কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৭ (১)

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৭ (১)
নন্দিনী নীলা

তৃষ্ণা নিচ থেকে এক মগ কফি নিয়ে উপরে এলো। মাথা ব্যথা করছে সারারাত জেগে থেকে ওর মাথা ধরে আছে। জায়ান সকাল সকাল উঠেই কোথায় যেন চলে গেছে। তৃষ্ণা রাতভর জায়ানের মাথার কাছে জেগে বসে ছিল। রুমে ঢুকতেই চমকে উঠল। বকুল ভয়ার্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে বলল,,” তুই এখানে কি করছিস?”
বকুল ভয়ের জন্য কথা বলতে পারছে না। তোতলাতে তোতলাতে বলল,” বুবু তোমারেই খুঁজতে আইছিলাম।”
তৃষ্ণা বকুলের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,”আমার কাছে তোর কি কাজ?”
বকুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

” মিথ্যা বলবি না সত্যি করে বল কি জন্যে এই রুমে এসেছি।”
বকুল বলল,,” হাছা বুবু শুধুই কথা বলতে আইছিলাম।”
” তাইলে এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?”
বকুল নিজের ভয় কাটানোর চেষ্টা করে বলল,,” ক‌ই ভয় পাচ্ছি না‌তো?”
” আমার চোখে ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ নয়। আমি তোর বুবু। আমি তোর নাড়ি নক্ষত্র বহুদিন ধরেই চিনি‌। তাই মিথ্যে বানোয়াট কথা না বলে সত্যটাই বল।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বকুল অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” বের হ আমার রুম থেকে আর কখনো আসবি না। যদি আসিস আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না মনে রাখিস।”
বকুল কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এল।
বাইরে এসে ওর দেখা হলো জোভানের সাথে। জোভান কে দেখে কান্নার গতি আরো বেড়ে গেল। জোভান শক্ত চোখে চাহনি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল জোভান কে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ জোভান ওর হাত ধরে আটকে দেয়। বকুলের বুক ধক করে উঠে। ও অবাক চোখে ফিরে তাকাল জোভানের দিকে।

জোভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,” তুমি যেহেতু আয়ান ভাইকেই ভালবাসো আমাকে কেন পোড়ালে? যার সাথে আমার বড় ভাইয়ের সম্পর্ক তার দিকে অন্তত নজর দিতাম না। কেন আমায় এই যন্ত্রণায় ছটফট করতে হচ্ছে বলো।”
” ছাড়ুন।” বকুল হাতের দিকে তাকিয়ে বলল। ও ভয়ে ঘামছে‌‌।
জোভান বকুলের অশ্রুসিক্ত নয়নে দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল হাত ছাড়িয়ে নিতে মোচড়া মোচড়ি করছে। জোভান হাত ছেড়ে দিল। বকুল এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল।

জায়ানের আগমন ঘটে এগারোটার দিকে এসেই ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে ভাবছে লোকটা সাতসকালে উঠে গেছিল কোথায়?
জিজ্ঞেস করবে ভেবেও করতে পারছে না। সাহস সঞ্চায় করে করেই ফেলল,,” আপনি কোথায় গেছিলেন?”
” মায়ের সাথে দেখা করতে!” চোখ বন্ধ রেখে বলল জায়ান।
” আমাকে নিয়ে গেলেন না কেন?” অবাক স্বরে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান বলল,,” এক পাগলের সামনে যেতেই ভয় পাও। এখন তো হাজার পাগলের সাথে তার বসবাস। ওখানে তুমি থাকতে পারতে না।”

” ঠিক পারতাম। আপনি আমাকেও নিয়ে যাবেন।” নাছোড়বান্দা গলায় বলল।
জায়ান বলল,,” বকুল এই রুমে এসেছিল?”
তৃষ্ণা চমকানো গলায় বলল,,” আপনি জানলেন কি করে?”
জায়ান বাঁকা হেসে বলল,,” এই রুমে একটা সিসি ক্যামেরা আছে তুমি ভুলে গেছ।”
তৃষ্ণা চমকে বলল,,” বকুল আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল বলেছে।”
” তোমাকে মিথ্যে বলেছে। ও এসেছিল চুরি করতে!” মুখমন্ডল কঠিন করে বলল।
তৃষ্ণা বিস্ফোরণ চোখে তাকাল জায়ানের দিকে।

” কি সব বলছেন আমার বোন আর যাইহোক চোর না।”
” তোমার বোন চোর না হলেও আমার ভাই চোর। আর এই চুরির কাছে পাঠিয়েছিল ওই ই।”
” আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”
” তোমাকে একটা গুড নিউজ দেই। তোমার হাজব্যান্ড এমপি হবে। বাবা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। তার জায়গায় আমাকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।”
” বাবা কেন দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে?”

” আয়ান নাকি এমপি হতে চায়। বাবাকে অনেক ভাবে বুঝিয়েছে তার জায়গা আয়ান কে দিতে। কিন্তু আয়ানের আশায় জল ঠেলে আমাকে দিয়েছে এটা আয়ান সহ্য করতে পারছে না। তাই তোমার বোনকে কাজে লাগিয়ে কাগজ হাতিয়ার করতে চাইযেছে।”
” তাহলে এই কারণেই আমার বোনকে বিয়ে করেছে। নিজের স্বার্থ হাসিল করতে?”
” আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। শোন তুমি বকুল কে এতো কিছু জিজ্ঞেস করো না। ওর গায়ে সব সময় সাউন্ড ক্যামেরা লাগানো থাকে। যার মাধ্যমে আয়ান যেখানে থাকুক বকুল কার সাথে কি কথা বলছে সব শুনতে পায়। বকুল চাইলেও এজন্য আয়ানের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না।”

” আপনি এতো কিছু কি করে জানলেন?”
” অনেক কিছুই তো জেনেছি তৃষ্ণা তোমাকে যে বলতে পারছি না।” বিড়বিড় করল জায়ান।
তৃষ্ণা জায়ানের দিকে প্রশ্নতুক চোখে তাকিয়ে আছে।
জায়ান তৃষ্ণা কে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে চুলে নাক ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে র‌ইল।
” খাবেন না?”
” একেবারে লাঞ্চ করব।”

আয়ান বকুলের দিকে তাকিয়ে আছে রাগী চক্ষে। আর বলল,,”তুই আমাকে না বলেই ওই রুমে গিয়েছিলি কেন?”
বকুল ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল,,” আমি তো আপনের ভালোর জন্য গেছিলাম। ওই ফাইল আনতে আর একটু হলে নিয়েই চলে আসতাম। কিন্তু সময় মতো বুবু চলে আসার জন্য পারলাম না।”
আয়ান বকুলের চুলের মুঠি ধরে বলল,,” তুমি ইচ্ছে করে গেছিস যাতে জায়ান সব বুঝতে পারে তাই না।”
বকুল কান্না করে দিয়ে বলল,,” না তার লিগা না। আমি তারাতাড়ি ফাইল এনে দিয়ে আপনার থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম। সত্যি আমি দুলাভাইকে কিছু জানাতে এসব করি নাই।”

” ওই রুমে ক্যামেরা আছে। ফাঁকা রুমে গেলেও সব জেনে যাবে জায়ান।”
” আমারে ক্ষমা ক‌ইরা দেন। আমি জানতাম না এসব।”
” আমার আদেশ ছাড়া কিছু করবি তো তোরে জানে মেরে দিমু। হা’রাম’জাদি।”
আয়ান বকুলকে রুমে থেকে বের হতে বারণ করে চলে গেল।

আয়ান টেনশনে আছে। দুইদিন ধরে পায়েল এর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা গেল কোথায়। এখনি পায়েলের ঠিকানায় যেতে হবে এটাকে মেরে ফেললেই আর টেনশন নিয়ে থাকতে হতো না। রুপের মোহে পড়ে এখন বিপদ ডেকে আনল। আয়ানের গলা শুকিয়ে আসছে। কোন ভাবে পায়েল জায়ানের হাতে পড়ল ওর সব ভেস্তে যাবে।
দুই ঘন্টা ড্রাইভ করে হোটেলে এসে পৌঁছাল। এখানে এসে ও পায়েলের সন্ধান পেল না। হোটেলে কর্মকর্তা কে ধরে আয়ান কতক্ষণ মারল‌।

” স্যার ম্যাম তো গত পরশু মার্কেট গিয়েছিল তারপর আর ফিরে আসে নাই।”
” তোরা আমারে দুই দিন বাদে খবর দিলি ক্যান?”
” আপনার ভয়ে খবর দিতে সাহস পাই নাই‌।”
আয়ান রাগারাগী করে বেরিয়ে এল।

তৃষ্ণা আর জায়ান বসে আছে তৃষ্ণা ভাই ভাবির ছোট বাসায়। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু গলায় বলল,,” আমরা এখানে কেন এসেছি?”
জায়ান উত্তর দিল না। তৃষ্ণার ভাবি ওদের জন্য হালকা নাস্তা তৈরি করছে। তৃষ্ণা জায়ানের থেকে উত্তর না পেয়ে রাগ করে উঠে চলে গেল। জায়ান তৃষ্ণাকে যেতে দেখেই তৃষ্ণার ভাইয়ের সাথে কিছু জরুরী কথা বলতে লাগল।

” ভাবি কেমন আছ?”
” আছি কোনরকম। তোমার কি খবর?”
” ভালোই আছি।”
” বকুল কেমন আছে?”
তৃষ্ণা মুখটা গম্ভীর করে বলল,,” জানি না।”

” থাক মন খারাপ কর না। এমন কাজ বকুল করবে আমরা ও ভাবতে পারি নাই।”
তৃষ্ণা আর কথা বলার কিছু পেল না চুপ করে দাঁড়িয়ে র‌ইল।
ট্রে হাতে বের‌ হতেই তৃষ্ণা বলল,,” এই রুমে তালা কেন? তোমাদের বাসা তো এমনিতেই ছোট এই রুম বন্ধ করে রাখে কেন আবার।”

তৃষ্ণার ভাবি মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,,” ওই আসলে কিছু দরকার জিনিস পত্র রাখা হয়েছে তো তাই।”
” দুজনেই থাকো আবার তালার কি প্রয়োজন?”
তৃষ্ণা সন্দেহ চোখে তাকিয়ে ছিল রুমটার দিকে।
তৃষ্ণা, আর ওর ভাবি আসতেই দুজনে আবার থেমে গেল। তৃষ্ণা ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল ভাই ঘামছে। মুখটা শুকিয়ে আছে। কি নিয়ে কথা বলছিল দুজনের মুখের ভঙ্গি এমন হলো কেন?
জায়ান তৃষ্ণাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” তৃষ্ণা চলো বের হবো।”

” এখনি? একটু বসব না।?”
” অনেক তো বসলাম। এবার যাওয়া যাক।”
গাড়িতে উঠে তৃষ্ণা নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছে না। এদিকে জায়ান কে প্রশ্ন ও করতে পারছে না।
জায়ান তৃষ্ণার দিকে না তাকিয়ে বলল,,” এভাবে তাকিয়ে থাকলে ড্রাইভ করতে পারব না। আজ মনে হচ্ছে ড্রাইভার না নিয়ে এসে ভুল হয়েছে। ব‌উ এতো রোমান্টিক হয়েছে আগে বুঝি নি।”

তৃষ্ণা জায়ানের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে বলল,,” আপনি ভাইয়ের বাসায় কেন গেছিলেন?”
” ঘুরতে। নাকি তোমার ভাইয়ের বাসায় যেতেও পারব না।”
” আপনারা কিছু লুকাচ্ছেন আমার থেকে।”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৬

বলতে বলতে তৃষ্ণা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই রোডের কিনার দিয়ে কাউকে হেঁটে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল,,”গাড়ি থামান।”
আচমকা তৃষ্ণার চিৎকার শুনে জায়ান চমকে গাড়ি ব্রেক করে।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৭ (২)