কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৯

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৯
নন্দিনী নীলা

আজকে বকুলের চলে যাওয়ার দিন। মন মরা হয়ে বকুল সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। আসার দিন কত হাসি খুশি মুখে এসেছিল। বাড়িতে ওর যেতে ইচ্ছে করছে না। এতো আরাম পেয়ে কারো কি গ্রামে যেতে মন চায়। গতকাল ঘুরতে গিয়ে কিছু কসমেটিক ও কিনে দিয়েছে দুলাভাই। সবকিছু ব্যাগে ভরে নিচ্ছে। তৃষ্ণা ও মন খারাপ করে বসে আছে‌। বকুল ছিল বিধায় এতদিন ও একজন সঙ্গী পেয়েছিল দুই বোন ইচ্ছামত থাকতো আবার সেই একাকীত্ব চলে আসবে।

” বুবু তুমি ও আমার লগে চলো যাই।”
” আমার তো যাওয়া যাইবো না রে। আজকে আমার শ্বশুর মানে তোর দুলাভাইয়ের বাবাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসবে। তিনি গুরুতর আহত না হলেও মোটামুটি আঘাত পেয়েছে এখন আমি যাওয়ার কথাও বলতে পারব না।”
বকুল এগিয়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সকাল সকাল বকুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কারণ যেতে তো কিছুটা টাইম লাগে, যাতে দিনের মাঝেই ওকে পৌঁছে দিয়ে আসা যায়।
বাসায় কেউ নাই কারো কাছে বিদায় নিতে পারল না বকুল‌। লিয়াও মন খারাপ করেছিল বকুলের জন্য লিয়াও তৃষ্ণার সাথে বকুলকে এগিয়ে দিতে গাড়ি পর্যন্ত এলো। জায়ান গাড়িতেই ছিল শালিকাকে নিজ দায়িত্বে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে বলে। বকুল গাড়ি উঠবে তখন জোভান আর উর্মি আসে আরেকটা গাড়ি করে বাসায়। ওদের গাড়ি দেখে বকুল থেমে যায়।
উর্মি গাড়ি থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে আসে পেছনের জোভানও আসে।

” তোমার সাথে দেখা করার জন্য খুব তাড়াহুড়া করে এলাম। আর একটু লেট হলেই তো গাড়ি মিস করে ফেলতাম।”
” আফা আপনে আমাগো বাড়ি যাইয়েন।”
“তোমার বিয়ের সময় যাব। আচ্ছা যাও সাবধানে যেও। জায়ান ভাইয়া তুমি কি বকুল কে বাড়ি অবধি দিয়ে আসবে?”
“হুম। ”

” বাবা তো বাড়ি আসছে আসতে আর দশ মিনিট লাগবে। তোমাকে বাসায় থাকতে বলেছিলো।”
“জরুরী কোন দরকার?”
“মনে হয়। আমাকে বলেছে তোমাকে যেন বাসায়‌ই থাকতে বলি কোথাও যেন না যাও।”
“বকুলকে একা কীভাবে ড্রাইভারের সাথে ছাড়বো?”

“ওর সাথে জোভান কে পাঠিয়ে দাও। ভাবি বকুলের সাথে জোভান গেলে কি তোমার কোন সমস্যা আছে?”
তৃষ্ণা কি বললে বুঝতে পারছে না তাও মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। জায়ান গাড়ি থেকে নেমে এলো আর এদিকে জোভান মনে মনে ইয়েস বলে গাড়িতে উঠে বসলো। বকুল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তৃষ্ণা বকুল কে গাড়িতে বসিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো গাড়ি চোখের সামনে থেকে উধাও হতেই বাসার ভেতরে ফিরে এলো। রুমে এসে মনমরা হয়ে বসে র‌ইল।

জায়ান তৃষ্ণার মনে অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,” তোমার বোনকেও আমাদের বাসায় পার্মানেন্টলি নিয়ে চলে আসি? এখানেই থাকবে তোমার সাথে।”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকাল জায়ানের দিকে।
“বোন চলে গেছে। মুখটা এমন করে রেখেছো যেন বাসায় কেউ মারা গেছে।”
“কি সব বলছেন?”
“ফেস ঠিক করো?”

“আপনাদের বাসার কারো সাথে মিশতে পারছি না। সবাই আমাকে কেমন করে যেন দেখে। মনে হয় কেউ আমাকে পছন্দ করে না। বকুল ছিল দুজন ছিলাম এখন ও চলে গেল এজন্য একা একা লাগছে। আর তাছাড়া বকুল গতকাল আমাকে একটা জরুরী কথা বলতে চাইছিল ঘুরতে যাওয়ার চক্করে সেসব মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল।”

” আমার তো আমার ব‌উ মাশাআল্লাহ অনেক পছন্দ আর কার পছন্দের হ‌ওয়ার দরকার নাই বুঝেছ‌। এজন্য তোমার এতো মন খারাপ? আর বকুল হয়তো এমনি কিছু একটা বলতে চাইছিল। ওতো গুরুত্বপূর্ণ হলে বলেই যেতো। আমার সামনে মুখ মলিন করে থাকবে না। তোমার মলিন মুখ আমার পছন্দ নয়।”
জায়ান এখন বসে আছে ওর বাবার রুমে। জায়ানের বাবা সাদিকুর রহমান। তিনি দিব্যি আয়েশি ভঙ্গিতে বিছানার উপর বসে আছেন।

জায়ান তার সামনে মুখোমুখি বসে আছে।
সাদিকুর রহমান চিন্তিত মুখে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,” আমার ঐ ফাইল কে নিয়েছে আমি জানি জায়ান এটাকে উদ্ধার তোমাকেই করতে হবে।”
“আপনার হাতের কাছ থেকে ফাইলটা নিয়ে চলে গেল। আপনি কিছুই করতে পারলেন না উল্টো হসপিটালে ভর্তি হয়ে তিনদিন থেকে আসলেন।”

“তোমার ওপরের রাগ সে আমার কাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তুমি তাকে হ্যান্ডেল কর জায়ান না হলে এবারের ইলেকশনে আমি নিশ্চিত ফেইল করব‌।”
“ফাইলে কি ছিল? আমাকে এই ফাইলের বিষয়ে কিছু জানাননি কেন?”
সাদিকুর রহমান এবার ঘামতে লাগলো। বাবা এমন ভীত চোখ মুখ দেখে জায়ানের সন্দেহ আরো বাড়লো।
“উত্তর দিন বাবা। আপনি না বলে এভাবে ঘামতে থাকলে কিন্তু ফাইলটা পাবেন না আর আমাকে ও আপনার পাশ থেকে হারাবেন।”

“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। ওই ফাইলের বিষয়ে তোমাকে সবই জানাতাম কিন্তু জানানোর আগেই তো মিসিং। সুযোগ পাইনি। তুমি আগে এনে দাও। তারপর সব খোলে বলব।”
” সরি বাবা আগে আপনাকে সব বলতে হবে।”
“আমার উপর হুকুম করছো আমি তোমার বাবা ভুলে যেও না।”
“আমিও তোমার ছেলে সেটা ভুলে যেও না। সব না বললে আমার থেকে কোন সাহায্যের আশা ভুলে যাও।”
“তুমি চাও না এবার ইলেকশনে আমি জিতি?”
“অবশ্যই চাই তুমি জিতো কিন্তু…

সাদিকুর রহমান বুঝলো জায়ান কে সব না বললে সত্যি সে ওনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সাদিকুর রহমান টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছে আমতা আমতা করে সব বলতে লাগলো। সব শুনে জায়ানের ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেল। পাশের থাকা কাচের গ্লাস ভর্তি পানি হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারল।
“আপনি এতো বড় একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন আমাকে ব্যবহার করে ছিহ। এতো কিছু করার পর এখনো আশা করছেন আমি আপনাকে সাহায্য করব‌।”

” তোমাকে ব্যবহার করে করলেও কিন্তু শেষে তোমাকে বাঁচাতেই আমি ফাইলটা হাতিয়ে নিয়েছিলাম। ওই ফাইলটা না আনলে আমার কি আর ক্ষতি হতো। তোমার বেশি ক্ষতি হবে। তোমার জন্য কিন্তু আমি এতোটা সহ্য করেছি হসপিটালে পরেছিলাম। ”

“এতোটা অন্যায় করে। এখন এইটুকু পূর্ণ দিয়ে আপনি সেটাকে ঢাকতে পারবেন না। কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি একদমই না। এর জন্য যদি আমাকে সাফার করতে হয় ভুলে যাব আপনি আমার বাবা। মাইন্ড ইট।”
জায়ান রাগে গজ গজ করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
জেসমিন বেগম জায়ানকে রাগান্বিত অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দেখে রুমে এসে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে?”
সাদিকুর রহমান গম্ভীর মুখে বলল,,” কিছু না।”

ফ্লোরে ভাঙ্গা কাচ দেখে বলল,,” এসব কি?”
“যাও তো এখান থেকে।”
জেসমিন বেগম ধমক খেয়ে সত্যি বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা পর বকুলদের বাড়ির কাছাকাছি চলে‌ এলো গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে বকুল ড্রাইভার কে বাড়ি যাওয়ার জন্য তোষামোদ করতে লাগলো কিন্তু একবারও জোভানকে যেতে বলল না।এ দিকে জোভান বকুলের বলার অপেক্ষায় রইলো না গাড়ি থেকে নেমে বকুলের আগে বাড়ি চলে গেছে।

ড্রাইভার গেল না গাড়ি রেখে বকুল বাড়ি পথে হাঁটতে লাগলো এ পাড়া ও পাড়ার অনেক ছেলেমেয়েরা ওকে দেখে দৌড়ে এলো। আর এলাকার অনেকের সাথে রাস্তায় দেখা হলো সেই বকুলকে বলল,”হ্যা রে বকুল শহরে গিয়া তো তোর বেশ‌ই পরিবর্তন হইয়া গেছে। ফর্সা মোটা তাজা হ‌ইয়া গেছিস শহরের আলো বাতাস খাইয়া।”
বকুল খুব ভাব নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

বাড়ি এসে বকুল দেখল জোভান উঠানে কাঠের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে দাঁত কেলিয়ে। বকুলকে দেখে বলল,”তোমার বাড়ি তুমি আসতেই পারলা না। আমি দেখো কত আগে এসে বসে আছি। এক গ্লাস পানি খাওয়াও তো বকুল।”

জোভানকে এতক্ষণ তৃষ্ণার মা জিজ্ঞেস করেছে কি খাবে জোভান না করেছে এদিকে তৃষ্ণার মা কিছু বানিয়ে আনার জন্য আগুন ধরাচ্ছে। তৃষ্ণার ভাবি বাসায় নাই সে গেছে বাপের বাড়ি। জোভানের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে পানি না দিয়ে বকুল রুমে চলে যাচ্ছিল। রান্নাঘর থেকে তৃষ্ণার মা চিৎকার করে বকুলকে বলে জোভান কে পানি দেওয়ার জন্য। বকুল রাগে গজগজ করে টিউবয়েল থেকে গ্লাস ভর্তি পানি এনে জোভান কে দেয়।

“এই বকুল ফুল তোমার রাগ কি কমে নি?”
” আপনে এইহানে ব‌ইয়া র‌ইছেন‌ ক্যান? পানি খাইয়া বিদায় হন।”
” বকুল রাগ কমাও তুমি কিন্তু আমারে বিয়ে করলে যমজ সন্তানের মা হতে পারবে।”
” এ্যা কি কন এইসব?”
” আমার অবশ্য এখনি বিয়ের বয়স হয়নি। তবুও তুমি রাজি থাকলে আমি ও রাজি।”
” ওইডা কি ক‌থা ক‌ইলেন আপনে?”

” ঠিক কথাই বলছি। আমার ফ্যামিলিতে কিন্তু সব যমজ সন্তান হয়। দেখনা আমরা ভাই-বোন সবাই যমজ। আবার আমার এক পিসির দুই ছেলে মেয়ে ওরাও যমজ। আমাদের গুষ্টিতে নাকি যত সন্তানই হয় তারাই যমজ হয়।”
” এ্যা”বকুল মুখটা হা করে আবার বলল,”আপনি ও কি যমজ? আপনের আবার যমজ কে?”
” উর্মি কে দেখো না। আমরা তো যমজ ভাই বোন।”
বকুল মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে জোভানের দিকে।

“আপনে মিছা কথা ক‌ইতাছেন? উর্মি আপু আপনের ছোট আর আপনেরা দুইজন তো একরকম দেখতে না দুলাভাই আর তার ভাইয়ের মতো।”
“যমজ হলে কি তারা শুধু একরকম দেখতে হয় নাকি? গাধি! আমি আর উর্মি হচ্ছে অমিল যমজ।”
” আপনের কথা আমার বিশ্বাস হয়না।”
” উর্মি কে জিজ্ঞেস করো ও বললে তো বিশ্বাস হবে?”
” তারে আমি ক‌ই পামু?”
” কল দেব।”

” আমার বুবুর ও তাইলে যমজ বাচ্চা হ‌ইবো‌।”
” আমারে বিয়ে করলে তোমার ও হবে।”
” আপনে মানুষ সুবিধার না আপনেরে আমি বিয়া করতাম না। যান দূর হন আমাগো বাড়ি থিকা‌।”
বকুলের মা চেঁচিয়ে ডেকে উঠল বকুল ভেতরে গিয়ে থালা হাতে এলো।
জোভান বলল,” বলো রাগ কমেছে তাহলেই খাবো নচেৎ উঠে চলে যাব আর কিন্তু রাগ ভাঙ্গানোর জন্য আমাকে খুঁজে পাবে না।”

“এমন কইরা বলছেন যেন আপনি চ‌‌ইলা গেলে আমি কান্দুম।”
জোভান সত্যি কিছু না খেয়ে চলে গেল বকুল থালা চেয়ারের উপর রেখে পেছন পেছন এগিয়ে এলো।
” যান মাফ ক‌ইরা দিলাম কিন্তু সত্যি আপনেরে আমি খারাপ পোলাই কমু। রাগ কমলেও আপনি ভালো পোলা হ‌ইতে পারবেন না।”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ১৮

জোভান ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো বকুলের দিকে। বকুল বাড়ির ভেতরে চলে এলো।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ২০