কৃষ্ণবেণী পর্ব ৪২

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৪২
নন্দিনী নীলা

জায়ানের জোরাজুরি এখন তৃষ্ণার কাছে রাগ লাগছে। লোকটা এমন কেন? সে বিছানায় পরে আছে অসুস্থ শরীর নিয়ে। আর ও এই অবস্থায় স্বামী ফেলে নাকি স্কুলে যাবে পড়তে। জায়ানের এক কথা আজকেই যেতে হবে কোন নড়চড় নয়। দুইদিন হলো ও ফিরে এসেছে জায়ানের কোন উন্নতি হয়নি। উল্টো তার শরীরে জ্বর বাড়ছে। ব্যথায় শরীর থেকে জ্বর সরছেই না। জায়ান নাকি ওকে ভর্তি ও করিয়েও ফেলেছে। কি অবস্থা!

রাগ লাগছে ওর। লেখাপড়া টা এখন ওর কাছে মস্ত বড়ো বিপদ লাগছে। জায়ান একাই ওকে স্কুলে ভর্তি করে ফেলেছে। ওর এখন শুধু ক্লাসে যেতে হবে। কয়েকদিন পর নাইনের ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা। সেটাতে অংশগ্রহণ করে ওকে টেনে উঠতে হবে। রাগ, বিরক্ত নিয়ে তৃষ্ণা বোরকা- হিজাব পরে রেডি হয়ে নিল। ওর নাকের পাটা ফুলে আছে। ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। জায়ান খাটে থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার রাগী ব‌উয়ের দিকে। তৃষ্ণার রাগী চাহনি, দেখে ও মিটিমিটি হাসছে। তৃষ্ণা উঠে দাঁড়িয়ে জায়ানের দিকে তাকাতেই ওর রাগ আরো বেড়ে আসমানে উঠে গেল। রাগে ফুঁস করে উঠল। জায়ানের মুখের হাসি ওর কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো লাগছে। অসহ্য লাগছে ওর জায়ান কে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জোভান দরজায় টোকা দিয়ে বলল,,” ভাবি হয়েছে তোমার?”
জায়ান উত্তর দিল,,” তুই নিচে যা। ও আসছে।”
জোভান নিচে চলে গেল। তৃষ্ণার সাথে স্কুলে যাবে জোভান। তৃষ্ণা পার্স হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
জায়ান রিমোট দিয়ে দরজা আটকে দিল। তৃষ্ণা রাগান্বিত গলায় তাকাল জায়ানের পানে।
” এদিকে আসো।” আদেশ গলায় বলল জায়ান।

তৃষ্ণা ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে এল। দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বলল,,” বলেন।”
” এতো রাগ?” জায়ান তৃষ্ণার হাত ধরে টেনে পাশে বসালো। তৃষ্ণা রাগ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। জায়ান টোপ করেই তৃষ্ণার নাকের ডগায় কামড়ে ধরল। তৃষ্ণা চোখ গোল গোল করে তাকাল জায়ানের চোখের দিকে। মুখটা বিষ্ময় এ কিশ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেছে। জায়ান তৃষ্ণার হা করা অধর দুটিতে গভীর ভাবে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,,” সাবধানে যাবে। আর একদম আমার সামনে নাক ফুলিয়ে রাখবে না।”

” এটা কি করলেন?” নাকের ডগায় আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান কামড় দেওয়া স্থানে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে চুমু দিল।
জোভানের সাথে গাড়িতে বসে আছে তৃষ্ণা। রাস্তার সব লেখা পরীক্ষা প্রশ্নের মতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে জোভান কে। দশ মিনিটের রাস্তা মাত্র। খুব তাড়াতাড়িই ওরা স্কুলে চলে‌ এল।
গাড়ি থেকে নেমে তৃষ্ণা বলল,,” এইটুকু রাস্তা তো আমি হেঁটেই আসতে পারব।”

জোভান বলল,,” ভাইয়া কয়দিন পর এমপি হবে। আর তার একমাত্র ওয়াইফ নাকি হেঁটে স্কুল এ আসবে কি যে বলো না ভাবি। কাছে হোক তোমায় গাড়ি করেই আসতে হবে। আর তাছাড়া জানো তো ভাইয়ার কত শত্রু আছে। তাই তোমায় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। এতো দিন ঘরের ভেতরে ছিলে বিপদের সম্মুখীন হ‌ওনি। কিন্তু এখন তোমায় বের হতে হবে।”

তৃষ্ণাকে নিয়ে অফিস রুমে আসলো জোভান। তৃষ্ণার সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তৃষ্ণা কে ক্লাসে পাঠালো। তৃষ্ণার সব ব‌ই বাসায় আছে। কিন্তু আজ কিছুই নিয়ে আসে নাই। ও শুধু ক্লাস চিনলো আর সবার সাথে স্যার’রা পরিচয় করিয়ে দিল ও নতুন স্টুডেন্ট বলে। আধা ঘন্টার মধ্যে ওদের কাজ শেষ হয়ে গেল। তৃষ্ণা এক কালারের স্কুল ড্রেস পরা একাধিক মেয়েদের দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। স্কুলের বাতাস ও ওর কাছে এতো সিগ্ধ লাগছিল মনটা নেচে নেচে উঠছিল।
জায়ান তৃষ্ণার নাম্বারে কল করল। তৃষ্ণা তখন মাঠের মাঝখানে দাড়িয়ে ছিল। ওকে দাড় করিয়ে রেখে জোভান অফিস রুমে গেছে আবার। তৃষ্ণার ফোনে রিংটোন বাজতেই ও তাকিয়ে দেখল হাজব্যান্ড লেখা। জায়ানের নাম্বার ও হাজবেন্ড দিয়ে সেভ করেছে।

” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম!”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি করছো?”
” মাঠে দাঁড়িয়ে আছি।”
” স্কুল পছন্দ হয়েছে।”
” হ্যা খুব।”
” আসবে কখন?”
” কখনি আসব।”

কথা শেষ করে কল কেটে দিল জায়ান। তৃষ্ণা দেখতে পেল অনেক ছেলে মেয়েরাই মাঠের এদিকে ওদিকে হাঁটছে। সবাই ফিরে ফিরে ওর দিকে তাকাচ্ছে। ওর অস্বস্তি হচ্ছিল। জোভান আসতেই স্বস্তি পায়।
” ভাবি চলো।”
” তুমি কোথায় গেছিলে?”
” তোমার পরীক্ষা ডেট জানতে।”
” কবে পরীক্ষা?”
” সামনে মাসের ১৪ তারিখ।”
” পরীক্ষা তো চলেই আসছে।”
” হুম।‌বাসায় গিয়ে ব‌ই নিয়ে বসবে। আর স্কুলে এসে আগামীকাল নোট নিয়ে যেও‌।”
” আচ্ছা।”

জোভান তৃষ্ণা কে জিজ্ঞেস করল স্কুলটা ঘুরে দেখবে নাকি। তৃষ্ণা রাজি হলো। জোভান তৃষ্ণা কে নিয়ে স্কুলটা ঘুরে দেখল। আরো মিনিট কুড়ি কাটিয়ে ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আসার সময় যতটা মন খারাপ নিয়ে এসেছিল যাওয়ার সময় ততটাই প্রফুল্ল হয়ে বাসায় ফিরে এল। তৃষ্ণা বাসায় এসেই লিয়ার থেকে জানতে পারল জায়ান নাকি কফি চেয়েছিল। লিয়া মাছ কাটায় ব্যস্ত ছিল শেফালী নাকি কফি করে নিয়ে গেছে। তৃষ্ণা বলল,,” তোমাকে বলেছিলাম ওই মেয়েকে উনার কাছে যেতে দিও না।”

” আমি মানা করেছিলাম কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না। কফি চেয়েছে জানা মাত্র‌ই চলে গেল কফি হাতে।”
তৃষ্ণা রাগ মাথায় নিয়ে দ্রুত পায়ে উপরে এল।শেফালী তখন রুমে নাই ও জায়ান কে বিছানায় একা পেয়ে স্বস্তি পায়।
ট্রি টেবিলের ওপর কফির কোন মগ দেখে না। ও কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজ করে। শেফালী কফি নিয়ে উপরে এলে সেই কফি ক‌ই।
জায়ান ল্যাপটপ এ কিছু করছিল তৃষ্ণা কে দেখে ল্যাপটপ রেখে বলল,,” কি‌ হয়েছে?”
তৃষ্ণা থতমত গলায় বলল,,” আপনাকে কফি দিতে আসছিল শেফালী?”

” হ্যা আসছিল। কেন?”
” কফি ক‌ই?”
” ফেরত পাঠিয়েছি। মেয়েটার হাবভাব অপছন্দ আমার। তাই বারণ করে দিছি। চলে গেছে। কি হয়েছে তাতে?” অবাক গলায় বলল জায়ান।

” কিছু না।” বলেই তৃষ্ণা কথা ঘুরিয়ে স্কুলের কথা বলতে লাগল। জায়ান ও আর এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না।
তৃষ্ণার এখন সম্পূর্ণ সময়টা পড়ালেখার মাঝে চলছে। ওদের একবছরের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে কেক কাটা হয়েছে। জায়ান খুব আফসোস করেছে নিজে অসুস্থ হয়ে কোন আয়োজন করতে পারল না। অনলাইনে অর্ডার করে তৃষ্ণাকে একটা নেকলেস সেট উপহার দিয়েছে। অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিল জায়ানের কিন্তু আটকে দিল ভাঙা পা। তৃষ্ণা বলেছে,” এতো টেনশন করছেন কেন? সামনের বছর না হয় আয়োজন করবেন। এসব নিয়ে মন খারাপ করবেন না।”

জায়ান আর কি করবে তাই মানতেই হয়েছে।
তৃষ্ণা স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত। ড্রাইভার গাড়ি করে প্রতিদিন দিয়ে আসে আবার নিয়ে আসে। জায়ানের ট্রিটমেন্ট চলছে। ও লাঠি ভর করে হাঁটার ট্রাই করে। কিন্তু এখনো পা ফেলতে পারে না। এক পা দিয়ে তো আর হাঁটা সম্ভব নয়। তৃষ্ণার পরীক্ষা আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়। জায়ান বসে থাকে তৃষ্ণার সাথে।
রাত তখন প্রায় বারোটার উপরে বাজে। তৃষ্ণা জায়ানের নগ্ন বুকে আঁকিবুঁকি করছে। জায়ান তৃষ্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

” একটা কথা বলবেন সত্যি করে?”
জায়ান তৃষ্ণার কথার কপাল কুঁচকে বলল,,” কি কথা?”
তৃষ্ণা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,,” আপনার কোন গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
জায়ান তৃষ্ণার কথায় অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল।
” কয়দিন হলো স্কুলে যাচ্ছ! এখনি সন্দেহ ঢুকছে মনে?”

তৃষ্ণা অসহায় মুখে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। ও জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও করেই ফেলেছে। স্কুলে গিয়েই ওর অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে। এমপির ছেলের ব‌উ আবার। জায়ান ভবিষ্যৎ এমপি এজন্য স্কুলে তার ভালোই নামডাক হয়েছে। সবাই তো যেচে এসে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। ওদের ক্লাসের ছেলে নাই। ছেলে মেয়েদের আলাদা ক্লাস। ওর ফ্রেন্ড রাই ওকে শিখিয়ে দিয়েছে জায়ান কে এসব জিজ্ঞেস করতে।

” না মানে এমনি জানতে চাইছিলাম।” মুখ নিচু করে বলল তৃষ্ণা।
জায়ান তৃষ্ণার কাঁধের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে গলায় মুখ ঠেকিয়ে অধর স্পর্শ করতে লাগে। তৃষ্ণা জায়ানের চুল খামচে ধরে কাঁপতে লাগে। আচমকাই কামড়ে ধরে তৃষ্ণা মৃদু চিৎকার করে উঠে। জায়ান মাথা উঁচু করে তৃষ্ণার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,,” ওই সব ফ্রেন্ডদের সাথে মিশবে না। যারা আমাকে নিয়ে সন্দেহ ঢোকায় তোমার ফ্রেশ মাথায়। বুঝেছ।”
তৃষ্ণা থমকানো মুখে তাকিয়ে আছে। মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলল।

” গুড গার্ল। এই বোকা সোকা মেয়েটাই আমার পছন্দের। যত স্মার্ট, চালাক, চতুর হ‌ও সেটা বাইরের মানুষের জন্য ওকে। আমার এই বোকা তৃষ্ণাই চাই সারাজীবন।”
তৃষ্ণা ফ্যালফ্যাল করে ড্রিম লাল লাইটের আলোয় তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। জায়ান তৃষ্ণাকে আরো গভীর ভাবে কাছে টেনে নিল। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা সব ভুলে জায়ানের ভালবাসার নিজেকে সঁপে দিতে লাগল। তৃষ্ণা অসাবধানতায় জায়ানের পায়ে আঘাত দিয়ে বসল।

জায়ান আর্তনাদ করে সরে গেল তৃষ্ণার উপর থেকে। তৃষ্ণা লাফ দিয়ে উঠে বসল।‌ ভয়ে ওর হৃদপিন্ড কেঁপে উঠল যেন। জায়ানের পায়ের কাছে এসে বসল। অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছে না কি হয়েছে। তৃষ্ণা সরি বলতে বলতে কান্নায় করে দিল। কিভাবে যে লাথি মেরেছে।ও নিজেই খেয়াল‌ করেনি। তৃষ্ণা শাড়ি নিয়ে গায়ে জড়িয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিল। রুমটা মুহূর্তে আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।

তৃষ্ণা জায়ানের পায়ের কাছে বসে দেখল রক্ত বের হচ্ছে। ভয়ে ও ঘামতে লাগল। জায়ান একাই উঠে বসেছে। এগারো দিন হয়ে গেল এখনো পায়ের কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। রক্ত দেখে তৃষ্ণা কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলল পরিবেশ। জায়ান একেতে ব্যথায় কুলাতে পারছে না তার মধ্যে তৃষ্ণার কান্নায় ও বিরক্তে চ উচ্চারণ করল। ও গাঢ় গম্ভীর গলায় ফাস্ট এইড বক্স চাইল। তৃষ্ণা দৌড়ে ড্রয়ার খুলে এনে দিল। জায়ান নিজেই পুরাতন ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে নতুন ব্যান্ডেজ করল।
” আমার জন্য কি হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে আপনাকে আঘাত দেই নি।”

” একেক সময় তোমার এই ছেলেমানুষি গুলো আমার বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। প্লিজ তৃষ্ণা স্টপ দেয়ার।”
তৃষ্ণা থামল না মুখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জায়ান কাজ শেষ করে বলল,,” দয়া করে কান্নাকাটি অফ করে বিছানায় আসো। লাইট বন্ধ করে। মাথা ধরিয়ে দিলে। ঘুমাতে দাও।”

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৪১

জায়ান বিছানায় শুয়ে পরল। তৃষ্ণা সব সরিয়ে রেখে লাইট অফ করে জায়ানের থেকে দূরত্ব রেখে গুটিগুটি মেরে শুয়ে পরল। অপরাধ বোধে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।

কৃষ্ণবেণী পর্ব ৪৩