কুসুম কাঁটা পর্ব ১৭

কুসুম কাঁটা পর্ব ১৭
সাবিকুন নাহার নিপা

স্বপ্নীল দুদিন ধরে শ্রাবণ্যর সঙ্গে কথা বলছে না। শ্রাবণ্য অবশ্য কারণ বুঝতে পারলো না, ও তেমন কিছু করেও নি। ছোট আপুর রাগ ও’কে দেখাচ্ছে সেটা ভাবলো প্রথমে। কিন্তু ছোট আপুর সাথে ঠিকই কথা বলছে। শ্রাবণ্য কিছু জিজ্ঞেস করলে ঘাড় নেড়ে জবাব দেয়। মুখ দিয়ে হু, হা পর্যন্ত বেরোয় না।
সকালে চুপচাপ রেডি হচ্ছে অফিসে যাবার জন্য। অন্যান্য দিন যাবার সময় বকবক করে। ফিরে আবার অফিসের কথা বলে। এই দুদিন ব্যতিক্রম হয়েছে। ফিরে চুপচাপ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।
শ্রাবণ্য আজও আগ বাড়িয়ে বলল,

“অফিসে যাচ্ছেন?”
স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলো। ও হেসে ফেলল। বলল,
“আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে আপনি কেন রেগে আছেন? বুঝতে পারলে সরি বলে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতাম। ”
স্বপ্নীল সিদ্ধান্ত নিলো যে কথা বলবে। আসলে এই দুদিন কথা না বলে ওরও খারাপ লাগছে। কিন্তু অভিমানও ভাঙছে না।
শ্রাবণ্য তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। স্বপ্নীল বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি তোমার উপর রেগে আছি। ”
“সেটা বুঝেছি। রাগের কারণ বুঝিনি।”
“তুমি সেদিন ছোটপার কথায় আমাকে নিয়ে হাসছ। আমি কষ্ট পেয়েছি। ”
শ্রাবণ্য বিস্মিত হলো। এই সামান্য ব্যাপারে ছেলেটা ওর সাথে দুদিন কথা না বলে মূক ও বধিরের মতো আচরণ করেছে। শ্রাবণ্য মৃদু হেসে বলল,

“আরেহ না তো। আমি তো আপনার জন্য হাসি নি। ”
স্বপ্নীলের চোখে কপট অভিমান। নাক ফুলিয়ে বলল,
“মিথ্যে কথা। আমি তোমাকে দেখেছি হাসতে। ”
“না। আপনাকে দেখে হাসি নি। আমি তো ছোট আপুকে দেখে হাসলাম। আপু যখন রেগে গেছে তখন ষাঁড়ের মতো লাগছিল। নাক ফুলে ফুলে উঠছিল। ”

শ্রাবণ্য এক্ষুনি একটা ঢাহা মিথ্যে বলল। আসলেই সেদিন ও স্বপ্নীল কে দেখে হাসছিল। রঙ্গনা যখন স্বপ্নীল কে বকাবকি করছিল তখন ওর মুখ টা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেছে। অন্যদিকে রেগেও গেছিল। দেখে শ্রাবণ্যর ভীষণ হাসি পেয়েছিল। ফিক করে হেসে ফেলল।
শ্রাবণ্যর মিথ্যেটা স্বপ্নীল সত্যি ভেবে নিলো। ও হেসে বলল,
“ঠিক ই বলেছ। ছোটপা কে দেখতে ষাঁড়ের মতোই লাগে। আর স্বভাবও তেমনই। সবসময় ই দেখবে কাউকে না কাউকে গুতাচ্ছে। ”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। স্বপ্নীলের মনের অভিমানী মেঘ কেটে গেছে। ওর এখন একটু খারাপ লাগলো। শুধু শুধু ও শ্রাবণ্যর সঙ্গে রেগে কথা বলল না। আসলেই ও সবকিছু কম বোঝে।
শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবলো। আল্লাহ এই মানুষ কে কিভাবে বানিয়েছেন! আর ওরও এমন হয়েছে! স্বপ্নীল কে কষ্ট দিতেও খারাপ লাগে।

রঙ্গনা বিয়ের জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিলাকে বলল,
“মা আমি ফকিরের মতো বিয়ে করব না। স্বপ্নীলের বিয়ে দিছো ফকিরের মতো। আমার বিয়ে কিন্তু ধুমধাম করে হবে। আমি পারসোনায় সাজব। মেহেন্দি, হলুদ সব হবে। নিজের বিয়েতে নিজে নাচতেও পারি, ম্যুড ভালো থাকলে। ”
শিলা হেসে ফেললেন। বললেন,

“সব হবে। তোর বিয়েতে সব আয়োজন হবে। এই বাড়ির শেষ বিয়ে।”
মন্টি, রিন্টি পাশেই ছিলো। রিন্টি মন খারাপ করে বলল,
“আপুমনি, তুমি আমার বিয়ে দিবে না? আমি আর মন্টিও বিয়ে করব। ”
মন্টি গম্ভীর গলায় বলল,

“আমি এক্ষুনি বিয়ে করব না। আগে প্লেনে চড়ে বাবার কাছে যাব।”
শিলা হেসে ফেললেন শব্দ করে। রঙ্গনা দুজনকে এক ধমক দিয়ে বলল,
“এই তোরা এক্ষুনি বিয়ের কথা বলবি না। আগে আমার চুল সাদা হবে তারপর তোদের বিয়ে!”
রিন্টি চুপ করে ভাবতে লাগলো কবে ওদের মনির চুল সাদা হবে।

রঙ্গনার বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়েছে। হাতে বাকী দেড় মাস। এই সময়টা বাকীসব আয়োজনের জন্য নেয়া হয়েছে। যদিও রাফাত দের বাসা থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের ঝামেলা সেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রঙ্গনা কঠিন গলায় বলল,

“এতো কম সময়ে হবে না। আর বিয়ের ঝামেলা এটা কেমন কথা! বিয়ে তো একটা আনন্দের ব্যাপার। ঈদে যেমন আনন্দ হয় তেমন। এটাকে ঝামেলা কেন বলা হচ্ছে!”
তারপর আর কেউ কিছু বলে নি। কোনো এক বিচিত্র কারণে রাফাতদের বাসার সবাই রঙ্গনার রাগ কে ভয় পাচ্ছে। তারা তেমন অভিযোগ করছেন না। হতে পারে রাফাত কিছু বলেছে।

আকাশী আজ ই জানতে পারলো শুভর বাড়ি যাবার কথা। শিউলি জানিয়েছে। শুভর মা আর মুনা নাকি সবাই কে বলেছে আকাশী অন্য একজনের সাথে ভেগে গেছে। আকাশী কথাটা শুনে মন খারাপ করলো না। এগুলো স্বাভাবিক! কিছু মানুষের ভাবনাই থাকে নেতিবাচক। মেয়েদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবনা একটু বেশী ই আসে। তাছাড়া ও আর নরসিংদী যাচ্ছে না, তাই এগুলো শুনতেও হবে না। তবুও একটুখানি খানি খারাপ লাগা থেকেই যায়। শুভর ভাবনায় ও এতো নীচ সত্যিই জানা ছিলো না।

থাক, যে যেমন ভাবে ভাবুক। আকাশীর তাতে যায় আসে না। শুভ কে হয়তো সত্যিই ওর জীবন থেকে মুছে ফেলেছে। বোধহয় তাই ই হবে। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে এই প্রশ্ন টা নিজেকে করে। কিভাবে পারলো ও এক মিনিটের সিদ্ধান্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে! এতো সাহস কিভাবে হলো! উত্তর খুঁজে পায় নিজের কাছেই। ও তো বরাবরই সাহসী৷ রাজার জীবন ছেড়ে ও প্রজার জীবন বেছে নিয়েছিল শুভর জন্য। বাবার দিকেও ফিরে তাকায় নি একবারের জন্য৷ শুভ তো সেখানে অন্য মানুষ! হতে পারে ওর দেখা ভুল মানুষ।

আকাশী আজ নিজের জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। জমানো টাকা নিয়ে কিছু গজ কাপড়, রঙ এগুলো কিনলো। আঁকাআঁকি কখনোই ওর শখের অংশ ছিলো না। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ ছিলো বলে খাতায় ফুল এঁকে সময় নষ্ট করতো। সেটা যদি কাজে লাগিয়ে কিছু করা যায়! অনলাইনে অনেকেই তো এসব কিনছে। শুরু করতে দোষ তো নেই। এখন আর ভবিষ্যৎ ভাবতে চায় না। যা হবার হবে। হয় ভালো নাহয় খারাপ।

বাড়িতে রঙ মিস্ত্রী এসেছে। রঙ্গনা নিজের ঘরের দেয়ালে রঙ করাবে। মিশুক কেও বলল,
“তুমি চাইলে তোমার ঘরেও রঙ করিয়ে নিতে পারো। ”
মিশুক স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
“বিয়ে তো তোমার। আমার তো না।”
রঙ্গনা স্মিত হাসলো। এই ছেলেটা মহাপাজি। শুরুতে কী ভাব নিলো আপনি আজ্ঞে করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি…
আর এখন ও তুমি বলছে দেখে ও’কেও তুমি বলা শুরু করছে৷
মিশুক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার বিয়েটা ফাইনালি হচ্ছে!”
“কেন? তুমি কী ভেবেছিলে আমাকে বিয়ে করার জন্য বাংলাদেশে একজন পাত্রও পাওয়া যাবে না?”
“না সেরকম ভাবিনি। ”
“তাহলে কি ভেবেছ?”
“তোমাকে নিয়ে আমি কিছুই ভাবিনি। আমার অতো সময় কই?”

রঙ্গনার মুখটা লাল হয়ে গেল। রাগ কিংবা অপমানে। সামনাসামনি হেসে ফেললে দন্ডনীয় অপরাধ হবে ভেবে হাসলো না। এই মেয়েটার ভেতরে শিশুসুলভ সত্তাটি এখনো বিরাজমান। রাগ, হম্বিতম্বি দিয়ে আড়াল করে রাখছে। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে যদি একটু রোমান্টিক হয় তাহলে ভালো। বেরসিক হলে চিরকাল রাগই দেখে যাবে।

কুসুম কাঁটা পর্ব ১৬

মিশুক ইদানীং বড্ড বেশী এদের নিয়ে ভাবছে। এই বাড়ির একজন হয়ে উঠছে দিন দিন। সেটায় সমস্যা না, সমস্যা হলো রঙ্গনাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তার ব্যাপার টা। না চাইতেও ভাবনায় এসে যায়। পায়ের শব্দ শুনলে কান সজাগ হয়ে যায়। খেতে গেলে মনে হয় রঙ্গনার এখানে থাকা উচিত ছিলো। এসব কী ভালোলাগার কারণে হচ্ছে! সর্বনাশ! আগে ভালো লাগে নি আর এখন লাগতে শুরু করেছে। মিশুক নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়! এ কেমন চরিত্র ওর…..!

কুসুম কাঁটা পর্ব ১৮