গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১১

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১১
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

হসপিটালের ও’টি রুমে মৃ”ত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ফারদিন। ডাক্তার’রা প্রানপন চেষ্টা করছে ও’কে বাঁচানোর। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য ওর বাঁচার চান্স অনেক কম। ব্লাড ব্যাংক গুলোতে র’ক্তের খোঁজ চলছে। কিন্তু, কিছু’তেই ও’নেগেটিভ(O-) র’ক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ফারদিনের অবস্থা প্রতি মুহূর্তে খারাপ থেকে ভালো হচ্ছেনা। হসপিটালের কড়িডোরে সায়মা খানম পা’গ’লের মতো বিলাপ করছেন। তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। স্বামী,সন্তান হারিয়ে ফারদিন’কে আকড়ে ধরে বেঁচে ছিলো এত বছর। আজ প্রানের টুকরো নাতির এমন অবস্থা কিছু’তেই সহ্য করতে পারছেন না তিনি। ও’টি রুমের পাশের দেয়াল ঘেষে নিজেকে হাটুর ভাঁজে গুটিয়ে বসে আছে ফাইজা। ওর মুখ’টা অশ্রুসিক্ত। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে বার বার ফারদিনের রক্তাক্ত মুখ’টা ভেসে উঠছে। কি ভয়ংকর সে দৃশ্য। বুক’টা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এ এক বিষাদময় যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনা কাকে বুঝাবে ও? কে বুঝবে এই কষ্ট? যে এই কষ্ট বুঝবে সে তো নিজেই মৃ’ত্যুর দুয়ারে।

ফাইজা কলেজ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় অনেক ভীড় দেখে কৌতুহল বশত এগিয়ে গেলো সেখানে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই ওর পা দুটো সহ শরীর অবশ হয়ে গেলো। সামনে র’ক্তা’ক্ত ফারদিন রাস্তায় পড়ে আছে। লোকজন বলা-বলি করছিলো “ছেলেটা বেঁচে নেই”। চারপাশে মানুষজন থাকতেও যেনো কানের মধ্যে কোনো শব্দ আসচ্ছিলো না ওর। ফাইজা হাটু ভেঙে বসে ফারদিনের গালে হাত দিতেই ওর হাত দুটো র’ক্তে লাল হয়ে গেলো। ফাইজার চোখ থেকে পানি পড়ছে কিন্তু ও কাদছে না। কেমন যেনো পাথরের মতো সব’টা দেখছে। ফারদিনের গাঁয়ে সাদা শার্ট’টা র’ক্তে লাল শার্টে পরিনত হয়েছে। ফারদিনের দিকে এক দৃষ্টি’তে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে থেকে হঠাৎ করে মুখ ফুটে বললো…..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—উনা’কে একটু কেউ হসপিটালের নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন প্লিজ…….
আশেপাশের থেকে কয়েকজন বললো…
–উনাকে নিয়া যাইয়া কোনো লাভ হইতো না। উনি ম/ইরা গেছে….
কথা’টা শুনে ফাইজা কানে হাত দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো……
–একটাও বাজে কথা বলবেন না আপনারা। উনি বেঁচে আছেন। আপনাদের কাছে হাত জোর করে বলছি প্লিজ একটু সাহায্য করুন আমাকে প্লিজ…..

কথাগুলো বলতে ফাইজার গলা আটকে আসচ্ছিলো। ও কি বলছে কি করছে নিজেও জানেনা। মনে হচ্ছে ও নিজের মধ্যে নেই। এই মুহূর্তে সব ভুলে শুধু একটাই কথা মাথায় ঘুরছে। যে করে হোক ফারদিন’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে? ফারদিনের কিছু হলে ও বাঁচবে কি করে? ফাইজা যখন সবাই’কে অনুরোধ করছিলো তখনি পেছন থেকে কেউ একজন নানুভাই বলে চিৎকার করে উঠলো। আকস্মিক চিৎকারে ফাইজা পেছনে ফিরতেই একজন বয়স্ক মহিলা’কে দেখতে পেলো। মহিলা’টিকে ফাইজা চিনতে পারলো না শুধু এইটুকু বুঝতে পারলো মহিলা’টি নিশ্চয়ই ফারদিনের কেউ হবে।

মহিলা’টি এক প্রকার দৌড়ে এসে ফারদিনের সামনে বসে পড়ে ফারদিনের মাথা’টা কোলে তুলে নিয়ে পা’গলের মতো কাঁদতে শুরু করলো। মহিলা’টির সাথে থাকা ড্রাইভার সহ কয়েকজন মিলে ফারদিন’কে গাড়ি’তে উঠালো। ফাইজা পাথরের মতো দাড়িয়ে সব’টা দেখলো। ফারদিন’কে গাড়ি’তে উঠিয়ে মহিলা’টি হঠাৎ এসে ফাইজার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে বসালো। ফাইজা অশ্রসিক্ত নয়নে সব’টা দেখছে কিন্তু রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে এতক্ষনে। এত বড় একটা ধাক্কা যে ফাইজা সামলাতে পারছেনা তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে। মেয়ে’টা এই কয়েক মিনিটে পা’গ’লের ন্যায় হয়ে গেছে। ফাইজা আলতো হাতে ফারদিনের মাথা’টা কোলে তুলে নিয়ে নিজের গায়ের সাদা ওড়না’টা শক্ত করে বেঁধে দিলো ফারদিনের মাথায়।

মহিলা’টি কাপড়ের আঁচল দিয়ে ফারদিনের কাঁধের সামনের ক্ষ’ত স্থান’টি চে’পে ধরে একাধারে কেঁদে যাচ্ছে। হসপিটালে আসা অব্দি ফাইজা এক নজরে ফারদিনের র’ক্তা’ক্ত চেহার’টার দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। ওর চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে ফারদিনের মুখের উপর পড়ছিলো। হসপিটালে আসতেই ডাক্তা’রা সবাই হুড়মুড়িয়ে আসলো চারদিক থেকে কারন গাড়ি’তে থাকা অবস্থা ভদ্র মহিলা’টি ফোন করেছিলো। তার কথায় ফাইজা’ বুঝতে পেরেছিলো মহিলা’টি হসপিটালেই ফোন করেছে সব রেডি রাখার জন্য। ফারদিন’কে দেখেই ডাক্তার’রা চিন্তিত দৃষ্টি’তে একেক’জনের দিকে তাঁকাচ্ছিলো। ইশারা করে বলছিলো অবস্থা ভালো নয়। তাড়াতাড়ি ও’টির ব্যবস্থা করে ফারদিন’কে ও’টি’তে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই থেকে সায়মা খান’ম কড়িডোরের চেয়ারে বসে কেঁদে চলছে। ফাইজা ফারদিনের সাথে সাথে ও’টির দরজা অব্দি এসে র’ক্তা’ক্ত ওড়না’টা বুকে চে’পে ধরে দেয়াল ঘে’ষে বসে পড়লো।

ফাই’জার কানের মধ্যে বার বার ফারদিনের একেক’টা কথা বাজচ্ছে। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই পরিচিত এক মুখের রক্তাক্ত দৃশ্য। আর সহ্য করতে পারছে না ও। দম আটকে যাচ্ছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড়ে সব উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ফাইজা’ আর সহ্য করতে না পে’রে এতক্ষন পর হাত দিয়ে জোরে চিৎকার করে পা’গলের মতো কেঁদে উঠলো। ওর কান্না হসপিটালের প্রতিটি দেয়ালে বা’রি খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। হসপিটালে উপস্থিত সবাই দূর থেকে অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করে আছে ফাইজার দিকে। ফাইজা’র সাদা ড্রেস’টা র’ক্তে লাল হয়ে আছে। হাটু’তে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদছে। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেতেই অশ্রুসিক্ত চোখে উপরে তাঁকাতেই সায়মা খানম’কে দেখতে পেলো। সায়মা খানমের চোখেও পানি। সে ফাইজার সামনে বসতেই ফাইজা কিছু না ভেবে’ই তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। সায়মা খানম’ ফাইজার মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…..

–আমার নাতি’টা যে তোমাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে। তোমাকে হারানোর ভয়ে পা’গ’লের মতো আচরণ করতে দেখেছি ও’কে। যেই ছেলে’টা মেয়েদের নাম অব্দি সহ্য করতে পারতো না। সেই ছেলে’টা তোমাকে পেয়ে এত বড় বিজনেস ছেড়ে কলেজে জয়েন হলো শুধু মাত্র তোমার জন্য। দূর থেকে আগলে রাখতো পরম যত্নে। তুমি যখন সবে ষোল বয়সী এক যুবতী তখন আমার পা’গ’লটা তোমাকে প্রথম দেখেছিলো। প্রথম দিন তোমাকে দেখেই ছেলে’টা অদ্ভুত আচরণ করছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম এই ছেলের মনে ভালোবাসা নামক সুন্দর অনুভূতি জন্ম দিতে কেউ এসেছে। প্রতিদিন তোমাকে দূর থেকে লুঁকিয়ে দেখতো৷ তুমি ওর লাইফে আসার পর থেকে ছেলে’টার মুখে সব সময় এক’টা সুন্দর হাসি লেগে থাকতো।

ছেলে’টা যে হাসতে ভুলে গিয়েছিলো নিজের মা’কে হারিয়ে। তোমাকে হারিয়ে ফেলবে বলে তোমার বাবা-মা কে গিয়ে সোজা সুজি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। আমার নাতি’টা যে কাউকে এত’টা ভালোবেসে ফেলবে আমি নিজেও জানিনা। আমার নাতি’কে তোমার বাবা খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলো কারন তুমি এখনো ছোট ছিলে বলে। সেদিন বাড়ি’তে এসে নিজে’কে পা’গলের মতো আ’ঘাত করেছিলো। বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি সহ্য করতে পারিনি ওর কষ্ট’টা। তোমার বিষয় সব’টাই আমার সাথে শেয়ার করতো। পরের দিন আমি নিজে তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে তাদের হাজার অনুরোধ করে রাজি করেছিলাম। কিন্তু তোমার বাবার একটা শর্ত ছিলো। তোমার বয়স আঠারো না হওয়া অব্দি ফারদিন যেনো তোমার ধারে কাছেও না ঘেষে। পা’গল ছেলে’টা তাতেই রাজী হয়ে গিয়েছিলো। তোমার অজান্তেই তুমি আমার ফারদিনের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠো। ছেলে’টা তোমাকে পেয়ে যখন ভয়ংকর অতীত ভুলতে বসেছিলো। ঠিক তখনি ছেলে’টার ভয়ংকর অতীত আবার ফিরে আসে। আর তখন…….

আর বলতে পারলো না। ও’টি রুমের লাইট’টা নিভে যেতেই তার চোখ সেদিকে গেলো। ফাইজা’কে ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো। এতক্ষনে ফাইজা’র কান্না ও থেমে গিয়েছিলো। মন দিয়ে তার কথাগুলো শুনছিলো। হঠাৎ থেমে সেতে দেখে ফাইজা ও তার সাথে সাথে উঠে দাড়ালো। ও’টি রুম থেকে একজন ডাক্তার বেড়িয়ে আসতেই ফাইজা আর সায়মা খানম দুজনেই সেদিকে এগিয়ে গেলো৷ ওরা দুজন কোনো প্রশ্ন না করে ডাক্তারের দিকে চেয়ে আছে। ডাক্তার চিন্তিত ভঙ্গী’তে বলে উঠলো…..
–ও নেগেটিভ (O-) র’ক্তের জোগাড় করার যাচ্ছেনা কিছু’তেই। এক ঘন্টার মধ্যে ও নেগেটিভ( O-) রক্তের জোগাড় না হলে ফারদিন’কে বাঁচানো সম্ভব না দিদা…….

কাকন সিকদারের নিজের রুমে পায়চারি করছে। তার পাশেই বসে আছে রেজওয়ান। কাকন’কে পায়চারি করতে দেখে সে এক’টা গ্লাসে ড্রিংকস ঢালতে ঢালতে বললো…..
–আহঃ কাকন এত টেনশন কেনো করছো? যেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে ওর সেখান থেকে বেঁচে ফিরা ইম্পসিবল। সো, নো টেনশন লেট’স ইনজয়…..
রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন এক প্রকার রেগে বললো……
–তোমার লজ্জা করেনা বাবা হয়ে ছেলে’কে মে/রে ইনজয় করছো?
কাকনের কথা শুনে রেজওয়ানের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। কাকন আবারো বলে উঠলো…..
–ফারদিন যদি বেঁচে যায় তাহলে আমরা বাঁচতে পারবো না ভুলে যাচ্ছো কথা’টা…….

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১০

[আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষ মা করবেন। একটু অগোছালো হয়েছে আজ প্লিজ মানিয়ে নিবেন]

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১২