তুমি আমি দুজনে পর্ব ২৭

তুমি আমি দুজনে পর্ব ২৭
হুমাইরা হাসান

ইনসাফ মাহবুব বাড়িতে আজ বিয়ের আমেজ,রাইমা আর ইমানের বিয়ে। মাহবুব বাড়িতে বিয়ের আয়োজনে রমরমা, সকাল থেকে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। কারো দুদন্ড বসার জো নেই,এসবের মাঝেও তুরা ঠাঁই বিছানায় দু পা ভাজ করে বসে আছে। নিচে যাওয়া তো দূর মাটিতে পা রাখাও নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা টা অবশ্যই তার গণ্যমান্য ব’জ্জাত বরটাই দিয়েছে,সবাই কত কত কাজ করছে অথচ তুরা একা ঘরের মধ্যে বসে আছে বিরক্তি আর আলসেমিতে তুরার ঝিম ধরে আসছে। এভাবে বসে থাকতে কার ভাল্লাগে? একটুই তো কেটেছে, এ নিয়ে এমন সাত দফা জারি করার কি আছে! লোকটাকে তো আর সাধে ব’জ্জাত বলে না তুরা।

সকাল বেলা উঠে ব্যথাযুক্ত পা নিয়েই খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে ওয়াসরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরতেই আহানের ঝারি শুনতে হয়েছে, সে নাকি সবকিছুতেই পাকনামি করে। আরে তো সকালে উঠে ফ্রেশ হতে হবে এটাকে পাকনামির কি আছে আজব। তুরা কিছু বলতে নিবে তার আগেই দু ধমকে ওকে বসিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে আহান,আর যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে বিছানা থেকে যেনো না নামে। এখন বাড়িতে বিয়ে আজ,সবার কাজে দম ফেলার সুযোগ নেই আর সে কি না বসে বসে ঝিমুবে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহান বের হওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই রুবি আর মিনু ফুফু এসেছিলো, রুবি অল্প কিছু বললেও মিনু ফুফু আচ্ছা মতো বকেছে তুরাকে, এতো বড় একটা ঘটনা ঘটলো আর সে কি না কাওকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো নাহ। অসাবধানতা বশত আরও বড় কিছুও তো হতে পারতো!

একা একাই বসে বিড়বিড়াচ্ছে তুরা,মনে মনে আহানকে হাজার বার ভৎসনা করছে, সব দোষ লোকটার কে বলেছিলো মা আর ফুফুকে বলতে, এভাবে বসে থাকতে কার ভাল্লাগে। পা টা সামন্য ঘুরিয়ে ক্ষত স্থান টা পরখ করে দেখলো তুরা। একেবারেও ভুল বলেনি আহান। কালকের তুলনায় আজকে ব্যথাটা অনেকটাই বেড়েছে, কাটা স্থান টা গোড়ালি হওয়ায় পাও ফেললে যন্ত্রনায় টনটন করছে।

বসে থেকে থেকে গলা শুকিয়ে এলো তুরার। পাশের টেবিলেই পানির জগটা রাখা। এক হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেও খানিকটা দূরে হওয়ায় নাগাল পেলো না। এক পা নামিয়ে হাতে ভর দিয়ে উঠতে নিলেই দরজার সামনে আহানকে আসতে দেখে ধপ করে আগের জাগায় বসে পরলো।
আহান কতগুলো মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকতে তুরার দিকে লক্ষ্য করলে ওকে অপ্রস্তুত ভাবে বসে থাকতে দেখে আড়চোখে তাকালো। আহানকে তাকাতে দেখে তুরা মেকি একটা হাসি দিলো,আহান মিষ্টির প্যাকেট গুলো রাখতে রাখতে বলল

-এভাবে বাঁদরের মতো দাঁত কেলাচ্ছ কেনো?
মুহুর্তেই তুরার মেকি হাসি দেওয়া মুখ খানা চুপসে গেলো, কত্ত বড় ব’জ্জাত হলে এভাবে অপমান করতে পারে ভাবা যায়!
-চোখের সামনে আস্ত উগান্ডা আসলে তো বাঁদরের মতো দাঁত কেলাবই
বিড়বিড়িয়ে বলল তুরা, আহান প্যাকেট গুলো সাজিয়ে রেখে তুরার দিকে ফিরে তাকালো । দু হাত মাজায় রেখে বলল
-এসব বাঁদরামি বাদ দাও। এসে থেকে একটার পর একটা অঘটন ঘটিয়েই যাচ্ছ, তোমার সাথে থাকলে কোনদিন আমাকেই তুমি স্বর্গবাসী করে দিবে।

তুরার আহানের কথার ভ্রু কুচকালেও পরমুহূর্তেই মেকি হেসে ভঙ্গিমা করে বলল
-ওগো,আপনি এমন অশুভ কথা মুখেও আনবেন না গো,আপনি স্বর্গে গেলে আমার কি হবে!
তুরার এমন মাত্রাতিরিক্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে আহান মুহুর্তেই নাক কুচকে বলল
-হোয়াট, কি যা তা বলছ তুমি ষ্টুপিড

-সে আমি ইস্টুপিট হই আর সিস্টুপিট হোক আমি তো আপনাকেই স্বামী মানি গো, আপনি স্বর্গবাসী হলে যে এই ধরণীতেই আমাকে আরেকটা স্বামী দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে,সে আমি কি করে মানবো গোওও!!
-শাট আপ, তুমি আসলেই একটা বাঁদর
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আহানের যাওয়ার পানে তুরা হা করে চেয়ে থেকেই ও দৃষ্টির সীমানার বাইরে যেতেই পেট ধরে হাহা করে হেসে উঠলো তুরা,,পেটে খিল ধরার মতো হাসি পেয়েছিলো তুরার আহানের বিব্রতকর চেহারা টা দেখে।

-আর যাই হোক মাস্টার মশাইকে খেপানো কিন্তু তুরি বাজানোর চেয়েও সোজা
একা একাই বলে আবারও হাহা করে হেসে দিল তুরা।
-কি ব্যাপার, এভাবে একাই একাই হাসছে যে আমার ভাবিটা,,কিসে এতো হাসি পেলো আমাকেও বলো,আমিও হাসি
মেয়েলি কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই হাসা থামিয়ে ফিরে তাকালো তুরা,রাইমা দরজা থেকে এগিয়ে এসে তুরার পাশে বসে আবারও বলল

-কি নিয়ে এতো হাসছিস রে তুরা, আহানকে দেখলাম মুখটা বাংলার পঁচিশ বানিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো
-সে তুমি মাস্টার মশাইকেই জিজ্ঞাসা করোনা আপু
বলেই আবারও খিলখিল করে উঠলো তুরা, হাসি যেনো থামছেই নাহ
-মাস্টার মশাই! এটা তুই আহানকে বলিস নি তো?
-কেনো বললে কি হবে গো ননদিনী
তুরা বেশ রসিকতা করে টুসকি মেরে বলল রাইমাকে।
-এই না না,তাইলে কিন্ত আহান ফায়ার হয়ে যাবে। এই মাস্টার মশাই ডাকটা ও একেবারেই পছন্দ করে না বললেই ক্ষেপে যাবে।

-তাহলে কিন্ত তোমার ভাইকে এটাই বলবো আমি
-তুরা, তুই কিন্তু দিনদিন ভারি দুষ্টু হচ্ছিস
রাইমার কথার পৃষ্ঠে তুরা কিছু বলবে তার আগেই তনু আর রুহি হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো ঘরের ভেতর,এসেই রুহি রাইমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল

-এই তোমাকে আমি কত জাগায় খুঁজে বেরাচ্ছি,আর তুমি এখানে বসে ভাবির সাথে গল্প জুড়েছ
-তাই ই তো। কয়টা বাজে দেখোতো, গোসল কখন করবে তুমি,পার্লার থেকে লোক এলো বলে
তনু রাইমার হাত ধরে বলল। রাইমা উঠার বদলে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো
-উফ,এই বিয়ে করা এতো ঝামেলা কেনো বল তো। এতো কাহিনি ভাল্লাগছে না তো
রুহি রাইমার পাশে কাত হয়ে আধশোয়া হয়ে বলল

-তাইলে তোমার হয়ে বিয়েটা আমিই করে ফেলি কি বলো আপু? এমনেও বাড়ি থেকে বিয়ে টিয়ে দিচ্ছে না তার উপর তোমার বর কে কিন্তু আমার হেব্বি পছন্দ হয়েছে
-তাই না খুব শখ তোর বিয়ে করার।
বলেই কান টেনে ধরলো রাইমা। রুহি এক হাতে কান ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
-তুমিই তো বললে বিয়ে করা ঝামেলা তাই তো..

-তোদের দুটোকে পাঠালাম রাইকে ডেকে আনতে আর তোরা কিনা বসে গল্প জুড়েছিস।
মাঝবয়েসী হাস্যজ্বল চেহারায় দাঁড়িয়ে দরজার সামনে৷ নারী কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই উঠে বসলো রাইমা আর রুহি,তনু সরে দাঁড়াতেই ঘরে প্রবেশ করলো আহানের ফুফু ইলা বেগম।
-ও মা আমিতো আপুকেই ডাকতে এসেছি, ওই তো বলছে এসব বিয়ের ঝামেলা নাকি ওর ভাল্লাগছে নাহ,বলি আমাকেই বিয়ে দিয়ে দাও না ইমান ভাইয়ের সাথে আপুর বদলে

-চুপ কর,,এই তোরা সবগুলো খুব বদমাশ হয়েছিস। যা শিগগির রাইকে নিয়ে যা বেলা হয়ে যাচ্ছে তো।
ইলার কথা মতো রুহি আর তনু রাইমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ইলা বেগম আবারও বলল
-শোন, প্রেমা এসেছে ওর বাবার সাথে
প্রেমা নামটা শুনে,তনু আর রুহির মুখ জুড়ে কালো আধার নেমে আসলো। রাইমাও বেশ বিরক্ত বোধ করলো বোধ হয় নামটা শুনেই।

-হোয়াট! ওই ন্যাকা টা আবার কেনো এসেছে
-এসব কেমন কথা, ও আসবে না কেনো। ওউ তো তোদের বোন ই হয়
-প্লিজ মা, ওই ন্যাকা টার কথা বাদ ই দাও।এবার না জানি কি নাটক শুরু করে
বলেই তুরার দিকে এক পলক তাকালো তনু, তারপর আবারও ওরা বেড়িয়ে গেলো। ওরা বেরতেই ইলা বেগম তুরার পানে চেয়ে চমৎকার হাসি দিলো। ইলা বেগম ও তার ভাই ইনসাফের মতোই নরম স্বভাবের। তুরার পাশে এসে বসে মমতাময়ী স্পর্শে মাথায় হাত রেখে বলল

-পায়ের ব্যথা কমেছে মা?
-জ্বি ফুফু আম্মা কমেছে
-ইশ কি মিষ্টি তুমি। এত সুন্দর করে তো রাই আর আহান ও ডাকে না আমায়।
প্রশংসার প্রত্যুত্তরে গাল এলিয়ে হাসলো তুরা, পরক্ষণেই কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
-প্রেমা কে ফুফু আম্মা? ওরা এমন বিরক্ত কেনো হচ্ছিল নাম শুনে?
-প্রেমা আহানের বাবার দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের মেয়ে, সিলেটের বাড়িতে আমাদের পাশেই ওদের বাড়ি তাই তোমার শ্বশুরের সাথে প্রেমার বাবা রায়হানের বেশ ভালো সম্পর্ক।

ঠোঁট গোল করে ওহ বলে উত্তর দিলো তুরা। পরক্ষণেই ইলার হাত ধরে বলল
-ফুফু আম্মা, আমাকে একটু নিচে নিয়ে চলুন নাহ। এভাবে বসে থাকতে একদম ভালো লাগছে না, পায়ে তো অল্প ব্যাথা,একটু ধরলেই হবে। কিছুই হবে না আমার

তুরার এমন বাচ্চামো আবদার ইলা ফেলতে পারলো নাহ। এক হাতে তুরাকে ধরে ঘরের বাইরে আনলো। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলে সামনে চোখ যেতেই থমকে গেলো তুরা, মুখ জুড়ে কালো আধার নামলো সামনের দৃশ্য দেখে। ড্রয়িং রুমে আহান দাঁড়িয়ে আর তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একটা মেয়ে, আহান তাকে না ধরলেও মেয়েটা একেবারে চিপকে আছে ওর সাথে। থমথমে মুখ করে তুরা সিড়ি বেয়ে নেমে এলো। মেয়েটাকে আহান নিজে থেকে ছাড়িয়ে নিলেও আহানের গালে হাত রেখে বলল

-আহান! হোয়াটস আপ? আই মিসড ইউ। কেমন আছো,কত দিন পর দেখা হলো বলো তো!
আহানে বেশ বিব্রতবোধ করলো। এভাবে লোকজনের ভেতরে জড়িয়ে ধরাটাকে কেও ভালো চোখে দেখবে নাহ। তুরা রীতিমতো ফুঁসছে। মেয়েটার এসব লীলাকান্ড দেখে গা জ্বলছে,কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো এই পেত্নী। তুরার ভাবনার মাঝেই জায়মা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে খোঁচা দিয়ে বলল

-এইটা হলো প্রেমা, রায়হান আংকেলের মেয়ে,এই প্রেমার আবার আহান ভাইকে দেখলে একটু বেশিই প্রেম উতলে পরে, এইটার থেকে দূরে থাকবা আর তোমার বরকেও দূরর রাখবা
বলেই আবারও সরে গেলো। তুরা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো কেনো তখন ওরা মুখ কালো করছিলো। আহান প্রেমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল
-তুই কখন এসেছিস

-আজই,রাইমার বিয়ের জন্য পাপা আসলো। কিন্তু আমিতো তোর জন্যে এসেছি
প্রেমার কথায় আহানের অস্বস্তি বেড়ে গেলো, কাজের অযুহাত দেখে বেরিয়ে যেতেই প্রেমা নামের মেয়েটা জায়মা রুহি আর তনুর দিকে এগিয়ে বলল
-হেই,কেমন আছো তোমরা? আমিতো লন্ডন থেকে ব্যাক করেই চলে এসেছি তোমাদের সাথে মিট করবো বলে।
-এই যে বললে আহান ভাইয়ের জন্য এসেছ
রুহির কথায় প্রেমা মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে হেসে বলল

-ওর জন্য তো এসেছিই, তোমাদের জন্যেও এসেছি
এবার জায়মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রেমার ফোন বেজে উঠলে ও ‘এক্সকিউস মি’ বলেই বেরিয়ে গেলো। তনু আর রুহি দুটো মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো নিজ কাজে। তুরা এখনো মুখটা থমথমে করে দাঁড়িয়ে আছে, মেজাজ টা যেনো তুঙ্গে চড়ে গেলো মেয়েটা তো আচ্ছা শাকচুন্নী!

অপরাহ্নের মাঝ সময়, পুরো বাড়িতে ‘বর এসেছে বলে উল্লাসী আওয়াজে ঝংকার তুললো। তুরা জায়মা তনু ইলা রুহি সবাই রাইমার ঘরে, ওকে ঘিরে আছে। রাইমার পরনে মোটা পারের টকটকে লাল বেনারসি। গা ভর্তি সোনার গহনায় জড়ানো। আরমান, বিহান, আহান সবাই নিচে খাওয়ার দিক টাই তদারকি করতে ব্যস্ত। বিয়ের বাড়ির গমগমে ভিড়ে আর কাজের চাপে এমুখো হবার সু্যোগ হয়নি তাদের।

তুরার পরনে খয়েরী রঙের একটা লেগেঙ্গা। জরজেটের কাপড়ে চিকচিকে মুক্তার মতো পুথির কাজ করা,লেগেঙ্গার উপরের অংশে এমব্রয়ডারির নিখুঁত কাজের সাথে গায়ের হালকা পাতলা গয়নায় তুরার সুনিপুণ চেহারার চমক আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। টকটকে রঙে ঠোঁটের উপর প্রলেপ দেওয়া, আধখোপা করা চুলে পাথরের ক্লিপ বসানো। পার্লারের লোকেরা রাইমার সাথে তনু জায়মা আর রুহিকেও সাজিয়েছে, আর ওদের জোরাজুরিতে তুরাও বাধ্য হয়ে সেজেছে,তার নিজেরও মন্দ লাগছে নাহ!

নির্বিঘ্নে শেষ হলো রাইমা আর ইমানের বিয়ে, বিদায়ের সময়ে সবাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে রাইমা। ইমান থামাতে গেলেও ফারিন থামিয়ে দেয়। সে নিজেও তো মেয়ে, তাই এ মুহুর্তে একটা মেয়ে কতটা আবেগ বশিভূত থাকে সেটা তার ও ঢের জানা। বিদায় বেলায় মা,বাবা তুরা সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আহানের সামনে যেতেই কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায় রাইমার।

একমাত্র ভাই তার বড় আদরের। ছোট থেকে একসাথেই মানুষ, আহানের পড়াশোনার প্রক্ষাপট ছাড়া কখনও আলাদা থাকতে হয়নি দুজনের। বোনের বিদায়ে আহান নিজেও শত কষ্ট পেলেও তা প্রকাশ করে নাহ। নিজে হাত ধরে গাড়িতে উঠিয়ে দেয় রাইমাকে। শুধু ইমানের হাত ধরে বলেছিলো
-আমার বোনটা আজ থেকে আপনার জিম্মায়, ওকে দেখে রাখবেন,আর কোনো দিনও যেনো ওকে কাঁদতে না হয়
প্রেক্ষিতে ইমানও প্রাপ্তির হাসি হেসে আহানের হাত আরও শক্ত করে ধরে বলেছে
-তোমার বোন কে বউ করে নিয়ে যাচ্ছি। আমার সাধ্যমতো রাণী করে রাখবো ইনশাআল্লাহ।

সকলের দোয়া আর ভালোবাসা নিয়ে বিদায় হলো রাইমা আর ইমান,সাথে আসা মেহমান। বিয়ে বাড়ির সকল ঝামেলা মেহমান, আপ্যায়ন চুকিয়ে আহানের ঘরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো। ইনসাফ, ইউসুফ তার মা ফুফু চাচী সকলেই আগেই এসেছে। অনুষ্ঠানে ভরা রমরমা পরিবেশ এখন অনেকটা ঠান্ডা।

বাড়িতে এখন লোকজন বলতে তারা নিজেরা, আর প্রেমা। প্রেমার বাবা রাইহান চলে গেলেও প্রেমা এখানে কয়েকদিন থাকবে বলে রয়ে গেছে, প্রেমা আর আহান প্রায় সমবয়সী। একই কলেজ থেকে পড়লেও গ্র‍্যাজুয়েশনের জন্য ভিন্ন দেশে ছিলো দুজনেই। প্রেমার বাবার ব্যাবসায়ীক কারণে বিদেশেই বেশি থাকা হয়,সেজন্য ওর মধ্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব বেশি। জড়িয়ে ধরা,হ্যান্ডসেক,গায়ে পরা এসব ওদের কাছে বেশ স্বাভাবিক হলেও এখানকার সবাই আড়চোখে দেখবে এটাই স্বাভাবিক।

ড্রয়িং রুম আপাতত ফাঁকা। কাজ সেড়ে বড়ড়া ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে,আর আরমান, বিহান সহ মেয়েরা সবাই ছাদে বসেছে আড্ডার আসরে। আহান ঘর্মাক্ত শরীরে সোজা ঘরে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়েই বেরোলো। এ্যাডিডাস এর একটা নেভি ব্লু টি-শার্ট আর ধুসর বর্ণের ট্রাউজার পরে ছাদের দিকে হাঁটা দিলো।

রূপালি পূর্ণ থালার আকৃতির চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে আশপাশ। দক্ষিণা বাতাস আর চাঁদের নরম আলোতে মাদুর পেতে বসেছে সবাই ছাদে, সবার পরনে এখনো আগের পোশাক। বিয়ের পর্ব চুকিয়ে সন্ধ্যার পরেই সবাই বসেছে আড্ডার আসরে। তুরা সবার সাথে হাসাহাসি করলেও আহানের আগমনে চুপ করে গেলো। আহান এসে বসতেই কোত্থেকে প্রেমা এসে ওর গা ঘেঁষে বসে পরল। তুরা চোখ মুখ কুচকে নিতেই রুহি পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল
-দেখলে তো ভাবি তখন ডাকলাম বলল আমার এসব বোরিং গসিপিং ভাল্লাগে না।আর ভাই আসতেই কেমন চিপকে গেলো।

তুরা নিজেও বেশ বিরক্ত মেয়েটার উপর। ওর পোশাক দেখেই তো গা জ্বলে যাচ্ছে তুরার। এক তো পাতলা মশারীর মতো শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে তার উপর ব্লাউজ টার হাতাও একদম চিকন ফিতার,বলি ওটুকু আর ঢাকার দরকার কি ছিলো। তবুও চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে রইলো তুরা। আড্ডার সাথে কোল্ড ড্রিংকস আর স্ন্যাকস ও এনেছে সকলে। প্লেট থেকে একটা ফ্রাই তুলে মুখে দিতেই প্রেমার কাশি শুরু হয়ে গেলো,
-দিস ইস টু মাচ স্পাইসি! ওয়াটার,ওয়াটার প্লিজ!

বলেই বসে থেকেই লাফানো শুরু করলো প্রেমা। আহান সামনে থেকে পানির গ্লাস তুলে ওর সামনে ধরতেই প্রেমা আহানের হাত সহ গ্লাসটা চেপে ধরে ঢকঢক করে গিলে ফেলল।
-থ্যাংকিউ সো মাচ আহান
প্রেমার ঢং দেখে তুরার মনে হলো বোতলের সব সস গুলো মুখে ঢেলে দিয়ে বলতে সো মাচ স্পাইসি। কিন্তু তা তো করা সম্ভব না,রাগে অসহ্য হয়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো তুরা

-কি হলো ভাবি?
জায়মার কথায় তুরা মুখ ভার করে বলল
-আমার খুব ক্লান্ত লাগছে,ঘুমাতে চাই
-আচ্ছা ঠিকাছে, তোমার পায়ের ব্যাথা টাও তো পুরোপুরি সারেনি। চলো
বলেই বাকিরাও উঠে দাঁড়ালো। মেজাজ দেখিয়ে জোরে সোরে তুরা এক পা ফেলতেই গোড়ালিতে লেগে ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করলেই আহান এসে ওকে ধরে বলল
-আমি সাহায্য করছি

তুরা এক ঝটকাই আহানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
-ইটস ওকে থ্যাংকিউ
টেনে টেনে কথাটা বলেই রুহির দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কি আমায় একটু ধরে ঘর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে?

রুহিও তুরার কথামতো ওকে ধরে এনে ঘরে দিয়ে গেলো। একে তো মেজাজ তুঙ্গে চড়ে আছে তার উপর এই ভাড়ি লেহেঙ্গা পরে গরমে যা তা অবস্থা। এটা এক্ষুনি পালটানো দরকার। ব্যাগ থেকে একটা পাতলা জামা বের করে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আহান ঘরে ঢুকতেই দরজা লাগানোর ধড়াম শব্দে চমকে উঠলো। এই মেয়ের কি হলো!
মিনিট দশেক বাদে তুরা বেরিয়ে এলো ওয়াসরুম থেকে।

আহান ফোন নিয়ে বসেছিলো। দরজা খোলার শব্দে তাকাতেই তুরার এলোমেলো অবস্থা দেখে অবাক হলো। এক হাতে মুঠো করা গায়ের গয়না গুলো থপ করে রাখলো ড্রেসিং টেবিলের উপরে। খোপা করা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খুলে আছে। লেহেঙ্গার ওড়না টা কোনো রকম পেচিয়ে রেখেছে, চোখে মুখে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে উল্টো করে দাঁড়িয়ে ঘাড় আয়নার দিকে ঘুরিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে

-কি করছ তুমি এসব?
-মুজরা করছি,করবেন?
তুরার নিকট এ ধরনের উত্তর নেহাত অপ্রত্যাশিত ছিলো আহানের, হঠাৎ এমন রণচণ্ডী হওয়ার কারণ টা কিছুতেই বোধগম্য না হলেও তুরা যে ব্লাউজের হুকটা খুলার চেষ্টায় করছে অনেক্ষণ ধরে এইটা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো আহান। উঠে গিয়ে তুরার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল
-দেখি পেছনে ঘুরো

তুরা থতমত খেয়ে আহানের দিকে তাকালো, নিজের অবস্থা টা পরখ করেই এবার হুস ফিরলো, এতক্ষণ তো রাগের বসে ধুপধাপ করে বেরিয়ে আসলোও,কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষটা যে বসে আছে,সে খেয়াল তার হয়নি। কিন্তু সে কেনো পিছু ফিরবে,কি করবে লোকটা?
-কি বললাম শুনতে পাওনি, পিছে ঘোরো?

তুমি আমি দুজনে পর্ব ২৬

বলেই তুরার অপেক্ষা না করে ওর দুবাহু ধরে পেছনে ঘুরিয়ে দিলো। তুরা এখনো ব্লাউজের পেছনে হাত দিয়ে রেখেছে, আহান তুরার হাতটা ধরে নামিয়ে দিলো। ব্লাউজের ফিতায় এক টান দিতেই খুলে গেলো ফিতা, সাথে সাথে ফর্সা পিঠ উন্মুক্ত হয়ে গেলো

তুমি আমি দুজনে পর্ব ২৮+২৯