কৃষ্ণবেণী পর্ব ১০

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১০
নন্দিনী নীলা

ঝড়ের রাত ভয়ে বকুল তৃষ্ণার রুমে একা না ঘুমিয়ে মায়ের রুমে চলে এসেছে। এখানে এসে আবার আরেক বিপদ। এই রুমের চালের অধিকাংশ জায়গায় ফুটো। এজন্য রুমে পানি পরে। বিছানার একপাশে বাটি বসিয়ে রেখেছে সেখানে টপ টপ করে পানি পরছে। নিচেও পরছে সেখানে বালতি রেখেছে তবুও নিচের মাটি ভিজে যাচ্ছে ছিটকে।

রুমের এক কোনায় হারিকেনের আলো জ্বলছে মিটিমিটি করে। তৃষ্ণার বাবা-মা দুজনে‌ই গোয়াল ঘরে গিয়েছে। খড়ির বেরার নিচ দিয়ে পানি ভেতরে চলে যাচ্ছে। আর তাতে গরু ছাগলের সমস্যা হচ্ছে। তারা কাপড়, মাটি দিয়ে ফাঁকা জায়গা আটকে পানি আটকাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বকুল গালে হাত দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা কয়টা পরছে বাটিতে তা গুনছে। ফোঁটা পরতে ঝনঝন করে শব্দ হচ্ছে।
বকুল নিজের বুবুকে মনে করছে। বৃষ্টির রাতে দুই বোন গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতো। ও ভয় পায় বলে তৃষ্ণা ওকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কত গল্প শোনাতো।
চোখ ছলছল করে অভিমানী গলায় বলল,” বুবু কত দিন তোমারে জড়িয়ে ধ‌ইরা ঘুমাই না। কবে আসবা তুমি। কত দিন তোমারে দেহি না।”

বকুলের মা রুমে এসে বকুল রে এখনো বসে থাকতে দেখে বলে,” এই তুই শুবি না? এহনো‌ ব‌ইয়া র‌ইছিস ক্যান?”
বকুল বিছানার এক কোনে শুয়ে পরল।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে আব্বা ক‌ইছিল শহরে যাইব। আমিও যামু বুবুর কাছে থাকমু। বকুল তখনি বাপকে ডেকে বলতে চাইল কথাটা কিন্তু এখন বললে বকা খাইবে তাই চুপ র‌ইল। কাল বলবে বলে ঘুমিয়ে গেল।

জায়ান আজ বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় এসেছে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতেই মন বলল, রোমাঞ্চকর একটা ওয়েদার। সেখানে বিবাহিত হয়েও যদি বউ ছাড়া থাকা হয় তাহলে সত্যিই খুব বড় অন্যায় হয়ে যাবে।

ও ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে তৃষ্ণার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় ভেতর থেকে লক করা। দুই তিনবার নক করে কিন্তু ভেতর থেকে সারা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আওয়াজ আসছে তাহলে জাগ্রত মানুষ একা একা কার সাথে কথা বলে? আবার দরজা খুলছে না! বিরক্তিকর গলায় ডেকে উঠে তৃষ্ণা’কে। তবুও খুলছে না। ও ফেরত চলে যায় রুমে এক্সটা চাবি আনতে।

এদিকে আয়ান ফ্লোরে ঠাস করে পরে গেছিল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। জায়ান যে রুমের বাইরে এসেছে ও বুঝে গেছে। ও তাড়াতাড়ি পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে। তারপর বাইরের আলোতে তৃষ্ণাকে দেখে ও তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,”ভাই’কে এসব বলতে যেও না। তাহলে আমি বলে দেব তুমি আমাকে এখানে আসতে বলছিলে।

ভাই তোমার সাথে দূরত্ব করে বলে তুমি ভাইয়ের মতো চেহারার আয়ানের প্রেমে পরে গেছ। এজন্য আয়ানের সান্নিধ্য নিতে চেয়েছিলে। আমি শুধু তোমার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আর ভাইকে বলেও লাভ নাই সে আমার থেকেও খারাপ। সে তার নিজের ভাইয়ের থেকে তোমাকে অবশ্যই সাপোর্ট করবে না। তাই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না। এসব বললে তোমার চরিত্র আমি দাগ লাগিয়ে দেব। মাইন্ড ইট।”

আয়ান দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল রুম থেকে দরজাটা খোলা পরে রইল।
তৃষ্ণা আবসা অন্ধকারে স্তম্ভিত হয়ে সে দিক পানে চেয়ে রইল। জায়ান কে বললে সত্যি কি তিনি বিশ্বাস করবে না আমাকে?
তৃষ্ণা দেয়ালের মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

যেখানে যেখানে আয়ান স্পর্শ করেছে সেই স্থান মন চাচ্ছে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে। তৃষ্ণার সারা শরীর মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে কাঁদছে। চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে ঠোঁট বেয়ে গলায় এসে পরছে। তৃষ্ণার মুখটা কাঁদার জন্য হা হয়েছিল। অশ্রু গড়িয়ে মুখের ভেতরে ঢুকে গেছে। নোনতা জল মুখের ভিতর
খক খক করে কেশে ওঠে বসে পরে।

জায়ান রুমে থেকে চাবি নিয়ে এসে দেখল দরজা খোলা। এবার প্রচন্ড রাগ হয় ওর। দরজা খুলেছে তবু ওকে ডাকল না। এতটাই নির্বোধ সে?
হাতে থাকা চাবি পকেটে ঢুকিয়ে জায়ান কপাল হাত দিয়ে ঘষে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে। নিজের মনটা শান্ত করে বউয়ের সাথে একটু রোমান্টিক ওয়েদার উপভোগ করার জন্য দুই কদম বাড়াতেই পায়ের তলায় পিচ্ছিল পায়।

আরো দুই কদম বাড়াতেই পরে যেতে নেয়। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয়। শংকিত চক্ষে ফ্লোরের দিকে তাকায়। থেকে থেকে বাজ পরছে এজন্য বৃষ্টির পানি এসে ফ্লোর ভিজে গেছে সেটা বুঝতে জায়ানের দুই সেকেন্ড লাগে। লাইট অন করতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটা আলোয় ঝলমল করে ওঠে।

সবার আগে নজর যায় ফ্লোরে পানি জমে সাগরের মত হয়ে আছে। জানালার পাশে পানি জমে সেই পানি গড়িয়ে ফ্লোর ভিজে সাগর বানিয়ে ফেলছে। যে কেউ অন্ধকারে এখানে হাঁটতে গেলে আছড়ে পরবে। এই পাশের কার্পেট ও ভিজে যাচ্ছে। এত কেয়ারলেস? কোথায় সে?

জানালা এভাবে কেউ খোলা রাখে? বাসাটা কে সাগর বানানো ইচ্ছে হয়েছে নাকি?
বিছানায় তৃষ্ণা নাই। চারপাশে নজর দিতেই দৃষ্টির গিয়ে ঠেকে ফ্লোরে। এক কোণে জড়োসড় হয়ে বসে আছে তার অর্ধাঙ্গিনী তৃষ্ণা।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভেজা। তার গায়ে রানি গোলাপি শাড়িটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। তৃষ্ণাকে দেখতে খুবই আবেদনময়ী লাগছে। তাকাতেই ঘোর লেগে গেল জায়ানের। কিন্তু জায়ান নিজের চক্ষু কে সংযত করল। এমন পাগলের মত এখানে বসে আছে কেন? সে নিজের শাড়িটা ও ঠিক করে গায়ে জড়ায় নি। এক পাশে আঁচল অবহেলায় ফেলে রেখেছে। ফর্সা ত্বক যেন আরো ফর্সা হয়ে উঠেছে।

সে থরথর করে কাঁপছে। তার বন্ধ চক্ষের পাতা, পাতলা চিকন গোলাপি ঠোঁট কাঁপছে। সেই তালে তার সারা শরীর কাঁপছে। হাটু উঁচু করে সেখানে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা সময় এই মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে। রাত বারো’টায় তৃষ্ণা জানলা খুলে ফ্লোরে বসে আছে কেন ভেজা শরীরে? সেটার ওর মাথায় ঢুকছে না!
জায়ানের দৃষ্টি স্তম্ভ! হতবিহ্বল চক্ষে বুঝার চেষ্টা করছে এখানে হচ্ছেটা কি?

” এই মেয়ে!”
যথেষ্ট গম্ভীরতা বজায় রেখে জায়ান ডাকল তৃষ্ণাকে। ওর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এখন। কারণ ওর মনে হচ্ছে তৃষ্ণা ছেলেমানুষি করে জানলা খুলে নিজে ভিজেছে।

পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসতেই তৃষ্ণা চক্ষুদ্বয় মেলে তাকায়। তৃষ্ণার চোখ দুটো রক্তিম হয়ে আছে। গোলাপি ঠোঁট দুটো নীল হয়ে এসেছে। ঠান্ডায় মুখের রং ফ্যাতফ্যাতে সাদা হয়ে গেছে। যেন শরীরে রক্ত নাই। জায়ান তৃষ্ণার মলিন মুখ দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলল। মুখ দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটাকে কেঁদেছে? কিন্তু কাঁদার কারণ কি?

“এত রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছ কেন? আর সারা রুম ভিজিয়ে এখানে এমন বসে আছ কেন সং সেজে? প্রবলেম কি তোমার? কি হয়েছে? ভেজা শরীরে কেঁপে মরতেছো অথচ ড্রেস চেঞ্জ করো নি। মরার শখ জেগেছে নাকি?”
জায়ান’কে আরেক দফা চমকে দিয়ে তৃষ্ণা ফট করেই দাঁড়িয়ে পরল। আর ভেজা শরীরে উঠে দু’হাতে জায়ান’কে জড়িয়ে ধরল।

তৃষ্ণার বরফের মতো শরীর’টা জায়ানের শরীর কে স্পর্শ করতেই জায়ানের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।
জায়ান বৃষ্টিতে ভিজেই বাসায় এসেছে কিন্তু তৃষ্ণার মত ঘন্টার পর ঘন্টা ভিজে নাই। ও শুধু গাড়ি থেকে নেমে বাসার ভেতরে ঢুকতে একটু ভিজেছিল। এজন্য ওর শরীরটা ঠান্ডা নয়। উষ্ণ ছিল কিন্তু এখন আর সেই উষ্ণ ভাবটা নেই। জায়ানের শরীরটা পাঁচ মিনিটে ঠান্ডা বরফ করে ফেলল তৃষ্ণার শীতল শরীর। জায়ান তৃষ্ণাকে আর কিছু বলার সুযোগই পেল না।

ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। তৃষ্ণা নিজেই জায়ান’কে ছেড়ে দিয়ে দু হাতে জায়ানের টি-শার্টের কলার টেনে জায়ানের মাথাটা নিচু করতে বলল ইশারায়। কারণ তৃষ্ণা জায়ানের থেকে অনেক খাটো। ওর মুখ নাগাল পায় না। জায়ান ঝুঁকে পরল তৃষ্ণার দিকে।

তৃষ্ণা নিজের শীতল দু’হাতে আবদ্ধ করে ধরল জায়ানের ক্লিন সেভের মসৃণ দু’গাল। তৃষ্ণার সাথে যেন এখন জায়ানের পেশিবহুল শক্ত শরীর ও কাঁপছে। জায়ান পলক ফেলে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার চক্ষের দিকে। তৃষ্ণা জায়ানের মুখটা নিচু করে খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল ডান ভ্রুয়ের মাঝে কোন তিল আছে কিনা।
জায়ান তৃষ্ণার চক্ষের ভাষা যেন পড়তে পারল। তৃষ্ণা ওর মুখে কিছু একটা খুঁজছে।
জায়ান জিজ্ঞেস করল,”কি খোঁজ?”

তৃষ্ণা উত্তর দিল না। নিশ্চিত হলো এটাই জায়ান।নিচে বসেও জায়ানের মুখশ্রী চেক দিয়েছে। কিন্তু আবার কেন জানিনা মনে ভয় ঢুকেছে। এটা যদি জায়ান না হয়ে ওই শয়*তান হয়। এজন্য ভালো করে দেখল নিশ্চিত হতেই ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা মিলল। আবার জায়ান’কে জড়িয়ে ধরে ওর বক্ষে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল।

জায়ান থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়ে কথার উত্তরও দিচ্ছে না কেন? ও কিছু বুঝতেও পারছে না! ওর এত কিসের কষ্ট? আর সেই কষ্ট থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ওকে জড়িয়ে ধরছে। যেন ও তৃষ্ণার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এত বিশ্বাস করে ফেলেছে? জায়ানের মুখেও হাসি দেখা মিলল।

জায়ান হঠাৎ ভাবল, হয়তো তৃষ্ণা ঝড় বৃষ্টির রাতে একা থাকতে ভয় পাচ্ছিল। এজন্য হঠাৎ ওকে দেখে ওর ভয় ছুটে গেছে সেই খুশিতে জড়িয়ে ধরেছে। জায়ান এক হাত তৃষ্ণার কোমরে রেখে ওকে আরো বুকে টেনে নেয়। আরেক হাত তৃষ্ণার হাটু পর্যন্ত ঘন কালো ভেজা চুলে ডুবিয়ে দেয়। মাথায় উপর হাত এনে তৃষ্ণা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতে লাগে।
এদিকে ছুটাছুটি’তে তৃষ্ণার আঁচল নিচে পরে ভেজা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেদিকে কারো নজর নাই।

দরজা খোলা ছিল বিধায় আয়ান উঁকি মেরে জায়ান আর তৃষ্ণা’কে একসাথে এতো কাছাকাছি দেখে জ্বলতে থাকে। আফসোস করতে লাগে এই মেয়েটার দেখা কেন আগে পেল না। তাহলে এই মেয়েটা এখন ওর বুকে থাকত। ওকে ও আদর করতো। ও স্পর্শ করতো। গ্রামে গিয়ে ভাই গাইয়া রূপসী বউ নিয়ে আসলো। আর ও কিনা উষসীর মতো একটা মেকাপ সুন্দরীকে বিয়ে করে বসে আছি।

“এই মেয়েটা তো আমার হবেনা কিন্তু এই মেয়েকে একদিন হলেও আমি চাই যে কোন মূল্যে।” বিড়বিড় করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল আয়ান।

আয়ান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে চলে এলো। বিছানায় ওর স্ত্রী উষসী শুয়ে ছিল। ওর পরনে খোলামেলা নাইটি। আয়ান এক নজর ওর চুলের দিকে তাকায় কালার করা ছোট ছোট চুল। মুহূর্তে চক্ষে ভাসে তৃষ্ণার ঘন কালো হাটু পর্যন্ত লম্বা চুল। সাথে সাথে ওর রাগ হয়।

এই বিছানায় উষসী কেন শুয়ে থাকবে? ওর চুল কেন এত লম্বা হলো না? তাহলে ঐ মেয়েটার প্রতি আকর্ষিত হতো না! আয়ান রাগে দামি শো পিচ হাতে নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। উষসী ঘুমের মাঝে ভয়ে আতকে ওঠে। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। ঘুম ঘুম চোখে তাকায় নিজে স্বামীর দিকে।

কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই আয়ান ছুটে এসে উষসীর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বলে,,” এই তোর চুল এতো ছোট কেন? কালো নয় কেন? কালার করেছিস কেন? ওর মতো কালো লম্বা চুল নেই কেন তোর মাথায় উত্তর দে?”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৯

উষসী থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে হিংস্র আয়ানের দিকে। আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়া তার ওপর আয়ানের এভাবে ওর উপর হিংস্র হয়ে ঝাপিয়ে পরা। ও কিছুই বুঝতে পারছে না। চুল এতো জোরে টেনে ধরেছে যে ব্যথায় ওর চক্ষে অশ্রু জমে উঠেছে।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১১