বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৯

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সকালবেলা প্রিয়ার ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘুমু ঘুমু চোখ মেলে ওর দিকে তাকাতেই বললো,
—ঘুম ভালো হয়েছে, ভাবী? কখন যে তোমার কাথাটা টেনে নিয়েছিলাম ঘুমের মধ্যে বুঝতেই পারিনি আমি। তোমাকে আবার মাঝরাতে উঠে অন্য কাথা নিতে হলো। সত্যিই সরি।

সদ্য ঘুম থেকে উঠে প্রিয়ার মুখে এমন কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না আমি। নিজের দিকে তাকাতেই খানিকটা চমকে গেলাম। আমার শরীর একটা মোটা কাথা দিয়ে মুড়ানো। কিন্তু এটা তো আমি নেইনি। আমি ক্লান্ত হয়ে ওড়না দিয়ে গা ঢেকেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রাতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার মানে এটা নিশ্চয়ই পূর্ণ এনে দিয়েছেন? এই লোকটা আসলেই পাগল। কখন এসে আমায় কাথা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে গেলেন আমি টেরও পেলাম নাহ! উনার কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করছে আমায়!

আমাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে প্রিয়া মাথা ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। তবে আমি ওর কথার কোন উত্তর দিলাম নাহ। হালকা হেসে ওর গাল টেনে দিয়ে উঠে গেলাম। পূর্ণর আচরণে আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেছে! হঠাৎ মনে হলো উনি আমাকে কাথা দিলে নিজে নিশ্চয়ই কাথা ছাড়াই ঘুমিয়েছেন? উনার যদি ঠান্ডা লাগে? আমারও উনার জন্য কিছু করা উচিত।

ভাবতে ভাবতেই চলে এলাম চুলোর পাড়ে। যেখানে দাদি আর কাকিমা বসে ছিলেন ইতোমধ্যেই। তাদের৷ গল্পের মাঝেই আমাকে আসতে দেখে হাসিমুখে বসতে বললেন দাদি। আমিও বসলাম দাদির পাশে। চুলোর দিকে তাকিয়েই দেখি কাকিমা দুধচা করছেন সবার জন্য। আমাকে সেদিক তাকিয়ে থাকতে বললেন,

—তোর না দুধচা খুব পছন্দ ছিলো? এখনও খাস নাকি ভালো লাগেনা আর? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবাই চা খায় এখানে। মনে আছে তো?
কাকির কথায় মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম আমি। দুধচা আমার ছোট থেকেই ভীষণ পছন্দ! বরাবরই বিশাল আকারের চা-খোর আমি!

আমি জানি আমাদের দাদুবাড়িতে সবাই ঘুম থেকে উঠে চা খায় আর এটাও মনে আছে যে তাজওয়ার ভাইয়া অর্থাৎ পূর্ণ বাদে সবাই এটা খায়। উনার দুধচা একেবারেই পছন্দ নাহ। উনি কফি পছন্দ করেন। একিসাথে এটাও মাথায় এলো যে উনার ঠান্ডা লাগতে পারে আর উনার কফি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু উনি তো এই চা খাবেন নাহ। আবার দাদি-কাকিমাদের সামনে লজ্জায় আমি উনার জন্য কফি বানাবো এটা বলতেও পাচ্ছিনা। ইতস্তত মুখে চেয়ে আছি নিচের দিকে। কাপে চা ঢালার আওয়াজে উপরে তাকাতেই দেখি কাকি বলছেন,

—চায়ের ট্রে-টা নিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখ তো, মা। তোর চাচুরা সবাই হয়তো উঠে গেছে এতক্ষণে। টেবিলে চা না পেলে আবার মাথা ধরবে সবার।

কাকির কথায় হাসি পেলেও ট্রে নিয়ে টেবিলে রাখতে গেলাম আমি। চাচুরা সবাই সোফায় বসে আছেন। প্রান্ত ভাইয়াও চলে এসেছেন। আমায় দেখে সবাই হাসি দিলেন, বিনিময়ে আমিও হাসলাম। পূর্ণ এখনও উঠেননি হয়তো, উনাকে চোখে পড়লোনা। সবাইকে চা দিতে দিতে দাদি-কাকিমাও এতক্ষণে রুমে চলে এসেছেন তাই আমি এই সুযোগে আস্তে করে কেটে পড়লাম রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।

কফি খুজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলোনা। সামনের দিকেই ছিলো। আমিও চটজলদি পানি গরম দিলাম চুলোয়। কফি বানানো প্রায় শেষের দিকে। কফি মগে ঢেলে যেই না রান্নাঘর থেকে বেরোবো এমন সময় দাদি এলেন সেখানে। দাদিকে দেখে খানিকটা বিস্ময় আর লজ্জা ঘিরে ধরলো আমায়! হাতের কফিমগ নিয়ে আড়চোখে দাদির দিকে তাকালাম। উনি মুখ টিপে হাসছেন। কিছুটা ব্যঙ্গাত্বক সুরে বললেন,

—এই কফিটা কার জন্য নিয়ে যাচ্ছো, বোন? আমার জানামতে তো তুমি কফি খাওনা।
দাদির কথায় লজ্জায় আরেকটু নুইয়ে গেলাম আমি!
—উফফো, দাদি তুমিও না…
দাদি হালকা হেসে আমার থুতনি ধরে বললেন,

—এটুকুতেই লাজরাঙা হলে চলবে? পাগলি একটা। তুই যার জন্য কফি বানিয়েছিস সে কিন্তু ঘুম থেকে উঠেছে। এখনও ওর রুমেই আছে। নিয়ে যা ওখানে।
দাদির কথায় লাজুক হেসে রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি। পথিমধ্যে শুনতে পেলাম দাদির মিহি কন্ঠের হাসি। হাসতে হাসতেই বললেন,

—তোরা দুজন পারিসও বটে! একজন মাঝরাতে বউয়ের যাতে ঠান্ডা না লাগে সেজন্য চুপিসারে নিজের কাথা মুড়িয়ে দিয়ে যায়, আরেকজন সকালবেলা যাতে বরের ঠান্ডা না লাগে সেজন্য লুকিয়ে লুকিয়ে কফি বানায়! নতুন বিয়ের এগুলোই মজা! তোর দাদার সাথে আমিও এমন সুখের মুহুর্ত কাটিয়েছি। তোদের প্রেম আমাদের চেয়েও মধুর হোক দোয়া করি!
দাদির কথায় যেমন চমকে গেলাম তেমনি খুশিও হলাম। তার মানে উনি খেয়াল করেছেন পূর্ণ যখন এসেছিলেন? ইশ কি লজ্জা!! আর খুশি লাগলো ভেবে যে আমার আর পূর্ণর মধ্যের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। যতটা আমি ভেবেছিলাম তার চেয়ে ভালোভাবেই হচ্ছে!

রুমে ঢুকে দরজা ভিজিয়ে দেখলাম পূর্ণ মাত্র ফ্রেশ হয়ে আসলেন। উদোম শরীরে তোয়ালা কাধে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সেদিকে এক পলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি! লোকটা যখন-তখন উদোম হয়ে ঘুরে বেরায় রুমের মধ্যে! কেমন একটা অসহ্যকর ব্যাপার। কিন্তু উনার মধ্যে কোন হেলদোল দেখলাম নাহ। আমাকে দেখেও উনি ধীরেসুস্থে মুখ মুছে বিছানায় তোয়ালা রেখে অপর পাশ থেকে টিশার্ট নিয়ে পড়লেন। আমি আড়চোখে উনার দিক চেয়ে কিছু না বলে বেডের সাইড টেবিলে কফির মগ রেখে ভেজা তোয়ালা হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম রুম থেকে। এমন সময় উনি মুখ খুললেন,

—বাহ! আজকে সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠেছে? তুমি তো দেখি একদম বউ বউ আচরণ শুরু করে দিয়েছো সকাল সকাল!
কিছুটা রসিকতা করেই বললেন উনি। তবে এই মুহুর্তে তার রসিকতা আমার পছন্দ হলোনা। চোখ ছোট করে কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম,

—কেন? আমি বউ বউ আচরণ করলে এত অবাক হওয়ার কি আছে? আমি কি আপনার বউ নই?
—বাপরে! সকালবেলাই ঝগড়া করার জন্য রেডি হয়ে আছো দেখি। কাল এতরাত পর্যন্ত হেটেও এত এনার্জি? পিচ্চি মানুষ এত এনার্জি কই পাও?

পূর্ণর কথা শুনে আরেকবার গায়ে জ্বালা ধরলো আমার। কই আমি তার জন্য কফি বানিয়ে এনেছি, একটু ভালো কথা বলবেন! তা নাহ। লোকটার তেতো মুখে সবসময় তেতো কথাই চলে। এজন্যই আমি আজকে ইচ্ছা করেই চিনি দিয়েছি তার কফিতে। একটু চিনি খাওয়ার অতীব প্রয়োজন উনার জীবনে! আমি উনার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বারান্দায় তোয়ালেটা নেড়ে দিয়ে আসলাম। ইতোমধ্যে উনি কফির মগ হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়েছেন। এক চুমুক মুখে দিয়ে মুখ বিষিয়ে বললেন,

—উফফ, এত মিস্টি কেন? হোয়াট ননসেন্স, তুরফা? তুমি কি জানোনা আমি কফিতে এত চিনি পছন্দ করিনা? নিজে তো শরবত বানিয়ে খাও-ই সাথে আমাকেও খাওয়ানোর ধান্দায় আছো নাকি?

—জি! ইচ্ছা করেই দিয়েছি। বেশ করেছি। কারণ আপনার এটাই দরকার এখন। মিস্টিমুখ করবেন তবেই তো মিস্টি কথা বলবেন। সারাদিন আপনার তেতো কথা শুনতে শুনতে মেজাজটাই তেতো হয়ে উঠেছে আমার!
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে বললাম আমি! এর মধ্যেই শুনলাম উনার চাপাকণ্ঠের বিরবির,

—মিস্টিমুখ যদি করতেই হয় এভাবে কেন করবো? আরও তো উপায় আছে করার।
—এই, আপনি কি বললেন? জোরে বলেন।
—কেন? শুনার জন্য খুব আগ্রহ হচ্ছে বুঝি?
—হতেই পারে। ফিসফিস করে কথা বলেন কেন? যা বলার জোরেই বলবেন।

—জোরে বলতে আমার সমস্যা নেই, তুমিই লজ্জা পাবে। তখন আবার আমার দোষ হবে।
আমি কিছুক্ষণ পিটপিট চোখে তাকিয়ে রইলাম উনার দেখে। তার দুষ্টু হাসি দেখে বুঝলাম উনি অবশ্যই ভালো কিছু বলেননি তাই মুখ বাকিয়ে ধীরস্বরে বললাম,

—ছিহঃ!!
পূর্ণ হেসে পুনরায় কফি মুখে দিতেই মুখ বিষিয়ে ফেললেন আবার। করুণ কন্ঠে বললেন,
—সত্যিই খেতে পাচ্ছিনা, তুরফা। কফিতে এত চিনি একটুও ভালো লাগেনা আমার।
তার চেহারা দেখে মায়া লাগলো আমার। আসলেই হয়তো চিনি দেওয়া উচিত হয়নি যেখানে উনি পছন্দ করেন না বিষয়টা। তাই হালকা হেসে বললাম,

—আচ্ছা রাখুন, খেতে হবেনা। আপনার ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবেই নিয়ে এসেছিলাম। তবে খেতে না পারলে জোর করবোনা। ফেলে দিন।
আমি স্বাভাবিকভাবেই বলে চলে আসছিলাম রুম থেকে। আমার হাত ধরে যাওয়ার পথে বাধা দিলেন পূর্ণ। পেছনে ফিরে দেখি উনি চোখ-মুখ বন্ধ করে কফিটা শেষ করলেন। একটু পর ম্লান হেসে বললেন,

—সে আমার চিন্তায় কস্ট করে কিছু বানিয়ে আনবে আর আমি তা খাবোনা এটা কি আদৌও সম্ভব? তাকে বলে দিও একদিন চিনি বেশি খেলে কিছু হবেনা!

এরপর আমার হাতে মগ ধরিয়ে দিয়ে রুমের বাহিরে চলে গেলেন। তার পিছু পিছু আমিও বের হয়ে এলাম। উনি ডাইনিং এ বসে হাসিমুখে কথা বলছেন চাচুদের সাথে। তার সদ্য ঘুম ভাংগা চেহারায় এক অদ্ভুত মায়া বিরাজ করছে! যে মায়ার তিলে তিলে ডুবে যাচ্ছি আমি! প্রতিদিন যেন নতুন এক পূর্ণকে আবিষ্কার করছি!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৮

একদিকে উনি আছেন সবার সাথে হাসিঠাট্টায় মত্ত, আর এদিকে তার প্রলয়ঙ্কারী হাসি আর কথা যে প্রতিনিয়ত আমার বুকে ঝংকার তুলছে সে খবর কি উনার আছে?

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩০