গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১২

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১২
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

হসপিটালের সবার সামনে আচমকা ফাইজা’র গালে থা’প্প’ড় পড়তেই ফাইজা ছিটকে পড়ে যেতে নিলে নীরব ছুঁ মে/রে ধরে ফেললো। হঠাৎ, ঘটনা’টা ঘটে যাওয়ায় উপস্থিত সবাই অনেক’টা অবাক হয়ে আছে। ফাইজা এখনো বুঝতে উঠতে পারলো না থা’প্প’ড়’টা ও’কে কে মা/র/লো? নীরব ফাইজা’কে দাড় করিয়ে বললো…..

–ঠিক আছো তুমি?
ফাইজা ছলছল চোখ মাথা নাড়ালো। সায়মা খানম রেগে সামনে তাঁকাতে’ই রেজওয়ান’কে দেখে আরো রেগে গেলো। রেজওয়ান সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ফাইজা’র সামনে এসে ফাইজা’র গালে আরেক’টা থা’প্প’ড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নিরব ধরে ফেললো। রেজওয়ানের দিকে রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে বললো……

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—ফারদিন আজ ও’টি রুম’টায় আছে বলে আপনি এত বড় একটা স্পর্ধা দেখাতে পারলেন আংকেল? নয়তো, ওর ভালোবাসার গায়ে হাত তোলার অপরাধে দেখা গেলো আপনার হাত’টাই আর রইলো না……
বলেই রেজওয়ানের হাত’টা ছিটকে ফেলে দিলো। ফাইজা ভয়ে চোখ মুখ খিচে আছে। নিরবের কন্ঠ স্বর শুনতেই চোখ মেলে দেখলো নিরব আর রেজওয়ান দুজন দুজনের দিকে রাগী দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে আছে। সায়মা খানম তাড়াতাড়ি এসে ফাইজা’কে জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো……

–তোমার সাহস দেখে আমি অবাক রেজওয়ান। কোন সাহসে তুমি ওর গায়ে হাত তুললে? কে দিয়েছে তোমাকে এই সাহস?
সায়মা খানমে’র কথা শুনে রেজওয়ান কান্নার ভঙ্গী’তে বলে উঠলো……
–মা আপ……
রেজওয়ানের কথা শেষ না হতেই সায়মা খানম পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন চেঁচিয়ে বললো……
—খবরদার তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে না? তোমার ওই পাপী মুখে মা ডেকে মা শব্দ’টাকে অপবিত্র করো না প্লিজ…….

সায়মা খানমের কথা শুনে রেজওয়ানের মুখ’টা থমথমে হয়ে গেলো। সে পূর্বের মতো কান্না মাখা আদুরে গলায় বলতে লাগলো…….
—আপনি জানেন না এই মেয়ে’টার জন্য আমার ছেলে’টার আজ এই অবস্থা। এই মেয়ে’টাকে আমি কিছুতেই ছেড়ে দিব না।
বলেই ফাইজা’র দিকে রেগে এগিয়ে যেতেই নিরব রেজওয়ানের বুকে হাত দিয়ে থামিয়ে বললো……
–আপনি আমার বাবার বয়সী বলে এতক্ষনে নিজের হাত-মুখ দুটো’ই সামলে রেখেছিলাম। ডোন্ট ক্রোস ইউর লিমিট আংকেল। তাহলে, আপনার গায়ে হাত তুলতেও একবার ভাববো না।

রেজওয়ান রেগে নিরবের এপ্রোন দুই হাতে শক্ত করে ধরে বললো….
–তোমার সাহস তো কম না। তুমি এই রেজওয়ান’কে থ্রেট করছো।
নিরব হালকা হেসে রেজওয়ানের হাত দুটো ধরে জবাব দিলো…..
–জানেন তো বেস্ট ফ্রেন্ড মানে ভাইয়ের চেয়ে কম না। ফারদিনের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে না ওর ভাই হয়ে ওর আমানত’কে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।

বলেই রেজওয়ানের হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ফাইজা ছলছল চোখে সব দেখছে। কি হচ্ছে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছেনা। সায়মা খানম এত ক্ষন চুপ থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ফাইজা’কে ছেড়ে রেজওয়ানের সামনে এসে রেজওয়ানের গালে ঠা’স করে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিয়ে জোরে বললো…..
—ছেলের জন্য দরদ উথলে পড়ছে তাইনা। এত বছর কোথায় ছিলো এই দরদ? সাত বছরের বাচ্চা’টাকে একা রুমে বন্দী করে যখন প্রেমিকা’কে নিয়ে চলে গিয়েছিলে তখন কোথায় ছিলো এই দরদ? এটা হসপিটাল আমার মুখ’ খুলিও না রেজওয়ান এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যাও? নয়তো……

আর বলতে পারলো না তার আগেই রেজওয়ান অপমানিত থমথমে মুখ নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কয়েক-পা সামনে এগিয়ে ফাইজার দিকে এক ভয়ংকর চাহনী নিক্ষেপ করে চলে গেলো। সায়মা খানমের বুক চিড়ে এক ফালি দুঃখী নিশ্বাস আছড়ে পড়লো। ফাইজা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। নিরব ফাইজার সামনে এসে দাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বললো……
–ভয় পেও না। ফারদিনের অনুপস্থিতিতে আমি থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি তো আমার ছোট্ট বোন…..
বলেই ফাইজার কাঁধে ভরসাপূর্ন এক হাত রাখলো। ফাইজা সব দিকে ছেড়ে ছলছল চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..

–উনি এখন কেমন আছে নিরব ভাইয়া?
ফাইজার কন্ঠস্বর যেনো জমাট বেধে আছে। কিছুতেই শব্দ বের হচ্ছেনা।।বুকের ভেতর ঝড় বইছে। সারাদিন গড়িয়ে অন্ধকার এসে গ্রাস করেছে চারদিকে। ফাইজা এখনো হসপিটালে। অনেক খোজাখুজির পর ও’নেগেটিচ [O-] রক্তের খোঁজ পাওয়া গেছে। ফাইজার কথা শুনে সায়মা খানম ও শান্ত দৃষ্টি’তে তাঁকালো নিরবে’র দিকে৷ নিরব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থমথমে কন্ঠে বললো…..

–ফারদিনের মাথায় বড় একটা চো’ট লেগেছে। হাতে পায়ে বিভিন্ন জায়গায় অজস্র ছোট-বড় ইঞ্জুরি হয়েছে। প্রচুর ব্লাড’লস হয়েছে। কিন্তু….
নিরব থামতেই ফাইজার মনে হলো ওর দম এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাবে। কাতর স্বরে বললো….
–বলো না নিরব ভাইয়া???
নিরব শান্ত স্বরে জবাব দিলো….
–ঠিক বুঝতে পারছিনা৷ ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখা হয়েছে ও’কে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে সেন্স ফিরলে আলহামদুলিল্লাহ। আর না ফিরলে?
একটু থেমে আবার বলে উঠলো…..
–কোমায় চলে যাবে….

বলেই নিরব আর দাড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে ওদের সাইড কাটিয়ে চলে গেলো। ফাইজা কয়েক পা পিছিয়ে দেয়াল ঘেষে বসে পড়লো তৎক্ষনাৎ। সায়মা খানম পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে চেয়ারের হাতল চে’পে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফাইজা’র শান্ত হয়ে বসে আছে। পাশের চেয়ার গুলোতে দুই হাত রেখে তার উপর মাথা রেখে শান্ত হয়ে রইলো। ফুঁপানোর একটা শব্দ ভেসে আসচ্ছে ফাইজার থেকে। সায়মা বেগম কপালে হাত দিয়ে একাধারে কেঁদে যাচ্ছে।

রেজওয়ান বাড়ি’তে রাগে কিড়মিড় করছে। কাকন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে নখে নেলপলিশ লাগাচ্ছে। রেজওয়ানের রাগ দেখে কাকন দায়সারা ভাবে বলে উঠলো…..
–কে বলেছিলো ওদের কাছে গিয়ে সিমপ্যাথি চাইতে যেতে….
রেজওয়ান কাকনের দিকে অগ্নী ঝড়া চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..
—তোমাকেই কে বলেছিলো এক্সিডেন্ট’টা করাতে। ফারদিন যদি বেঁচে যায় তাহলে সবার আগে তোমাকে মা-র-বে?
রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন মুচকি হেসে বললো….

— তুমি ওর প্রান ভ্রমরার রাগে হাত তুলেছো আজ। এতদিন তোমাকে বাবা বলে মা/রতে চেয়েও পারেনি। কিন্তু, যদি শুনে তুমি এই কি যেনো নাম( একটু মনে করার চেষ্টা করে) ওহ হ্যা, ফাইজা না ফিজা ওর গাঁয়ে হাত তুলেছো তাহলে আর কি? তোমার হাত’টাই গায়েব করে দিবে…….
কাকনের কথা শুনে রেজওয়ান টেবিলের উপরে থাকা ভাঁজ’টা ছুড়ে ফেলে বলে উঠলো…..
–আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিলো তোমাকে বিয়ে করা আর তোমার কথায় সনিয়া’কে……

সনিয়া নাম’টা শুনতেই কাকন চোখ গরম করে রেজওয়ানের দিকে তাঁকাতেই রেজওয়ান রাগে বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে গেলো। আর কাকন একটু রহস্যময় হাসি দিয়ে নিজে নিজেই বললো….
–এত বছর তোমাকে সহ্য করেছিলাম শুধুমাত্র তোমার এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তি’র জন্য। কিন্তু, এখন তো এইসব কিছু আমার। তাই তুমি বাঁচলে কি ম-রলে আই ডো’ন্ট কেয়ার। আমি তো এক সপ্তাহের মধ্যেই এই দেশ ছেড়ে সবার নাগালের বাইরে চলে যাব।
বলেই শব্দ করে হাসলো।

ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সায়মা খানম দূর্বল হয়ে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায় তাকে পাশের কেবিনে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফাইজা’র বাড়িতে নিরব খবর দিয়ে দিয়েছে৷ ফাইজা’র বাবা-মা দুজনেই সারাদিন চিন্তায় ছিলো ফাইজা বাড়ি ফিরে’নি বলে। যখন খবর টা শুনেছে তারা এক প্রকার ছুটে হসপিটালে চলে এসেছে। এসেই ফাইজা’কে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফারদিনের কেবিনের দরজার বাইরে বসে থাকতে দেখে ফাইজার মা হাঁউমাঁউ করে কেঁদে দিলো মেয়েকে জড়িয়ে।

হাসনাত সাহেব দূর থেকে অসহায় দৃষ্টি’তে তাকিয়ে আছে ফাইজা’র দিকে। ফাইজা কাঁদছে না। ওর চোখ জোড়া স্থির। চোখ দিয়ে পানি পড়ে গালে মোটা করে পানির দাগ বসে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ফাইজা’কে দেখতে এই মুহূর্তে পা’গলের থেকে কম লাগছে না। নিরব ফাইজা’র মাকে ড্রেস নিয়ে আসতে বলেছিলো। কারন সাদা জামা’টা রক্তে মাখামাখি অবস্থা। ফাইজার মা জোর করে ও’কে নিয়ে গেলো চেঞ্জ করা’তে। নিরব বসে বসে হাসনাত সাহেবের সাথে কথা বলছে। চেঞ্জ করে ফাইজা নিরবের সামনে এসে দাড়িয়ে করুন স্বরে বললো…..

–একবার একটু তাকে দেখতে দিবেন নিরব ভাইয়া……
নিরব ফাইজার দিকে অসহায় চাহনী দিয়ে বললো….
–ফারদিনের জীবন এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। এই মুহূর্তে ওর কেবিনে ঢোকা সম্পূর্ণ নিষেধ বোন….
নিরবের কথা শুনে ফাইজার চোখের অবাধ্যজল গুলো গড়িয়ে পড়লো। ভেতরের জমাট বাধা কান্না গুলো বেড়িয়ে আসতে চাইলো। ফাইজা কান্না নিবারন করার চেষ্টা করে বললো…..

–প্লিজ ভাইয়া একবার একটু দেখে চলে আসব। একটুও কাঁদব না। একটুও শব্দ করব না। তাকে ধরব ও না। দূর থেকে দেখব। এই যে এই যে দেখুন আমি এক্ষুনি চোখের পানি মুছে নিচ্ছি। কারন, সে জেগে যদি দেখে আমি কাদঁছি তাহলে রেগে না জানি একটা থা’প্পড় বসিয়ে দেয়…..

বলেই হাসতে হাসতে কেদে দিলো। ফাইজার অবস্থা দেখে ফাইজার মা মুখে আঁচল গুঁজে নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। হাসনাত সাহেবের ও চোখের কোনে পানি জমে আছে। নিরব কোনো মতে নিজেকে সামলে ফাইজা’কে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। অনুমতি পেয়েই ফাইজা দৌড়ে ফারদিনের কেবিনে চলে আসলো। ফারদিনের কেবিনে ঢুকে ওর দিকে তাঁকাতেই ফাইজার হার্টবিট কমতে শুরু করলো। শ্বাসকষ্ট শুরু হবে কিছুক্ষন পর এমন মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ফারদিনের বেডের সামনে। এই তো এই ছেলে’টাই আজ ওর সাথে রেগে চলে এসেছিলো।

এই ছেলে’টাই কাল রাতে হাসচ্ছিলো। আর আজ.. ভাবতেই ফাইজা’র চিৎকার করে কান্না আসচ্ছিলো ভেতর থেকে। বুকের ভেতর থেকে হাহাকার ভেসে আসচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে থমকে দাড়ালো ফাইজা। নিশ্বাস যেনো ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। পা জোড়া স্থির হয়ে রইলো। নির্বাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে ফারদিনের দিকে। মাথা সম্পূর্ণ পাষান সাদা ব্যান্ডেজে আবৃত। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। কাঁদের দিক’টা পুরোটাই ব্যান্ডেজ প্যাচানো। গাল’টা রক্তিম হয়ে আছে। হাতের মধ্যে ব্যান্ডেজ প্যাচানো। ডান পায়েও সাদা ব্যান্ডেজ ঘিরে রেখেছে। এই ছেলে’টাকে সাদা রঙে চোখ ধাধানো সুন্দর লাগতো। তাহলে, আজ কেনো এই সাদা রঙ’টা এই ছেলে’টার গায়ে বড্ড বেমানান লাগছে। ফাইজা আর ভাবতে পারলো না বেডের সামনে বসে বেড’টাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো……

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১১

–একবার উঠবেন প্লিজ। আপনাকে এইভাবে দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। একবার উঠুন না প্লিজ। আমি আপনার সাথে কোনো দিন অভিমান করব না। প্লিজ উঠুন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উঠুন না প্লিজ উ…..
আর বলতে পারলো না ধপ করে নিচে পড়ে গেলো সেন্সলেস হয়ে………

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ১৩