প্রেয়সী পর্ব ১৪

প্রেয়সী পর্ব ১৪
নন্দিনী নীলা

মধু তিন্নির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মধুর সম্পূর্ণ দৃষ্টি তিন্নির উপর। জ্বর এখন কমে এসেছে। টানা চারদিন জ্বরে ভোগে নেতিয়ে গেছে একদম। চারদিনের জ্বরেই তিন্নির গুলুমুলু দেহ অর্ধেক হয়ে গেছে যেন। মুখটা শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেছে। চোখ পাড় কালো হয়ে গেছে। তিন্নি ফোন থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল মধুর দিকে। এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মধুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,,,” ওই কি দেখস? ওমন ক‌রে তাকায় আছিস ক্যান?”

মধু বলল,,” তুই কত শুকিয়ে গেছিস রে।”
তিন্নি উজ্জ্বল ঝলমল গলায় বলল,,” সত্যি?”
মধু তিন্নির উজ্জ্বল মুখের দিকে হতবুদ্ধি চোখে চেয়ে বলল,,” এতে এতো খুশি হলি কেন?”
” তো খুশি হবো না। আমি তো শুকিয়ে কাঠ হতে চাই।”
মধু চোখ গোল গোল করে বলল,,” পাগল হলি নাকি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিন্নি গলার স্বর চেঞ্জ করে বলল,,”জানিস এই মোটা দেহের জন্য আমাকে সবাই রাহী আপুর থেকেও বড় বলে। অথচ তার থেকে আমি তিন বছরের ছোট। দেখতেও তো শ্যামলা আমি। রাহী আপু যেমন সুন্দরী আবার গায়ের গঠন ও পারফেক্ট। আমি সব দিক দিয়েই আন পারফেক্ট। জানিস আমাদের কলেজে সবাই আমাকে মোটা বলে উপহাস করতো। তুই ছাড়া তো আমার তেমন ভালো বেস্ট ফ্রেন্ড ও নাই। কলেজে সবাই আমার সাথে শুধু বন্ধুত্ব করতো স্বার্থের জন্য। আমি যে স্টুডেন্ট ভালো ওরা তাই সুবিধার জন্য বন্ধুত্ব করতো। কথা বলতো কিন্তু নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে বন্ধুত্ব করতে দেখিনি। একমাত্র তুই আমাকে কখনো উপহাস করিস নি। ফেসবুকে পরিচয় হলেও কত আপন হয়ে গেছিস।”

মধু তিন্নিকে জড়িয়ে ধরল। তিন্নির মনে এতো কষ্ট ছিল নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ও জানতো না। ওদের পরিচয় তো কয়েকদিনের নয়। এস‌এসসির পর পর বাবা ফোন কিনে দিয়েছিল ওকে। নতুন নতুন ফেসবুক খুলে দূরদূরান্তে মানুষের সাথে কথা বলতেই মজাই লাগত। নিজে থেকে অনেককে রিকোয়েস্ট দিতো আবার কেউ ওকে দিতো। এভাবেই তিন্নির আইডি পেয়েছিল। তিন্নি ওর করা সব ছবিতে লাইক কমেন্ট করতো। একদিন তো স্টুরি দেখে মেসেজ ও করেছিল।

প্রশংসা করেছিল ওর রুপের। তারপর থেকে একটা দুইটা কথা পরিচয় আদান প্রদান। সেইম ব্যাচ ওরা।‌ জানার পর থেকে কথা হতো। দীর্ঘ সময় দুজনে কথা বলতো নিজেদের জীবনে মজার কথা শেয়ার করতো। তিন্নির সাথে এরপর ভিডিও কলেও কথা হয়েছে। কোথাও বেড়াতে গেলেই দুজন দুজনকে ছবি দিতো কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করতো। এইভাবেই ফেসবুক ফ্রেন্ড থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেছিল।

” তোকে গুলুমুলু তেই মানায়। যেমন আছিস পারফেক্ট আছিস। অন্যের কথায় কষ্ট পাবি না। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে কখনো নিজেকে নিচু করবি না।”
তিন্নি নাক টেনে বলল,,” দোস্ত জানিস আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নাই।”
তিন্নির কথা শুনে মধু হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। তিন্নির গাল টেনে বলল,,” আহারে কি কষ্ট! বয়ফ্রেন্ড এর জন্য মরে যাচ্ছে রে। আমার ও তো বয়ফ্রেন্ড নাই। দেখ আজ বয়ফ্রেন্ড এর অভাবে পালিয়ে বান্ধবীর বাড়িতে চেপে বসেছি। বয়ফ্রেন্ড থাকলে হবু শশুর বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিতাম।”

মধুর ফোন বেজে উঠল। এই বিকেলে টাইমে কে কল করল। হাতে নিয়ে দেখল খালামনি কল করেছে। রাত ছাড়া তো কখনো কল করে না খালামনি।
তিন্নি গাল ফুলিয়ে বলল,,” দোস্ত আমার কি বয়ফ্রেন্ড হবে না?”
” না হবে না।” বলেই মধু ফোন রিসিভ করে বেলকনিতে চলে গেল।
পেছনে থেকে তিন্নি বলল,,” তুই বান্ধবী না শত্রু বলতো এভাবে হবে না বলতে পারলি?” কাঁদো কাঁদো গলায় তিন্নি বলল।
মধু আর উত্তর দিল না। ফোনে কথা বলছে ফিসফিস আওয়াজ আসছে। তিন্নি দুই মিনিট উত্তরের আশায় থেকে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকল।

মধু খালামনির ফোন কেটে বসে র‌ইল বেলকনিতেই। খালামনি বললেন ওকে নিজের কাছে নিতে চায়। মধু চমকে উঠেছিল তখন বাবা মা কে ফেলে দেশ ছেড়ে ভীনদেশে ও একটুও যেতে চায় না। কিন্তু খালার মুখের উপর কিছু বলতে ও পারেনি মধু। মধুকে তার ওখানে নিজের কাছে রেখে পড়াবে তারপর উপযুক্ত করে দেশে পাঠাবে। কি আজব চিন্তা ভাবনা। মধু নিজের মাকে ছেড়ে ভীনদেশে থাকবে কি করে। হঠাৎ বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল‌। কতদিন হয়ে গেছে মধু বাসার বাইরে মমতাময়ী মাকে ছাড়াই তো থাকছে। দিব্যি আনন্দ করছে। কিন্তু মা সে কি ভালো আছে? মধু মাকে কল করতে চাইল। বুকের ভেতর জ্বলছে একটু কথা‌ না বললে যেন ও মরেই যাবে। কল‌ দিল ফোন রিসিভ ও হলো।

মধুর বুকের ভেতর কাঁপছে। হাত পা কাঁপছে। আজ মায়ের সাথে কথা বলবে এমনটা ভেবেই কল করেছে। মধু ঢোক গিলে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ডেকে উঠল ‘মাম্মা’ বলে। অপরপাশে থেকে কোন আওয়াজ আসেনি। মধু কথা বলতেই গম্ভীর গলায় মধুর বাবা ফোনের অপরপাশে থেকে বলে উঠল,,” মধু?”
বাবার কন্ঠস্বর শুনে মধু থমকে গেল। ভয়ে ওর হাত পা থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। হাত থেকে ঠাস করে ফোনটা ফ্লোরে আছড়ে পরল। মধুর ফোন নিচে পরে আছে। কল এখনো কাটে নি। মধু চোখমুখে আতংক ছড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফ্লোরে পরে থাকা ফোনের দিকে।

তিন্নি কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে উঠে আসে। মধুর ফোন ফ্লোরে পরে আছে। মধু পাশেই দাঁড়িয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে। তিন্নি মধুকে ভয়ে কাঁপতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,,” কি হয়েছে মধু?”
মধু তোতলানো অস্ফুট স্বরে বলল,,” ফোন কাট।”
তিন্নি ফোন হাতে তুলে নিয়েছে। একটা নাম্বারে মিনিট উঠে আছে। কানে নিতে যাবে মধু কাঁপা হাতে টান দিয়ে ফোন কেটে দেয়।
” এতো ভয় পেয়ে আছিস কেন? কে ছিল কলে?”
মধু কথা বলছে না‌ এখনো ভয়ের রেশ যায়নি।
” তোর বাসার কেউ?”

মধু আতঙ্কিত মুখে তাকাল তিন্নির দিকে। মধু ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা বোঝাল।
” এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? উনি তোকে খোঁজে পাবে না।”
মধু ভয়ে কুঁকড়ে বলল,,” আমাকে আবার বাসায় ফিরতেই হবে সেটা আজ নয়তো কাল। তখন বাবা আমার কি হাল করবে তিন্নি ভাবতেই আমার শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। বিয়ে করব না বলে তো পালিয়ে এলাম। এইভাবে পালিয়ে আর কতদিন বা থাকব? ধরা তো দিতেই হবে।”
” তোর বাবাকে এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? বকবে বড়ো জোর চর থাপ্পড় দেবে‌। আর বিয়ের ভূত মাথা থেকে নামলেই ফিরে যাবি কাহিনী সলভ।”

মধু কিছু বলল না। তিন্নি অনেক কথা বলে ওকে সাহস দিয়ে ভয় কমানোর চেষ্টা করল। মধুর ভয় আস্তে আস্তে কেটে গেল।
মধু তিন্নির সাথে নিচে এসে টিভির সামনে বসল। সেখানে বসে আছে নাফিসা বেগম। তার সামনে পানের বাটি তিনি পান বানিয়ে মুখে পুড়ে নিলেন।উনি দেখতে সুন্দর। বয়স্ক ও লাগে না তেমন। কে বলবে উনার বড়ো বড়ো চারটা ছেলে? তিনি পান খেলে মধুর ভালো লাগে না। পান খাবে খুনখুনে বয়স্ক মানুষ। তিনি এতো স্মার্ট হয়ে কেন পান খাবে? কিন্তু তাকে ঠোঁট লাল করে পান খেতে দেখে মধু মাঝে মাঝেই ভাবে খান খেয়ে একটা সুবিধা আছে ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার প্রয়োজন হয় না ঠোঁট সব সময় লাল হয়েই থাকে।

তার এই অভ্যাস নাকি হয়েছে তার দাদি শাশুড়ির থেকে। তিনি নাকি পানখোর মানুষ ছিলেন। তাকে পান বানিয়ে খাওয়ানো তার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। তার কাছে বসলে সে নাকি তাকেও খেতে জোর করতো। তারপর একটাই অভ্যাস তিনি পান খাবে আর যার সাথে গল্প করবে থাকেও তার সাথে পান খাওয়াবে। কি আজব অভ্যাস। প্রথমে খেতে ভাল লাগতো না তার কিন্তু দাদি শাশুড়ি সঙ্গীকে ফান না খাইয়ে ছাড়তই না। তার কাছে বসে গল্প করলেই তাকে জোর করে বুঝিয়ে পান খাওয়াতেন।

খেতে খেতে একটা অভ্যাস হয়ে যায় তার। তারপর থেকে এতো তোষামোদ করতে হয় না‌। নাফিসা তার কাছে পান খাওয়ার লোভেই বসে যেতো। পানের মজা তিনি বুঝে গেলেন‌। খেতে তখন মন্দ লাগত না ভালোই লাগত আস্তে আস্তে সেটা এখন নেশায় পরিনত হয়েছে। পান বিহীন তিনি থাকতেই পারেনা। পান আর সিগারেট দুটো জিনিস নেশার মতো ধরলে আর ছাড়া যায় না।
মধু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে এই বাসার টিভিতে বেশিরভাগ সময় গান চলে।

দুনিয়ার যত পুরাতন নতুন শিল্পীদের গান আছে সব এই বাসায় চলে আর মধু এই কয়েকদিনে হাজার গান ও সিঙ্গারদের দেখেছে। দেখতে দেখতে মুখস্থ করে ফেলেছে। এরা এতো গান শুনে কেন তিন্নির থেকে জানতে পেরেছে। নাফিসা বেগম এক কালে গান গাইতেন। এখন গান গাইতে পারেন না। সংসার ফেলে তাই শুনেই মন ভরে। মধুর খুব তার গলার গান শুনতে ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু বলার মতো সাহস নাই। চুপচাপ বসে দুনিয়ার খবর ভাবছিল। তখন কলিং বেল বেজে উঠে। কাজের মহিলা দরজা খুলতেই ফুয়াদের দিকে নজর আটকায়। একটা চেক শার্ট পরে আছে চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। মধু এক পলক তাকিয়ে নিজেকে লুকানোর ট্রাই করল তিন্নির শরীরের আড়ালে। পারল কিনা জানে না কিন্তু ফুয়াদ একবার এদিকে তাকিয়ে ছিল। মধু তখন মুখ লুকিয়ে রেখেছিল তিন্নির পিঠে।

ফুয়াদ চলে যেতেই মধু মাথা সোজা করে বসল।
সেদিনের পর থেকে আর ফুয়াদের মুখোমুখি হয়নি। হলেই লুকিয়ে পরেছে। আগে থেকেই ফুয়াদের প্রতি ওর ভয় আর সেইদিন থেকে তো ভয়ে আরো বেড়েছে সামনে দাঁড়াতে পারেনা। লোকটার যা রাগ না জানি কি করে বসে। ও ভয়ে আছে কবে জানি বাসা থেকে বের করে দেয়।

সেইদিন আল্লাহ তাআলা সহায় ছিল নিচে সমুদ্র কে পেয়ে গেছিল মধু। পেয়ে সেকি খুশি সমুদ্রের কাছে গিয়ে আবদার করে বসল।
” আমি আপনার সাথে যাব।”
সমুদ্র বসে ছিল হঠাৎ মধুর কথা শুনে চমকে তাকায় ওর দিকে। কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,” কোথায় যাবে আমার সাথে?”

মধু থতমত খেয়ে এদিকে ওদিকে তাকায়। রাহী ও এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। সমুদ্র কে দেখে মধু রাহী কে ফেলেই ছুটে এসেছে। সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আসায়।
মধু মুখ কাচুমাচু করে বলল,,” বাসায় ফেরার কথা বলছি। আপনি নাকি আগেই চলে যাবেন। তাই আপনার সাথে আমিও যাব।”
” আগেই যেতে চাইছিলাম কিন্তু ফাহাদ বাথরুমে দৌড়াচ্ছে। বেশি খেয়ে এখন অসুস্থ হয়ে গেছে।”
মধু কি বলবে বুঝতে পারছে না।

” তাহলে আপনি কি যাবেন না?”
” হ্যা যাব। যাব না কেন? তুমি আর রাহী ফুয়াদের সাথে আসতে পারবে। আমি ফাহাদ আর চাচা চাচিকে নিয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু ফাহাদ তো ঝামেলা করে ফেলল।”
” আমি আপনার ভাইয়ের সাথে যাব না।”
সমুদ্র কপাল কুঁচকে বলল,,”কেন সমস্যা কোথায়?”
রাহী উত্তর দিল,,” ভাই মধু তো ফুয়াদ ভাইয়ের ভয়ে তার সাথে যাবে না বলছে।”
” ভয়? কেন মধু ভয় পাচ্ছ কেন?”

রাহী সব খুলে বলল সব শুনে সমুদ্রের হো হো করে হেসে উঠল। সমুদ্রের হাসি দেখে মধুর খুব লজ্জা লাগল।‌ লজ্জা মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরল।
মধু নিচু করে আবার বলল,,” আমি উনার সাথে যাব না প্লিজ আপনার সাথে যাব।”
সমুদ্র হাসি থামিয়ে বলল,,” আচ্ছা চলো তাহলে। ফাহাদ ফুয়াদের সাথে আসবে নি।”

প্রেয়সী পর্ব ১৩

ফাহাদ আর রাহী কে রেখে ওরা চলে এসেছিল।
তারপর তিনদিন চলে গেছে। মধু নিজেকে ফুয়াদের থেকে দূরে রেখেছে। যেচে বিপদের সামনে যেতে চায় না।

প্রেয়সী পর্ব ১৫