প্রেয়সী পর্ব ১৭

প্রেয়সী পর্ব ১৭
নন্দিনী নীলা

মিতুল সবার আগেই নাচতে নাচতে ফুয়াদের গাড়িতে উঠে গেছে। ফুয়াদের সাথে যাবে বলে। বাকিরা সমুদ্রের সাথে গেল। মধু সারা রাস্তা আর একটা কথাও বলল না। কথা বলতেই পারল না। বারবার আজেবাজে কথা ভেবে রাস্তা পার করল। মনে মনে শঙ্কিত হচ্ছিল বার বার। সমুদ্র ওকে অন্যমনস্ক দেখে অনেক কথাই বলব কিন্তু মধু কোন কথাই বলল না। বাসায় ঢুকতেই সমুদ্র ওকে বলল,,”মধু তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

মধু শুকনো মুখে তাকাল সমুদ্রের দিকে।
তারপর তোতলানো গলায় বলল,,” না তো।”
সমুদ্র বলল,,” তোমার চোখ মুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে। আর এতো চুপচাপ হয়ে গেলে যে হঠাৎ?”
মধু শুকনো হাসি দিয়ে বলল,,” ক্লান্ত লাগছে তাই নিরব আমি। এছাড়া আর কিছুই না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সমুদ্র বিশ্বাস করল কিনা মধু জানে না। মধু সেই আশায় দাঁড়িয়ে ও র‌ইল না। ধপাধপ পা ফেলে তিন্নির রুমে চলে এল।‌ ড্রেস চেঞ্জ করে মধু বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কখন ঘুমিয়ে গেছে নিজেও জানে না। যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর সকাল। সবাই ঘুমিয়ে কিন্তু মধু একাই জাগ্রত। ও উঠে গেল আর সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল। ফুয়াদের রুমটা সামনাসামনি হ‌ওয়াতে ও এক নজর সেদিকে তাকিয়ে দেখল দরজা বন্ধ ও আর কোন দিন না তাকিয়ে ছাদে এসে দাঁড়াল। রাত‌ গভীর অবধি অনেকেই হয়ত ছাদে যাতায়াত করে এজন্য ভোর সকালেও ছাদের দরজায় তালা দেওয়া থাকে না। মধু ভোরের মিষ্টি শীতল বাতাস নিল চোখ বন্ধ করে।

দুইদিন পর
আনিতা ও নাফিসা রান্না করছে। মধু তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এতো দিন হয়ে এল এ বাসায় আছে ও এখনো রান্না ঘরে আসে নাই। তাই কি মনে করে যেন আজ আসতে মন চাইল। আকাশ সকাল থেকেই মেঘলা। সূয্যিমামার দেখা নাই। ফাহাদ আকাশের অবস্থা দেখেই আজ স্কুলে যায়নি‌। খিচুড়ি খাবে বলে বায়না ধরেছে। তাই লাঞ্চে খিচুড়ির আয়োজন করা হচ্ছে। মধুর ও খিচুড়ি পছন্দ বিশেষ করে বৃষ্টির মধ্যে তো খিচুড়ি আরো বেশি পছন্দ। বৃষ্টির দিন মানেই তো খিচুড়ি খাওয়া।

নাফিসা আন্টি খিচুড়ির জন্য সব রেডি করে আনিতা কে বললেন,” তুই খিচুড়ি রান্না করে ফেল আমি ফুয়াদের জন্য অন্য কিছু তৈরি করি। ও তো আবার খিচুড়ি খায় না।”
মধু অবাক স্বরে বলল,,” খিচুড়ি খায় না কেন?”
নাফিসা আন্টি বললেন,” ফুয়াদ খিচুড়ি পছন্দ করেনা। ছোট থেকেই খেতে চায় না।”

মধু মুখ বেঁকালো খিচুড়ি কেউ অপছন্দ করে ওর জানা ছিল না‌। ভালো জিনিস ওমন খাটাস লোকদের পছন্দ থাকে ও না।
বৃষ্টির মধ্যে রাহী আপু পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। বিকেলে এক্সাম এজন্য তার সাথে গিয়েছে সমুদ্র। তিনি বাদে বাসার সব পুরুষ কাজে ব্যস্ত থাকে তাই তাকেই এই দায়িত্ব নিতে হল। চিত্রা ভাবিকে রান্না ঘরের ধারের কাছেও পাওয়া যায় না। আজ বৃষ্টি তাই আজ সেই সকালে একবার বের হয়েছিল ব্রেকফাস্ট করে আবার যে ঢুকেছে আর বের হয়নি। মধু রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

ড্রয়িংরুম পার করতে যাবে ফাহাদ এসে মধুর হাত চেপে ধরল,,” মধু আপু চলো বৃষ্টিতে ভিজি।”
মধু বৃষ্টিতে ভিজতে খুব একটা পছন্দ করে না কিন্তু জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ে খেলতেও পছন্দ করে। বৃষ্টিতে ভেজা‌ খুব একটা হয়ে উঠে নি। বাসার কেউ এসব পছন্দ করে না এজন্য আরো আগ্রহ করেনি কখনো। কিন্তু আজ ফাহাদের বলায় কেন জানি ভিজতে ইচ্ছে করল।

” তিন্নি কে ডাকো।” মধু বলল।
” সে ভিজবে না। চাদর মুড়ি দিয়ে ফোন টিপছে আর অনলাইনে গল্প পড়ছে।”
“আমি ডেকে আসি?”
” গিয়ে ও লাভ হবে না আপু বৃষ্টিতে ভিজতে অপছন্দ করে।”
” আমিও পছন্দ করি না। কিন্তু আজ করতে ইচ্ছে করছে।”
” তাহলে চলো বাগানে যাই। নাকি ছাদে যাবে! ছাদ দোলনা নাই ফুল নাই। কিন্তু বাগানে ফুল গাছ আছে, দোলনা আছে সুইমিং পুল আছে চাইলে সেখানেও সাঁতার কাটতে পারবে।”

মধু তিন্নিকে আর ডাকল না ফাহাদের সাথেই বেরিয়ে এল। জুতো খুলে রেখে এসেছে। সবুজ ঘাস বৃষ্টির ফোঁটা চিকচিক করছে। বড়ো বড়ো ঘাস তাই পায়ে কাদা লাগছে না। হাঁটতে মজাই লাগছে। মধু দোলনায় বসল ফাহাদ ওকে দুইটা ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে সুইমিংপুল এ নেমে পড়ল ঝাঁপ করে। এখন সাঁতার কাটছে। মধু দোলনা ওইভাবেই বসে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ফোঁটা উপভোগ করছে। উঠে ফুল গাছের কাছে গেল। ওর গায়ে নীল টপস ও নীল স্কার্ট গলায় ওরনা। মধু একটা গোলাপ ফুল নিয়ে কানে গুঁজে আরো কিছুক্ষণ বৃষ্টি বিলাস করল। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠোঁট কাঁপছে শীতে থরথর তিরতির করে। ও ফাহাদ কে ডাকল। ফাহাদ ও সুইমিংপুল থেকে ডাকছে,” মধু আপু নেমে আসো।”

” আমি সাঁতার পারি না। তুমি উঠে আসো।”
” এতো তাড়াতাড়িই? আর একটু থাকো।”
” না আমি চলে‌ যাব কিন্তু।”
ফাহাদ উঠে এল না মধু দোলনায় বসে র‌ইল ওর জন্য। তখনি একটা গাড়ি শো করে বাসার ভেতরে আসলো। মধু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল দেখল ফুয়াদের গাড়ি‌। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টির জন্য দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে গেল। মধু তাকিয়ে র‌ইল। চলে যেতে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল।
সবাই লাঞ্চে বসেছে তখনি এসে উপস্থিত হয়েছে মিতুল।

তিন্নি মধুর কানে ফিসফিস করে বলল,,” দোস্ত এই মিতুল আপু এতো ঘনঘন আসা শুরু করল‌ কেন বলতো?”
মধু বলল,,” তোর ভাবী আমি কীভাবে জানব সে কেন আসে। আর আসলে সমস্যা কি?”
” সমস্যা নাই কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আপু‌ই বলেছিল সে নাকি বিয়ের আগে এতো ঘনঘন হবু শশুর বাড়ি আসবে না। তার নাকি খুব লজ্জা করে কিন্তু এখন দেখ সুযোগ পেলেই চলে আসছে।”
মধু কিছুই বলল না। খাবার খেয়ে উঠে চলে এল। মিতুল কে খেতে বলা হয়েছিল ও খায়নি। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ছিল। মধু সবার আগে খাওয়া শেষ করে এদিক দিয়ে দুতলায় যাচ্ছিল। মিতুল পিছু ডাকল‌। মধু চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
” কিছু বলবেন আপু?”

মিতুল মুখে হাসি নিয়ে নরম সুরে বলল,,” কেমন আছো?”
মধু অবাক স্বরে বলল,,” ভালো‌ আপনি কেমন আছেন?”
মধুর চোখ মুখে চরম বিষ্ময়। মিতুলের থেকে যতটা সম্ভব খারাপ ব্যবহার পেয়েছে আজ ভাল আচরণ দেখে ও পুরাই হতবাক।‌
” হ্যা ভালো‌। তুমি সেই যে একমাস আগে পালিয়ে এলে এখনো অন্যের বাসায় পরে আছো লজ্জা করছে না? নিজের বাসায় ফিরে যাচ্ছ না কেন?”

মধু লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। মাথা নিচু করে ফেলল।
মিতুল আবার বলল,,” আমার কথায় তোমার খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি কিন্তু তুমিই বলো আমি কি ভুল‌ কিছু বলেছি? এভাবে একজনের বাসায় কেউ এভাবে থাকতে পারে এতো দিন। সবাই ভদ্রতার খাতিরে তোমাকে নিজে থেকে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু তুমি তাই বেহায়ার মতো এতো দিন থাকবে‌। এবার তোমার নিজের বাড়ি চলে যাওয়া উচিত।”
মধু অনেক চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারল না।

ওর চোখ বেয়ে গলগলিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
মধু জড়ানো গলায় বলল,,” আমি খুব শীঘ্রই চলে যাব আপু। ধন্যবাদ আমাকে ভালো পরামর্শ দেওয়ার জন্য।”
মধু আর এক সেকেন্ড দাঁড়াল না। এক দৌড়ে সিঁড়ি ধাপ অতিক্রম করতে লাগল এলোমেলো পায়ে। ফুয়াদ ফোন টিপতে টিপতে নিচে নামছিল হঠাৎ ঝড়ের বেগে মধু কে ছুটতে দেখে ও কপাল কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। এক পলকেই মেয়েটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। ফুয়াদ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। মধু চোখের আড়াল হতেই নিচে নেমে দেখল মিতুল বসে আছে। ফুয়াদ আবার ফোনে মনোযোগ দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। মিতুল ওকে দেখেই কথা‌ বলতে আসলো ফুয়াদ ওকে অবজ্ঞা করে চলে গেল।

ফাহাদ মিতুলের পাশে বসে বলল,,” তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে আসলে?”
মিতুল শক্ত মুখে বলল,,” গাড়ি করে এসেছি।”
” হঠাৎ এলে যে আজো কি বেড়াতে যাব নাকি আমরা?”
” না এমনিতেই আসছি। তোমার পড়ালেখার কি অবস্থা?”
” ভালো। আজ তো বৃষ্টির জন্য আমি স্কুল এ যা‌ই নি। আর তুমি আমাদের বাসায় চলে এলে।”
মিতুল মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে‌। নাফিসা আসতেই মিতুল তাকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে বলল,” আন্টি কেমন আছো তুমি?”

নাফিসা সোফায় বসে বলল,,” আছি ভালোই। তা এই ঝড়ের মধ্যে বের হয়েছ যে। এইসময় গাড়ি চালানো ঠিক না। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।”
” আসলে আন্টি তোমাদের খুব মিস করছিলাম তাই চলে এলাম অনেক দিন ধরেই থাকা হয়না এখানে। তাই ভাবলাম আজ থেকে যাই। ‌বাসায় আম্মু আর নিহা মামার বাসায় গেছে আমি একা এই ঝড়ের মধ্যে থাকতে ভালো লাগছিল না।”
” বেশ ভালো করেছ। খেলে না যে?”
” আমি খেয়ে এসেছি আন্টি।”

মিতুল তার পাশেই বসে গল্প করতে লাগল। ফাহাদ মায়ের উপস্থিতি পেতেই উধাও হয়েছে।
রাহী আর সমুদ্র আসলো সন্ধ্যা নাগাদ। রাহী আপু এসেই না খেয়ে ঘুম। মধু তিন্নির আর ফাহাদ লুডু খেলছিল‌। আর একজন থাকলে জমতো ভাল কিন্তু এখন রাহী আপু আসবে না। সমুদ্র ও খাবার খেয়েই ঘুম। এখন বাকি আছে ফুয়াদ আর মিতুল। মধুর মন খারাপ ছিল মিতুলের তিক্ত কথা শোনার পর থেক। কিন্তু নিজের চোখের জল ও আর কাউকে দেখায় নি। তিন্নি আসার আগেই নিজেকে সামলে নিয়েছে।
ফাহাদ আর তিন্নি লুডু আনতেই মন খারাপ ফেলে খেলতে বসেছে। ফাহাদ এক দান খেলে উঠে চলে গেল যেকোনো আরেকজন কে ডাকতে।

” যাই ফুয়াদ ভাইকে ডেকে আনি।”
তিন্নি বলল,,” ভাইয়া আসবে না‌ শুধু শুধু ফাহাদ গেলে এক ধমক খেয়ে আসবে দেখিস।”
মধু কিছুই বলল না শুধু হাসল।
” বলে দেখি না আসলে মিতুল ভাবি আছে, আম্মু চাচি যাকে পাব তাকেই নিয়ে আসব।” বলেই ফাহাদ দৌড়ে চলে গেল।
একটু পর রুমে প্রবেশ করল ফাহাদ, মিতুল ও ফুয়াদ। মধু মিতুল কে দেখেই ওর খেলার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে গেল। এতো তিক্ত কথা শুনে তাকে পছন্দ বা তার সাথে ভালো করে চলার মতো ভালো মেয়ে ও না। চারজনের জায়গায় পাঁচজন হয়ে গেল। এবার খেলবে কি করে? কাকে বাদ দিবে?

মধু ফট করেই উঠে দাঁড়াল আল ফাহাদ কে উদ্দেশ্য করে বলল,,” আমি খেলব না। তোমরা খেলো।”
তিন্নি মধুর হাত টেনে ধরে বলল,,” কি হলো উঠিস ক্যান? তুই খেল আমি পরের বার খেলব।”
মধু বসল না। ফোন হাতে তুলে বলল,,” আমার জরুরি কল আছে। তোরা খেল কথা বলে আসি।”

প্রেয়সী পর্ব ১৬

বলেই বেলকনিতে এসে বসল। কারো দিকে তাকাল ও না একবার। মিতুলের সামনে থাকতেও অসহ্য লাগে ওর। বেলকনিতে এসে মধু ফেসবুকে লগইন করে দেখল সমুদ্র ওকে রিকোয়েস্ট দিয়েছে। ও রিসিভ করল। তারপর নিউজফিডে স্কল করতে লাগল।

প্রেয়সী পর্ব ১৮