বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩০

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩০
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সকাল পেরিয়ে দুপুর হতেই দাদুবাড়ি জুড়ে চাচাতো-ফুফাতো কাজিনদের আগমন শুরু হয়ে গেলো। আমার সাথে দেখা করতে এতক্ষণে যে যার অবস্থান থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে সবাই! সবার হৈচৈ কোলাহলে দাদুবাড়ি ভরে গেছে একেবারে! দোতলার বারান্দা থেকে সবাইকে নিচে নামতে দেখে উচ্ছাসিত হাসলাম আমি! রুমে গিয়ে দেখি পূর্ণ ফোনে কথা বলছিলেন। মুখটা বাংলার পাচের মতো গম্ভীর করে রেখেছেন। হয়তো অফিসের কারও সাথে কথা বলছিলেন। যাই হোক, উনি ফোন রাখতেই আমি এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললাম,

—শুনুন, আমি নিচে যাচ্ছি। আপনিও চলুন। সব কাজিনরা চলে এসেছে।
—তুমি যাও। আমি একটু পর যাবো।
ফোন টিপতে টিপতে বললেন পূর্ণ। কিন্তু আমার ভালো লাগলোনা বিষয়টা। সব কাজিন বাসায় এলো আমাদের সাথে দেখা করতে আর উনি এখনও ফোনের মাঝেই ব্যস্ত। বেড়াতে এসেও মনে হয় কাজ থেকে নিস্তার নেই লোকটার! তাই খানিকটা জিদ করেই বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—কেন? এখন কেন যাবেন না আপনি? সবাই এতদিন পর ঈদ ছাড়া একসাথে হয়েছে! আপনিও চলুন না আমার সাথে নিচে!!
পূর্ণ কিছু বলার জন্য উদ্যত হচ্ছিলেন তার আগেই উচ্চস্বরে ফোন বেজে উঠলো উনার। ফোনের দিক চেয়ে উনি গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

—একবার কথা বললে বুঝোনা কেন, তুরফা? তোমার মতো ফাকা বসে নেই আমি। আমার আরও কাজ আছে। এখন যেতে পারবোনা আমি।
অনেকদিন পর পূর্ণর রাগী সুরের কথা শুনে একরাশ অভিমান ভর করলো আমার মনে। সামান্য নিচে যাওয়ার জন্য জিদ করলাম বলে উনি আমায় এভাবে বলবেন ?

হঠাৎ করে কি হয় উনার? এভাবে রাগ দেখাচ্ছেন কেন? উনার মতো ব্যস্ত নই বলে যা ইচ্ছে তাই বলবেন নাকি আমায়! অযথাই অন্য কারও রাগ আমার উপর ঝাড়লেন! এতক্ষণে অভিমানের রেশ ধরে চোখে ভর করতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজল। সেগুলো নিচে পড়ার আগেই উনার দিকে না তাকিয়েই চুপচাপ নিচে চলে আসলাম আমি। উনি যদি আমার উপর অযথা রাগ দেখাতে পারেন তবে আমিও উনার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো। বয়েই গেলো উনার সাথে নিচে নামতে আমার!

নিচে পৌঁছাতেই কাজিনমহলের মুখোমুখি হলাম আমি। বরাবরই সবার সাথে গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা করতে আমার খুব ভাল্লাগে। আর সেটা কাজিনদের সাথে হলে তো কথাই নেই! আমায় দেখেই সবাই ঝাপিয়ে পড়লো আমায় জড়িয়ে ধরার জন্য! আমিও খুশিমনে কথা বললাম সবার সাথে! একিসাথে পরিচয় হলো তাদের সাথে এতবছর পর নতুন করে! আমার ফুপাতো ভাই তাসিন আমায় বললো,

—কি রে তুরফা, এতবছর কোথায় লুকিয়ে ছিলি? তোর বিরহে যে একজন শহীদ হতে চলেছিলো সে-খবর কি আছে তোর?
তাসিন ভাইয়ার কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো আমার। কার কথা বলছেন তিনি? ভ্রু কুচকে বললাম,
—কি বললে কিছুই তো বুঝলাম না ভাইয়া। ভালোভাবে বলো।
—বুঝবি কিভাবে? এখনও বুঝতে দেয়নি যে সে।
বলেই মুখ টিপে হাসলেন তাসিন ভাইয়া। এদিকে কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন প্রান্ত ভাইয়া। গম্ভীর মুখে বললেন,

—অনেক কথা বলছিস, তাসিন। এবার থাম। ভাই শুনলে কিন্তু খবর আছে তোর।
—ভাই নেই দেখেই তো বলছি। ভাইয়ের সামনে এসব বলার সাহস আছে নাকি আমার!
কাচুমাচু মুখ করে বললেন তাসিন ভাইয়া। এদিকে উনাদের কথা শুনে বোকার মতো তাকিয়ে আছি আমি। কারণ তাদের কথার আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকলোনা আমার। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছোট ফুপুর মেয়ে দিশা আপু মুখ বাকিয়ে বললো,

—আরে কাকে কি বলছো তোমরা? তুরফার মাথায় এত ঘিলু নেই যে ও বুঝবে। ছোটবেলা থেকে সেই বোকার বোকাই রয়ে গেলো। পূর্ণ যে কোন দুঃখে তুরফাকে বিয়ে করতে গেলো কে জানে!
দিশা আপুর কথাটা কিছুটা তাচ্ছিল্যপূর্ণ ছিলো যা ভালো ঠেকলোনা আমার কাছে। এতক্ষণ বাকি কাজিনরাও আমায় ক্ষেপিয়ে অনেককিছুই বলেছে কিন্তু তাদের কথা দিশা আপুর কথার মতো লাগেনি। আপুর কথা শুনে মনে হলো উনি যেন খানিকটা অপমানই করলেন আমায় কিন্তু কেন বিষয়টা বোধগম্য হলোনা আমার!

আমার চিন্তার মাঝেই নিচে এসে উপস্থিত হলেন পূর্ণ। উনার গম্ভীর মুখ এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়েছে। আমাদের দিকে এগিয়ে এসেই বললেন,
—কি ব্যাপার? সবাই চুপ হয়ে গেলো কেন? আমার পিছে আমার বউকে বুলি করা হচ্ছিলো নাকি?

পূর্ণর কথা শুনে মুখ টিপে হাসলো সবাই। শুধু দিশা আপু বাদে। উনার চাহনিতে স্পষ্ট বিরক্তি দেখা যাচ্ছে। এদিকে পূর্ণর মুখে “আমার বউ” শুনে আজ কোনরুপ প্রতিক্রিয়া দেখালাম না আমি। অন্যসময় হলে লজ্জায় আড়স্ট হয়ে যেতাম হয়তো তবে আজ উনার উপর আমার অভিমানের পাল্লাটা ভারী! একটু আগেই রুমে রাগ দেখিয়ে এখন এসে সবার সামনে “আমার বউ” বলা হচ্ছে! ঢং যত্তসব।

এক পলক তার দিকে চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। সেই সাথে কানে এলো প্রান্ত ভাইয়ার আওয়াজ,
—বড় ভাইয়া, তুমি কোথায় ছিলে? সবাই বড্ড মিস করছিলাম তোমায় এতক্ষণ। এখন তুমি এসেছো, আরও মজা হবে। এই বৃষ্টিমুখর দিনে নাস্তা খেতে খেতে সবার মিলে জম্পেশ আড্ডা দিবো।
নাস্তার কথা কানে ঢুকতেই এখান থেকে কেটে পড়ার বাহানা পেলাম যেন আমি। পূর্ণর সামনে থাকার কোন ইচ্ছেই হচ্ছেনা আমার আপাতত। তাই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

—ভালো কথা মনে করে দিয়েছ, প্রান্ত ভাইয়া। আমি এক্ষুনি নাস্তা নিয়ে আসছি।
আমার সাথে যোগ দিলো রাইসাও। দুজন মিলে চলে যেতে লাগলাম রান্নাঘরের দিকে। যেতে যেতেই কানে এলো প্রান্ত ভাইয়া পূর্ণকে বলছেন,

—এই গাধা তাসিনটা তুরফাকে সব বলেই দিচ্ছিলো বড় ভাইয়া। সময় থাকতেই আমি ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছি। ঠিক সময়েই তুমি এসেছো।
প্রান্ত ভাইয়ার প্রতিউত্তরে পূর্ণ কি বললেন আমার শুনা হলোনা। রাইসার কথার নিচে চাপা পড়ে গেলো সেই কথা। রাইসার সাথে কথা বলতে বলতেই রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম আমি।

শরতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। আমার সাথে সাথে যেন আজ মেঘেদেরও মন খারাপ! যেকোন সময় যেন মন ভালো করতে বৃষ্টি হয়ে ধরা দিবে ধরনীর বুকে। এমন মেঘলা দিনে ছাদের মধ্যিখানে আসর জমেছে কাজিনমহলের। সবার হৈ-হুল্লোড়ের ভীড়ে যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে মেঘের গর্জন! দমকা হাওয়া ছুটতেই আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠলো সবাই।

আমার সেদিকে মন নেই। একদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। আজ আমিও চাইছি বৃষ্টি নামুক। যে বৃষ্টিতে মন খারাপ ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যায়। যে বৃষ্টিতে দুটি মন মিলেমিশে এক হয়ে যায়। হঠাৎ প্রান্ত ভাইয়ার উচ্ছাসিত আওয়াজ কানে এতে তার দিকে ফিরলাম আমি। পূর্ণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—বড় ভাইয়া, আজকে সময়ও আছে, সুযোগও আছে। এমন বৃষ্টিবাদল দিনে গান ছাড়া আড্ডা কোনভাবেই জমেনা। অনেকদিন তোমার গান শুনা হয়না। আজ একটা গান শুনাও না প্লিজ। তাসিন তো গিটারও এনেছে। ও বাজাবে, তুমি গান গাবে।

প্রান্ত ভাইয়ার কথায় উল্লাসে মেতে উঠেলো বাকি কাজিনরা। সবাই তাড়স্বরে চিল্লিয়ে উঠে সায় জানালো প্রান্ত ভাইয়ার কথায়। এর মধ্যে পূর্ণকে সবাই ঘিরে ধরেছে গান গাওয়ার জন্য। এত মানুষের ভীড়ে উনি শান্তচোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। আর তার দৃষ্টি অনুসরণ হতেই চোখ সরিয়ে নিলাম আমি। মনে মনে খানিকটা অবাকও হলাম।

উনি আবার গানও গাইতে পারেন? কখনো শুনলাম না তো আমি। পরে অবশ্য মনে হলো উনাকে কয়দিনই বা পেয়েছি আমি যে গান শুনাবেন! রাগ আর খোচা মার্কা কথা ছাড়া আমার সাথে তো বেশিরভাগ কোন কথাই বলেন নাহ উনি! নিমিষেই মনটা হাহাকার করে উঠলো আবার। দুঃখী মুখে এক বুক অভিমান নিয়ে পুনরায় আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখতে লাগলাম আমি।

কয়েক মুহুর্ত অতিক্রম হলো। গিটারের রিনিঝিনি তাল কানে আসতেই চোখ তীক্ষ্ণ হলো আমার। আড়চোখে চেয়ে দেখি তাসিন ভাইয়া ইতোমধ্যেই গিটারে সুর তুলছেন। পূর্ণও আকাশের দিকেই চেয়ে আছেন এখন।
সবাই “পূর্ণ ভাইয়া পূর্ণ ভাইয়া” বলে চিয়ার করছেন উনার জন্য। উনি একটু পর শ্বাস নিয়ে হালকা হেসে খোলা গলায় গাইতে আরম্ভ করলেন,

~তুমি চাইলে বৃষ্টি, মেঘও ছিল রাজী
অপেক্ষা শুধুই বর্ষনের,
মাতাল হাওয়া বইছে, দূরে পাখি গাইছে গান
বৃষ্টি তোমার আহবান
সাদা রঙের স্বপ্নগুলো দিল নাকো ছুটি
তাইতো আমি বসে একা,
ঘাসফুলেদের সাথে আমি একাই কথা বলি
ঘাসফুল গুলো সব ছন্নছাড়া
তুমি চাইলে জোছনা, স্বপ্নীল কোনো এক রাতে
আকাশটা ঘিরে প্রার্থনা,
চাঁদটা বলবে হেসে, জোছনা এলে শেষে
জানিও তোমার অভ্যর্থনা~

গানটা আমার অনেক প্রিয় একটা গান। এই গানটার মধ্যে যেন মিশে আছে কিছুটা একাকিত্ব, লুকিয়ে আছে দীর্ঘ অপেক্ষার কোন স্মৃতি। পূর্ণর খোলা গলায় গানটা সত্যিই বড্ড মানিয়েছে যেটা ছিলো আমার আশাতীত! এমন বিষন্ন দিনে এর চেয়ে মানানসই গান আর হতে পারে বলে আমার মনে হলোনা। না চাইতেও চোখ চলে গেলো পূর্ণর দিকে!

উনিও মাত্রই তাকালেন আমার দিকে। চোখাচোখির মুহুর্ত দীর্ঘকায় হলো। দুই চোখে কিছু না বলা কথা প্রেরিত হলো। আচমকাই আকাশের বুক চিড়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির বর্ষিত হলো। যেন বৃষ্টি এতক্ষণ এই মুহুর্তেরই অপেক্ষায় ছিলো!

বৃষ্টি নামতেই সবাই হইহই নিচে নেমে গেলো আম কুড়াতে। দাদুবাড়ি এসেছে আর বৃষ্টির দিনে আম কুড়োবেনা এমনটা তো আর হতে পারেনা! পূর্ণ এখনও শান্ত-নিশ্চুপ। সবাই এতক্ষণে নিচে নেমে গেছে তাই আমিও চুপচাপ চলে যাচ্ছিলাম তাদের পিছু পিছু। হঠাৎই পূর্ণ শান্ত গলায় ডাকলেন আমায়।

—একটু পরে গেলে হয়না, তুরফা?
মায়াময় সামান্য আবদার। অথচ এই ডাকেও আজ মন গললোনা আমার। এভাবেই আমিও সকালবেলা বলেছিলাম তাকে, বিনিময়ে তার রাগ ও অবহেলা ছাড়া কিছুই পাইনি। তাই পেছনে না ঘুরেই তার কথাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে লাগলাম নিচে। কিন্তু পূর্ণ ধপাধপ পা ফেলে এসে হাত ধরে ফেললেন আমার। তার দিকে ঘুরিয়ে আমার দিক চেয়ে কাতর চোখে কোমল কন্ঠে বললেন,

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৯

—অভিমানের পাল্লাটা কি খুব বেশি ভারী? অনেক রাগ করেছো আমার উপর?
এবার আর নিজের অনুভুতিগুলোকে সামলাতে পারলাম না আমি। অভিমানগুলো বৃষ্টির মধ্যেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আমার! পূর্ণর মাঝে কি অদৃশ্য মায়া আছে আমি জানিনা। যে মায়া সর্বদাই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেয় আমার মনকে!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৩১