালে ম,রেও যেতে পারি।”

আফিয়া বেগম তাচ্ছিল্য করে বললো,
“বাহ!দুই দিনের বন্যাকে পেয়ে এতো বছরের বাবা মাকে ভুলে যাবি?”
তাহসান মায়ের গালে হাত রেখে বললো,

“বাবা মা তো বাবা মায়ের জায়গায়।আর ভালোবাসার মানুষটা হলো মানুষিক শান্তি।দুটোই সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।”
আফিয়া বেগক দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে উনার স্বামী মোবারক সাহেব দরজার কাছে এসে দাড়িয়েছেন।সারাদিন উনি এই ব্যাপারে বুঝিয়েছেন,আফিয়া বেগম কিছুটা নরম হলেও মনে যে খচখচ আছে সেটা সম্পূর্ণ গেলো না।একমাত্র ছেলে যদি উল্টাপাল্টা কোনো কিছু করে ফেলে তাহলে?আফিয়া বেগম মনের সাথে যুদ্ধ করে তাহসানকেই জিতিয়ে দিলেন।যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক উনার ছেলে উনার সামনে হেসে খেলে থাকলেই হলো।স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“বন্যাদের বাসায় বলে দাও,তাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে আমরা কালকে সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট করতে যাবো।”
মোবারক সাহেব গম্ভীর গলায় বললো,

“আমি একা বললে হবে কেনো?উনারা মেয়ে বিয়ে দেবে,শাশুড়ী হলো ঘরের প্রধান শাশুড়িই যদি না যায় তাহলে বুঝবে তুমি রাজী না।”
অগ্যতা আফিয়া বেগমও বন্যাদের বাসায় যায়।মোবারক সাহেব খালি হাতে যেতে নারাজ।শুভ কাজ,শুভ কথা মিষ্টি না হলে চলবে?মিষ্টি এনে স্ত্রী সমেত বন্যাদের বাসায় যায়।

আফিয়া বেগমকে দেখে সবাই অবাক।বন্যা ভ”য়ে রুমে বসে আছে।আফিয়া বেগম সবাইকে চমকে দিয়ে বললো,
“আপনারা চাইলে আপনাদের বাড়ির মেয়ে আমার ঘরে নিয়ে যেতে চাই।”
রেনু অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছে।উনার চোখের ভাষা দেখেই আফিয়া বেগম বললো,
“আসলে সেদিন হঠাৎ করে এসব শুনে মাথা ঠিক ছিলোনা।আমি চাই আগের কথা মনে না রেখে আমরা সামনের দিকে যাবো।ছেলে মেয়ের মঙ্গল কামনা করবো।”

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৭

সবাই উনার কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়।তাহসান যেহেতু ভালো ছেলে,চেনাশোনা আছে বন্যার পরিবার আর অমত করলো না।ঠিক করা হয় আগামীকাল এনগেজমেন্ট করা হবে।আল্লাহ চাইলে আগামী শুক্রবার বিয়ে।

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৯