কৃষ্ণবেণী পর্ব ২৩

কৃষ্ণবেণী পর্ব ২৩
নন্দিনী নীলা

আয়ান একটু সুস্থ হয়েই বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গেছে কেউ বুঝতে পারছে না। এদিকে জায়ানের এসবে কোন মাথা ব্যথা নাই। নিজের মতো থাকছে। এজন্য সবার সন্দেহ হচ্ছে জায়ান কে। আয়ান হঠাৎ গায়েব হ‌ওয়ার পিছনে জায়ানের হাত আছে নাকি?

জেসমিন বেগম ছেলের রুমের সামনে এসে পায়চারি করছে। ছেলের কাছে আয়ানের খবর কিভাবে জিজ্ঞেস করবে ভাবছে!
তিনি পায়চারি করছিল তখনি জায়ান দরজা খোলে বাইরে আসে। চমকে উঠে সটান দাড়িয়ে পরে‌ জেসমিন বেগম। জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকায় জেসমিন বেগমের দিকে।
জেসমিন বেগম ঢোক গিলে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,” তুমি কি জানো আয়ান কোথায়? এই শরীর নিয়ে ছেলেটা কোথায় গেল। ফোন ও লাগছে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আপনার ছেলে কোথায় আমি কি করে জানবো?”
” এভাবে বলছো কেন ও তো তোমার ভাই। হঠাৎ উধাও হয়ে গেল তুমি একটু খোঁজ নিবে না?”
” সরি এতো বাড়তি সময় আমার কাছে নাই।”
জেসমিন বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,” আমার মনে হচ্ছে আয়ান উধাও হ‌ওয়ার পেছনে তোমার হাত আছে।”
জায়ান তাকালো জেসমিন বেগমের দিকে। তারপর রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো। হেলেদুলে হেঁটে চলে গেল। জেসমিন বেগম জায়ানের মুখের ভঙ্গিমা দেখে শিউর হ‌লো আয়ানের নিরুদ্দেশ এর পেছনে জায়ানের হাত আছে।

তৃষ্ণা অনেক দিন পরে কলে বাড়িতে কথা বলেছে। তখন জানতে পেরেছে সুজনের ব‌উ মারা গেছে। মেয়েটাকে না চিনলেও শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আহারে বিয়ে কয়দিন হলো এতেই মরে গেল। কি এমন হয়েছিল যে আত্মহত্যা করলো। বকুল তো বলার সময় কান্না করে দিয়েছিল। বকুলের সাথে যে ভালোই সম্পর্ক ছিল তা আসার পর ও বুঝেছে। অনেক কথাই বলেছিল বকুল তার হয়ে। তৃষ্ণা উদাস হয়ে বসে র‌ইলো। লাস্ট বার তো সুজন ভাই ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছিল আচ্ছা তিনি কি ব‌উয়ের সাথেও খারাপ আচরণ করতো?

সেই কষ্টে কি আত্মহত্যা করলো?
আর সুজন ভাই ব‌উয়ের মৃত্যুতে পালিয়ে কেন গেল?
তৃষ্ণা আনমনে নানান কথাই ভাবছিল তখন বাইরে থেকে জায়ান আর জেসমিন বেগমের কথা শুনে ও দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনতে পায়।
তৃষ্ণা বেরিয়ে আসে রুম থেকে জেসমিন বেগম তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে হনহনিয়ে চলে যায়। তৃষ্ণা ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে উষসীর রুমের দিকে যায়। উষসী রুমেই ছিল ও উঁকি মেরে চলে আসতে যাবে পেছনে ঘুরে তখন উষসী ওকে ডেকে উঠে। চমকে লজ্জা মুখে দাঁড়িয়ে যায়।

” আরে বাইরে থেকে চলে যাচ্ছ কেন? ভেতরে আসো।”
” না না ভেতরে যাব না।”
” আরে আসো তো।”
জোর করেই ভেতরে নিয়ে গেল উষসী তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা আয়ান আর উষসীর অনেক ছবি দেয়ালে টাঙানো দেখল। জরোসরো হয়ে সোফায় বসলো। উষসী নিজে থেকেই অনেক কথা বলে ভাব জমাতে চাইছে। তৃষ্ণা ও বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। আড্ডায় মেতে উঠলো।
দুই জা এর মধ্যে এভাবে একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল।

আয়ান নিখোঁজ হয়েছে আজ এক সপ্তাহ হলো। বাড়ির সবাই সেই নিয়ে টেনশনে আছে কিন্তু জায়ানের নির্লিপ্ত ভঙ্গি দেখে সবাই ওকে সন্দেহ করে নিয়েছে কিন্তু এখনো মুখে স্বীকার করাতে পারেনি। এদিকে আয়ান নিখোঁজ এর কোন প্রভাব পরেনি উষসীর উপর। পার্টি আড্ডা মাস্তি নিজে মতো করেই যাচ্ছে।
এদিকে উর্মির পেছনে আঠার মতো লেগেছে আরিফ। ওদের দুজনের সম্পর্ক ঠিক করতে অনেক বার ঘুরতে বা লং ড্রাইভে যাওয়ার অফার দিয়েছে আরিফ কিন্তু উর্মি প্রথম বারের পর আর কখনোই দেখা করতে রাজী হয়নি। এমনকি আর জায়ান কে বলেও কাজ হয়নি জায়ান বলেছে,

” সব সময় বড় ভাই ধমক দিয়ে কি বোন কে প্রেম করতে পাঠাবে? তোমার নিজের উচিত ওকে মানিয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া।”
লজ্জা আর আরিফ কিছু বলার সাহস করেনি।
এদিকে জায়ান হঠাৎ একটা ফ্যামিলি ট্যুরের আয়োজন করলো। ট্যুরের কথা শুনে সবাই অবাক। আয়ান এখনো বাড়ির বাইরে। এর মধ্যে জায়ান ট্যুরের আয়োজন করলো। জেসমিন বেগম আজ স্বামীকে নিয়ে খাবার টেবিলে কথা তুললো। কিন্তু জায়ান উত্তর না দিয়ে খাওয়া শেষ করল।

উঠে দাঁড়ালো চলে যাবার জন্য তখন জায়ানের বাবা বলল,” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে কেন?”
” অনেকদিন কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। সবার মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। ঠিক করা দরকার সামনে বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে এই মেজাজ নিয়ে বিয়ে আয়োজনে কেউ মনোযোগ দিতে পারবে না।”
“কিন্তু আয়ান!”
” সময় মতো চলে আসবে।”

আয়ানের দেখা মিলল ট্যুরে যাওয়ার দিন। আগের থেকে সুস্থ হাঁটতে পারে। শরীরে আঘাত না থাকলেও রোগা ও কালো হয়েছে আগের থেকে। যেন অনাহারে অযত্নে ছিল।
আয়ান নিজের রুমে এসে দেখল উষসী মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু উষসীর দৃষ্টি ফোনে নিবন্ধ।
আয়ান উষসীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে উষসী আড়চোখে তাকিয়ে অবাক হ‌ওয়ার ভঙ্গিতে বলল,” এতো তাড়াতাড়ি বাসুরের দেওয়া শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে? আমিতো ভেবেছিলাম এইমাস তোমার দেখা পাবো না। সত্যি গো তোমার বিরহে খুব‌ই কাতর হয়ে গেছি দেখো চোখের পাড় কালো হয়ে গেছে। তোমার চিন্তায় আমার ঘুম উবে গেছিলো।”

” মশকরা করো আমার সাথে? আমি ছিলাম না এতে সব চেয়ে আনন্দিত হয়েছিলে তুমি তা কি আমি জানি না ভেবেছ!”
” জানলে তো জানোই আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
” তুমি জানতে আমি বিপদে ছিলাম আর কোথায় কে রেখেছিল। সব তুমি জানতে তবুও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলে? ব‌উ হয়ে স্বামীর প্রতি কি এতটুকু ও টান নেই?”

উষসী বিছানায় থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়ানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আয়ানের গালে আঙুল স্পর্শ করে বলল,” ভালোই শাস্তি পেয়েছো তাই না? অন্য মেয়েদের দিকে বাজে নজর দেওয়ার চিন্তা ভাবনা এবার অন্তত বাদ দিও। আর টানের কথা বললে? তা পাওয়ার তুমি কিছু করেছো? উল্টো দিনের পর দিন ওয়াইফ রেখে ভাবি, বাইরের অন্যান্য মেয়েদের দিকে কু নজর দিয়েছো। এরপর তোমার প্রতি আমার কোন টান থাকবে?”

আয়ান থেমে গেল ভেতরে ভেতরে ও আক্রোশে ফুঁসছে। উষসী ওর ভাইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে ওর সাথে এসব করছে। ভাইকে এর জন্য ভুগতেই হবে। কিন্তু তার আগে নিজের ঘর শত্রু উষসীর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমাকে বিপদে ফেলে নিজে শান্তিতে ঘুমাবো তাই না।

” কি ওমন চোখে তাকিয়ে আছো কেন? আবার কোন শয়তানি বুদ্ধি আঁকছ?”
আয়ান হঠাৎ রাগী ভাব কাটিয়ে নরম সুরে বলল,” আমি এই কষ্টের মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। বাকিদের প্রতি আমার কোন ভালোবাসা নাই শুধু দৈহিক সৌন্দর্য দেখে আমি আটকে যেতাম কিন্তু মন থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

বলতে বলতে উষসীর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলো। উষসী থতমত খেয়ে গেলো হঠাৎ আয়ানের পাল্টে যাওয়া সুর দেখে।
উষসী বুঝতে পারছে আয়ান ওকে পটানোর চেষ্টা করছে। উষসী ছাড়াতে হাত পা ছুঁড়ছে। আয়ান না ছেড়ে উষসী জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার বাক্য ছাড়তে লাগে। উষসী অস্বস্তিতে ঘাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে আয়ান শয়তানি হাসি দিচ্ছে আড়ালে। ওর মনে আবার কোন শয়তানি বুদ্ধি এলো সে শুধু আয়ান ই ভালো জানে।

তৃষ্ণা জায়ানের ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে। জায়ান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তৃষ্ণা পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নামিয়ে বলে,” আপনি এতো লম্বা কেন? তালগাছের মতো মাথা মুছতে গিয়ে আমার পায়ের পাতা ব্যথা হয়ে যায়।”
জায়ান ভ্রু কুটি করে বলল,” আমি তালগাছের মতো লম্বা?”
” হ্যা।” বলেই জিভ এ কামড় দেয়। আর সাথে সাথে বলে,” না মানে আপনি নিজেই যদি চুল মুছে নিতেন‌।”
” একদম স্বামী সেবা করায় গাফিলতি করবার চিন্তা ভাবনা করবে না।”
“আমি ওমন ব‌উ‌ই না আমি খুব লক্ষ্মী ব‌উ।”

” ওরে আমার লক্ষ্মী ব‌উ গো। পেছনে ঘুরে দাঁড়াও তোমার চুল আমি মুছে দেই। এখন থেকে আমার চুল তুমি মুছে দিবে। আর তোমার চুল আমি মুছে দেবো।”
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে পিঠ করে দাঁড়ালো। জায়ান খুব সুন্দর করে চুল মুছে দিলো। ওভাবেই তৃষ্ণা কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে বসালো।

হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে তৃষ্ণার চুল শুকিয়ে দিলো। তৃষ্ণা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। এটা আবার কেমন জিনিস। এখানে আসার পর জায়ান কে ব্যবহার করতে দেখেছে নিজে করেনি। আজ ওকেও ব্যবহার করাচ্ছে।
এখন জিজ্ঞেস না করেই তৃষ্ণা দেখেই বুঝতে পারলো এটা চুল শুকানোর যন্ত্র।
” চুল শুকাতে ও মেশিন যন্ত্র লাগে আল্লাহ। কিছুক্ষণ খোলা রেখে ফ্যানে বা রোদে বসলেই তো শুকিয়ে যায়।”
” তাড়াতাড়ির সময় কিছুক্ষণ ও ওয়েট করার উপায় থাকে না।” থেমে আবার বলল,
” যাও প্যাকিং করো একটু পর বের হবো আমরা।”
” আচ্ছা।”

তৃষ্ণা আলমারির খোলে সব পোশাক বের করতে লাগলো।
” আপনার কোন গুলো নেব?”
” তোমার পছন্দ মতো নিয়ে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি।”

জায়ান বাইরে চলে গেল। তৃষ্ণা নিজের শাড়ি ব্যাগে ভরে নিচ্ছে। জায়ানের গুলো নিতে গিয়ে দুটানায় ভুগছে যদি আবার বকে। এটা পছন্দ না হয়। অনেক সময় নিয়ে একটাও নিলো না জায়ানের সব শার্ট প্যান্ট বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো।
এদিকে আয়ান এই ট্যুরকে নিজের একমাত্র অস্ত্র বানিয়ে নিয়েছে। বড় কিছু অঘটন না ঘটিয়ে বাসায় ফিরবে না বলেই প্রতিজ্ঞা করে নিলো। ওর উপর হ‌ওয়া সব অন্যারের প্রতিশোধ ও নিবেই।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ২২

( আসসালামু আলাইকুম। আমার পরীক্ষা ২৯ তারিখ শেষ হবে ইনশাআল্লাহ ফ্রেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে নিয়মিত হয়ে যাব। ভালোবাসা অবিরাম পাঠকমহল।)

কৃষ্ণবেণী পর্ব ২৩(২)