চড়ুইপাখির অভিমান গল্পের লিংক || নন্দিনী নীলা

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ১
লেখনীতে- নন্দিনী নীলা

ম্যাথ ক্লাসে নতুন স্যার রুপে নিজের হবু বর স্পর্শ কে দেখে মাথা ঘুরে উঠলো আমার। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি। নয় মাস পর দেখছি স্পর্শ কে তবুও চিনতে অসুবিধা হয়নি। উনি স্যার হয়ে গেলো কবে? আমি তো এসব কিছুই জানি না। লেখাপড়া শেষ করে না উনি জবের জন্য ঘুরছিলো শুনছিলাম। আমি চোখ কচলে কচলে দেখছি আবার ঘোরের মধ্যে আবোল তাবোল দেখছে না তো। আমার তো আবার এই লোকটাকে নিয়ে দিবা স্বপ্ন দেখার রোগ আছে।

আজকেও তাই হচ্ছে নাকি তাই ভাবছি বসে। এদিকে স্যার ক্লাসে আসায় যে দাঁড়িয়ে ভদ্রতার সাথে সালাম দিবো তার ও খেয়াল নাই আমার।‌আমি হা করে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। তা দেখে প্রিন্সিপাল স্যার রেগে এক ধমক দিলো আমাকে। আমি ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম ক্লাসের সবাই দাঁড়িয়ে আছে একমাত্র আমি ই গাধার মত বসে ছিলাম। হায় কি লজ্জা! মাথা নিচু করে প্রিন্সিপাল স্যারকে সরি বললাম। প্রিন্সিপাল স্যার বিরক্তকর চাহনী দিয়ে বললো, সিট ডাউন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারপর বললো, এই হচ্ছে তোমাদের নতুন ম্যাথ টিচার সাদাফ মাহফুজ স্পর্শ
স্যার আর বলতে পারলেন না তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল।
আদিম কালের একটা গান রিংটোন দেওয়া স্যারের সবাই মুখ টিপে হাসছে কিন্তু আমি তা করতে পারলাম না। নিচু স্বরে হাসতে গিয়ে ও খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। আর সম্পূর্ণ ক্লাসে আমার হাসির শব্দ দেয়ালে বাড়ি খেল। আমার বান্ধবী মিষ্টি আমাকে ধাক্কা মারলো রাগে।

আমি সাথে সাথে মুখ চেপে ধরলাম। হায় আল্লাহ আজ আমি এসব কি করছি। একেতে প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে বেয়াদবি করছি তার উপর আমার হবু বর স্পর্শর সামনে এসব করে নিজের মান সম্মান ক্ষুন্ন করছি ছিহ।
আমার নিজের গালে নিজেকেই কষিয়ে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করছে। স্পর্শের সামনে ইজ্জতের লুফা হয়ে গেল।
স্পর্শের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তার মধ্যে কোন হেলদোল নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিচ্ছে। হেসে হেসে কথা বলছে। আমি একটু পরপরই আড়চোখে তাকিয়ে দেখছি তার কার্যক্রম। স্পর্শ সবাইকে দাঁড়িয়ে পরিচয় দিতে বলেছে। সবাই একে একে দাঁড়িয়ে নাম ধাম বলছে। প্রিন্সিপাল স্যার কথা শেষ করে এসে স্পর্শের স্বাভাবিক ভাবেই সুন্দর করে কথা বলতে দেখে খুশি হয়ে তাড়া দেখিয়ে চলে গেল।

স্পর্শ তাকে বিদায় দিয়ে সবাইকে একে একে নাম জিজ্ঞেস করতেই লাগলো। আমি ছিলাম দরজার পাশের লাইনে একদম লাস্টের সিটের জানালার পাশে। আমার ডান পাশে আছে মিষ্টি মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। আরো আছে এক সিটে পাঁচজন করে বসা হয়। কারণ আমাদের বেঞ্চ গুলো অনেক বড়। আমাদের আরো ফ্রেন্ড আছে নিঝুম, সিনথি, ধারা।
স্পর্শ এতো গল্প করতে পারে উফ অবশেষে আমার পালা এলো। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে র‌ইলাম। আমাকে তো চিনেই আমি আবার কি বলবো। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি তাই স্পর্শের গম্ভীর গলায় আওয়াজ কানে এলো আমি চমকে মাথা উঁচু করলাম,

‘ হে ইউ! চুপ করে কেন? হোয়াটস ইউর নেম?’ আমার দিকে আংগুল তাক করে স্পর্শ জিগ্যেস করলো। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। অবাক নয়নে তাকালাম স্পর্শের মুখের দিকে। তিনি তার ভ্রু উঁচু করে কথা বলতে ইশারা করছে। ক্লাসের সবাই ফিসফিস করে কি যেন বলছে আমি আকাশ‌ সমান রাগ মাথায় নিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে টেনে টেনে বললাম,
‘ মারিয়া ‘
স্পর্শ আমার কথা শুনে বলল, ‘ শুধু মারিয়া? নামের আগে পরে কিছু নাই!’
আমি বললাম, ‘ আছে‌!’
স্পর্শ বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ তাহলে সম্পূর্ন বলেন!’

আমি বলতে যাব এমন সময় ক্লাস শেষের ঘন্টা বাজলো। আমি থেমে গেলাম। স্পর্শ ও আর দাঁড়ালো না গটগট করে চলে গেল। বিদায় নিয়ে। আমি মুখ কালো করে বসে পরলাম। উনি আমাকে চিনতে পারলো না। একদম অপরিচিতদের মতো বিহেভ করলো। উনি আমাকে চিনলো না কেন? এই উনার ভালোবাসা! সবাই যে বলে উনি নাকি আমাকে খুব ভালোবাসে? এজন্য নাকি আব্বুর পায়ে ও পরে বলেছেন তার সাথেই যেন আমাকে বিয়ে দেন। আব্বু তো বেকার ছেলে দেখে নাকি না করে দিয়েছিল। কিন্তু স্পর্শ হাল ছাড়ে নি আব্বুর পেছনে ভালো করেই নেমেছিল তাকে না মানিয়ে থামবে না। শেষ পর্যন্ত নাকি পায়েও পরেছিল তখন আব্বু একটু নরম হয়েছিল।

স্পর্শের পরিবারের সবার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে সম্ভান্ত পরিবার দেখে রাজি হয়েছে কিন্তু বিয়ে এখন না স্পর্শকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তারপর হবে সব। স্পর্শ রাজি হয়ে যায় এক পায়ে কিন্তু একটা অনুরোধ করে এনগেজমেন্টটা যেন করিয়ে রাখে তাই হয় আমাকে আমার হবু শাশুড়ি মা আংটি ও চেন দিয়েছে। আমি তো তখন স্পর্শকে দেখিনি। তখন আমি ক্লাস নাইনে পরি আমি বিয়ের খবর জানতে পেরে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলাম আর বলেছিলাম। আপুর আগে আমার বিয়ে কেন ঠিক করছো তোমরা। আমি তো ছোট এখনি কেন আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়েছ। আমি বিয়ে করবো না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে আংটি পরিয়ে ছিল। আমি সেটা টেনে খুলে ফেলে দিয়েছিলাম। শত বলেও কেউ পরাতে পারেনি। আমি খাওয়া দাওয়া ও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সবাই শত চেষ্টা করেও আমাকে এক ফোঁটা পানিও খাওয়া তে পারেনি।

সবাইকে বলেছিলাম বিয়ে দিবে না বলো তাহলে খাব না হলে না খেয়ে মরে যাব। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না তাই ত বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাইছো। সবাই আপুকে ভালোবাসো। তখন সবাই বলেছিল বিয়ে দিবে না। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। সেই দিনের পর আর সত্যি বিয়ে না কোন কথা বার্তা শশুর বাড়ি নিয়ে কোন আলোচনা হয় নি আমি ভেবেছিলাম সব বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু না।

এসব কিছুই শেষ হয়নি। সব ছিল শুধু আমার চোখের আড়ালে। কারণ আমি রিয়েক্ট বেশি করতাম তাই আমার বুঝ হ‌ওয়া অব্দি সব লুকানো ছিল। কিন্তু একদিন আমি সব জেনে গেলাম তখন আমি ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের পরি। এক বছর আগে জানতে পেরেছি। সব আমি আমার বড় বোন তানহা তখন সব বললো। সাথে একটা পিকচার ও দিল। ছবিটা ছিল স্পর্শের। আমি প্রথম দেখেই ক্রাশ খেয়েছিলাম। তারপর ছবিটা নিজের কাছে নিয়ে রুমে গিয়ে নেচেছিলাম এতো সুন্দর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে।

আমি বিয়েটা নিয়ে আর আগের মতো ঝামেলা করিনি বলে সবাই তারপর থেকে আমার সামনেই আলোচনা বসতো। আমি প্রথম রোজার মধ্যে আমার শশুর বাড়ির সবাইকে দেখেছি। স্পর্শ ও সেদিন এসেছিল কিন্তু সামনাসামনি দুজনের কথা হয়নি। আমি উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখেছি তাকে। কথা বলির জন্য হাঁসফাঁস করছিলাম। কিন্তু কথা হলোই না। তিনি ইফতার করেই তাড়া দেখিয়ে চলে গেলো। আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম কান্ড কারখানায়। কীভাবে কথা বলবো ভাবছিলাম কিন্তু লোকটা চলেই গেল।

এইভাবে এই একবছরে তিনবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। আর কথা হয়েছে একবার। তাও সেটা আমার শশুর বাড়ী গিয়ে। আমি এই পর্যন্ত সাত বার শশুর বাড়ি গিয়েছি। কিছু হলেই আমাকে নিতে চলে আসে আমার একমাত্র ননদ সীফা নয়তো শাশুড়ি মা। আমি গেলে স্পর্শের জন্য ওয়েট করি কিন্তু ফাটা কপাল আমার মহাশয় জীবনে ও আমি ওই বাসায় গেলে বাসায় থাকে না। যতক্ষণ থাকি বাড়ি ও আসে না। সব সময় আমায় এমন পেরেশানি করেছে উনি। কতো শখ ছিল প্রেম করব। যখন জানতে পারলাম এমন হিরোর মতো বর ঠিক করে রেখেছে সবাই তখন তার সাথেই প্রেম করার সিদ্ধান্ত নিলাম কিন্তু পারলাম না। একদিন নিজে থেকে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু আর কখনো তিনি ফোন করেননি। লজ্জায় অপমানে আর ফোন করিনি। তার ফেসবুক একাউন্ট ও আমি রাউন্ড করি কিন্তু তার পাত্তা নাই।

তাই রিকোয়েস্ট ও দেয়নি আমার একটা ভাব আছে না। হুহ
রষকষ হীন বর আমার ধুর। গালে হাত দিয়ে পুরোনো স্মৃতি বিচরণ করছিলাম তখন মিষ্টির ধাক্কা খেয়ে বাস্তবে ফিরলাম।
‘ এই মারু তুই এমন হা করে কি ভাবতাছিলি হ্যা!!”
‘আমার জামাইয়ের কথা ভাবতাছিলাম। লোকটা খাটাশ রে। ওইটারে আমার পচা পানিতে চুবাইতে মন চাইছে খালি ভাব দেখায় আমারে।’

ধারা বলল, ‘ এই মাইয়া নিশ্চিত পাগল হ‌ইয়া গেছে। জামাইয়ের খবর পাওয়া পর থিকা খালি এসব বলে। জীবনে দেখা করাতে পারলো না। ওর সাথেও কথা কয় না তার প্রেমে দেওয়ানা হয়েছে।’
‘ হ রে ঠিক ক‌ইছত এহন থিকা আমি ও ভাব দেখামো। আমারে না চেনার ভান করলো তাই না ওকে আমিও চিনি না এমন ভাব‌ই ধরবো।’

ওরা সবাই অবাক হয়ে বলল, ‘ তুই কি কস এগুলো কিচ্ছু তো বুঝতে পারছি না। সব আওলাইয়া যাচ্ছে।’
আমি সব সত্যি টা বলে দিলাম ওদের। ওরা মুখে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ২

2 COMMENTS

Comments are closed.