তান্ডবে ছাড়খার শেষ পর্ব 

তান্ডবে ছাড়খার শেষ পর্ব 
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

বিয়ের আর মাত্র দু’দিন বাকি।বিয়ের সব কেনাকাটাই ইতোমধ্যে শেষ।বন্যা সব নিজের পছন্দে কিনেছে।যদিও আফিয়া বেগম প্রথমে রাজী হয়নি কিন্তু তাহসানের আর তাহিয়ার পিড়াপীড়িতে রাজী হয়েছেন।
বন্যা ভার্সিটিতে থাকাকালীন তাহসান বন্যাকে ফোন দেয়।মিহি গলায় বললো,

“আর ভালো লাগে না।”
“কেনো?”
“অসুখ করেছে,আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
বন্যা হেসে বললো,
“তাই!আপনার ওষুধ আমার কাছে।”
তাহসান বন্যার কথায় হাসে।
“ওষুধ নিয়ে বসে আছে আর এখানে যে রোগী ছটফট করে মা,রা যাচ্ছে সে খেয়াল আছে?”
“আছে,আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”
তাহসান হতাশ গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“শুক্রবার আসতে আর যানো কয়দিন বাকি?”
“মাত্র দুইদিন জনাব।”
“তুমি দিনদিন মিষ্টি হয়ে যাচ্ছো।”
“আপনার বউ হবো যে তাই।”
“আমার লক্ষী বউটা।”
তাহসানের মুখে বউ ডাক বন্যার বুকে মাতাল করা ঝড় তুলে।ঘন হয়ে আসে গলার স্বর।
“আবার বউ বলেন না।”

তাহসান চুপচাপ বন্যার আবদার পূরণ করে।আজকাল মেয়েটা তার কাছে যতো পাগলামিময় আবদার করে আর সেও বিনাসংকোচে সব আবদার পূরণ করে।
“বউ,ও বউ।”
বন্যার সুখ সুখ লাগে।সুখে চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
“আরেকবার প্লিজ।”
“আমার সোনা বউ,টুকটুকি বউ।”
বন্যা ফিসফিস করে বললো,
“ভার্সিটি থেকে ফিরার পরে রাতে ছাদে যাবো,তারপর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন তো।আপনাকে জড়িয়ে ধরে আমার মন ভরে না।”
“আচ্ছা।”
তারপর বন্যা ফিসফিস করে বললো,

“তারপর আমাকে অনেকগুলো চুমু দেবেন,আপনার ঠোঁটের স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে,আপনার সাথে থেকে আমি খারাপ হয়ে যাচ্ছি,ধ্যাৎ।”
“এখন চলে আসি?আজকে ভার্সিটিতে ক্লাস করতে হবে না।”
বন্যা মাথা নেড়ে বললো,
“না না।আজকে আমার ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে।”
“আচ্ছা।বাসায় এসে ফোন দিও।রাখছি।”
বন্যা ঘন গলায় বললো,
“ভালোবাসি হৃদয়পুরুষ।”
তাহসান হেসে বললো,
“আচ্ছা।”

তারপর বন্যা এক অভাবনীয় কাজ করে ফেললো।মোবাইলের স্কিনে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে চুমু দিয়ে বললো,
“আজকে কেনো যে আপনাকে এতো ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে বুকে পুরে নেই।”
বন্যার কথা শুনে তাহসানের বুকে তোলপাড় হয়।ফিসফিস করে বললো,
“এখনি আসি প্লিজ।”
বন্যা ফিক করে হেসে বললো,
“জ্বি না।রাতে আসবো।”

তাহসানের আজকে কেমন ছটফট লাগছে।বুকে কেমন অচেনা জ্বালাপোড়া হচ্ছে।কোনোভাবেই সে স্থির থাকতে পারছে না।বিকালের দিকে আসরের নামাজ পড়ে মনের শান্তির জন্য আরো দুই রাকাত নফল নামায পড়ে।মোনাজাতে না চাইতেও কেনো জানি কান্না চলে আসে,বুক ফেটে যায় কান্নায়।আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বললো,
“আল্লাহ!আল্লাহ গো।আমার এই অশান্তির কারণ কি আমি জানি না।মানুষ বলে শরীর এমন জ্বালাপোড়া করলে নাকি প্রিয় কিছুর ক্ষতি হয়।আল্লাহ আপনি আমার প্রিয় জিনিস হেফাজতে রাখবেন।আমার মনে শান্তি দিন।নবীর উম্মত হিসেবে আপনার দরবারে হাত উঠিয়েছি খালি হাতে ফিরিয়েন না।আপনি দয়ালু,আমার সৃষ্টিকর্তা।”

নামাজ পড়েও তাহসানের শরীর শান্ত হয় না।না চাইতেও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করে বন্যাকে ফোন দেয়।কিন্তু তাকে নিরাস করে ফোন সুইচড অফ ঘোষণা করে।ঘড়িতে সময় প্রায় পাঁচটা এতোক্ষণে বাসায় চলে আসার কথা।সে দ্রুত পা চালিয়ে বাসায় আসে।বন্যাদের বাসার কলিং বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।রেনু বেগম দরজা খুলে জানায় বন্যা আসেনি।তাহসান অগ্যতা বাসায় যায়।সিদ্ধান্ত নেয় বন্যা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
বিকাল তিনটা।বন্যা আজকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়।উদেশ্য নিউমার্কেট যাবে।তাহসানকে একটা ঘড়ি উপহার দেবে।তাহসানের হাতে ঘড়ি খুব মানায়।ভার্সিটির গেইট দিয়ে বেরিয়ে সামনে গিয়ে রিকশার জন্য দাঁড়ায়।তখনি হঠাৎ কেউ তার মুখ চেপে ধরে বললো,

“হাতের জোর কমছে না এহনো আছে।থাক হাতের জোর লাগবো না,গতরে জোড় হইলেই হইবো।”
বন্যা ছোটার জন্য ছটফট করে কিন্তু ততক্ষণে কয়েকজন মিলে বন্যাকে ঠেলে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলে।তার মুখে এতো জোড়ে চেপে ধরেছে যে চিৎকার করবে দূরের কথা ঠিকমতো শ্বাসও নিতে পারছেনা।এদের সাথে তার কি শত্রুতা কিংবা কি কাজ বন্যার মাথায় আসে না।সে হাত পা নেড়ে নিজেকে ছাড়াতে চায়।এক মোটা করে লোক বন্যার স্তনে হাত ভুলিয়ে বললো,
“মাম্মাহ মালটা খাসা।শক্ত কইরা হাত পা চাইপা ধর।বাসায় নিয়া তেল ঊঠামু।”

লোকটার স্পর্শে বন্যার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে।ঘৃণায় রি রি করে উঠে মস্তিষ্ক।সামনের লোকটাকে এতোক্ষন না চিনলেও এখন চিনতে পারছে।সেদিন তিন্নির গায়ে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিলো আর বন্যা প্রতিবাদ সরূপ থাপ্পড় দিয়েছিলো।সেই থাপ্পড়ের সূত্র ধরে যে তাকে ধরে নিয়ে যাবে সেটা বন্যা কম্পনাও করেনি।কথাবার্তায় যা বুঝার সে বুঝে গেছে,ভ,য়ে কলিজা মুচড়ে উঠে।আবারো সেই কালো রঙ তাকে মাখিয়ে দেবে।

বন্যা গাড়ির সবাইকে লক্ষ করে।তেরোজন একটা হাইএক্স গাড়িতে বসে আছে।সবগুলো চোখে লুলুপ দৃষ্টি,বন্যার চোখ ফেটে পানি আসে।ইতোমধ্যে একজন বুকে হাত দিচ্ছে।সে চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকে।আজকে কি সে রক্ষা পাবে?তাহসানের বুকে কি যাওয়ার ভাগ্য হবে?তার কিছু হলে তাহসান পাগলই হয়ে যাবে।ততক্ষণে গাড়ি নিরিবিলি এক রাস্তায় প্রবেশ করেছে।হঠাৎ গাড়িটা একটা পাঁচতলা বাড়ির সামনে থেমে যায়।সবগুলো ছেলে বেরিয়ে বন্যাকে ঠেলে ভেতরে নিয়ে যায়।দারোয়ান জিজ্ঞাস্য চোখে তাকালেও কেউ পাত্তা দেয় না।তাকে পাঁচতলায় এক ফ্লাটে নিয়ে যাওয়া হয়।সেদিনের লোকটা বন্যার শার্টে হাত দিয়ে বললো,

“সেদিন বেশী জোড় হইয়া গেছিলো পাখি?আসো আজকে আমার জোড় দেখাই।”
বন্যা তখন কাঁদছে।কাঁপা গলায় বললো,
“ভাই,আমারে ছেড়ে দেন।আমি আর জীবনেও কাউকে থাপ্পড় দেবো না।”
বন্যার কথা শুনে সবাই অট্টহাসি হাসে।
“ছাড়লে এই সবার খিটা কে মিটাবে?আজকে তোর সারাজীবনের জ্বালা মিটিয়ে দেবো।সারাজীবন আর ছেলেদের কাজ লাগবে না।”

“আপনাকে আমি ভাই ডাকতেছি প্লিজ আমার এতো বড়ো ক্ষতি করবেন না।ভাই আমার বিয়া ঠিক হয়ে আছে।”
“তাই নাকি!তাইলে তো ভালোই তোমার জামাই সারপ্রাইজ পাইবো।”
বন্যা সারা বাসায় ছুটাছুটি করে নিজেকে বাঁচাতে চায় কিন্তু সবগুলো ছেলে হায়েনার মতো টেনে,ছিড়ে তার কাপড় খুলে দেয়।নিজের এই অবস্থা দেখে বন্যা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কিন্তু পশুর কি মায়া আছে?নেই। বন্যা কাতর গলায় তাহসানকে ডাকে।

“তাহসান।তাহসাননন।অ- তাহসান,আমারে বাঁচাও।আমি বাঁচতে চাই,তোমার সাথে।”
চিকন করে একটা ছেলে বন্যার গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“খান*কি আমাদের তাপে হয় না নাকি,আবার ভা,তাররে ডাকোস।এতো তেজ,এতো!”
তারপরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক।তেরোজন ছেলে পর্যায়ক্রমে বন্যাকে ধর্ষণ করে।ভিষণ যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে।শরীরে খুদা নেই কোন মানুষের?কিন্তু সেই মিলন তো তখনই আনন্দ দেয় যখন মানুষটা যত্নের হয়,প্রিয় হয়।এই মিলনটা হওয়ার কথা ছিলো তাহসানের সাথে কিন্তু কি হলো?বন্যার সাথেই কেনো এমন হয়?শরীরের সব শক্তি যেনো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে গেছে।চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে।তার কপালে আল্লাহ এসব অমানুষ দের কেনো দিচ্ছেন?প্রচন্ড যন্ত্রনায় বারবার তাহসানকে মনে পড়ছে।বারবার ফিসফিস করে বলছে,

“আম্মা,আব্বা আমারে বাঁচাও।অ আম্মা।তাহসান কই তুমি?আমাকে নিয়ে যাও না।কষ্ট হচ্ছে।অহ!তাহসান।”
বন্যা সামান্য হাতও নাড়াতে পারছে না।তাকে চেপে ধরে রাখা হয়েছে,সাথে চড় থাপ্পড়,অশ্রাব্য ভাষায় গালি।বিকাল চারটা থেকে রাত দশটা অবধি পালাক্রমে একজনের পর একজন বন্যাকে ধর্ষণ করে।বন্যা মাথা নেড়ে বলল,
“ভাই,আমারে ছাইড়া দেন ভাই।আমি কাউকে কিছু বলবো না ভাই।আমারে ছাইড়া দেন।”
ছেলেগুলো তখন কাপড় পড়ছে।মোটা করে লোকটা বললো,

“কিরে ছাড়মু নাকি খতম কইরা দেমু?”
খতম করার কথা শুনে বন্যা মিনতি করে বললো,
“ভাই,মা,ইরেন না আমারে।জান ভিক্ষা দেন।আমি কাউকে কিছু বলবো না।”
একজন হেসে বললো,
“না মারলে আরেক রাউন্ড……”

ছেলেটার কথায় সবাই সম্মতি দেয়।আবারো ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠে।মোটা করে লোকটা ভিষণ জোড়ে বন্যার তলপেটের সাত আটটা লাথি মারে।মেয়েদের তলপেটে আঘাত করা মানে তাকে অর্ধেক মে,রে ফেলা।বন্যার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।ভিষণ যন্ত্রনায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে।একসময় সে জ্ঞান হারায়,জ্ঞান হারানোর আগে ফিসফিস করে বললো,
“তাহসান তোমার কাছে যাবো।”

সন্ধ্যার পরেও যখন বন্যা বাসায় আসে না তখন তাহসান বেড়িয়ে পড়ে।সোজা বন্যার ভার্সিটিতে যায়।সেখানে তখন কেউ নেই।তারপর তিন্নিকে ফোন করে জানতে পারে বন্যা সেই দুপুর তিনটায়’ই বেরিয়ে গিয়েছিলো তারপর আর যোগাযোগ হয়নি।বন্যা যেখানে যাবার কথা সব যায়গায় খুঁজে কিন্তু কোথাও পায় না।ইতোমধ্যে বন্যার বাবাও আসে।দুজনে মিলে খুঁজে কিন্তু কোনো হদিস পায় না।

ততক্ষণে রাত দশটা বেজে গেছে।তাহসানের বুকটা ভয়ে হাপড়ের মতো লাফাচ্ছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।বন্যা বাসায় ফিরতে এতো রাত কখনো করে না।সবাই মিলে থানায় গিয়ে রিপোর্ট করে আসে।রাত দশটা থেকে ঘড়ির কাটা নেচে নেচে বারোটায় যায় কিন্তু কোনো খবর পাওয়া যায় না।তাহসানের মনে যতো খারাপ চিন্তা আসছে, সে মনকে বুঝায় বন্যা ঠিক আছে।কিন্তু মন এই স্বান্তনা মানতে নারাজ। ভ,য়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।না চাইতেও চোখ ভরে পানি আসছে।

বিল্ডিংয়ের দারোয়ান রাত দশটা থেকে দোটানায় ভুগছে।এই বাড়িটা এক আমেরিকান প্রবাসীর।উনি দেশে থাকেন না দেখাশোনা করে এলাকার এক প্রভাবশালী লোক।আর বিকালে আসা ছেলেগুলো হলো একটা ওই লোকের ভাগিনা আর বাকিগুলো বন্ধু।কেউ সচরাচর এই বাসায় থাকে না কিন্তু আজকে এমন দলবল নিয়ে আসাতে উনি বেশ অবাক হয়েছিলেন আর সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন সাথে একটা মেয়ে দেখে।

মেয়েটাকে দেখেই বুঝে গিয়েছেন যে জোর করে এনেছে কিন্তু উনি কিছু বলার সাহস পায়নি।বাড়িওয়ালার ভাগিনাটা একটা বেয়াদব, কিছু বললেই গায়ে হাত তুলে ফেলে।উনি ব্যাপারটা এতোটাও ঘাটায়নি কিন্তু রাত দশটার সময় সব ছেলেপেলে বেরিয়ে গেলেও মেয়েটা অনুপস্থিত তখন চিন্তা হয়।উপরে যাবেন কি যাবেন না এটা ভাবতে ভাবতে এগারোটা পেরিয়ে যায় তারপর আর নিজেকে আটকাতে না পেরে উপরে আসে।

ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে উনার চোক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটা মেয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে।উনি কি করবেন বুঝে পায় না,বিছানা থেকে চাদর এনে মেয়েটাকে ঢেকে দেয়।মেয়েটার থেকে কিছুটা দূরে একটা ব্যাগ পড়ে আছে।উনি ব্যাগ হাতড়ে একটা মোবাইল পায়।কিছু লেখাপড়া জানে বিধায় বন্ধ মোবাইল খুলে ইমারজেন্সি বাটন প্রেস করে একটা নাম্বার পায় কিছু না ভেবে ফোন দেয়।

তাহসানের ফোনটা তীক্ষ্ণ স্বরে চেচিয়ে উঠে।ফোনটা হাতে নিয়ে বন্যার নাম্বার দেখে চেচিয়ে সবাইকে বলে ‘বন্যা ফোন দিয়েছে।’সবাই তার কাছে ছুটে আসে।সে ফোন রিসিভ করে বললো,
“বন্যা তুমি কই?ফোন বন্ধ ছিলো কেনো?”
দারোয়ান বললো,
“আপনি কি উনাকে চিনেন?”
অপরিচিত পুরুষের কণ্ঠ শুনে তাহসান থমকে যায়।
“আপনি?”
দারোয়ান বাসার ঠিকানা বলে বললো,
“আমার ঠিকানা পড়ে নিয়েন আগে তাড়াতাড়ি আসেন।”

তারপর সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় ঠিকানামতো,যাওয়ার আগে পুলিশকে খবর দেয়।সবার আগে তাহসান প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে পাঁচতলায় উঠে যায়।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে তাহসান স্তব্ধ হয়ে যায়।বন্যা সম্পূর্ণ শরীর চাদরে ঢেকে ফ্লোরে শুয়ে আছে।পাশে একজন মধ্যবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে।তাহসান হাটুমুড়ে বসে বন্যার হাত স্পর্শ করে।তার বুঝতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না বন্যার সাথে কি হয়েছে।রেনু বেগমসহ বাকিরা এসে মেয়ের এই করুন পরিনতি দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে।তাহসান সবাইকে শান্ত হতে বলে,রেনু বেগম বন্যাকে
কাপড় পড়ায়।তাহসান বন্যাকে পাজকোলা করে দ্রুত সিড়ি দিয়ে নামে।সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাহসান ঝরঝর করে কেঁদে দেয়,ফিসফিস করে বললো,

“বন্যা,এই।তোমার কিচ্ছু হবেনা।শুনতে পাচ্ছো আমাকে?”
বন্যা শুনে না।সিএনজিতে করে বন্যাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।সারাটা পথ তাহসানের বুকে ছিলো।তাহসানের সারা শরীর কাঁপছিলো থর থর করে।সে বন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো কিন্তু এভাবে তো না।হাসপাতালে গিয়ে বন্যাকে ডাক্তারের হাতে সমর্পণ করা হয়।তাহসান এখন আর লুকিয়ে কাঁদছে না।সবার সামনেই কাঁদছে।আফিয়া বেগম ছেলের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়।পাশে গিয়ে মাথায় হাত রাখলে তাহসান বাচ্চাদের মতো কেঁদে বললো,
“আমার বন্যা আম্মু।কি হয়ে গেলো।ওরে ছাড়া আমি বাঁচবোনা।”

আফিয়া বেগম কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না।কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বেরিয়ে আসে।জানায় বন্যার প্রচুর রক্ত গিয়েছে।তাছাড়া তলপেটে বোধহয় কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে যা ঘোরতর।আশংকা করা হচ্ছে ভিষণ গুরতর। আল্ট্রাস্নোগ্রাফি করার পরেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।।আপাতত উনার জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান ফিরেছে শুনে সবাই ছুটে গেলো।বন্যা অনেক কষ্টে চোখ খুলে রেখেছে।রেনু বেগম চিৎকার করে কান্না শুরু করলে ডাক্তার সবাইকে বের করে দেয়।তাহসান দুই মিনিট থাকার অনুরোধ জানায়।তাহসানের অবস্থা হাসপাতালের প্রত্যেকটা মানুষের নজরে পড়ে। সবাই চলে গেলে তাহসান ফ্লোরে হাটুগেড়ে বসে।তাহসানকে দেখেই বন্যার ঠোঁট কেঁপে উঠে,চোখের পাতা নড়ে।তাহসানের চোখেও পানি।বন্যা ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয়।

“তাহসান।”
তাহসান বন্যার হাত মুঠোয় নিয়ে বললো,
“বেশী খারাপ লাগছে?”
বন্যা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।
“ভিষণ খারাপ লাগছে,নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।”
তাহসান বন্যার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
“ঠিক হয়ে যাবে।”

বন্যা মাথা নেড়ে না করে।ওর ভিষণ কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে।
“আপনাকে পাওয়ার সাধ এই জীবনে পূরণ হলো না।”
“চুপ।বাজে কথা বলোনা।”
তাহসান মুখে এই কথা বললেও বন্যার অবস্থা দেখে হারানোর ভ,য় বুকে চেপে ধরছে।
বন্যা চুপ করে থাকে।ঝাপসা দৃষ্টিতে প্রিয় পুরুষকে মন ভরে দেখে।হাত বাড়িয়ে তাহসানের গাল ছুঁয়ে দেয়।
“আপনাকে ভিষন ভালোবাসি।”
তাহসান নিঃশব্দে কাঁদে।বন্যা হঠাৎ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়।শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাহসানের হাত।তাহসান বন্যার এই উৎকন্ঠা দেখে বললো,

“কি হলো বন্যা?বেশী কষ্ট হচ্ছে।”
বন্যা মাথা নাড়ে।হাত দিয়ে বুকটা দেখায়।
“শ্বাস নিতে পারছিনা কেনো তাহসান?”
“ডাক্তার ডাকি।”
“না।একবার জড়িয়ে ধরো শক্ত করে।”
বন্যা বলতে দেরী তাহসান শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে দেরী হয়নি।
বন্যা ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।ফিসফিস করে কান্নারত গলায় বললো,

“আমি মরে গেলে একটুও পাগলামি করোনা।”
তাহসান চিৎকার করে বললো,
“মরবেনা তুমি।তুমি মরলে আমিও মরে যাবো।চাঁদ আমার জন্য ভালো হয়ে যাও।”
“আপনার সাথে বাঁচতে চাই,মরতে চাইনা।”
বন্যা হু হু করে কেঁদে দেয়।তাহসান শক্ত করে ধরে বললো,
“বাঁচবে।”

বন্যা কাঁপছে,ভিষণভাবে কাঁপছে।তাহসান বন্যাকে জড়িয়ে রেখেই চিৎকার করে সবাইকে ডাকে কিন্তু সবাই আসার আগেই বন্যা তার সারাজীবনের এতো কষ্টের উপর অভিমান করে পরপারে পারী জমিয়েছে।তাহসান হঠাৎ বুঝতে পারে বন্যা আর কাঁপছে না,হাতগুলো সোজা হয়ে বিছানায় পড়ে গেছে।সে তার বুক থেকে মুখটা তুলে দেখে বন্যার পাখির মতো ছোট ছোট চোখগুলো বন্ধ করে রেখেছে।গলা ফাটিয়ে তাহসান চিৎকার করে বললো,
“বন্যা।এই বন্যা।চোখ খুলো,খুলো না।”

রেনু বেগম ছুটে এসে বন্যাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে।তাহসান চিৎকার করে বললো,
“ও মা আমার বন্যা চোখ খুলে না কেনো?”
সবাই তাহসানকে সরাতে চায় কিন্তু সে বন্যার কাছে থেকে সরে না।
“ও তো আগে থেকেই ভাঙ্গা ছিলো আজকে আবার কি করলো ওরা?আল্লাহ তুমি কি করলে,আমাকে কেনো নিঃস্ব করে দিলে?”

তাহসান ফ্লোরে বসে আছে।হাত দিয়ে বন্যার হাত শক্ত করে ধরে রাখা।শফিক সাহেব হাতটা সরাতেই তাহসান মাথা ফ্লোরে আঘাত করে আর বলে,
“আমার বন্যা না থাকলে আমিও থাকবোনা আমিও ম,রতে চাই।আমার বন্যা বলছিলো আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে,সেই জড়িয়ে ধরে যে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তা তো বলেনি।এই মেয়ে তুমি না বলেছিলে আমার সাথে অনেকবছর বাঁচতে চাও কথা রাখলে না কেনো?”
তাহসান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে উনিও কাঁদছে।সে রাগে বললো,

“কাঁদো কেনো?তোমার তো খুশীর দিন।ছেলেকে আর এই নষ্ট মেয়েটাকে বিয়ে করাতে হবে না।হাসো তুমি।কাঁদবো তো আমি,ক্ষতি তো আমার হয়েছে, আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।”
তারপর বন্যার কানে কানে বললো,
“আমার বউ হবেনা?ভিষন আদর,ভালোবাসা সব তো জমিয়ে রেখেছিলাম,একা করে চলে যেতে পারলে?আমার কি হবে চাঁদ?আমি কিভাবে বাঁচবো?”

পুলিশের সব ফর্মালিটি পূরণ করার পরে বন্যার লাশ বাসায় আনা হয়।যারা ধর্ষক তারা পালিয়ে আছে।দারোয়ানকে সাক্ষী দেয়ার জন্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সম্ভবত ভ,য় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।তাহসান স্তব্ধ হয়ে গেছে।বন্যার কবরের পাশে সারাদিন বসে থাকে।ভুল করেও ছাদের দিকে পা বাড়ায় না।আদালতে আসামীদের নামে কেস লড়ে কিন্তু টাকা আর ক্ষমতার কাছে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না।আসামীরা তার চোখের সামনে দিয়ে হেসে হেসে যায় সে কিছুই করতে পারে না।

আফিয়া বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে অঝোড়ে কাঁদে।বছর পনেরো হয়ে গেছে কিন্তু আর বিয়ের নাম মুখেও আনা যায়নি।তার এক কথা বন্যাকে বিয়ে করতে পারেনি আর কাউকে করা সম্ভব না।তাহসানের আর বিসিএস দেয়া হয়নি আগের ভার্সিটিতে আবরো জয়েন করেছে।দুষ্টু ছেলেটা হুট করেই নদীর মতো শান্ত হয়ে গেছে।তান্ডব!একটা তান্ডব এসে তাহসানের জীবনটাই ছাড়খার করে দিয়ে গেলো।

পনেরো বছর কেস লড়ার পড়েও তাহসান কেস জিততে পারে না।তাহসান বন্যার কবরের পাশে বসে বললো,
“এ দেশে ধর্ষকদের বিচার হয়না চাঁদ।আল্লাহ বিচার করলেই হয়।তুমি ভালো আছো?জানো,আমি একটুও ভালো নেই।”
তাহসান বুকে হাত দিয়ে বললো,

“এই বুকে এতো য,ন্ত্রনা হয়,তুমি কেনো এতো যন্ত্রণা দিয়ে চলে গেলে চাঁদ।একবারো ভাবলে না তোমার তাহসান শেষ হয়ে যাবে।তান্ডবে ছাড়খার হয়ে গেছে সব।আমি আর এই জীবন টেনে এগিয়ে নিতে পারছিনা।তোমাকে ছাড়া একা লাগে,খুব করে চাই নতুন করে কোনো তান্ডব এসে আমাকে শেষ করে দিক।”

তান্ডবে ছাড়খার পর্ব ১৯

এদেশে ধর্ষকদের বিচার হয়না,বিচার হয় ধর্ষিতাদের।সমাজ সংসার তাদের বাঁচতে দেয় না।অথচ ধর্ষকরা দিব্বি বেঁচে থাকে,সংসার করে।বন্যাও তার প্রাপ্র বিচার পায়নি,সে নিরপরাধ হয়ে পরপারে চলে গেছে আর অপরাধীরা হেসেখেলে জীবন কাটাচ্ছে।

সমাপ্ত