কুসুম কাঁটা পর্ব ১২

কুসুম কাঁটা পর্ব ১২
সাবিকুন নাহার নিপা

স্বপ্নীল অফিসে এসে দেখলো ওর মতো আরও কয়েকজন এসেছে। সবাই ই ফর্মাল ড্রেসে। কিন্তু তাদের দেখতে ভালো লাগছে। ও’কে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। চারজনের মধ্যে একজন মেয়ে আছে। সে বোধহয় একটু বেশি বিরক্ত। কেমন যেন বিরক্তি নিয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে। স্বপ্নীলের ভীষণ নার্ভাস লাগলো৷

ইচ্ছে করছে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু সেটা যাবে না। এই চাকরি টা যদি করতে পারে তাহলে দাদু নাকি ও’কে আর গাধা, গরু ডাকবে না।
কিছুক্ষন পর ওদের টিমে ভাগ করে দেয়া হলো। প্রথম দিন তেমন কাজ নেই, সবার সঙ্গে হাই, হ্যালো করলো। অন্যদের কাজ দেখলো, কফি খেল। সবাইকে দেখে বুঝলো যে এমন সেজেগুজে না আসলেও চলবে। অফিসের পরিবেশ টা ভালোই। ফ্যামিলি টাইপ ভাইব পাওয়া যায়৷ দুপুরের দিকে মনে হলো এখানে খারাপ লাগবে না৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শ্রাবণ্য শপিংমলে গিয়েছিল একটু। নিজের দরকারী কিছু জিনিস কিনলো। একাই চকলেট, কফি খেয়ে ঘুরে বেড়ালো। দুপুরের দিকে স্বপ্নীল ফোন করে জিজ্ঞেস করলো,
“শ্রাবণ্য তুমি পৌছে গেছ?”
“না আমি একটু বসুন্ধরায় এসেছি।”
“ওহ। একা গেলে কেন? আমাকেও বলতে।”
“একা একা ঘুরতে ভালো লাগে আমার। আপনার কী খবর? অফিস কেমন লাগছে? ”
“তেমন ভালো না।”
“আস্তে আস্তে লাগবে। এখন রাখি।”
“আচ্ছা।”

শ্রাবণ্য বাড়ি ফিরে দেখলো বাবা, মা এসেছেন। আজ যে আসবে সেটা ও’কে জানায় নি। বাবা ও’কে দেখে বললেন,
“তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
শ্রাবণ্য বুঝতে পারলো কি বিষয়ে কথা বলবে। বাবার কাছে সব খবর যায়। যতই আকাশীকে অস্বীকার করুক, তার খবর বাবা জানেন। শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
মা গেলেন শ্রাবণ্যর সঙ্গে। তিনি অস্থির প্রকৃতির মানুষ। বললেন,
“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হই। কত বড় বেয়াদব মেয়ে হইছিস তুই।”
শ্রাবণ্য জবাব দিলো না। মা যে ওর শ্বশুর বাড়ি এসে এভাবে কথা বলছেন এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই৷ আসলে মা কোনোদিন ই ওদের পক্ষের লোক না৷ সে সবসময় বাবার হয়ে কথা বলেন। বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা ভুল কিছু করলেও সে বাবাকে সেটা বলে দিতেন। তার মাথার মধ্যে এটা ঢুকে গেছে, জগতে সব সঠিক কাজ শুধু তার স্বামীই করেন।
মা আবারও বললেন,

“তুই তোর বাবার কথা অমান্য করলি কোন সাহসে?”
শ্রাবণ্য মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,
“এখন তো আর বাবার বাড়িতে থাকি না যে অমান্য করা যাবে না। এখানে তো যা খুশি তাই করতে পারি। ‘
রেহানা রেগে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন,
“এক থাপ্পড় মারব। দুদিন হলো বিয়ের, এরমধ্যে এতো ডানা গজিয়েছে। তুই যা খুশি করতে পারিস না। তুই চলবি এই বাড়ির নিয়মে। স্বপ্নীল, আর বড়দের কথা শুনে।”
শ্রাবণ্য এই কথার জবাবে কিছু বলল না। রেহানাকে ওভাবে রেখেই বেরিয়ে গেল।

শ্রাবণ্যর বাবা মুনসুর আলী ব্যবসায়ী মানুষ। পৈতৃক সম্পত্তি কে বাড়িয়ে চাড়িয়ে অনেক কিছু করেছেন। তিনি গম্ভীর, রাগী স্বভাবের। নিজের যুক্তিতে চলেন। মান, মর্জাদা নিয়ে খুব ই খুতখুতে ধরনের। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটার নড়চড় খুব কম ই হন। ছেলেমেয়েদের প্রতি যে মায়া মমতা আছে সেটার বহিপ্রকাশও ঘটে খুব কম।
শ্রাবণ্য বাবার মুখোমুখি বসলো। একটু পর রেহানা এসে বসলেন। ওদের ফ্যামিলির আলাপ বলে কেউ এদিকে ভিড়ছে না। মন্টি, রিন্টি পর্দার ফাঁক থেকে মাঝেমধ্যে দেখে যায়। মামীর মোচওয়ালা বাবাটাও ওদের বাবার মতোই। চকলেট, জুস আনে ঠিকই। কিন্তু ভীষণ রাগী।
মুনসুর শ্রাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আকাশীর কথা এই বাড়ির লোকজনকে তুমি কী বলেছ?”
শ্রাবণ্যর জবাবও বাবার মতো সোজা সাপ্টা। বলল,
“স্বপ্নীল ছাড়া আর কাউকে কিছু বলিনি। স্বপ্নীল চাইছিল আমি আপুকে হেল্প করি।”
“আকাশী এখন কোথায়? ”
“আমি যেখানে ছিলাম। ”

রেহানা শ্রাবণ্যকে কিছু বলতে গেলে মুনসুর থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ও কী ওই ছেলের সঙ্গে থাকবে না?”
“সেরকম ই জানালো৷ ”
মুনসুর কিছু সময় নীরব থেকে বলল,

“আকাশীকে তুমি জানাবে, ও যদি আমার কথা শুনে চলে তাহলে আরও একবার আমার ঘরে ওর জায়গা হবে। সব মানুষের ই আরেকবার সুযোগের দরকার হয়। তবে এটাই লাস্ট সুযোগ। এবং ও’কে আমার কথা শুনে চলতে হবে। আমি যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব তাকে বিয়ে করতে হবে।”
শ্রাবণ্য মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের মুখ টা থমথমে। বাবার সিদ্ধান্ত এমন কিছু হবে সেটা আশা করে নি৷
এই সুযোগে বাড়ির লোক আকাশীর কথা জেনে গেল। দাদু, তুলি সবাই বলল আকাশীকে এখানে এনে রাখতে। শ্রাবণ্যর সেটা মন:পুত হলো না। ও কাউকে কিছু বলল না অবশ্য।

স্বপ্নীল সন্ধ্যেবেলা ফিরলো ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে। একটা দিন অফিস করেই হাপিয়ে গেছে বেচারা। শ্রাবণ্যর ভীষণ হাসি পেল। ওর মাঝেমধ্যে ভাবতে কষ্ট হয় যে এই ছেলেটা বয়সে বড় একজন কে পছন্দ করেছিল। সবকিছুতে যে অল্পেই বিচলিত হয় সে কিভাবে এরকম দু:সাহসিক কাজ করলো।
স্বপ্নীল ঘরে ঢুকে শ্রাবণ্যকে বলল,
“তুমি তো আমাকে বললে না যে আমাকে হাস্যকর লাগছিল।”
শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,

“কেউ বলেছে?”
“হ্যাঁ। অফিসের একটা মেয়ে হাসলো আমাকে দেখে। ”
“অফিস কেমন লাগলো? ”
“ভালো না। আমার আসলে লোকজন ভালো লাগে না। ”
“তাহলে চাকরি কিভাবে করবেন?”

“মনে হয় করতে পারব না। ওখানে সবাই কাজে ভীষণ দক্ষ, আমি ওদের সঙ্গে পারব না। ”
শ্রাবণ্য ঠোঁট টিপে হেসে বলল, অনেক কিছুই ভালো লাগে না, এই যে আপনার পায়ের কাছে মাথা রেখে আমি ঘুমাই, মানে একটা মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করতে ভালো লাগে?
স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। একটা মেয়ে শব্দটাই তো অদ্ভুত। দূরের কারো কথা বললে এমন লাগে। শ্রাবণ্য তো দূরের কেউ না।

স্বপ্নীল বলল, তুমি একটা মেয়ে কেন হবে? তুমি তো আমার বউ।
শ্রাবণ্যও স্বপ্নীলের দিকে অন্য চোখে তাকালো। স্বপ্নীল চোখ নামিয়ে নেয়। ও নীলাকে ভালোবাসে, তবুও শ্রাবণ্য ওর জীবনে কেমন যেন অন্যরকম একজন।
শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবে, একটা কিছু সমস্যা হচ্ছে। স্বপ্নীল দিন দিন জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে। না চাইতেও সবচেয়ে বেশী কথা ওর স্বপ্নীলের সঙ্গেই হয়।

মাস খানেক পরের ঘটনা।
মিশুক এই বাড়িতেই আছে। বাতাসী খালা এখন ওর সঙ্গে কথা কম বলেন। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে চলে যান। তার দু:খের গল্পগুলোও এখন আর মিশুকের সঙ্গে শেয়ার করে না।
বাড়ির লোকজন আগে যেমন ছিলো তেমন ই আছে। স্বপ্নীলের সঙ্গে সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। স্বপ্নীল ওর কাছ থেকে ইকোনমিকস এর বইগুলো নিয়ে পড়ছে ইদানীং।

দাদু আগের মতোই গম্ভীর স্বরে কথা বলেন। দাদী এসেছেন অনেক দিন বাদে। তিনি মিশুকের সামনে আসেন। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেন। মন্টি, রিন্টি আঙ্কেল ডাকার পরিবর্তে মামা বলে ডাকে। মিশুক অবশ্য বাচ্চা দুটোকে অতো সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। বাচ্চা দুটো ইচড়ে পাকা। ওর নিজেরও একটা ভাগ্নে আছে। বাসার বাইরে খেলতে গিয়ে প্রতিবার ই মার খেয়ে আসে। এই বাচ্চাদের মতো না।
একদিন সন্ধ্যেবেলা শ্রাবণ্য এলো কিছু বরফি, সন্দেশ নিয়ে। এসে বলল,

“আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ। আপনি?”
“আমিও ভালো। আমাকে তুমি করে বলুন। আমি ইউনিভার্সিটি তে পড়ছি এখনো। এই নিন মিষ্টি খান।”
মিশুক প্লেট টা হাতে নিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ। কিসের মিষ্টি? ”
এই বাসায় প্রতি শুক্রবারে মিলাদের মিষ্টি আসে। আজ শুক্রবার না বলেই মিশুক জিজ্ঞেস করলো।
শ্রাবণ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, ছোট আপুর বিয়ের।
মিশুক মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করলো,

“কার?”
“রঙ আপুর। বিয়েতে মত দিয়েছে।”
মিশুক স্বাভাবিক ভাবেই দুটো মিষ্টি খেল। বিষয় টা স্বাভাবিক ই। তবুও ওর কৌতূহল গেল না। কোথায় বিয়ে ঠিক হয়েছে, কার সঙ্গে হয়েছে এগুলো জানার ইচ্ছে হলো খুব।
রঙ্গনার সঙ্গে ওর এই এক মাসে দুটো কথা হয়েছে। কারেন্টের লাইনের কাজ চলছিল তখন বলেছিল, সবকিছু অফ রাখতে। এছাড়া বাড়তি কথা হয় নি।

কুসুম কাঁটা পর্ব ১১

রঙ্গনা বিয়েতে মত দিয়েছে। তার জন্য পাত্রকে হতে হবে পুলিশ অথবা পাইলট। ভুড়ি থাকলে চলবে না। আর গায়ের রঙ যেন ফর্সা হয়। কারণ ওর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে লাগবে। নিজের রঙ টা ঘষেমেজে ফর্সা বানালেও লাভ নেই। দুদিন পর আগের রঙেই ফিরে আসে।

কুসুম কাঁটা পর্ব ১৩