গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৮

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৮
লেখনীতে জেনিফা চৌধুরী 

মেরুন রঙের গর্জিয়াস লেহেঙ্গা’র সাথে ম্যাচিং গহনা। চুলের সামনের দিকে স্টাইল করে বাঁধা আর পেছনের সব খোলা চুল। মাথায় মেরুন রঙের ব্রাইডাল-ওড়না। ফাইজা’র সৌন্দর্যের বর্ননা দেওয়ার ভাষা নেই হয়তো। কল্পনার চাইতে বেশি সুন্দর আর কিছু হতে পারেনা। কল্পনা বাস্তবতার চাইতেও ভয়ানক সুন্দর। ফারদিন আজ মেরুন রঙের শেরওয়ানি সাথে মেরুন করে পাগরি পড়েছে। শেরওয়ানির সাথে সানগ্লাস’টা বুকে ঝুলানো। হাতে কালো কালো ঘড়ি। আর মুখে সেই বিখ্যাত হাসি। জেহের আজ পড়েছে লাল শেরওয়ানি, পাগরি পড়েছে। হাতে ফারদিনের মতো সেম ঘড়ি। আরজা আজ লাল লেহেঙা আর সাথে ম্যাচিং গহনা পড়েছে। আরজা’র চুল গুলো সুন্দর করে খোঁপা করে সাদা রঙের গাজরা ফুল লাগানো। সব থেকে বেশি অবাক করার বিষয় আজ আরজা’র যেখানে অবাক হওয়ার কথা সেখানে আরজা আর অবাক না হয়ে সবার সাথে নেচে বেড়াচ্ছে৷ সাজানো হতে’ই ফোন নিয়ে বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলে নিলো। মাঝে ফাইজা’র সাথেও কয়েক’টা ছবি তুলে নিলো। ফাইজা অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে আরজা’র দিকে। পার্লারের লোকেরা চলে যেতে’ই ফাইজা আর কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে আরজা’র সামনে দাড়িয়ে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো……

–আজ তোর অবাক লাগছে না এইসবে? আজ তুই একবার ও প্রশ্ন করলি না তো তোকে কেনো বউ সাজানো হলো?
ফাইজার কথা শুনে আরজা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। তা দেখে ফাইজা আরো বেশি অবাক হলো। এই মেয়ের হয়েছে কি? ফাইজা এইবার কিছু’টা ধমকের স্বরে বললো…..
–হেয়া’লি করবি না একদম। কি হয়েছে তোর বল?
আরজা উওর না দিয়ে ফাইজা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে খুশিতে মেতে উঠে বলে উঠলো….
–এতদিন আমরা দুইজন বেস্টু ছিলাম। আর আজ থেকে ননদ-ভাবী।
আরজা’র কথা শুনে ফাইজা এইবার অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো। আরজা সব’টা কি করে জানলো? কে বলেছে? এইসব প্রশ্ন মুহূর্তে’ই মাথায় উঁকি দিতে লাগলো। আরজা ফাইজা’কে ছেড়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে বলে উঠলো…..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–আজ আমার বিয়ে আর আমি যদি না নাঁচি তাহলে কি হয়? আয় আমার সাথে তুই ও নাঁচবি?
বলে ফাইজা’র হাত ধরে ঘুরতে লাগলো। আর ফাইজা “থম” মে’রে আছে। আরজা’র এত খুশি তো হওয়ার কথা ছিলোনা। অন্য কিছু ঘটবে না তো। মনের মধ্যে কেনো যেনো খটকা লাগতে শুরু করলো ফাইজা। তাই আরজা’কে থামিয়ে ওর দুই বাহু’তে ধরে কিছু’টা রাগ মিশ্রিত গলায় বললো…..
–তুই কি আমার সাথে মজা করছিস। দেখ আরজু আজকের দিনে অন্তত আমার সাথে অন্তত……
ফাইজা এইটুকু বলতে’ই আরজা শব্দ করে হেসে দিলো। আরজা’কে হাসতে দেখে ফাইজা বিস্মিত হয়ে আছে। আরজা হাসতে হাসতে ফাইজা’র নাক টেনে বলে উঠলো…..
–সারপ্রাইজ কি তোরা দুই ভাই-বোনে’ই দিতে পারস। আমি বুঝি পারি’না……

বলে চোখ টিপ মা’রলো। ফাইজা আরজার কথার একটা শব্দ ও বুঝে উঠতে পারছেনা। আরজা এইবার সব খুলে বললো ফাইজা’কে। আসলে মেহেন্দীর দিন যখন জেহের সবার সামনে নিজের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করলো। সেদিন আরজা’র কষ্ট’টা হয়তো সবাই বুঝতে পেরেও চুপ ছিলো বিয়ের দিনের অপেক্ষা। শুধুমাত্র একজন বাদে। সেই একজন হলো ফারদিন। সেদিন রাতে’ই ফারদিন আরজা’কে সব সত্যি’টা বলে দিয়েছিলো। আর সব শুনে আরজা’ খুশিতে সেদিন সারা রাত কান্না করেছিলো সবার চোখের আড়ালে। আর সেদিন রাতে ফারদিন আর আরজা মিলে উল্টো ওদের সবাই’কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য প্লান করে। আরজা সব জেনেও না জানার ভান করে এতদিন কষ্ট পাওয়ার অভিনয় করে গেছে। যাতে সবাই বুঝে আরজা কত’টা কষ্টে আছে। কিন্তু আরজা’র কষ্টের পেছনে লুঁকিয়ে থাকা খুশি’টা কেউ দেখে’নি। সব শুনে ফাইজা মাথায় হাত দিয়ে খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লো। একটা মানুষ এমন অভিনয় কিভাবে করতে পারে? ভেবেই ফাইজা ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। আর আরজা ওর সামনে দাড়িয়ে বত্রিশ পাটি খুলে হাসচ্ছে। হাসতে হাসতে আরজা ভাব নিয়ে বললো…..

–কি ননদিনী। ভাবীর অভিনয় কেমন লাগলো বলো তো?
ফাইজা উওরে কি বলবে খুঁজে পেলো না। আরজা’র খুশি দেখে নিজের ভেতরের জমে থাকা অপরাধবোধ নিমিশেই কেটে গেলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরজা’কে। শান্ত কন্ঠে’ই বলে উঠলো……
–তোকে অভিনয়ে আমি একশো’র মধ্যে এক হাজার দিব….
বলে কেঁদে দিলো। ফাইজা’কে কান্না করতে দেখে আরজা টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে রাগী স্বরে বলে উঠলো…..
–এই এই একদম চোখের পানি ফেলবি না। খবর দার। সব মেকাপ ধুয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। কি ভেবেছিস তোর কান্না দেখে আমিও কান্না করে দিব। কাবি নেহি। আমার এত সুন্দর মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে তখন আমাকে দেখতে শেওড়া গাছের পে’ত্নী লাগবে। আর তখন আমার এক মাত্র জামাই’টা আমাকে দেখে দৌড়ে পালাবে। ইহা আমি কিছুতেই সহ্য করিবার পারিব না ননদিনী…….

অনেক অভিনয় করে এই কথাগুলো বলে উঠলো আরজা। আরজা’র অভিনয় দেখে ফাইজা না হেসে থাকতে পারলো না। পূর্নরায় আরজা’কে জড়িয়ে ধরে হেসে দিলো। এর মধ্যে’ই তনুজা আর আরজা’র মা দুজনে তাড়া দিতে দিতে রুমে ঢুকলো। রুমে ঢুঁকে’ই আরজা আর ফাইজা’কে দেখে উনারা দুজন ও অবাক হয়ে গেলো। ফাইজা উনাদের সব’টা বললো। আরজা’র মা আর তনুজা দুজনেই আরজা’কে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আরজা’র মা’য়ের ও বুকের থেকে একটা পাথর নেমে গেলো। মেয়ে’টাকে কষ্ট পেতে দেখে নিজেই কষ্ট পাচ্ছিলো। এখন মেয়ে’টাকে হাসি-খুশি দেখে খুশিতে উনার চোখে পানি চলে এলো। আরজা’ কিছুক্ষন মা’কে জড়িয়ে ধরে রাখলো শক্ত করে। একদিকে ভালোবাসার মানুষ’টাকে নিজের করে পাওয়া আরেকদিকে বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে আসা। একদিকে খুশি আরেকদিনে দুঃখ। দুইটার মাঝে রয়েছে আরজা। আরজা’র মাকে জড়িয়ে ধরা দেখে ফাইজা’র নিজের বাবা-মায়ের কথা মনে উঠলো। মুহূতে’ই চোখ বেয়ে নেমে আসলো অশ্রধারা। তনুজা ফাইজা’র দিকে খেয়াল করে ও’কে দুই হাতে আকড়ে ধরে বলে উঠলো…..

–আজকের এই খুশির দিনে একদম চোখের পানি ফেলবিনা। মনে করবি তোর সাথেই তোর মা-বাবা রয়েছে। ওরা দূর থেকে তোকে দেখছে। তুই খুশি আছিস দেখে ওরা ও খুশি থাকবে। তাই একদম চোখের পানি ফেলবি না। আমি আছি তো তোর পাশে সারাজীবন……
তনুজা’র কথা শুনে ফাইজা’ কান্না রত স্বরে বলে উঠলো….
–তুমি আছো বলে’ই আমি খুব তাড়াতাড়ি সব’টা মানিয়ে নিতে পেরেছি মনি। তুমি তো আমার দ্বিতীয় মা…..
এইটুকু বলে ফুঁপিয়ে কান্না করে দিলো। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আরজা জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….
–শোনো শোনো শোনো সবাই….
আরজা’র চেঁচানো শুনে ফাইজা চোখের পানি টুকু মুছে নিয়ে ওর পিঠে একটা থা’প্প’ড় মে’রে বলে উঠলো….
–চেঁচাচ্ছিস কেনো?
আরজা এইবার একটা মেঁকি হাসি দিয়ে বললো….

–এতদিন তোমার ভাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে। তাই এখন তোমার ভাই’কে কি শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো ননদিনী……
আরজার কথা শুনে তনুজা আর আরজার মা দুজনে হেসে দিলো। আর ফাইজা কপট রাগ দেখিয়ে বললো….
–একদম আমার ভাই তোকে কষ্ট দেয়’নি বরং তুই কষ্ট পাচ্ছিস বলে আমার ভাই নিজে তোর থেকে দ্বিগুন কষ্ট পেয়েছে। তাই নো শাস্তি…..
আরজা ও কিছুটা ভাবলো। তারপর বললো….
–শাস্তি তো আমি দিব’ই। যদি আমার একমাত্র জিজু আমাকে সত্যি’টা না বলতো। তাহলে,তো আমি কষ্ট পেতাম তাইনা। তার শাস্তি’টা বরং আমি নিজে নিজে ঠিক করি। এখন চলো আমি বিয়ে করব তো দেরি হয়ে যাচ্ছে…..
বলে ফাইজা’র হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো একা একা’ই। তা দেখে তনুজা আর আরজা’র মা হেসে উঠলো।

“Mujhe sajan ke ghar jana hai”
গান’টা হঠাৎ সাউন্ড বক্সে উচ্চ ভলিউমে বেজে উঠতে’ই ফারদিন আর জেহের দুজনে’ই হকচকিয়ে উঠলো। সবার হাত তালি শুনে সিড়ির দিকে নজর দিতে’ই দুজনে থমকে গেলো। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো দুজনের। এক মুহূর্তে’র জন্য অন্য রাজ্যে চলে গেলো। সিড়ি দিয়ে আরজা আর ফাইজা দুজনে “mujhe sajan ke ghar jana hai” গান’টায় নাঁচতে নাঁচতে সিড়ি দিয়ে নামছে। ফারদিন আর জেহের দুজনে বোকার মতো হা করে তাঁকিয়ে আছে সেদিকে। ওদের চোখের পাতা পড়ছেনা। আরজা আর ফাইজা দুজনে পুরো’টা গানে খুব সুন্দর করে নাঁচ শেষ করলো। গান’টা শেষ হতে’ই ওরা দুজন ঘুরে ফারদিন আর জেহেরে’র সামনে এসে দাড়ালো। আরজা আর ফাইজা দুজনে একবার চোখাচোখি করলো। তারপর দুজনে’ই একসাথে আরজা জেহের’কে আর ফাইজা ফারদিন’কে হাতের তালু’তে ফ্লাইয়িং কিস ছুড়ে দিতে’ই ফারদিন আর জেহের একসাথে বুকের বা পাশে হাত রেখে……

–হ্যায় মা’রডালা…..
বলে পড়ে যেতে নিলে পেছনে ওদের ফ্রেন্ড সার্কেল যারা ছিলো সবাই ধরে ফেললো। তারপর পুরো বিয়ের আসরে হাসির রোল পড়ে গেলো।

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি বোনাস পর্ব 

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। বিয়ে নিয়ে আর দুই বা তিন পর্ব হবে। যত তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাচ্ছি?ততই বাড়ছে কেনো বুঝিনা? যাই হোক একটা সুন্দর মন্তব্য করবেন দয়া করে]

গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব ৩৯

1 COMMENT

Comments are closed.