বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৮

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা

আমার এক কদম সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। ইষৎ অন্ধকার ঘরে দুজনের দৃষ্টি দুজনার পানে। হাত ছেড়ে দিলেও দূরত্ব বাড়েনি আমাদের মাঝে। উনি কিছুক্ষণ পর ধীম আওয়াজে ধমকিয়ে বললেন,

—এত রাতে ঘুমাওনি কেন? গল্প কি এখনও শেষ হয়নি তোমাদের??
ভ্রু কুচকে তাকালাম আমি উনার দিকে। এমনভাবে বলছেন যেন আমি কি একাই জেগে আছি এত রাতে আর উনি ঘুমের মধ্যে হেটে এসেছেন এখানে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—ঘুমিয়েছিলাম আমি। পানির তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেছে তাই এখানে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন? আমার তো তাও জেগে থাকার একটা কারণ ছিলো, আপনার তো ছিলোনা। তাহলে আপনি কি করছেন এখানে এত রাতে?
আমার কথায় সুচারু দৃষ্টিতে চাইলেন উনি। যেই দৃষ্টি বোধগম্য হলোনা আমার। তবে উনি আমার প্রশ্নের সরাসরি উওর দিলেন নাহ। মৃদু কণ্ঠে বললেন,

—ঘুম ধরছেনা, তুরফা।
ছোট্ট একটি বাক্য অথচ এর মধ্যেও আমি খানিকটা বিষাদের গন্ধ পেলাম! আচ্ছা উনার কি মন খারাপ? আমি কৌতুহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

—কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ করছে না ক্ষুধা লেগেছে? কিছু বানিয়ে দিবো??
আমার প্রশ্নের বিপরীতে উনি জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। এই আধো আলোছায়ার খেলার মাঝেও যে হাসি হৃদয়ে কম্পন তুলে দিলো আমার! এত সুন্দর হতে হবে কেন লোকটাকে! কি আছে তার মাঝে যা আমার এত ভালো লাগে? বিস্মিত অন্তরে ভাবলাম আমি। আমার ভাবনার মাঝেই পূর্ণ বললেন,

—খাবার বানিয়ে দিতে হবেনা তবে অন্য কিছু করতে হবে। পারবে?
—কি করতে হবে? বলুন।
—আমার সাথে হাটতে যাবে, তুরফা?

পূর্ণর কথায় আরেকদফা বিস্ময় এসে ছুয়ে গেলো আমায়। এই মাঝরাতে উনি আমার সাথে একা হাটতে যেতে চাইছেন? এটা সত্যিই পূর্ণ তো? নাকি ঘুম না হওয়ায় মাথা নস্ট হয়ে গেছে উনার? আমি কিছু না বলে চট করে উনার মুঠোয় ধরে রাখা ফোন অন করে সময় দেখে নিলাম। রাতের ১২টা ১০ বাজে।

শহরে এটা খুব বেশি সময় না হলেও গ্রামের জন্য গভীর রাত! এতক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়। এই মাঝরাতে চাঁদের আলোর নিচে পূর্ণর সাথে নিরিবিলিতে হাটবো ভাবতেই একটা শিহরণ হচ্ছে মনে! এদিকে পূর্ণ চুপচাপ দেখছিলেন আমার কর্মকাণ্ড, আমি কিছু না বলায় উনি পুনরায় বললেন,

—কি হলো? যাবেনা? আচ্ছা তাহলে এখন চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও।
আমায় নির্দেশ দিয়ে উনি একাই হেটে যাচ্ছিলেন দরজার দিকে। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো যে পুরোটা বুঝে উঠতে বেগ পেতে হলো আমার! দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে উনার বাহু চেপে ধরলাম আমি।
—এই, আপনি কোথায় যাচ্ছেন একা একা? আমিও যাবো তো আপনার সাথে।

আমার কথার মাঝে আমরা ইতোমধ্যে বাড়ির দরজার বাহিরে চলে এসেছি। পূর্ণ আমার হাত ছেড়ে বাড়ির গেইট লাগিয়ে এসে পুনরায় আমার হাত ধরলেন। আমি হাটার জন্য পা বাড়াতেই উনি থেমে গেলেন। আমি ভ্রু তুলে উনাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কি হয়ছে। উনি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে একবার আমার কপালে, গলায় হাত ছোয়ালেন। হঠাৎ করে তার ছোয়ায় খানিকটা কেপে উঠলাম আমি। চকিত নয়নে তার দিকে তাকাতেই বললেন,

—গা-হাত এত ঠান্ডা কেন তোমার? মনে তো হচ্ছে জ্বর আসবে। তুমি কি নিচে শুয়েছিলে??
তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন ছুড়লেন পূর্ণ! এদিকে অবাক হয়ে গেলাম আমি। লোকটার আসলেই ভীষণ বুদ্ধি। এটুকুতেই বুঝে গেছেন আমি নিচে শুয়েছি! জিব দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বললাম,

—আসলে বড়াম্মুর কোমড়ে ব্যাথার জন্য উনাকে দাদির সাথে শুতে বলেছি। আপনি তো জানেনই এটা। তাকে নিচে ব্যথা পেতে দিয়ে আমি উপরে ঘুমাতে পারি, বলুন?
—নিচে ঘুমোলেও এটলিস্ট মোটা কাথা নিয়ে ঘুমাতে পারতে ইডিয়েট। তাহলে ঠান্ডা লাগতোনা।
উনাকে কিভাবে বলবো কাথার কাহিনি তাই আমতা আমতা করে বললাম,

—আসলে কাথা নিয়েই শুয়েছিলাম। কিন্তু প্রিয়া ঘুমের মাঝে …
—প্রিয়া ঘুমের মাঝে কাথা নিয়ে নিয়েছে আর তুমিও অন্য কাথা না নিয়ে কাথা ছাড়াই ঘুমিয়েছো? রাইট?
আমার মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে বলে উঠলেন উনি। তার কথায় ধীরে মাথা নাড়লাম আমি। উনি দাতে দাত চেপে বললেন,
—বাহ!! কত মহান কাজ করেছো তুমি। স্টুপিড কি সাধে বলি তোমায়! বেয়াদব!

—আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন আশ্চর্য? একদিন ঠান্ডা লাগলে কিছুই হবেনা। আর তাছাড়াও নিচে ঘুমানোর অভ্যাস আছে আমার। এত বছর কতবারই তো কাথা ছাড়া নিচে ঘুমিয়েছি…
—এত বছর আমি ছিলাম না। এখন আমি আছি। এখন থেকে আর কোন অযত্ন হতে দেবোনা তোমার, বুঝেছো??

পূর্ণ অতি কোমল অথচ শান্তগলায় বললেন কথাটি যেটি বেশ এলোমেলোভাবে আমার কর্ণকুহরে এসে ধাক্কা খেলো। একিসাথে বেসামাল করে দিলো আমার মন! এতটা আবেগ দিয়ে কথা বলতে পারেন উনি? জানা ছিলোনা তো আমার। আর কতভাবে অবাক করবেন উনি আমায়? আমার ভাবনার মাঝেই দৃষ্টিগোচর হলো উনার হাত আমার হাত ছাড়িয়ে আমার ওড়নায় গিয়ে পৌঁছেছে। পূর্ণ ধীর হাতে আমার ওড়নাটুকু মেলে গায়ে পেচিয়ে দিলেন শালের মতো করে। কপালজুড়ে খেলতে থাকা এক গুচ্ছ বেখেয়ালি চুল কানের পিছে গুজে দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন,

—এবার চলো।
আমি কিছু বললাম না। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চলতে লাগলাম তার পিছু পিছু। পূর্ণ একমনে সামনে তাকিয়ে হাটছেন আর আমি হাটছি তার দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে।

আকাশের বিশালতাকে পূর্ণতা দিতে তার বুকজুড়ে জেগে আছে এক ফালি চাঁদ। তার কিরণে যেন অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে! চাঁদের নিসঙ্গতাকে দূর করতে তাকে পাহারা দিচ্ছে শততারার মেলা! শরতের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রাতজাগা শিউলি ফুলের সুবাস। যার গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ! রাতের আধারেও যে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে কতজনই বা জানতো?

ঠিক কতদিন পর এমন মনমাতানো পরিবেশে নির্জনে হাটছি আমার মনে নেই। তবে আজকের মতো অনুভুতি আমার কোনদিনই হয়নি! হঠাৎ করেই এত্ত ভালো লাগছে কেন চারপাশ? আগে তো এমন লাগেনি কখনো। এই ভালো লাগা কি শুধুই প্রকৃতির কারণে না যার হাত ধরে যার পাশে হাটছি তার কারণে? পূর্ণর দিকে তাকাতেই দেখি উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি মৃদু হেসে বললাম,

—এত সুন্দর কেন আজকের আকাশটা? চাঁদটাও দেখুন কত্ত বড়। আজ মনে হয় পূর্নিমা তাই না? এজন্যই এত বড় চাঁদ উঠেছে!! এত সুন্দর কেন লাগছে সব আজ? চোখই ফিরাতে পাচ্ছিনা আমি!
—হুম, আমিও।

পূর্ণর কথায় তার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি গভীরচিত্তে চেয়ে আছেন আমার দিকে। তার চোখের ভাষা পলকহীন, অন্যরকম। যে চোখের মায়ায় বহুবার হারিয়ে যাই আমি। আমার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি বুঝতেই পূর্ণ চোখ সরালেন আমার থেকে। গলা ঝেড়ে বললেন,

—আরো হাটতে চাও? নাকি পা ব্যাথা হয়ে গেছে তোমার??
—এটুকুতেই পা ব্যাথা হবে কেন? আমি আরও হাটতে পারবো। আমার তো মনে হয় আপনার পা ব্যথা হচ্ছে।
ব্যঙ্গ করে বললাম আমি। আমার কথায় বেজায় চটিয়ে গেলেন উনি। রাগী গলায় বললেন,
—আমি তোমার মতো ফার্মের মুরগি নই যে এটুকুতেই হাপিয়ে যাবো। আমায় পুরো গ্রাম হাটতে দিলেও ইজিলি হাটতে পারবো, বুঝেছো পিচ্চি?

পূর্ণর খোচামার্কা কিথা শুনে এতক্ষণের ভালো লাগা উবে গেলো আমার। মনের মধ্যে জমা হলো বিন্দু বিন্দু রাগ। যখনই মুডটা ভালো হয় এই লোকটা ঠাশ করে কিছু উল্টোপালটা বলে মুড নস্ট করে দেয়! রেগে ভাবলাম আমি। উনার হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে হাটতে লাগলাম। একটু আগে যেখানে দুজনের মধ্যে ব্যবধান ছিলো খুব সামান্য এখন নিমিষেই সেটা বেড়ে গেছে।

আড়চোখে পূর্ণর দিকে চেয়ে দেখি উনি একমনে হাসছেন সামনের দিক তাকিয়ে৷ এতে রাগ আরও বেড়ে গেলো আমার। আমাকে রাগিয়ে লোকটা কি এমন আনন্দ পায় বুঝিনা? হাটতে হাটতেই শুনলাম উনি বলছেন,
—শুনেছি পুর্নিমারাতে ভূতের আসর বসে মাঝরাতে। গ্রামের খোলা পরিবেশ, ভুতের পারফেক্ট আস্তানা! না জানি এখন কোথায় আসর জমাচ্ছে তারা। এদিকটায় আবার বসেনি তো? কে জানে!

হঠাৎ করে এই সময় ভুতের কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো আমার। এতক্ষণের সুন্দর পরিবেশ যেন নিমিষেই গা ছমছমে মনে হলো আমার কাছে। তবুও একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। উনার সামনে কোনভাবেই দেখানো যাবেনা যে আমি ভয় পাচ্ছি৷ চারদিকে ভয়ার্ত নজর বুলিয়ে দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে হেটে চলছি আমি। এদিকে পূর্ণ নিজমনে হেসে এগিয়ে চলছেন। তার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেলেও এ মুহুর্তে কিছু বলছিনা। উনার সাথে দূরত্ব রেখেই হেটে চলছি বাড়ি পৌছানোর আগ পর্যন্ত।

হঠাৎ ঝোপের মধ্যে একটি ইদুরের মতো প্রানী দৌড় দিতেই ভয়ে পূর্ণর পাশে চলে গিয়ে উনার বাহু খামচে ধরলাম আমি। এদিকে আমি ভয়ে শেষ, ওদিকে সামান্য উচ্চস্বরেই হাসলেন উনি। যেন এটার অপেক্ষায়ই ছিলেন এতক্ষণ। ভ্রু তুলে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

—কি ব্যাপার? আমার সাথে লেগে গেলে কেন? তুমি না দূরে দূরেই হাটবে?
মনে মনে অনেককিছু বলতে চেয়েও নিজেকে শান্ত করলাম আমি। উনাকে এখন কিছু বলা যাবেনা, এটলিস্ট বাসায় পৌছানোর আগ পর্যন্ত উনিই আমার একমাত্র ভরসা, তাই কিছু না বলে চুপচাপ তার বাহু ধরে হেটে চললাম বাড়ির দিকে।

বাড়ি পৌছাতেই পূর্ণর হাত ছেড়ে দিলাম আমি। উনি দরজা লাগাতে ব্যস্ত থাকায় আমি কিছু না বলেই হনহন করে হেটে যেতে লাগলাম দাদির রুমের দিকে। আকস্মিক চাপা কন্ঠের গুনগুন শুনে পা-জোড়া থেমে গেলো আমার।

~সেই রাতে রাত ছিলো পূর্ণিমা
রঙ ছিলো ফাল্গুনি হাওয়াতে
সব ভালো লাগছিলো চন্দ্রিমা
খুব কাছে তোমাকে পাওয়াতে
মন খুশি উর্বশী সেই রাতে
সুর ছিলো গান ছিলো এই প্রাণে
ঐ দুটি হাত ছিলো এই হাতে
কি কথা বলছিলে মন জানে
সব ভালো লাগছিলো তুমি ছিলে তাই
মন ছিলো মনেরই ছায়াতে~

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৭

পেছনে ফিরতেই দেখি পূর্ণ আনমনে হাসছেন। আমার দিক এক পলক চেয়ে চুপচাপ পাশ কেটে চলে যেতে লাগলেন উনার রুমের দিকে। এদিকে তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছি আমি! বেশি কিছু না বলেই যেন অনেক কিছুই বলে ফেলেন লোকটা।
“কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী” উক্তিটি যেন উনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য!!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৯