কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৪১

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৪১
জাওয়াদ জামী

অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে শিখা কান্তার সাথে একান্তে কথা বলতে চায়। সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে কান্তার মুখোমুখি হয় শিখা।
কান্তা উসখুস করছে। ও কিছুতেই শিখার পূর্বের আচরণগুলো ভুলতে পারেনা। শিখার হিং’স্র’তা ওর মন ও মস্তিষ্কের প্রতিটি কোনে গেঁথে গিয়েছে।
শিখা কান্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, কান্তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।

” যদি আর বেঁচে না ফিরি, তবে আমার ছেলেটাকে দেখিস। দেরিতে হলেও আজ বুঝতে পারলাম, কে আমার আপনজন। সারা জীবন যাদের জন্য সংসারকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছি, আজ তারাই আমাকে নিজেদের পিঠ দেখাল। অথচ আজ আমার স্থান তাদের বুকে হওয়ার কথা। তুই আমাকে মাফ করে দিস। তুই মাফ না করলে আমাকে অনন্তকাল ধরে জ্বলতেই হবে। এতদিন তোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছি, অথচ আমার কঠিন সময়ে তুই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিস।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অতীতের কথা একটাবারও না তুলেই নিজের মানবিকতা দেখিয়ে দিলি। আমি তোর খারাপ চাইলে কি হবে! ওপরওয়ালা তোর সাথে আছেন। তাই আজ তোর কাছে আমি চিরদিনের জন্য ঋণি হয়ে গেলাম। আচ্ছা শোন, এই কয়দিন ঢাকা আছি অথচ তোর মেয়েকে দেখতে পারলামনা। যদি ফিরে আসি, তবে মেয়েটাকে একবার দেখাস। তোর ভাই দিনে কয়েকবার করে ওর কথা বলে। আরাফও তাই। যাই রে, দোয়া করিস, যেন নিজেকে বদলানোর সুযোগ পাই। ” শিখা চোখের পানি মুছে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। কান্তাকে কোন কথা বলার সুযোগ দেয়না।

কান্তা শিখার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবে, ভাগ্য যে কখন, কাকে, কোথায় এনে দাঁড় করায়, তা সৃষ্টকর্তা ছাড়া আর কেউই জানেনা। এই ছোট দুনিয়ায় নিজের কৃতকর্মের ফল, ঘুরেফিরে নিজের উপরই পতিত হয়।
যথাসময়ে শিখার অপারেশন শেষ হয়। ডক্টর জানায়, ওকে তিনদিন অবজারভেশনে রাখবে। এরপর যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাতদিন পর ডক্টর জানায়, শিখার শারিরীক অবস্থা আগের থেকে ভালো। তবে তাকে আর কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হবে। হার্টের চিকিৎসার জন্য। তাছারা ডায়বেটিস থাকায় অপারেশনের ক্ষত শুকাতে সময় লাগবে এবং ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই অপারেশনের পরও বিশ দিন ওকে হসপিটালে ডক্টরের তত্বাবধানে থাকতে হয়।
কান্তা খাবার নিয়ে হসপিটালে এসেছে। আজ ও সাথে করে মেয়েকে নিয়ে এসেছে। ওর মেয়ের বয়স তিনমাসের বেশি হচ্ছে।

শিখা বেডে শুয়ে আছে। ওর পাশে আরাফ বসে আছে। জাবেদ সিস্টারের সাথে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে।
কান্তাকে দেখে আরাফ দৌড়ে আসে। কায়াকে কোলে নিতে হাত বাড়ায়। কান্তা হাসিমুখে আরাফের কোলে দেয় মেয়েকে। খাবারের পাত্র নিয়ে এগিয়ে যায় শিখার কাছে।
” আজ কেমন আছো, ভাবি? ”
” ভালো আছিরে। তুই কেমন আছিস? মেয়েকেও নিয়ে এসেছিস! কই আমার কাছে একটু নিয়ে আয়। আমিও একটু ওকে দেখি। ”

মায়ের কথা কানে যেতেই আরাফ কায়াকে নিয়ে ওর মা’য়ের কাছে আসে। শিখা আলতোভাবে কায়াকে কোলে নেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ ওকে কোলে রাখতে পারেনা। কান্তার কাছে ফিরিয়ে দেয়। কান্তা বেডের পাশে চেয়ারে কায়াকে নিয়ে বসে। শিখা ওর বালিশের নিচ থেকে পার্স বের করে। এরপর ভেতর থেকে একটা সোনার চেইন নিয়ে পরিয়ে দেয় কায়ার গলায়।

” আমি নতুন জিনিস দিয়ে মেয়েটার মুখ দেখতে পারলামনা। এটা আমার চেইন। অপারেশনের আগে খুলে রেখেছিলাম। আপাতত মেয়েকে এটাই দিলাম। এরপর আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি গিয়ে ওর জন্য একসেট সোনার জিনিস গড়িয়ে আনব। ”
” তোমার চেইন দেয়া লাগবে কেন! ভাইয়া ওকে দিয়েছে তো। ওকে যা দেয়ার দিয়েছ। পরে আর কিছুই দিতে হবেনা। ”
” বিয়ের সময় তোকে কিছুই দেয়া হয়নি। তাই তোর মেয়ে ডাবল সোনা পাবে ওর মামার বাড়ি থেকে। তুই আর এই বিষয়ে কোন কথা বলিসনা। ”

কান্তা ওর ভাবিকে যতই দেখছে, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এতটা পরিবর্তনও হয়!
জাবেদ এসে কায়াকে কোলে নেয়। তখন কান্তা উঠে শিখাকে খাওয়ানোর জন্য। শিখাকে খাইয়ে, জাবেদকে খেতে দেয়। এরপর কিছুক্ষণ ওদের সাথে গল্পগুজব করে। এরপর শহিদ আহমেদ হসপিটালে আসলে আরাফকে নিয়ে ওরা বাসায় ফিরে। কান্তা আরাফকে হসপিটালে থাকতে দেয়না। নিজের কাছেই রাখে।

বিশ দিন পর শিখাকে রিলিজ দিলে, শহিদ আহমেদের জোড়াজুড়িতে শিখাকে নিয়ে জাবেদ তাদের বাসায় উঠে। সেখানে দশদিন থাকার পর ওরা বাড়ি ফিরে। এই দশ দিন কান্তা শিখার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে, সেবাযত্ন করেছে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ শিখা ও জাবেদের সাথে আপনজনের মতই আচরণ করেছে। শ্রীজার সাথে শিখার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

বিদায় কালে শিখা হঠাৎই কান্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। এই একমাসের বেশি সময় কান্তা শিখার সাথে কোন খারাপ আচরণ করেনি। কমতি রাখেনি শিখার সেবাযত্নের।
শিখা সেদিনের পর থেকে নিজের বাবা-মা আর বোনের সাথে একবারও কথা বলেনি। তারা মাঝেমধ্যে ফোন দিলে ও জাবেদকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। জাবেদ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে, শিখা জানিয়েছে, সুসময়ের বন্ধুর ওর কোন প্রয়োজন নেই। জাবেদও আর কোন কথা বাড়ায়নি।

ওরা রওনা দেয়ার সময় কান্তা জাবেদের হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে শিখা রান্না করতে পারবেনা ভেবেই কান্তা খাবার ফ্রোজেন করে রেখেছিল। আগামী সাতদিন শিখাকে কোন রান্না করতে হবেনা। এছাড়া কান্তা আরমানের নির্দেশে শিখাকে ওর ভাই, ভাতিজাকে পোশাক কিনে দেয়। যাওয়ার সময় জাবেদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। যদিও জাবেদ এসবের কিছুই নিতে চায়নি। কিন্তু কান্তার জোড়াজুড়িতে নিতে বাধ্য হয়।
জাবেদ যাওয়ার আগে শহিদ আহমেদকে জানায়, ও বাড়িতে ফিরেই তার টাকা পাঠিয়ে দিবে।
শহিদ আহমেদ তাকে বলেন, তারাহুরো না করতে। টাকাগুলো ধীরেসুস্থে দিলেই হবে।

শিখা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বামী-সন্তানের সাথে বেরিয়ে যায়। পেছনে ফেলে রেখে যায়, তার অতীতের তিক্ত স্মৃতি। অতীতকে পেছনে ফেলে, সৃষ্টি হওয়া নতুন সম্পর্কের বাঁধনকে মজবুত করতে পা বাড়ায় নিজের গন্তব্যে। এবার পুরাতন শিখাকে ভেঙ্গেচুরে, নতুন শিখাকে গড়ে তোলার সময় এসেছে।
আরমান ঢাকায় এসে ওর বাবাকে নিয়ে খালার বাসায় গিয়ে, শ্রীজার বিয়ের দিন ঠিক করে আসে। সামনের মাসের পনের তারিখ বিয়ের দিন ঠিক করে। সে হিসেবে ওদের হাতে আর পঁচিশ দিন সময় আছে।
আরমান কান্তাকে এই কয়দিন ঢাকাতেই থাকতে বলে। কান্তাও সহাস্যে রাজি হয়।

আরমান অফিসে বসে কাজ করছে। এমন সময় টেবিলে থাকা ওর ফোন বেজে ওঠে। আরমান ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ঢাকার ধানমন্ডি থানা থেকে ওসি ফোন দিয়েছে। এই সময় ওসির ফোন দেখে আরমানের কপালে ভাঁজ পরে। কয়েক মূহুর্ত চুপচাপ থেকে ফোন রিসিভ করে।

” আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি ধানমন্ডি থানার ওসি বলছিলাম। ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি চিনতে পেরেছি। বলুন কেন ফোন দিয়েছেন? ”
” স্যার, আপনিতো জানেন, আপনার বাবাকে আঘাত করা সেই ড্রাইভার, দেড়মাস আগে জামিন পেয়েছে। ও জামিনে বের হওয়ার পর থেকে, আমরা ওর দিকে নজর রাখছিলাম। ওর ফোনে আঁড়িপাতার ব্যবস্থা করেছিলাম। এছাড়া সাতদিন পর পর ওর কল লিষ্ট চেইক করি। গতকালই আমরা ওর কল লিষ্ট চেইক করেছি। সেখানে আমরা কিছু অসংগতি পেয়েছি। ”

” কি অসংগতি? ” আরমানের হার্টবিট বেড়ে গেছে।
” গত পাঁচদিন আগে ওর ফোনে একটা ফোন এসেছিল। ও প্রায় ছয় মিনিট সেই নম্বরে কথা বলেছে। এর একদিন পর আবার সেই নম্বর থেকে ওর কাছে ফোন আসে। আর গতকাল ওর এ্যাকাউন্টে হঠাৎ করেই পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়েছে কেউ। আমরা খোঁজ নিয়েছি সেই অজ্ঞাত নম্বরের ব্যাক্তি সম্পর্কে। আর এ-ও জানতে পেরেছি, সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটিই ড্রাইভারের এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে। ”

ওসির কথা শুনে আরমান হাতের মুঠো শক্ত করে। সেই সাথে শক্ত হয় ওর চোয়াল।
” আপনারা নিয়মিত ওর খোঁজ রাখুন। আর আমাদের কেউ যেন ওর আশেপাশে না যায়। ওকে বুঝতে দেয়া যাবেনা, আমরা ওকে ফলো করছি। আপনারা আগে সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তির ডিটেইলস জানুন। এরপর যা ব্যবস্থা করার করতে হবে। আমি দুইদিনের ভেতর ঢাকায় আসছি। এই দুই দিন তাকে নির্বিঘ্নে থাকতে দিন। আর কল লিষ্ট আমাকে এখুনি ইমেইল করুন। ”

আরমান ফোন রেখে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। এরইমধ্যে ওসি কল লিষ্ট আরমানকে ইমেইল করেছে। আরমান লিষ্টে চোখ বুলিয়ে, ফোন করে তার সোর্সদের। যাবতীয় নির্দেশনা দেয় তাদের।

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৪০

বিঃদ্রঃ গল্প লিখার পর রি-চেইক দেয়ার সময় হয়না। তাই বানান একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। আপনার সেগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৪২