গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৪

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৪
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী

জ্ঞান ফিরতে’ই ফাইজা’কে খাটের সাথে মাথা হেলিয়ে ঘুমান্ত অবস্থায় দেখে ফারদিনের কিছু’টা মায়া হলো। মেয়ে’টা সারারাত বোধহয় জেগে থেকে সকালের দিকে ঘুমিয়েছে। হাতের মধ্যের এখনো ব্যাথায় টনটন করছে। মাথায় ও যন্ত্রনা অনুভব করছে। ফাইজা’র মুখের দিকে তাঁকিয়ে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে ওর? মেয়ে’টা পর পর সব ধাক্কা গুলো সামলাতে পারছেনা। ফারদিন এক হাতে ভর করে উঠে বসে ফাইজার মাথা’টা বুকে জড়িয়ে নিলো। ফাইজা ও ঘুমের ঘোরে ফারদিনের বুকে জড়োসড়ো হয়ে রইলো। ফারদিন ব্যান্ডেজ প্যাচানো হাত’টা ফাইজা’র মাথায় রাখলো। আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ঘন কালো চুলে। তারপর করুন স্বরে নিজে নিজে বলতে লাগলো……

—আর কষ্ট দিব না তোমাকে জান। খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাইনা। নিজেকে ঠিক করে নিব। তুমিই তো আমার বেঁচে থাকার সম্বল।
বলে নিজেও ফাইজার মাথার সাথে নিজের মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে নিলো। কিছুক্ষন পর দরজায় কেউ নক করতে’ই ওরা দুজন ধড়ফড়িয়ে উঠলো। ফাইজা ঘুম ঘুম চোখে তাঁকিয়ে দেখলো ও ফারদিনের বুকে। ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছে ভেবে মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটলো। ফারদিন ও ঘুমে চোখ মেলতে পারছেনা। ওষুধের কড়া ডোজের কারনে ঘুম যেনো চোখের থেকে নড়ছে’ই না। ফাইজা ঘুম জড়ানো কন্ঠে’ই বললো….
–আপনি ঠিক আছেন?
ফারদিন ঠিক করে বিছানায় সুয়ে পড়তে পড়তে বললো…
–তুমি পাশে থাকলে আমি এমনিতেই খুব বেশি ভালো থাকি…..
বলে চোখ বন্ধ করে নিলো। ফাইজা ও আর কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা তো খোলা রয়েছে তাও কে নক করলো? ফাইজা দরজার সামনে যেতে’ই জেহের কে দেখে মুখে হাসি টেনে জেহের কে একটু জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো…..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–তুই কখন আসলি ভাই?
জেহের বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো….
–আমি মাত্র’ই এসেছি। আর এখন থেকে এখানেই থাকব আই মিন আমাদের বাড়ি’তে।
প্রতি উওরে ফাইজা হাসি ছাড়া আর কোনো উওর দিলো না। কারন আগে’র থেকেই জানতো জেহের চট্রগ্রাম থেকে এখানে চলে আসবে। জেহের আবারো প্রশ্ন করে উঠলো….
–ফারদিন কেমন আছে? দীদার কাছ থেকে শুনলাম সব’টা…
ফাইজা একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো…
–ছোট থেকে একটা মানুষ ধোকা খেতে খেতে বড় হয়েছে। আর সেই স্কুল লাইফ থেকে যাকে এত বছর ধরে নিজের ভাইয়ের চোখে দেখে এসেছে তার থেকে এই ধাক্কা’টা সে সামলাতে পারছে না ভাইয়া। খুব বেশি ভালোবাসতো নিরব ভাইয়াকে তাই এসব কিছু থেকে সে বের হতে পারছে না……..
জেহের কিছুক্ষন চুপ করে থেকে চিন্তিত স্বরে বললো….
–তোদের বিয়ে’টা ভালোয় ভালোয় মিটে যাক। তারপর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। চিন্তা করিস না…..
বলতে না বলতে ওর ফোনে মেসেজের আওয়াজ ভেসে উঠতে’ই জেহের ফাইজা’কে বলে নিচে নেমে এলো। আর ফাইজা ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে গেলো।

ভরদুপুরে ফুটপাতে দাড়িয়ে আছে আরজা। রোদের জন্য ঠিক করে তাঁকানো যাচ্ছেনা। বিরক্তি’তে চোখ মুখ কুচকে রেখেছে। হাতের বই’টা মাথার উপর ছাতার মতো ধরে রেখেছে। অনেক ক্ষন যাবৎ অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত চলে এসেছে ওর। মনে মনে একজনের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে। ঘড়ি দেখতে দেখতে পেছনে ফিরে’ই ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে নিলে ভয়ে চিৎকার করে সামনের ব্যাক্তি’টার শার্ট খামচে ধরলো। চোখ মুখ খিচে’ই বলে উঠলো….
–এই আপনি চোখে দেখতে পারেন না। রাস্তা ঘাটে মেয়ে দেখলে খালি ধাক্কা খেতে ইচ্ছে করে। আজব….
আরজা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। তাই সামনের ব্যাক্তি’টাকে না দেখেই এইসব বলে উঠলো। সামনের ব্যাক্তি’টা ওর কথা শুনে রাগী স্বরে বলে উঠলো….

–তুমি বোধহয় রাস্তা ঘাটে ছেলে দেখলে এভাবেই ঝাপিয়ে পড়ো……
চেনা কন্ঠ পেয়ে আরজা ফট করে চোখ খুলে জেহের’কে দেখে আরো ভয় পেয়ে শার্ট ছেড়ে দিলো। এবার ও পড়ে যেতে নিলে জেহের এক টানে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় আরজা’কে। ঘটনার আকস্মিকতায় আরজা বড় বড় চোখ করে আছে। জেহের নিজেকে সামলে আরজা’কে পাশে দাড় করিয়ে আবারো রাগী স্বরে বললো……
–রাস্তা ঘাটে দেখে শুনে চলতে পারো না।
আরজা তোতলানো স্বরে বলে উঠলো….
–আপনি হুট করে এভাবে এসে দাড়ালেন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম…..
আরজার মুখ’টা দেখে জেহেরের খুব হাসি পাচ্ছে। তাও নিজের হাসি’টা চে’পে রেখে ওর দিকে রাগী চাহনী দিয়ে রইলো। আরজা ঢোক গিলে বলতে লাগলো….
–দেখুন আপনার সাথে ঝগড়া করার জন্য আমি আপনাকে আসতে বলিনাই।
জেহের এইবার ভ্রু কুচকে বললো…..

–তাহলে আপনি কেনো আমাকে এই ভর দুপুরে এখানে ডাকলেন?
আরজা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে জেহের দিকে তাঁকালো। ওর চাহনী’তে অন্য কিছু খেয়াল করে জেহের ও শান্ত হয়ে তাঁকিয়ে রইলো। আরজা জেহেরের দিকে তাঁকিয়ে শান্ত স্বরেই বলে উঠলো…..
–আমি নিজের মনের কথা চেপে রাখতে পারিনা জানেন তো৷ তাই সোজাসুজি বলছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি জেহের ভাইয়া……
আরজার কথা শুনে জেহের একটুও চমকালো না। মনে মেনে তৃপ্তির হাসি হেসে নিলো। তাও মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলো…..
–ভালোবাসি বলছো আবার ভাইয়া বলছো। আমি ঠিক কোন’টা ধরে নিব বলো তো?
জেহেরের খাম খেয়ালি কথা শুনে আরজা অসহায় ভাবে ওর দিকে তাঁকাতে’ জেহের ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে উঠলো…..

–যাক এসব বাদ দেই। আসল কথায় আসি। এইসব ভালোবাসা টালোবাসার ভূত মাথা থেকে নামিয়ে ফেলো। আমার জীবনে একজন আছে যাকে আমি নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসি। বুঝেছো বাচ্চা। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। তুমি এখনো অনেক ছোট তাই বুঝতে পারছো না। ভালো লাগা’কে ভালোবাসা নাম দিচ্ছো। কয়েকদিন পর ঘোর কেটে যাবে। তাই এইসব বাদ দিয়ে এইবার বাড়ি যাও বাচ্চা।
বলেই আরজার নাক’ হালকা করে টেনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ই আরজা ওর হাত’টা টেনে ধরলো। টলমলে চোখে বিস্ফোরিত চাহনী দিয়ে কান্না ভেজা স্বরে বলতে লাগলো…..
–বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে সত্যি ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে মেনে নিতে না পারেন সমস্যা নেই। কিন্তু আমার ভালোবাসা’কে অপমান করবেন না……
আরজার অসহায় স্বরে কথা গুলো শুনে জেহেরে বুকের ভেতর’টা মুচড়ে উঠলো। তাও একটু আরজা’কে টাইট দেওয়ার জন্য মুখে হাসি টেনে বলে উঠলো…..

–চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। সাথে আন্টি আংকেল’কে বলে আসি তোমার জন্য খুব শিঘ্রই পাত্র রেডি করতে……
বলে আরজা’কে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসালো। আরজা নি’শ্চুপ হয়ে চোখের পানি ফেলছে। ওর বুকের ভেতরে মনে হচ্ছে কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করেছে। জেহের সব বুঝতে পেরে ও মুখের কোনে রহস্যময় হাসি টানলো।

একটা পার্কে দোলনায় বসে ফারদিনের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে ফাইজা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে চারদিকে। সারাদিন ঘুমিয়ে কেটেছে ফারদিনের। বিকেল দিকে শরীর’টা বেশ ফুরফুরে লাগছিলো বলে ফ্রেশ হয়ে ফাইজা’কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ফারদিন এক হাতে ড্রাইভিং করতে পারবেনা তাই ওরা হাটতে হাটতে সামনের একটা পার্কে এসে বসে পড়লো। কিছুক্ষনের নিরবতা ভেঙে ফাইজা বলে উঠলো…..
–নিজেকে সামলে নিতে কতদিন লাগবে শুনি?
ফারদিন এইবার ফাইজা’র মাথা’টা উঠিয়ে ওর দুই গালে হাত রাখলো আলতো করে। মুখে মুচকি হাসি রেখে বলে উঠলো….

–তোমার জন্য আমি সব পারি। আজকের পর আর অতীত নিয়ে ভাববো না। বরং, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববো। ওরা দোষী তাই শাস্তি পেয়েছে। আর আমি নিজের হাতে ওদের শাস্তি দিয়েছি৷ নিজেকে আর অপরাধী ভাববো না। জীবনের কালো অধ্যায় শেষ করে রঙিন অধ্যায় শুরু করবো।
বলেই ফাইজার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফাইজা খুশিতে ফারদিনের দুই হাতে পাগলের মতো কয়েকবার চুমু খেয়ে ফারদিন’কে জড়িয়ে ধরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো…..
–আমি আজ কত’টা খুশি আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। আমরা সব ভুলে দুজনে মিলে নতুন সংসার শুরু করবো…….
ফারদিন এইবার একটু দুষ্টুমি ভঙ্গী’তে বলে উঠলো….
–আমরা ফুলশয্যা ও কিন্তু করব জান। আর…….
বলতে পারলো না। তার আগেই ফাইজা ওর মুখ চে’পে ধরে চারদিকে চোখ বুলিয়ে রাগী স্বরে বললো……

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৩

–চুপ একদম চুপ। অসভ্য লোক একটা। কোথায় কি বলতে হয় এখনো শিখলেন না আপনি।
ফাইজার রাগ দেখে ফারদিন হাহা করে হেসে দিলো। অনেকদিন পর ছেলে’টাকে মন খুলে হাসতে দেখে ফাইজা তৃপ্ত চোখে তাঁকিয়ে আছে ওরদিকে। ছেলে’টা আবার আগের রুপে ব্যাক করছে। আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা তারপর সারাজীবনের জন্য দুজন বাঁধা পড়বে একি গাটছড়ায়। মনের প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে ফাইজা’র। কালো অধ্যায় গুলো আজ এখানে’ই সমাপ্ত হোক মনে মনে এটাই দোয়া করতে লাগলো……

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৫