কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৮

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৮
নন্দিনী নীলা

মালদ্বীপ এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখল জায়ান, তৃষ্ণা, আরিফ, ও উর্মি। প্রথমবার দেশের বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করল তৃষ্ণা। সময়গুলো অনেক বেশিই ভালো কেটেছে। নতুন সব কিছুর সাথে পরিচিত হয়েছে। নতুন এক জগত থেকে ঘুরে এসেছে।‌ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারছে না। বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু উপহার এনেছে তৃষ্ণা নিজে পছন্দ করে।

চারজন আলাদা হয়ে গেল এয়ারপোর্ট থেকে। দুটো গাড়িতে উঠে বসল নিজেদের থেকে বিদায় নিয়ে। তৃষ্ণা উত্তেজনায় এটা ওটা বলছে জায়ান কে।
জায়ান তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলল,,” তৃষ্ণা তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।”
তৃষ্ণা ভ্রু কুটি করে বলল,,” কি সারপ্রাইজ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” বাসায় গেলেই দেখতে পাবে।”
” শুনন না আমি না বকুলের জন্য উপহার আনছি। দেব কি করে?”
” কেন তোমার হাত নেই?”
” উফফ সেটা নয়। ওর উপর আমার অনেক রাগ। রাগ নিয়ে উপহার দিতে কেমন জানি লাগছে।”
” তাহলে রাগ ঝেড়ে ফেলে দাও। তাহলে আর কোন রকম লাগবে না।”
” এতো সহজে রাগ ফেলতে পারব না। সত্যি কথা না বলা পর্যন্ত আমার এই রাগ যাবে না।”
” তাহলে সত্যিটা শুনেই না হয় রাগ সরিয়ে নিও।”

” ও এমন চাপা স্বভাবের হতে পারে কোনদিন ভাবিনি। ও সব সময় পাতলা স্বভাবের ছিল জানেন। ও আগে কখনো কোন গোপন কথা আমার থেকে লুকিয়ে রাখতে পারত না।”
জায়ান তৃষ্ণার মলিন মুখটা ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,,” এই মাত্র না আনন্দিত ছিলে। নিমিষেই মলিন করে ফেললে মুখটা। এতো তাড়াতাড়ি মুড পরিবর্তন করো কিভাবে?”
তৃষ্ণা জায়ানের বক্ষস্থলে মাথা ঠেকিয়ে বলল,,”আমার বোনটা কবে আপনার ভাইয়ের হাত থেকে ছাড়া পাবে!”
জায়ান তৃষ্ণাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল,,” হয়ত পেয়ে গেছে।”
তৃষ্ণা ঝট করে মাথা তুলে অবাক চোখে তাকাল জায়ানের দিকে।

” কি বললেন?”
জায়ান অবুঝ স্বরে বলল,,” কি বললাম?”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে।
” শান্ত হয়ে থাকো। এতো জার্নি করেও কোন ক্লান্তি ভাব নাই এই ছোট মুখটায়। কিন্তু বিয়ের দিন গাড়িতে একটুতেই বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলে।”

তৃষ্ণা লজ্জায় কাঁচুমাচু মুখে তাকাল জায়ানের দিকে। জায়ান তৃষ্ণার লাজুক মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলল।
জায়ান তৃষ্ণার লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিতে বলল,,”কেমন আড়চোখে আমাকে গিলে খাচ্ছিলে মনে আছে? লজ্জা তো আমি তাকানোর চান্স ই পাই নি।”
তৃষ্ণা অবাক স্বরে বলল,,,” আপনি তখন লজ্জা পাচ্ছিলেন? ক‌ই দেখে তো মনে হচ্ছিল না।”
” আমার মুখ দেখে সব বুঝা যায় না।”
” এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। আপনি তো সব সময় রাগী, গম্ভীর মুখ করে থাকেন। আমি তো আগে ভাবতাম আপনি হাসতেই পারেন না।”

“এখন?”
” এখন তো মাঝে মাঝেই হাসেন। রগচটা গম্ভীর মানুষটার হাসিটা দারুন সুন্দর।”
জায়ান তৃষ্ণার কথা শুনে শব্দ করেই হেসে উঠল।
” প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর?”
” তার থেকেও বেশি।”
“আদর করার মতো?”
” ধ্যাত।”

নতুন পরিবেশে ঘুরে বেরিয়েছে ভালোই কেটেছে সময় গুলো। কিন্তু তবুও মনটা বাসার জন্য ছটফট করেছে। সবাইকে মিস করেছে। বাসায় এসে তৃষ্ণা একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এমনটা ফেলেছিল এই বাসা থেকে প্রথমবার ওদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে। তখন এখানে মানিয়ে নিতে পারত না। জায়ানের দিকে তাকিয়ে ভাবল,, তখন এই মানুষটা ভালবাসতো না। কিন্তু এখন সব কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। এই মানুষটাকে ও ভালবাসে।

এই বাসার প্রত্যেকটা মানুষকে ও ভালবাসে। বিদেশে গিয়ে ও সবাই অনেক মিস করেছে। সদর দরজা পেরিয়ে যেতে কোথা থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বকুল ওকে। বকুল কে দেখে তৃষ্ণা কিছুক্ষণ থমকে যায়। বকুল তৃষ্ণাকে ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,,” বুবু।”

তৃষ্ণা বিষ্ময় প্রকাশ করতে পারছে না। বকুল সেলোয়ার কামিজ পড়ে দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি।
” বুবু আমার তোমার লগে অনেক কথা আছে।”
তৃষ্ণা নিজের হতভম্ব দৃষ্টি সংযত করে বলল,,” তোর এই বেশ কেন?”
বকুল কিছু বলতে যাবে জায়ান বলে উঠে,,” এখন আমি তোমার বুবু দুজনেই ক্লান্ত বকুল। তোমার কথা কি পড়ে শুনলে চলবে?”

” চলবে দুলাভাই।” বকুল তৃষ্ণাকে ছেড়ে দাঁড়াল।
তৃষ্ণা এখনি সব শুনতে চায় কিন্তু জায়ান সেই সুযোগ দিল না। তৃষ্ণা কে টেনে উপরে নিয়ে এল। তৃষ্ণা জায়ানের দিকে শুধু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।

” আপনি আমাকে টেনে নিয়ে আসলেন কেন? আমি এখনি সব শুনতে চাই বকুল আমায় যা বলতে চায়।”
জায়ান তৃষ্ণার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল,” চুপ এতো জোর কোথা থেকে আসে হ্যা? তাড়াতাড়ি চলো আগে গোসল করবে, খাবে, ঘুমাবে দেন সব শুনবে। আমিও শুনব।”
তৃষ্ণা প্রতি উত্তর করতে চাইলে জায়ান তৃষ্ণাকে জোর করে এখনি গোসলের জন্য রাজি করায়। তৃষ্ণা জায়ানের সাথে জোরাজুরি করে পারে না।

” আপনি আমার সাথে আসছেন কেন?” তৃষ্ণা জায়ান কে বাথরুমে ঢুকতে দেখে বলল।
জায়ান বলল,,” আজ ব‌উয়ের সাথে গোসল‌ করব।”
” না না একদম না। আপনি বের হোন।”
” তৃষ্ণা আমি খুব ক্লান্ত ওয়েট করতে পারব না।”

তৃষ্ণা বলল,,” আচ্ছা তাহলে আপনি‌ আগে করেন আমি অপেক্ষা করি।”
বলেই তৃষ্ণা বেরিয়ে আসতে চাইল বাথরুম থেকে। জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে টেনে দরজা আটকে বলল,,”আমরা একসাথে শাওয়ার নেব।”

তৃষ্ণা জায়ানকে ঠেলে সরিয়ে উঠে বসল। ঘুমাবে না বলেও কখন ঘুমায় গেল। জায়ান খাবার খাইয়ে জোর করেই ওকে জাপ্টে ধরে শুয়ে ছিল। মনে ভেতর উশখুশ করছে সব জানতে। এদিকে ওর বর ওকে আটকে দিচ্ছে শুধু তৃষ্ণা ঘুমন্ত জায়ানের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে নেমে যাবে বিছানা থেকে জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে এক টাকে বুকের উপর ফেলে দেয় তৃষ্ণা চমকে উঠে।

” আপনি ঘুমান নি?”
” তুমি যে ভাবে ধাক্কা দিয়েছ এখনো ঘুম থাকে নাকি? আমার ঘুম নষ্ট করার জন্য তোমার আজকে আর উঠা হবে না।”
” এমন করবেন না। আমি শুনেই চলে আসব প্রমিজ।”
” নো।”
” দয়া করেন আমি এভাবে শান্তি পাচ্ছি না।”
অগত্যা জায়ান উঠে বসে।
” চলো রহস্য উন্মোচন করেই আসি!”

জায়ান আর তৃষ্ণা মালদ্বীপ যাওয়ার দু’দিন পর বাসায় পুলিশ আসে। পুলিশের সাথে আসে উষসীর ভাই।
সাদিকুর বাসায় ছিল না। আয়ান রুমে ছিল। পুলিশ আসার খবর পেতেই ও ভয়ে ঘামতে থাকে। জেসমিন চেঁচিয়ে ডাকছে আয়ান কে। কারণ পুলিশ আয়ান কেই খুঁজছে। আয়ান পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে চায় এদিকে পুলিশে সেই রাস্তা ও ঘেরাও করে ফেলেছে।‌

আয়ান চোরের মতো মুখ করে বলে,,” আমায় কোন প্রমাণের ভিত্তিতে আপনারা অ্যারেস্ট করতে আসছেন। একবার কিন্তু ছেড়ে দিতে হয়েছিল ভুলে যাবেন না। এবার আমাকে থানায় নেওয়ার চেষ্টা করলে আমি কিন্তু বাবাকে বলে আপনার চাকরি খেয়ে দেব।”
অফিসার কিছু বলল না তাচ্ছিল্য হাসি দিল।‌
উষসীর ভাই বলল,,” থানায় চল তোর প্রমাণ সেখানেই অপেক্ষা করছে।”

” মানে?”
পুলিশ অফিসার নিজের ফোন বের করে আয়ানকে পায়েল এর ছবি দেখিয়ে বলল,,” দেখুন তো এই মেয়েকে চেনেন নাকি?”
আয়ান চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না। তোতলানো গলায় বলল,,” না কে এই মেয়ে?”
ভয়ে ওর আত্না উড়ে যাবার অবস্থা। পায়েল পুলিশের কাছে গেল কি করে? তাহলে কি উষসীর ভাই এই কাজ করেছে?
পায়েল সন্ধান সেই বের করেছে?

ভয়ে আয়ান ঘামতে শুরু করেছে।
থানায় যাওয়া থেকে কেউ ওকে আটকাতে পারল না। আর জেসমিন ছাড়া আটকানোর কেউ ছিল ও না। বকুল সবটা অবাক নয়নে দেখছিল। আয়ান কে নিয়ে যাওয়ার পর‌ই জোভান ওকে নিয়ে নিজের রুমে আসে আর ওর গায়ে থেকে সাউন্ড ক্যামেরা খুলে ফেলে দেয়।
বকুল বিস্ফোরণ চোখে তাকিয়ে বলল,,” এই যন্ত্র আমার গায়ে আছে আপনি জানলেন কি করে?”

“জায়ান ভাইয়া বলেছে।”
” দুলাভাই জানল কি করে?”
” ভাইয়ার পক্ষে কোন কিছু জানা অসম্ভব নয়।”
” আয়ান কে পুলিশ কেন ধরে নিয়ে গেল?”
জোভান শক্ত গলায় বলল,,” হাজব্যান্ড কে পুলিশ নিয়ে গেল দেখে কি কষ্ট লাগছে?”
বকুল মাথা নিচু করে ফেলল।
অসহায় গলায় বলল,,” ওই যন্ত্র তো ফেলে দিলেন এখন কি আয়ান আর কিছু জানতে পারবে না?”

“না।”
বকুলের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।
” সত্যি?”
” হ্যা।”
বকুল আনন্দের চুটে জোভান কে জড়িয়ে ধরল।
বকুল নিজে থেকেই সরে বলল,,” আমাদের বিয়ে হয়নি।”
জোভান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,”জানি।”
বকুল চোখ কপালে তুলে বলল,,” কিভাবে?”

” জায়ান ভাই বলেছে।”
” দুলাভাই এটাও জানত?”
” হ্যা।”
” আপনি সব জেনেও আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছেন? আমি তো নিরুপায় ছিলাম।”
জোভান বলল,,” আমি দুইদিন আগে জানতে পেরেছি। ভাইয়া বাসায় থাকবে না তাই আমাকে সবটা জানিয়েছে। আর ভাইয়া জানত আমি তোমাকে ভালবাসি তাই.

” দুলাভাই সব জেনেও নিশ্চুপ কেন ছিল?”
” জানিনা।”
” আজ কেন আয়ান কে পুলিশ নিয়ে গেল?”
” উষসী ভাবিকে খুন করেছে।”
বকুল মুখে হাত দিয়ে বলল,,” হায় আল্লাহ।”
জোভান বকুলের মুখটা দুহাতে ধরে বলল,,” তুমি আমার আছো এতেই আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কমেছে। এই কয়টা দিন আমার যে কি অবস্থায় কেটেছে।”

বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলল,,” মানুষ কতটা নিকৃষ্টতম হয় আপনার ভাইকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। দুলাভাই কে দুই চোখে দেখতে পারে না। সব সময় তার মৃত্যু কামনা করে। আর তীব্র হিংসা করে। দুজন যমজ ভাই হয়ে এতোটা বিদ্বেষ ভাবাই যায় না।”
” তোমাকে ব‌উ কেন সাজালো কি উদ্দেশ্য ছিল ওর?” জানার আগ্রহ প্রকাশ করে বলল জোভান।
বকুল ডুকরে কেঁদে উঠল। জোভান ওর চোখে অশ্রু মুছে কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল,,” কেঁদো না। বলো আমার সব।”
বকুল কল্পনায় চলে গেল….

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৭ (২)

সেদিন সেই অন্ধকার ঘরে ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজেও ঢুকে দরজা আটকে দেয় আয়ান। বকুল ভয়ে জড়সড় হয়ে ফ্লোরে বসে ছিল। হঠাৎ আয়ানের ফোনের ফ্লাশ জ্বলতেই চমকে উঠে।
আয়ান ওর পাশে বসে বলল,,” কিরে ভয় লাগছে?”
বকুল ভয়ে কান্না করে দেয়।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৩৯