কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৬

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৬
নন্দিনী নীলা

বাসা সম্পূর্ণ খালি উর্মি নিজের রুমে দরজা বন্ধ করেছিল বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনে হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে ছুটেছে। আয়ান আর জেসমিন বেগম হসপিটালে গেছে। জায়ান তো আগেই গেছে। এখন বাসায় আছে শুধু বকুল আর তৃষ্ণা। উষসী না বাসায় আছে আর না হসপিটালে গেছে সে কোথায় গেছে কেউ জানে না। জোভান সকালবেলায় তার কোন এক বন্ধুর বাসায় গেছিল সেখান থেকে এখনো ফিরেনি। সে জানেও না তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে। তৃষ্ণা আর বকুল খালি বাসায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

বকুল বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,”বুবু তোমার শশুর এক্সিডেন্ট করলো। তুমি যাইবা না হসপিটালে ?”
তৃষ্ণা আনমনে বলল,”আমি কেমনে যামু। হসপিটাল কোথায়? আমি তো এই বাসার বাইরে পা রাখি নাই আমি হসপিটাল চিনমু কেমনে? সবাই চলে গেছে আমারে নেওয়ার হলে তো নিয়েই যাইতো।”
” হ, আচ্ছা বুবু তোমারে একটা কথা কই।”
” বল।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বকুল ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,”বুবু ঐ পূর্ব পাশে একটা রুম আছে না। বাইরে তালা মারা। তার ভিতরে কেউ একজন থাকে। চিৎকার করে কান্না করে।আমি ঐ দিন গেছিলাম। আমি না দরজা খুলতে চাইছিলাম। কিন্তু বাইরে ইয়া বড়ো একটা তালা দেওয়া। তুমি কি জানো ওই রুমে কে থাকে? আর তারে কেন তালা দিয়ে রাখছে?”
তৃষ্ণা মনে করার চেষ্টা করে বলল,” বকুল তুই ওই পাশে গিয়েছিলি ক্যান? তুই জানিস ঐরুমে একটা পাগল থাকে!”
পাগলের কথা শুনে বকুল ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,”ও মাগো বলো কি ওই রুমে পাগল থাকে। আমি আরো দরজা খুলে দেখার জন্য কত কষ্ট করছিলাম।”

” তোরে আমি বলছি না বেশি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবি না।”
বকুল মাথা নিচু করে বলল,” আর করমু না আমি শুধু তোমার পাশে পাশেই থাকমু।”
“এবার বলতো একটু আগে তোর কি হয়েছিল? তুই শাড়িটা খোলার জন্য এতো উতলা হয়েছিলি ক্যান?”
বকুল ভয়ার্ত চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে আছে।

কি করে বুবুকে সত্যিটা বলবে? মনে পরলে ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে দুলাভাই ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল আর তৃষ্ণা বলে ওকে চুমু দিয়েছিল। ছি ছি ছি আমি কেন বুবুর শাড়ি পরতে গেলাম। আমি তো কত শুকনো বুবুর থেকে তাহলেও দুলাভাই ভুল করলো কি করে?
বকুল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা সন্দেহ চোখে চেয়ে বলল,” চুপ করে আছিস কেন? সত্যি টা বল আমাকে।”

বকুল মাথা নিচু করে সব খুলে বলবে তখন বাসায় আসে জোভান। ওরা দুজন ড্রয়িং রুমে বসেছিল এজন্য জোভান কে দেখে দুজনেই কথা থামিয়ে দেয়।
” কি ব্যাপার ভাবি বাসা এতো নিরব কেন?”

তৃষ্ণা উঠে এসে জোভান কে সব খুলে বলে। জোভান এক নজর বকুলের দিকে তাকিয়ে ফোন বের করে উর্মিকে কল দেয়। কথা বলতে বলতে নিজের রুমে চলে যায়। জোভান কে দেখে তৃষ্ণার বকুল কে জেরা করার কথা মাথা থেকে চলে যায়।
বকুল কে খেতে দিয়ে তৃষ্ণা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। খেতে ইচ্ছে করছে না। সবার উপর দিয়ে কত ঝড় যাচ্ছে আর উনিও তো না খেয়ে আছে‌। কখন গেছে সবাই এখন রাত দশটা বাজে এখনো কেউ বাসায় আসলো না। জোভানের থেকে শুনতে হবে বাবা কেমন আছে?

তৃষ্ণা বকুল কে রুমে শুইয়ে দিয়ে জোভানের রুমে যাবে।
জোভানের থেকে খবর নিয়ে জানতে পারল।হসপিটালে পাশে নাকি উষসীর বাবার বাড়ি তাই সবাই সেখানে গেছে। জায়ান আর উর্মি চলে আসবে একটু পর।
আর জায়ানের বাবা এক্সিডেন্ট করে মোটামুটি ভালোই আঘাত পেয়েছে। কিন্তু গুরুতর আঘাত নয়। তিনি যতোটা আঘাত পেয়েছে তার থেকে বেশি ভেঙে পরেছে গাড়ি থেকে তার ইম্পর্ট্যান্ট একটা ফাইল মিসিং সেই টেনশনে তিনি অসুস্থ হয়েছেন বেশি।

বকুল একা কোনভাবেই শুয়ে থাকবে না ওর জন্য তৃষ্ণা ওর পাশে একটু শুয়েছিল কিন্তু জায়ান না আসা পর্যন্ত তৃষ্ণা দুচোখের পাতা এক করতে পারবে না। অনেক বলে কয়ে ওর থেকে ছাড়া নিয়ে জোভানের কাছে গেছিল শুনতে। এসে দেখে এই মেয়ে বেস আছে। তাই বাধ্য হয়ে শুয়ে পড়ে।

শুয়েও জেগে ছিল বকুল ঘুমিয়ে পরতেই তৃষ্ণা বিছানায় থেকে উঠে যায়। জায়ানের রুম থেকে ঘুরে এসে কি মনে করে যেন সেই পাগলের রুমটায় যায়। একবার সামনাসামনি থেকে পাগল টাকে দেখার কৌতূহল দমাতে পারছে না। আবার জায়ান নাকি ওই রুমে যায়। জায়ান তাহলে পাগল টাকে ভয় পায় না।
ওই পাগল এই পরিবারের কি হয়?

আজ যেহেতু বাসায় কেউ নাই একটা সুযোগ তো নেওয়া যায়। তৃষ্ণা সত্যি সত্যি ভয় ডর ভুলে পাগল-টার রুমের সামনে এসে হাজির হলো। জায়ানের রুমে একটা বড়ো চাবির গোছা পেয়েছিল সেই চাবির গোছা টা নিয়ে এসেছে সাথে করে। একটা একটা করে চাবি তালায় দিয়ে খোলার চেষ্টা করছে।
দশটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করে ফেলল তবু খুলে না আর মাত্র চারটা চাবি আছে। আর একটা দিয়ে মুচার দিতেই তালা খুলে যায়। ও লাফ দিয়ে উঠে তাল হাতে নিয়ে। আজ একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে ভেতর থেকে কোন সারা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। পাগলটা এতো নিশ্চুপ হয়ে আছে কেন?

তৃষ্ণা এবার কিছুটা ভয় পাচ্ছে ভেতরে যেতে তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার ছিটকারি ফুলে দরজা খুলতেই ভেতর থেকে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ নাকে এসে ঠেকলো‌। রানী গোলাপী কালার শাড়ি ওর পরণে ও তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল টেনে নাকের মধ্যে চেপে ধরলো। ছি এখানে কোন মানুষ থাকে? কি বিশ্রী গন্ধ আর কি বিশ্রী অবস্থা?

এই গন্ধটা এসেছে সামনে পাগল টা হতো বমি করে ভাসিয়েছে সেগুলো দেখে তৃষ্ণায় এখানেই বমি আসা ধরলো।ও আর ভিতরে যাওয়ার সাহস করতে পারছে না ভাঙাচোরা দিয়ে কি অবস্থা করে রেখেছে রুমটার। ও দরজা আটকে বেরিয়ে আসতে চাইল তখনই ভেতর থেকে এক ভুতের মত কেউ দৌড়ে এসে ওর চুল টেনে ধরলো।আচমকা কেউ দৌড়ে আসতে তো ভয় পেয়েছেই তার মধ্যে সেই মানুষটাকে দেখেও ভয়ে আরো কাঁপতে লাগে। কি ভয়ংকর লাগছে পাগলটাকে। চুল গুলো পুষ্ক খুশকো হয়ে মুখ ঢেকে আছে চোখ দুটো লাল টকটকে। মহিলাটার মাথার মাথার কয়েকটা চুল পাকা ধরেছে।

চুলের বিনি ধরে এমন ভাবে টেনেছে ওর মাথা ব্যথা হয়ে গেছে ও ছাড়ানোর জন্য হাঁসফাঁস করতে লাগে। পাগলটা ওকে টেনে রুমের ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজে রুমের বাইরে চলে আসে। তারপর নাচতে নাচতে বলে,” আমারে রুমের ভেতর আটকে রাখবি তোরা। আমারে আটকে রাখবি? তুই আটকে থাক আমি এখন বাইরে যামু গা। সবকটারে পুলিশে দিমু আমার বাপ পুলিশ আমারে আটকে রেখে আমার জ…

আর কিছু বলতে পারে না পাগলটা তার আগেই জায়ান সেখানে চলে আসে আর এসে দেখতে পায় তৃষ্ণা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে । আর পাগল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে হাততালি দিচ্ছে আর কি সব বলছে। তৃষ্ণার অবস্থা দেখে ওর মাথা খারাপ হয়ে যায় ও পাগলটাকে একটা ধমক দিতেই পাগলটা থেমে যায়।
তৃষ্ণা ভয় কাঁপছে জায়ান কে দেখে স্বস্তি পায় আর সাথে সাথে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান হারানোর আগে একটা কথাই ভাবে কোন কুলক্ষণে এই পাগলের উপর কৌতুহল দেখাতে এসেছিলাম।

পাগলটা জায়ান কে দেখেই হাসি দেয় আর জড়িয়ে ধরতে চায়। জায়ান নাক ছিটকে সরে যায় আর ধমক দিয়ে বলে,” একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তুমি কোন সাহসে? ওর গায়ে হাত তুলেছ ওকে আঘাত করেছ? তুমি জানো ওকে ও আমার স্ত্রী। ওকে আঘাত করে তুমি মোটেই ঠিক কাজ করো নি।”
পাগলটা ঠোঁট ভেটকিয়ে তাকায় তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা অচেতন হয়ে গেছে। পাগলটা তৃষ্ণার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর দিতে থাকে।

জায়ান পাগলটার হাত তৃষ্ণার মাথায় থেকে সরিয়ে একবার পাগলটার মুখে দেখে তাকিয়ে বলে,”তুমি এত মিষ্টি একটা মেয়েকে কিভাবে মারতে পারলে? পাগল হলেও তো তুমি ভালো আর খারাপের তফাৎ বুঝো। তাহলে ওকে তুমি মারার আগে বুঝতে পারোনি ও খারাপ নয় ও ভালো।”
পাগলটা এবার জায়ানের বাহু ধরে কান্না করে দিল।

“ওরা সবাই আমাকে মারে তুমি আমাকে একবার ও বাঁচাতে আসো নি কেন? তুমি ও কি সবার মতো আমাকে ঘৃণা করো?”
জায়ান তৃষ্ণাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” হ্যা করি ঘৃণা এজন্যেই তো আমি তোমার সামনে আসি না।”
বলে জায়ান চলে আসার জন্য পা বাড়ায়‌। পেছনে থেকে পাগলটা বলে উঠে,” তুমি জানো তোমার ওই মুখটা আমার খুব প্রিয় ছিল কিন্তু তুমি রুপি আয়ান আমায় খুব কষ্ট দেয়।”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৫ (২)

“যেটা আমার করার কথা ছিল সেটা এখন করে আয়ান। আমি রুপি আয়ানের থেকে আঘাতটা সহ্য করা তোমার জন্য ভালো নাকি সে আঘাতে তুমি আমার হাত থেকে সরাসরি নিতে চাও?”
পাগলটা সেখানে ফ্লোরে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৭