প্রেয়সী পর্ব ১৬

প্রেয়সী পর্ব ১৬
নন্দিনী নীলা

কোলাহল পূর্ণ একটা জায়গা ক্লাব। এখানে বেশি সময় থাকা গেল না। ছোট ভাই বোনদের নিয়ে সমুদ্র এখানে বেশি সময় কাটালো না। এই এতো সময় পার হয়েছে তার মধ্যে ফুয়াদের দেখা নাই। ফুয়াদ আসে নাই তাই মিতুল গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ঘন্টা খানিক পর ওরা ক্লাব থেকে বেরিয়ে একটা নামকরা রেস্টুরেন্টে এসে বসে। ডিনার আজ বাইরে করে বাসায় ফিরবে।

সমুদ্র ওদের নিজের ইচ্ছামতো অর্ডার করতে বলল। মিতুল কিছুই অর্ডার করল না। রাগ লাগছে ওর ও ভেবেছিল আজ ফুয়াদের কাছে ক্ষমা চাইবে সেদিনের জন্য। কিন্তু তার সাথে দেখায় হচ্ছে না। আগে যাও ফোন রিসিভ করত ওইদিন রাতের ঘটনার পর একেবারেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। রাগের মাথায় নিজের করা কান্ডে নিজেই হতভম্ব। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। এবার ফুয়াদ যদি বিয়ে ভেঙে দেয় সেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ ভেবেছিল সবার সাথে এসে ফুয়াদের দেখা পাবে আর ক্ষমা চাইবে। মিতুল কটমট চোখে তাকিয়ে আছে মধুর দিকে। মধু ওর সামনাসামনি বসেছে। পাশেই তিন্নি। দুই বান্ধবী কি বলে যেন মিটিমিটি হাসছে। মধুর পাশে ফাহাদ সেও যোগ দিয়েছে হাসাহাসি তে। মিতুল সহ্য করতে পারছে ওকে। এই মেয়েটার জন্য সব হয়েছে এই মেয়েটা না আসলে আজ ফুয়াদের সাথে ঝগড়া হতো না।

সমুদ্র ওদের বসিয়ে খাবার অর্ডার করতে বলে বাইরে এসেছে। রাহী ফোনে মগ্ন মিতুলের কটমটে চোখ মধুর দিকে।
মধু হাসতে হাসতে তাকাল সামনে মিতুলের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাসি থেমে গেল‌ অকারণে কেউ ওকে অপছন্দ করছে। কটমটে করে তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে ব্যাপারটা ওর পছন্দ হলো না। ও কি এমন করেছে যে মিতুলের চোখে ওর জন্য এতো রাগ?

মধু তিন্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,,” দোস্ত আমার ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে।”
তিন্নি দাঁড়িয়ে গেল মধু কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ভেতরে থাকা ওয়াশরুমে নিয়ে এল।
মধু বাথরুমে না ঢুকে তিন্নি কে বলল,,” মিতুল আপুর আমার উপর এতো রাগ কেন বলতো? উনার সাথে তো কখনো আমার ঝগড়া হয়েছে বলে মনে পড়ছে না‌।”
তিন্নি বলল,,” তুই ওয়াশরুমে যাবি না?”

” না এসব জিজ্ঞেস করতেই এখানে এলাম। উনার সামনে থাকতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে রে কেমন করে তাকিয়ে থাকে যেন চোখ দিয়ে ভষ্স করে দেবে।” মন খারাপ করে বলল মধু।
তিন্নি বলল,,” বাদ দে তো মিতুল আপুর কথা। উনার যা খুশি করুক তোর কি? আর তুই দাড়া আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

মধু তিন্নির হাত ধরে বলল,,” সবাই মিতুল ভাবি বলে তুই মিতুল আপু বলিস কেন?”
” বিয়েটা হোক তারপর না হয় ভাবি বলব এখনো তো হয়নি।”
তিন্নি ওয়াশরুমে চলে গেল মধু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে র‌ইল। তিন্নি আসতেই ওরা আবার নিজেদের জায়গায় চলে এল। এসে দেখল সমুদ্র আর ফুয়াদ বসে আছে। ফুয়াদ কখন এল? কাকতালীয় ভাবে ফুয়াদ আর মিতুলের পোশাকের কালার কি সুন্দর মিলে গেছে। নাকি তারা নিজে থেকেই মিলিয়ে পরেছে।

সেটাই হবে হবু বর ব‌উ এটাই তো স্বাভাবিক। মিতুল ও ফুয়াদ দুজনেই রেড কালার পরেছে। ফুয়াদ রেড শার্ট ও মিতুল রেড টপস। মধু খেয়াল করল সমুদ্র ব্লক শার্ট পরেছে। ওর গায়ের ব্লাক ড্রেস। তিন্নি আর ও পাশাপাশি বসে পরল। ওর আসতেই ফুয়াদ একপলক তাকাল ওর দিকে তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিল। ফুয়াদের এক পাশে সমুদ্র আরেক পাশে ফাহাদ। মিতুল নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ফাহাদ কে টেনে উঠিয়ে নিজে ফুয়াদের পাশে বসল। আর ফাহাদ মুখ কালো করে মিতুলের চেয়ারে গিয়ে বসল।

মিতুল অসহায় গলায় ফুয়াদ কে বলল,,” ফুয়াদ,”
ফুয়াদ ফোন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,,” বলো।”
” তোমার সাথে আমার জরুরি কথা ছিল।” মিনমিন স্বর।
” আমার কোন কথা নেই তোমার সাথে।”
মিতুল আহত গলায় বলল,,” প্লিজ জাস্ট ফাইভ মিনিট।”
ফুয়াদ ফোন অফ করে টেবিলের উপর রেখে সরাসরি তাকাল মিতুলের দিকে। মিতুল অসহায় মুখ করে আবার বলল,,” প্লিজ একটু আসো বেশি সময় নেব না।”

ফুয়াদ ফোন টেবিলে রেখেই উঠে দাঁড়াল। ও রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে এল মিতুল খুশি মনে নিজেও পেছনে পেছনে যেতে লাগল।
” বলো কি বলবে!” তাড়া দিয়ে বলল ফুয়াদ।
মিতুল মাথা নিচু করে বলল,,” সেদিনের ব্যবহারে জন্য আই এ্যাম সরি। তুমি তো জানো আমি তোমার উপর কতটা দূর্বল। তোমার সাথে কাউকে আমি সহ্য‌ করতে পারি না। রাগের মাথায় সেদিন কি থেকে কি করেছি বুঝতে পারিনি পরে অনেক লজ্জা লেগেছে। নিজের কান্ড কারখানার কথা ভেবে আমি সত্যি লজ্জিত।”

ফুয়াদ কপাল কিশ্চিৎ কুঁচকে তাকিয়ে আছে মিতুলের মুখের দিকে। মিতুল লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। ফুয়াদ কয়েক সেকেন্ড সেদিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,,” ঠিক আছে।”
মিতুল খুশি মনে বলল,,” তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?”
ফুয়াদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মিতুলের দিকে তারপর কিছু না বলেই গম্ভীর মুখ করে ভেতরে চলে এল। মিতুলের কে হাসি মুখে আসতে দেখে মধু বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। মধু নিজেই পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দিয়েছিল। ওরা সবাই দিয়েছিল শুধু মিতুল দেয়নি তাই ও এবার দিল। ফুয়াদ ক্ষমা করেছে কিনা মুখে সরাসরি না বললেও ওর মনে হচ্ছে রাগ কমেছে। তাই ওর ও মন ফুরফুরে হয়ে গেছে। এদিকে মিতুলের রাগী দৃষ্টি আর‌ না‌ পেয়ে মধুও অবাক। ফুয়াদ শুধু কোল্ড কফি অর্ডার করল মিতুল ওর মন মতো অর্ডার করল।

ডিনার করার সময় সবাই কম বেশি কথা বলল।
তিন্নি ফিসফিস করে বলল,,” দোস্ত দেখ।”
মধু তাকাল তিন্নির দেখানো টেবিলে একটা কাপল বসেছে। দু’জন চিপকে বসে আছে আর গুজুরফুজুর করছে। দুজন দুজন কে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ ছেলেটার হাত থেকে আইসক্রিম মেয়েটার গায়ের উপর পরে গেল মেয়েটা রাগে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল। মধু আর তিন্নি এটা দেখে উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। ওদের হাসির শব্দে সবাই চমকে তাকাল। সবার তাকানো দেখে মধু মুখ চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। মধুর দৃষ্টি এখনো সেই কাপলদের দিকে।
মেয়েটা রেগে রেগে ছেলেটাকে কিছু বলছে। মধু নিজের হাসি আটকালেও তিন্নি আটকালো না দম ফাটানো হাসি দিতেই লাগল।

ফুয়াদ গম্ভীর গলায় বলল,,” অভদ্রের মতো হাসছিস কেন?”
তিন্নি ফুয়াদের ধমক খেয়ে হাসি কন্ট্রোল করল অনেক কষ্টে।
ফাহাদ আঙুল তাক করে বলল,,” ভাইয়া দেখ ওই মেয়েটার ড্রেসে ওই ছেলেটা আইসক্রিম ফেলে দিয়েছে। সেটা দেখে তিন্নি বাঁদরের মতো হাসছে।”
সমুদ্র ফাহাদের হাত টেনে নিচে নামিয়ে বলল,,” সবার সামনে মান ইজ্জত নষ্ট করিস না ভাই। যা খুশি হোক ওদিকে নজর দিস না।”

আর কেউ কোন কথা বলল না। মিতুলের খাবার আসলো সবার পরে। এদিকে বাকিদের খাওয়া শেষ। মধু আর তিন্নি উঠে দাঁড়াল বসে থাকতে ভাল লাগছে না ওদের।
সমুদ্র বলল,,” কোথায় যাস?”
” ভাইয়া একটু বাইরে ঘুরে আসি বসে থাকতে বোরিং লাগছে আমার আর মধুর।”
সমুদ্র কিছু বলবে এইদিকে ফাহাদ ও উঠে এল।
” আমিও যাব আমার ও বিরক্ত লাগছে।”
সমুদ্র বলল,,” নিচে যাবি না এদিকে থাকবি। আমরা বেরিয়ে যেন পাই তোদের।”

তিন্নি মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলল। ওরা দুতলার একটা রেস্টুরেন্টে আছে। মধু, তিন্নি ও ফাহাদ বেরিয়ে এল। বাইরে এসে ওরা এ দোকান ও দোকান ঘুরতে লাগল। ছেলেদের জিনিস পত্রের দোকান সব। একটা প্যান্ট এর দোকান আরেকটা ছেলেদের কসমেটিকস এর দোকান।
মধু মুখ গোমড়া করে বলল,,” ধুর সব ছেলেদের জিনিস। এখানে মেয়েদের জিনিস থাকলে দেখা যেত।”
ফাহাদ এক দোকানে ঢুকে সানগ্লাস দেখছে চোখে পরে সাথে ট্রি শার্ট চয়েজ করছে। মধু আর তিন্নি সেখানে গিয়ে দুজনে দুইটা সানগ্লাস চোখে পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল কেমন লাগছে।

ফাহাদ তিন্নি কে ডাকল ট্রি শার্ট পছন্দ করে দেওয়ার জন্য। কালো একটা সানগ্লাস পরে দেখছিল তিন্নি সেটা চোখে থেকে খুলে জায়গার টা জায়গায় রেখে ফাহাদের কাছে গেল‌। ঘুরে ঘুরে দুই ভাই বোন শার্ট বেল্ট প্যান্ট দেখছে। মধু ব্লাক ড্রেস পরেছে তাই তার সাথে ব্লাক সানগ্লাস চোখে পরেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে খারাপ লাগছে না। কালো গ্লাসের জন্য চারপাশের আলোকিত স্থানটা আঁধার হয়ে এসেছে।

সন্ধ্যায় যেমন পৃথিবী আবসা আঁধার হয়ে আসে ওর চোখে ও সব এখন তেমন। সানগ্লাস পরা অবস্থায়ই ও আয়নায় নিজের পেছনে কারো ছায়া দেখতে পেল। স্পষ্ট একজনের মুখ। ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। লোকটাকে ও চিনেছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। তিনি ওর পেছনে কেন এসেছে? নাকি ভুল দেখছে? ঢোক গিলে মধু সানগ্লাস খুলে ভালো করে পরোক্ষ করতে যাবে লোকটা সত্যি ওর পেছনে আছে নাকি ওর মনের ভুল।

ও পেছনে ঘুরে সানগ্লাস খুলতে হাত বাড়িয়েছে কিন্তু ওর হাত চশমা স্পর্শ করার আগেই সামনের অগত্যা ব্যক্তিটি ওর হাত চেপে ধরে আটকে দেয়। ওর সারা শরীর শিরশির করে উঠে পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেয়ে। মধু থমকানো হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামনের লোকটার দিকে। তার গাঢ় চাহনি ওকে বিষ্ময়ে হতভম্ব করে দিয়েছে। মধু কিছু বলতে যাবে লোকটা‌ ওর ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করতে বলে। মধু ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগলে। ওর সারা শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। বিষ্ময়ে ও কথা বলতে পারছে না। কথা গলায় আটকে পরেছে।

লোকটা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,,” মাই ব্লাক এনজেল।”
লোকটার গরম নিঃশ্বাস মধুর কাঁধে আছড়ে পরে ও শক্ত করে নিজের জামা খামচে ধরে। চোখ খিচে বন্ধ করে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগে। ওর হাত পা অসাড় হয়ে আসতে চায়। আস্তে আস্তে ওর শরীর থেকে লোকটার স্পর্শ সরে যেতে লাগে। মধু চোখ খুলতে পারে না। বিষ্ময় এ ও পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা হচ্ছে।
” এই মধু কি হয়েছে এমন হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কখন থেকে ডাকছি।”

তিন্নির ধাক্কা খেয়ে মধু সম্মতি ফিরে পায় ঝড়ের গতিতে সানগ্লাস খুলে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগে কেউ নাই।
ও ঢোক গিলে বলল তোতলানো গলায়,,” তিন্নি এখানে কি কেউ ছিল আমার সাথে?” ওর ঠোঁট কাঁপছে উত্তেজনায়।
তিন্নি কপাল কুঁচকে বলল,,” কে থাকবে? তুই তো একাই দাঁড়িয়ে আছিস আমি ওদিক থেকে তোকে ডাকতে ডাকতে এখানে এলাম। হঠাৎ এমন স্ট্যাচু হয়ে গেল কেন?”
মধু ভয়ার্ত গলায় বলল,,” সত্যি কেউ ছিল না?”

প্রেয়সী পর্ব ১৫

” কে থাকবে?”
মধু ঢোক গিলল। কি বলবে? তিন্নি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ওর দিকে। মধু থমকানো মুখ নিয়ে ওর সাথে হাঁটতে লাগল। সানগ্লাস খুলে রেখে দিছে। ওর কানে এখনো বাজছে মাই ব্লাক এনজেল কথাটা। সত্যি কি কেউ এসেছিল নাকি ওর মনের ভুল। ওর কল্পনা! এমন বাস্তব কল্পনা ও হয় বুঝি! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে কেউ আছে নাকি দেখতে।

প্রেয়সী পর্ব ১৭