কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩২ (১)

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩২ (১)
নন্দিনী নীলা

দুইদিন গ্রামে কাটিয়ে তৃষ্ণা, জায়ান বাসায় এসে পৌঁছেছে। বকুল তৃষ্ণা’দের সাথে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করেছিল কিন্তু ওর মা যেতে দেয় নাই। তৃষ্ণা, জায়ান ও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু বকুলের মা রাজি হয়নি। রাজি না হওয়ায় একমাত্র কারণ হলো ওদের এখন সরিষা নিতে হবে এই সময় মেয়ে চলে গেলে উনি একা কাজ করবে কি করে। মেয়ে থাকলে তো একটু সহায়তা হয়।

ছেলে ছেলের ব‌‌উ তো বাড়ি ফেলে চলে গেছে এখন বাড়ির সব কাজ উনা’কেই একা করতে হয়। তৃষ্ণা ও ব্যাপার’টা বুঝতে পেরে বোনকে বলেছে কয়েকদিন পরে উর্মির বিয়ে, তখন ওকে নিতে গাড়ি পাঠাবে ও যেন তখন যায় এখন না। বকুল গাল ফুলিয়ে চেয়েছিল শুধু। শহরে যাওয়ার কারণ এবার জোভান ছিল। অনেক দিন ধরেই তার কোন পাত্তা নাই। কত ভালবাসা না তখন দেখাই ছিল এখন সব ফুস হয়ে গেছে। এতো দিন হয়ে গেল তার খবর নাই। কিন্তু নিজেও যেতে পারল না। তাই মন খারাপ করে বসে আছে উঠানে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” বকুল ক‌ইরে…” বকুলের মা ডাকছে।
” আম্মা কি হ‌ইছে? দেখ না ব‌ইসা র‌ইছি। ডাকো ক্যান?”
” তেজ দেখাস কারে তুই‌‌। কাজে হাত লাগা। দেখস না সরিষা তুলতাছি তুই দেইখাও ব‌ইসা র‌ইছিস উঠ ক‌ইতাছি।”
” দেখ আম্মা আমার ভাল লাগতাছে না তুমি করতে পারলে করো। নয়তো আব্বা রে ডাইকা আইনা করাও। আমারে ডাকবা না।”

” ঝাড়ুর বাড়ির খাইবার না চাইলে তাড়াতাড়ি আয়। ক‌ইছি না কয়দিন পর নিয়া যাইব তাও সং এঁর মতো বসে আছিস।”
” আমার আজকেই যাইতে মন চাইছিল তোমগো লিগা যাইতে পারলাম না। এই কয়ডা কাজ তুমি করবার পারবা না। আমারে লাগে সব কিছুতে। বুবুর নাগাল আমারো বিয়া হ‌ইয়া গেলে তুমি কি কাজ না ক‌ইরা খাইবা?”
” মাইয়া মানুষের এতো মুখে মুখে তর্ক করা লাগে না। তোর যা স্বভাব তুই দুইদিন ও শশুর বাড়ি টিকতে পারবি না। আমার তৃষ্ণা তো তোর মতো মুখে মুখে তর্ক করে না। শান্ত শিষ্ট আছিল তাই তো এতো বড়ো ঘরে বিয়া দিতে পারছি। সুখে সংসার করছে।”
বকুল ভেংচি কেটে ঝাড়ু হাতে নিল। অতঃপর কাজ করতে লাগল বাধ্য হয়ে।

বাসায় আসতেই জায়ান আর আয়ানের মধ্যে তর্কাতর্কি লেগেছে। তৃষ্ণা দূরে দাঁড়িয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসার প্রত্যেকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আয়ান ক্রোধে ফেটে এগিয়ে এসে জায়ানের কলার চেপে ধরে বলল,,” তুই চক্রান্ত করে আমাকে জেলে পাঠাই ছিস। নিজে ব‌উ নিয়ে ফুর্তি করে ঘুরে বেড়াস আর আমাকে ওই জেলে বন্দি করে রাখিস। তোর সব অত্যাচার সহ্য করেছি আর না। নিজে উল্লাস করবি আর আমি শুধু সাফার করব তাই না। আর না। এই আয়ান আর কিছু মুখ বুজে সহ্য করবে না।”

জায়ানের চোখ রাগে রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। সবাই জায়ানের মুখমন্ডল দেখে ভয়ে সিটিয়ে যায়। জেসমিন বেগম দৌড়ে এসে আয়ান কে টেনে সরিয়ে আনতে চায় জায়ানের থেকে কিন্তু আয়ানকে সরানো যাচ্ছে না। আয়ানের বাবা বাসায় নাই। দুইজন গার্ড এসে টেনে সরাতে যাবে জায়ান হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয় তাদের। তারা মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ায়।

হাত মুঠো করে এক ঘুসি মারে আয়ানের নাক বরাবর আর আয়ান ছিটকে ফ্লোরে পরে যায়। জায়ান আবারো এগিয়ে লাথি মারে পেটে। মুখে কোন কথাই বলে না। জেসমিন বেগম জাপ্টে ধরে ছেলেকে আটকায়।
” ওকে ছেড়ে দে বাবা‌। ও মরে যাবে। ওর শরীরের দিকে একবার তাকায় দেখ ছেলেটা জেল খেটে একটু খানি হয়ে গেছে আর মারিস না।”

” ওর সাহস কিভাবে হলো আমার দিকে আঙুল তোলার। আমার গায়ে হাত বাড়ায় কোন সাহসে? এক ঘুসি’তে মাটির সাথে মিশে যায় ও আসছে জায়ানের দিকে আঙুল তুলতে এতো স্পর্ধা।”
হুংকার দিয়ে বলল জায়ান। আয়ানের নাক দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে। জায়ান রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। তৃষ্ণা আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে ঢোক গিলে। আয়ান হঠাৎ ওর দিকে তাকাল‌। এই অবস্থায় ও কেমন নোংরা চোখে শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা নিজের শাড়ির আঁচল টানতে টানতে রুমে চলে এলো।

জেসমিন বেগম ছেলেকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল। লিয়াকে দিয়ে ফাস্ট এইড বক্স এনে নাকের রক্ত মুখে দিল। আয়ান শক্ত হয়ে বসে বলল,, ” দেখেছ কেমন পশুর মতো মারল ও আমায় মানুষ মনেই করে না। সবসময় নিজ স্বার্থে শুধু ইউজ করে আর সব ঝড় এনে আমার কাঁধে ফেলে। আর কিছু বলতে গেলেই এভাবে মারে। গায়ের জোর দেখায়। আমার কি গায়ের জোর নাই? চাইলে আমিও মারতে পারতাম কিন্তু ওকে আমি মারতে পারি না ও আমার ভাই। আমরা যমজ ভাই এটা ও ভুলে গেলেও আমি ভুলি না কখনো।”

জেসমিন বেগম কিছু বলল না।
আয়ান মনে মনে বলল,” গায়ের জোরে জায়ানের সাথে না পারলেও বুদ্ধির ক্ষেত্রে আমিই সেরা। আমার বুদ্ধির কাছে জায়ান তো শিশু।”
বলেই শয়তানি হাসি দিল।

তৃষ্ণা আজ অনেক দিন পর সেই পাগলটার রুমে কাছে এসে উঁকি ঝুঁকি মারছে। বাইরে থেকে তালা দেওয়া তাই ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নাই ও এটা ভেবেই এসেছে। বাইরে থেকেই রুমটা দেখতে। কিন্তু আজ ওর জন্য এক চমক রেডি ছিল এখানে। ও না আসলে জানতেই পারত না। আজ দরজা তালা দেওয়া নাই‌। তালা ঝুলিয়ে রাখা শুধু। মনে হয় তালা দিতে ভুলে গেছে। সেদিনের সেই ভয়াবহ কান্ডের কথা মনে হতেই ও ফিরে আসতে চায় কিন্তু আরেকবার ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে’টাকেও দমাতে পারছে না।

এদিক ওদিক তাকিয়ে তৃষ্ণা দরজার ছিটকিড়িতে হাত দেয়।
ওর হাত পা কাঁপছে ভয়ে। তবুও সাহস দেখাতে ভুল করছে না। দরজাটা ঠাস করে খুলে নিজের গলা উঁচু করে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি মারে। দেখতে পায় পাগলটা হাতে খাতা কলম নিয়ে কি যেন লিখছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে লাল চোখ মেলে ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে। চাহনি দেখেই তৃষ্ণার হৃদস্পন্দন কেঁপে উঠল।

ও তাড়াতাড়ি দরজা থেকে মাথা সরিয়ে নেয়। আর দ্রুত দরজা আটকাতে যায়। ভয়ে ওর হাত অস্বাভাবিক মাত্রায় কাঁপছে।এদিকে পাগলটা ছুটে এসে দরজার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তৃষ্ণা ভয়ে পিছিয়ে গেছে। দরজা না আটকে পালাতে যাবে তার আগেই পাগলটা ছুটে এসে তৃষ্ণার আঁচল টেনে ধরে। তৃষ্ণা হার্ট ফেল করবে এমন করে বুকে হাত দিয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে। নিজেকে বকছে অনবরত কেন আসতে গেল এই বিপদে আজ আর রক্ষে নাই। এই পাগলের হাত থেকে তো নাই ই আর জায়ান জানলে কি করবে আল্লাহ তাআলা জানেন।

” ঐই মিষ্টি ব‌‌উ আয় না আমার কাছে।”
তৃষ্ণা পাগলটার এতো সুন্দর কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেল। বিস্মিত নয়নে ফিরে তাকালো পাগলটার দিকে। পাগলটা গোল গোল চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও চাইতেই হাসল দাঁত বের করে। তৃষ্ণার বমি আসতে চাইল পাগলটার দাঁত কালো কুচকুচে হয়ে গেছে কত কাল ধরে দাঁত ব্রাশ করে না যে। মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগল। ও কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। পাগলটা ওর হাত ধরে চুমু দিয়ে বলল,,” কি সুন্দর আমার জায়ানের ব‌উ। পরীর মতো ব‌উ।”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে আজ হিংস্রতা দেখাচ্ছে না কেন? এতো সুন্দর করে কথা বলছে কেন? স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে পাগলটার শান্ত চোখে দিকে। জায়ানের ব‌উ জেনেই কি এতো সোহাগ করছে? জায়ানের প্রতি এই পাগলের এতো টান কেন?

তৃষ্ণা ভয় কেটে গেছে পাগলটার ভালো আচরণ পেয়ে ও কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। পাগলটা ওকে নিয়ে নিজের রুমে এলো। রুমের অবস্থা এতো নোংরা যে ওর দম আটকে আসতে চাইল। কিন্তু তার সাথে ওর খারাপ ও লাগল। ইশ কি নোংরা জায়গায় উনি থাকেন। একটু পরিষ্কার করার মানুষ ও নাই। আহারে খুব মায়া লাগছে ওর। পাগলটার বিছানা পরিষ্কার ও একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসল।

পাগলটা মাথা চুলকে বলল,,” তুই তো খুব সুন্দর ঠিক আমার মতো।”
বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। তৃষ্ণা পাগলটার হাসির শব্দ ভয়ে ঘামতে লাগল। যত‌ই ভালো আচরণ করুক তিনি পাগল তারে দেখে ওর ভয়টাই বেশি আসছে।
তৃষ্ণা উঠে চলে আসতে যাবে পাগলটা হাত টেনে ধরে বলল,,” যাইস না আমার সাথে থাক। তোর সাথে অনেক গল্প করব। কেউ আমার কাছে থাকে না গল্প করে না। আমার খুব কষ্ট হয়। ওইদিন তোরে মারছিলাম বলে চলে যাচ্ছিস তাই না?”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩১ (২)

চোখ দিয়ে গলগলিয়ে পাগলটার জল পরছে তৃষ্ণা এমন অবস্থা দেখে নিজেও কান্না করে দিল। খুব বেশিই মায়া লাগছে পাগলটার জন্য। কি অসহায় আবদার করছে।
কিন্তু কেউ চলে আসে যদি। আর এখানে ওকে দেখে নেয়! কি হবে তখন?

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩২ (২)