বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৭

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

দাদির কথায় চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন পূর্ণ। আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকালেন, উনার দৃষ্টি নিজের দিকে পড়তে দেখেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।

পরক্ষণেই আবার এক পলক তার দিকে চাইলাম ঠিকই, তবে উনি ভেতরে ভেতরে কি ভাবছেন তা উনার মুখ দেখে খুব একটা বুঝার উপায় নেই! খানিকক্ষণ বাদে শুষ্ক কেশে বরাবরের ন্যায় গম্ভীর গলায় দাদিকে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—তোমার নাতনি এতবছর পর এসেছে তুমি ওর সাথে থাকার ইচ্ছে করতেই পারো, দাদি। আমার এতে কোন আপত্তি নেই। তবে তুরফার ঘুমানো কিন্তু একদমই ভালো নয় আগেই বলছি।

ও যেভাবে বিছানা দখল করে রাখে তা আর না-ই বলি। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমিই পড়ে যাবো খাট থেকে। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমাতে হয় আমায় ওর জন্য। তুমি বুড়ো মানুষ, এ বয়সে খাট থেকে পড়ে গেলে হাড়-হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবেনা৷ তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে আমার! সাবধানে থেকো, দাদি।

পূর্ণর কথা শুনে হাসির রোল পরে গেলো উঠোনজুড়ে। এদিকে আমার চক্ষু চড়কগাছ! উনি যে আমার সম্পর্কে এমন কথা বলবেন সবার সামনে সেটা কখনো কল্পনায়ও আনিনি আমি!

রাগে দাত কিড়মিড় করে তাকালাম উনার দিকে! আমি কবে উনার পুরো বিছানা দখল করলাম? অযথাই একটা বলে দিলেন সবার সামনে! এখন রাগের চোটে মনে হচ্ছে উনার মাথা ফাটিয়ে দিই! এদিকে বাকি সবাই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে!

আর পূর্ণ চেহারার এমন ভাব করে আছেন যেন এই মুহুর্তে উনার চেয়ে সত্যবাদী দুনিয়াতে আর কেউ নেই! উনার কথা বলার সিরিয়াস ভঙ্গিমা দেখে কারও বুঝারও জো নেই যে উনি ঠাট্টা করছেন নাকি সত্যি বলছেন।

তাই বিষয়টা সত্য হোক আর মিথ্যা, সবাই এখন সেটার মজা নিতেই ব্যস্ত! মাঝখান থেকে শুধু আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিলেন খারাপ লোকটা।
পূর্ণর থেকে চোখ সরিয়ে দেখি বাকি ছেলেরাও হাতমুখ ধুয়ে এসে পড়েছে।

বড়াম্মু, কাকিমারা চুলো থেকে গরম গরম তেলপিঠা তুলে দিচ্ছেন সবাইকে।আমি একটা পিঠা চুলো থেকে তুলে এনে ফু দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করছিলাম মনোযোগের সাথে।

কারণ আমি আবার একদম গরম গরম খাবার খেতে পাইনা। জিব পুড়ে যায় আমার। তাই কিছুক্ষণ পর এক কামড় যেই না মুখে দিয়ে দেখবো ঠান্ডা হয়েছে কি না এমন সময় হাত থেকে পিঠেটা কেড়ে নিলো কেউ।

অবাক হয়ে সামনে চেয়ে দেখি পূর্ণ মহাশয় মহা আয়েশে নিজের জায়গায় বসে আমার ঠান্ডা করা পিঠা খাচ্ছেন। আরেকদফা উনার প্রতি রাগ হলো আমার। লোকটা কি শুরু করেছেন সন্ধ্যা থেকে?

সকাল থেকে দাদুবাড়ি আসার আগ পর্যন্ত কত সুন্দর ব্যবহার করছিলেন আমার সাথে আর এখানে আসার পর আবার আগের মতো খাটাশ হয়ে গেলেন!

—আপনি আমার পিঠা নিলেন কেন? আপনার লাগলে আমি তো অন্য একটা তুলে দিতামই। ওটা আমি ঠান্ডা করেছিলাম, সেটাই নিতে হলো আপনার?
চোখ পাকিয়ে পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।

উনি এক পলক আমায় দেখে আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে মনের সুখে পিঠা খেতে লাগলেন যেন তার জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন কাজ নেই!! এদিকে সবাই মিটিমিটি হাসছে আমাদের দেখে।

অবশেষে ফোস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি নতুন করে আরেকটি গরম পিঠা আমার বাটিতে তুলে নিয়ে ঠান্ডা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে দাদির আওয়াজ শুনে তার দিকে তাকালাম,

—কত বছর পর তোদের দুজনের খুনসুটি দেখছি! মনটাই ভরে গেলো আমার! ছোটবেলায় ঈদে দেখা হলেই তো একসাথেই থাকতি তোরা। এখন তোদের বিয়ে হওয়ায় বেশ হয়েছে। আমি অনেক খুশি হয়েছি। খুব মানিয়েছে আমার প্রিয় নাতি-নাতনিকে একসাথে। মাশাল্লাহ!!

দাদি হাসিমুখে বললেন। তার সাথে হেসে মাথা নাড়লো সবাই। এরই মাঝে ছোট চাচু বললেন,

—তবে পূর্ণ কাজটা ঠিক করলোনা, মা। তুমি আর যাই বলো এটা তো আমরা সবাই জানি যে ছোট থেকেই তুরফা মামনি গরম পিঠা খেতে পারেনা। বেচারি এতক্ষণ ধরে ফু দিয়ে ঠান্ডা করেছে আর পূর্ণ তখনি নিয়ে নিলো।

অথচ ছোটবেলায় তো ও নিজেই তুরফার জন্য পিঠা ঠান্ডা করে দিতো আর …
ছোট চাচুর কথা শেষ না হতেই হঠাৎ করে বিষম খেলেন পূর্ণ। যার কারণে মাঝপথে থেমে গেলেন চাচু। কাকিমা পাশ থেকে পূর্ণকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—আস্তে খা, বাবা। খাওয়ার সময় এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে??
কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ পানি খেতে লাগলেন উনি। এদিকে ছোট চাচুর পুরো কথা শুনার জন্য ছটফট করছে আমার মন! পূর্ণ ছোটবেলায় আমার জন্য পিঠা ঠান্ডা করে দিতো?

আর কি কি করতেন উনি? এসব তো মনেই নেই আমার ঠিকমতো! আমি পিঠা খেতে খেতে চোখ গেলো পূর্ণর দিকে। উনি শান্তভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার থেকে চোখ সরিয়ে তাই ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে ছোট চাচুকে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি বলছিলে যেন চাচু? শেষ করলে না যে!
চাচু পুনরায় কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন পূর্ণ। চাচুর কথা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই বললেন,

—আরে চাচু, আমি তো জানতাম না যে তোমাদের আদরের ভাস্তি এখনও আগের মতোই আছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো সময়ের সাথে বড় হয়ে গেছে ও। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো তুরফা যে ও শরীরে বাড়লেও বাকি সব দিক থেকে এখনও সেই ছোটবেলার মতোই স্টুপিড আছে।

পূর্ণর কথায় চাপা পড়ে গেলো চাচ্চুর কথা। হেসে উঠলেন চাচু। একিসংগে আরেকদফা হাসির রোল পড়লো উঠানজুড়ে। লোকটা মনে হয় আজ আমাকে হেনস্তা করার জন্যই মুখ খুলছেন বারবার!

উনার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবলাম আমি! এরই মাঝে পূর্ণ একটা শয়তানি হাসি দিলেন আমার দিকে তাকিয়ে। মুখ বেকিয়ে উনার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি দাদিকে বললাম,

—আচ্ছা দাদি, এসব বাদ দেও। আমি যাওয়ার পর কি কি মজার ঘটনা ঘটেছে ঈদে, আমি কি কি মিস করেছি সেগুলো বলো। কতদিন ধরে ইচ্ছে ছিলো পরিবারের সাথে আড্ডা দেওয়ার, গল্প করার। আজ পূরণ হবে! সব গল্প শুনতে চাই আমি!

আমার উচ্ছাসিত মুখ দেখে হেসে ফেললো সবাই। চাচু-কাকিমারাও যোগ দিলেন দাদির সাথে গল্প শুনাতে। মাঝেমধ্যে প্রান্ত ভাইয়া কিছু একটা বলছে যেটা নিয়ে পূর্ণর সাথে উনার কথা কাটাকাটি হচ্ছে, দুই ভাইয়ের খুনসুটি দেখতেও বেশ মজা লাগছে!

এদিকে সবার গল্প শুনতে শুনতে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছি আমি। এতক্ষণ হাসলেও আনমনেই চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জলের উপস্থিতি টের পেলাম আমি! তবে কেউ দেখে ফেলার আগেই তা দ্রুত মুছে ফেললাম! এতবছর পর এই প্রথম কোন আড্ডায় নিজেকে ‘পর’ লাগছেনা।

কেননা আশেপাশে যারা আছেন তারা সবাই আমার আপন মানুষ, আমার আপনজন। দাদুবাড়ির বিশাল উঠোনটা এই হালকা শীতের মধ্যেও সরগরম হয়ে গেছে এত প্রাণের উপস্থিতি পেয়ে! হাসিমুখে মাথার উপরের বিশাল আকাশের দিকে তাকালাম আমি। আকাশের কোণে ঝুলে থাকা চাঁদটাও যেন হাসছে আজ আমার খুশিতে!

দাদির ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে শুয়ে-বসে আছি সব মেয়েরা। গভীর রাত পর্যন্ত পরিবারের সব ছেলেমেয়েরা মিলে আড্ডা দিয়ে চলে গিয়েছে যে যার ঘরে। যাওয়ার সময় পূর্ণ একটাবারও তাকালেন না আমার দিকে! আমিও চুপচাপ দাদির রুমে চলে এসেছি।

অবশ্য পরে দাদির কথায় শুধু আমিই নয়, তার ঘরে থেকে গেছি আমরা সব মেয়েরা। বড়াম্মু-কাকিমারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। রাইসা বেচারি প্রান্ত ভাইয়ার থেকে দূরে থাকার কস্টে উনার সাথে মেসেজে আলাপ করছে। প্রিয়া ফ্লোরে করা বিছানায় ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে কাদা আর এদিকে আমি মাটিতে বসে আছি দাদির সামনে, যিনি আমার চুল আচড়ে দিয়ে বেনি করে দিচ্ছেন!

দাদির সাথে আমার শোয়ার কথা থাকলেও বড়াম্মুর কোমড়ে ব্যাথার সমস্যা থাকায় তাকেই খাটে থাকার জন্য জোর করলাম আমি। আর যাই হোক বড়াম্মুকে নিচে শুয়ে কস্ট পেতে দিয়ে দাদির সাথে খাটে ঘুমাতে পারবোনা আমি। আমার চুল বেনি করা শেষ হতেই দাদি বললেন,

—যা তুরফা। শুয়ে পড়। সবাই শুয়ে শুয়েই গল্প করবো, অনেকক্ষণ ধরেই তো বসে আছি।
দাদির বড়াম্মুদের রেস্ট লাগবে ভেবে আমিও মাথা নেড়ে শুয়ে পড়লাম। রাইসা খাটের একপাশে শুয়ে ফোনে মেসেজ করেই যাচ্ছে, অন্যপাশে কাকিমা ইতোমধ্যে নাক ডাকছেন।

দরজার কাছে এক পাশে প্রিয়া ঘুমাচ্ছে তাই ওর পাশে জায়গা দেখে বালিশ-কাথা নিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। দাদি বলেছিলেন গল্প করবেন কিন্তু উনি নিজেও নাক ডাকা শুরু করেছেন বিছানায় গা এলিয়েই। কোথায় গল্প কোথায় কি, রুমের বেশিরভাগ মানুষই ঘুমাচ্ছে এখন ক্লান্তির চোটে।

আমি নীরবে হাসলাম সেদিকে তাকিয়ে! চোখ বন্ধ করতেই ক্লান্ত শরীরে এসে ভর করলো রাজ্যের ঘুম! ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেলাম আমি…

গায়ে হিম-বায়ু অনুভব হতেই ঘুমের রেশ কেটে গেলো আমার। গায়ের কাথাটা সরে গেছে বুঝে চোখ বন্ধ করেই কাথাটা খুজলাম। না পেয়ে চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখি প্রিয়া আমার কাথাটা টেনে কোলবালিশ বানিয়ে ঘুমাচ্ছে।

এদিকে গায়ে ঠান্ডা লাগছে বেশ কিন্তু ওর থেকে কাথা টানলেও প্রিয়া দিচ্ছেনা, বেশ জোর দিয়েই চেপে ধরে ঘুমাচ্ছে। হতাশ হয়ে কাথা ছাড়াই ঘুমানোর চেস্টা করলাম আমি। ঠান্ডায় ঘুম তো ধরলোই না, উল্টো পিপাসা পেলো আমার। মনে করলাম পানির তৃষ্ণায়ই ঘুম ধরছেনা তাই রুমের দরজা খুলে পানি খাওয়ার জন্য ডাইনিংরুমের এর দিকে গেলাম আমি।

পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই মনে হলো আমার পেছনে যেন কেউ আছে। যেহেতু ঠান্ডা লাগছিলো তাই ঘাড়ের কাছে গরম নিশ্বাস অনুভব করতেই মানুষটার উপস্থিতি টের পেলাম আমি! কিন্তু এ সময় কে আসবে?

সবাই তো ঘুমিয়ে থাকারই কথা! বাড়িতে চোর ঢুকেনি তো? উল্টোপালটা ভাবতে ভাবতেই পেছনে ঘুরে একটা চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মনে মনে! পেছন ফিরতেই ধাক্কা খেলাম কারও শক্ত বুকের সাথে, খানিকটা পিছিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারের সাথে বারি খেতে ধরলাম আমি কিন্তু তার আগেই আমাকে টেনে কাছে আনলেন পূর্ণ।

পুরো বাড়িতে এখন ড্রিমলাইট আর জানালার পর্দার ফাকে দিয়ে আসা চাঁদের আলো ব্যতীত কোন আলো নেই! এর মাঝেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি তার চেহারা!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৬

আমার মতো উনিও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার মুখপানে!
দুজনেই অবাক হয়ে হঠাৎ একসাথেই ধীর গলায় বলে উঠলাম,
—তুমি/আপনি এখানে??

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৮