কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৪ (২)

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৪ (২)
নন্দিনী নীলা

তৃষ্ণা এক গ্লাস পানি এনে সাদিকুর রহমানকে দিল। মেয়ের বিদায় তিনিও কেঁদেছেন। সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। সেই মুহূর্তেই আয়ান বাসায় প্রবেশ করে। জায়ান রুমে ছিল। তৃষ্ণা পানি দিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিল তখনি মেইন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আয়ান।

জেসমিন বেগম আয়ানের পাশে বকুলকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে কপাল কুঁচকে এগিয়ে আসে।
” এসব কি আয়ান? তোমার একমাত্র বোনের বিয়ে আর তুমি অনুপস্থিত। এতো কল করলাম ফোনটা অবধি অফ করে রেখেছ। বোনের বিদায় এ পর্যন্ত উপস্থিত হলে না কেমন ভাই তুমি?”
তিনি বকুল কে অসম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আয়ান কে প্রশ্ন করল। তৃষ্ণা তাদের কথা শুনে থেমে গেছে। আয়ানের উত্তর শুনতেই দাঁড়িয়ে পড়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” মা আমি দরকারি কাছে বিজি ছিলাম।”
জেসমিন বেগম এবার বকুলের দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি এমন তোমার দরকারি কাজ?কেমন কাজ করতে যাও জানা আছে। এই মেয়ে তোমার সাথে কেন?”
আঙুল উঠিয়ে বলল।

তৃষ্ণার দৃষ্টি বিষ্ময়ে ভরা, হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। ও দাঁড়িয়ে আছে জেসমিন বেগমের পেছনে। ওর দৃষ্টি বকুলের মাথা নিচু করে থাকা ছোট মলিন মুখশ্রীর দিকে। তার থেকে ও বড় শখ খেয়েছে আয়ান বকুলের হাত ধরে আছে দেখে। বড়ো বড়ো চোখ করে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। আয়ান বকুলের ছোট হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে। ও যে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। কথাই বলতে পারছে না।

” কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
আয়ান মাথা নিচু করে বলল,,” আমি বকুল কে বিয়ে করেছি।”
” হোয়াট?” জেসমিন বেগম চেঁচিয়ে উঠল। তৃষ্ণা দু’পা পিছিয়ে গেল। চোখে জল ছলছল করছে। বকুলের চোখ বেয়ে গলগলিয়ে অশ্রু ঝরছে।
বাইরের চেঁচামেচির শুনে জায়ান নিচে নেমে আসে।

তৃষ্ণার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। এতো বড় শক ও নিতে পারছে না। ও পরে যেতে নেয় জায়ান ছুটে এসে ওকে ধরে ফেলে। তৃষ্ণা অজ্ঞান হয়ে গেছে।‌ বকুল আয়ানের থেকে হাত ছাড়াতে মুচড়া মুচড়ি করছে।
” ছাড়ুন আমার হাত বুবুর কাছে যাব।”
” চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। নচেৎ ফলাফল ভালো হবে না।”

বকুল অসহায় চোখে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। জায়ান তৃষ্ণাকে এক হাতে আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
” দুনিয়ায় এতো মেয়ে থাকতে তোর আমার শালিকা কেই বিয়ে করতে হলো?”
” ইটস মাই মেটার। তোর বিয়ের সময় আমি যখন কোন বাধা সৃষ্টি করি নাই। তুইও এখানে বাড়তি কথা বলবি না।”
বাসার সমস্ত আত্নীয়-স্বজন দরজার কাছে এসে ভীড় করেছে। কাহিনী বুঝার জন্য সবাই নিশ্চুপ চেয়ে আছে। সবাই ফিসফিস করে হাসাহাসি করছে।

জায়ান তৃষ্ণাকে পাঁজকোলে তুলে বেডরুমে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এলো। আয়ান নিজের কথা শেষ করে বকুলের হাত টেনে ভেতরে প্রবেশ করে। জায়ান এসে ওদের পথ আগলে দাঁড়ায়।

” সামনে থেকে সর।”
” বকুলের সাথে আমার কথা আছে ওর হাত ছাড়।”
” তোর সাথে কোন কথা বলবে না বকুল।”
” বকুল?” বকুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল জায়ান।
বকুল ঢোক গিলে বলল,” উনি যা বলবেন তাই হবে।”

জায়ান সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। আয়ান শয়তানি হাসি দিয়ে বকুলকে নিয়ে উপরে চলে যায়। জায়ান ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ফোন বের করে কাউকে কল দিয়ে বলল,,” ড্রাইভারের খোঁজ পাওয়া গেছে?”
” স্যার আমি মজনুর বাড়ি গেছিলাম ও মারা গেছে এক্সিডেন্ট এ।”
” হোয়াট?”

জায়ান ফোন নামিয়ে কপালে আঙুল চালাতে লাগল। রাগান্বিত মুখশ্রী করে একবার জেসমিন বেগমের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো।
জেসমিন বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পরল সোফায়।
এই বাসায় কি সব হচ্ছে দুই ছেলেই নিজে নিজে বিয়ে করে নিল। একজনকেই সহ্য করতে পারে না আবার আরেকজন।

আয়ান বকুলকে রুমে এনেই ছুঁড়ে মারে। বকুল ফ্লোরে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,,” আপনার কথা মতোই আমি সব করেছি এবার আমাকে ছেড়ে দিন।”

আয়ান বকুলের পাশে বসে ওর ওর গাল চেপে ধরে বলতে লাগল,,” বকুল ফুল কেঁদো না। তোমাকে ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। এখনো তো কাজ শুরু‌ই করতে পারলাম না এখনি ছেড়ে দেব? আরেকটা কথা বকুল ফুল তোমার বোনের সাথে বেশি আড্ডাবাজি করবে না। আর ভুল করেও এসব বলতে যাবে না। যা শিখিয়ে দিয়েছি তাই বলবে মনে থাকবে?”
বকুল ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে গলগলিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। এতো জুড়ে চেপে ধরেছে যে মনে হচ্ছে গালের চামড়া ছিঁড়ে খেলবে।

আয়ান বকুলকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বকুল ওই ভাবেই বসে আছে।
চোখ য‌ত‌ই মুছে নিচ্ছে ফের ভিজে উঠছে। আয়ান ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে আলমারি থেকে নিজের টিশার্ট বের করে গায়ের কোর্ড শার্ট খুলতে লাগল। বকুল মাথা নিচু করে ওইভাবেই বসে আছে। আয়ান কাজ শেষ করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে নিচে এসে বলল,,” মা খেতে দাও তো।”

জেসমিন বেগম বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে।
” কি হয়েছে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছো কেন?”
” তোমার কি লজ্জা নাই? ওই মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসছো কেন?”
” মা তোমাদের পছন্দে তো একবার বিয়ে করলাম‌ই এবার নিজের পছন্দে করলাম। এতে এতো রিয়েক্ট কেন করছ? জায়ানের বেলায় তো কিছুই বলো নি তাহলে এখন কেন এতো কথা বলছ?”

” সব কিছুতে জায়ানের নাম নিবে না।”
” অফকোর্স নেব। ওই তো আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। ও ছাড়া আর কার নাম নেব?”
” তোমার এতো বাড়াবাড়ি সীমা অতিক্রম করছে এবার।”
” বাবা কোথায়?”
” জানি না।”

রাগে জেসমিন বেগম চলে গেল। আয়ানকে কাজের মহিলা খেতে দিল। আয়ান রাক্ষসের মতো খেয়ে বলল এক প্লেট নিয়ে উপরে আসতে। কাজের মহিলা ওর পেছনে পেছনে উপরে এসে খাবার দিয়ে গেল।
” আমি একটু বুবুর লগে দেখা করে আহি।”
” নাহ।”
বকুল আয়ানের পা জড়িয়ে বসে পরল।
” একটু যেতে দিন। এহনি চলে আসমু।”
” পা ছাড় নয়তো লাথি খাবি।”
আয়ানের ধমক খেয়ে বকুল সরে গেল।

জায়ান তৃষ্ণার মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে।
” তৃষ্ণা চোখ খোল।”
তৃষ্ণা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে উঠে বসল।
জায়ান তৃষ্ণার গালে হাত রেখে বলল,,” ঠিক আছ?”
” ওই শয়তানটা আমার বোনকে বিয়ে করেছে।” ফুপাতে ফুপাতে বলল তৃষ্ণা।
” শান্ত হ‌ও।”

” এতো কিছু হয়ে গেছে আর আমি শান্ত হবো? আপনার ভাই একটা খুনি। আবার নোংরা চরিত্রে তার খারাপ দৃষ্টি আমি দেখেছি। তার মতো একজন আমার বোনের বর আমি কিভাবে মেনে নেব। এসব কীভাবে হলো আমার পাগল পাগল লাগছে আপনার ভাই কেন আমার বোনের সর্বনাশ করল।” বলেই তৃষ্ণা ঠুকরে কেঁদে উঠল।
” উফফ কেঁদো না তো। কেঁদে তুমি কিছু সমাধান করতে পারবে? পারলে নিজের বোনকে আমার কাছে নিয়ে আসো ওর সাথে আমার কথা আছে।”

“কোথায় বকুল?”
” আয়ানের রুমে হয়তো‌।”
তৃষ্ণা লাফ দিয়ে বিছানায় থেকে নেমে এলো। বকুলকে খেতে দিয়েছে। আয়ানের ধমক খেয়ে বকুল খাবারে কেবল হাত দিবে। তখনি তৃষ্ণা ছুটে এসে বকুলের হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।
” আমার সাথে আয়।”

আয়ান আটকাতে যেয়ে ও পারল না তৃষ্ণা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়েছিল।
বকুলকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে এলো।
” ওই শয়তান’টার হাতে কীভাবে পরলি? কি করেছে ও তোকে সব বল আমাকে।”
তৃষ্ণা বকুলের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল। জায়ান নিশ্চুপ বসে আছে বকুলের কথা শোনার জন্য।
” কিরে কথা বলছিস না কেন? তোদের বিয়ে হয়নাই তাই না। বাবা মার থেকে আয়ানের কাছে কীভাবে গেলি বল আমাকে।”

” বুবু আমাদের বিয়ে হয়েছে এটা সত্য।”
‘ মিথ্যা বলছিস তুই। কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নাই সত্যি টা বল আমাদেরকে। তোর দুলাভাই ওকে শাস্তি দেবে।”
বকুল চুপ করে আছে।
” কথা বলছিস না কেন থাপ্পড় খাবি কিন্তু।”
বকুল বলল,,” আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি আমার আয়ান কে পছন্দ ছিল আগে থেকেই। তাই বিয়ের কথা বলাতেই রাজি হয়ে গেছি।”

তৃষ্ণা রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ঠাস করে চর মেরে দিল। বকুল আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল। আয়ান এমনিতেই গাল চেপে ধরে ব্যথা দিয়েছিল এখন আবার চর খেয়ে ওর মাথা ভনভন করছে। তৃষ্ণা বকুলকে আবারো জিজ্ঞেস করল বকুল কথা বলছে না দেখে তৃষ্ণা মারতে লাগে। জায়ান তৃষ্ণাকে জোর করে সরিয়ে ইশারায় বকুলকে চলে যেতে বলে।
তৃষ্ণা জায়ানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিল।

” শান্ত হ‌ও।”
” ও কেমন মিথ্যা বলল দেখছেন। আয়ান ওকে কব্জা করে নিয়েছে আমার বোন আমার কথার উত্তর দিল না।”
” ও ভয় পাচ্ছে। ওকে আসতে ধীরে জিজ্ঞেস করিও। কেন ভয় পাচ্ছে।”
” কেন আবার আপনার ওই ভাই আমার বোনকে ভয় দেখিয়েছে। আমি ছাড়ব না উনাকে আমার বোনের জীবন নষ্ট করতে দেব না আমি।”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৪ (১)

” এই হাতের দাগ আমার তৃষ্ণা বেবির নাকি।”
বলেই আয়ান বকুলের গালে স্পর্শ করল। তৃষ্ণা এতো জোরে থাপ্পড় দিয়েছে যে লাল দাগ ফুটে উঠেছে।
বকুল আয়ানের হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,,,” আমার বুবুকে একদম খারাপ নজরে দেখবেন না। আমার বুবু আপনার ভাবি। বুবুকে সম্মান দিবেন।”
আয়ান বকুলের হাত মুচড়ে ধরে বলল,,” তোর কথায় আমি আয়ান চলব? বেশি কথা বলবি তো একদম জানে মেরে ফেলব।”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৫ (১)