সঞ্চারিণী শেষ পর্ব 

সঞ্চারিণী শেষ পর্ব 
আফনান লারা

-‘ রিভলবারটা আমায় দিন।যে কাজ একবারে করতে পারিনি তা আজ করবো।ওকে আমি কিছুতেই বেঁচে থাকতে দেবোনা।আশাকে ও মেরেছে।উপযুক্ত শাস্তি তাকে আমি নিজ হাতে দেবো’
-“তোমার একটা কথাও আমি আর রাখছিনা।এই পথটা চেনা আছে তোমার?এত অন্ধকারে কোথা থেকে কোথায় যাব তাই ভেবে পাইনা।রেদোয়ান নির্ঘাত ধাওয়া করেছে।নিজের জীবন নিয়ে টানাটানি। আজ কেউ না কেউ মরবেই।’
অনেকটা পথ অন্ধকারে ছোটার পর শাওন কি মনে করে মেধাকে নিয়ে বনে ঢুকে পড়েছে।রোডে থাকলে রেদোয়ান খুব সহজে ধরে ফেলতে পারবে ওদের।তাছাড়া ওর কাছে তো জিপ ও আছে।
হেঁটে/দৌড়ে তারা দুজন বেশি দূর কখনওই যেতে পারবেনা তাই জেনেশুনে ভয়ঙ্কর জঙ্গলে তারা ঢুকে পড়লো এক প্রকার বাধ্য হয়ে।ওদিকে রেদোয়ান নিজে জিপ নিয়ে রোড দিয়ে আসছে আর বন দিয়ে তার সাথের লোকদের আসতে বলেছে।

মেধা পায়ের কারণে দৌড়াতে পারছেনা ঠিকমত,পথে পথে থেমে যাচ্ছে।মাটিতে বসে পড়ছে।
শাওন ওকে কোলে তুলে নিতে চাইলে ও বাধা দেয়।ওকে কোলে নিয়ে শাওন নাকি দৌড়াতে পারবেনা।তাই ভেবে বারবার বাধা দিচ্ছে।
পাঁচ মিনিট বসলেই দূর থেকে আলো দেখা যায়।রেদোয়ান খুব কাছে এসে গেছে।রক্ষা পেতে হলে পালাতে হবে।কিন্তু পালানোটা হয়ে উঠছেনা মেধার চোটের কারণে।মেধা বারবার করে বলছে শাওন যেন চলে যায়।মেধাকে এত সহজে রেদোয়ান মারবে না।কিন্তু শাওনকে মারতে সে দেরিও করবেনা।বরং সবার আগে শাওনকেই মারতে আসবে।
শাওন নাছোড়বান্দা।সে মেধাকে ফেলে কিছুতেই যাবেনা।কি করে যাবে?মেধাকে সে ভালোবাসে।তাছাড়া ভালোবাসার কথা দূরে থাকুক।সবার আগে হলো মনুষত্ব।একটা মেয়েকে বিপদের মুখে একা ফেলে যাওয়া কোনো ভালো পুরুষের কাজ হতেই পারেনা।মেধা এমন ভাবে শাওনকে চলে যেতে বলছে যেন শাওন না গেলে সে ধাক্কা মেরে তাড়াবে ওকে।বারবার ধমকাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কোনদিকে গেলে একটু প্রশান্তি মিলবে তা ওদের দুজনের জানা নেই।শেষে মেধা শাওনের হাত থেকে রেদোয়ানের রিভলবারটা কেড়ে নিলো।পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,’আমি আর পালাবোনা।আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো’
-“মেধা একবার ভুল করেছো সেই ভুলটা ভুলে পরিণত হয়নি।এখন আবার সেই ভুলকে নাম দেওয়ার জন্য তুমি এমন করছো?ওটা ফেলে দাও।আমাদের জন্য একটা সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে’
-‘না!আজ যদি আমি রিভলবার ছেড়ে দিই তো আমাদের দুজনকেই মরতে হবে।আমি নিজে মরলে মরবো কিন্তু আপনার কিছু হতে দেবোনা।’

শাওন মেধার হাত থেকে কৌশলে পুনরায় রিভলবারটা ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো।অনেকদূরে আওয়াজ হলো।কোথায় গিয়ে পড়েছে তা বুঝতে পারলেও এই অন্ধকারে সেটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।ভোর হয়ে আসবে কিছুক্ষণ পরেই।তাও সেরকম আলো চারিদিকে ছড়ায়নি যে রিভলবার খুঁজে পাওয়া যাবে।
মেধা চেঁচিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,’এটা আপনি কি করলেন?কেন করলেন?’
-‘আইন হাতে নিতে পারিনা আমরা’

ঠিক সেসময়ে রেদোয়ানের লোকজন এসে চারিদিক থেকে ওদের ঘিরে ধরেছে।তারা অপেক্ষা করছে রেদোয়ান আসার।সবার হাতের ফোনের আলো জ্বলছে।আলোর কারণে মেধা তাকাতেও পারছেনা।মুখের সামনে হাত রেখে চুপ করে আছে সে।একসময়ে শক্ত হয়ে শাওনকে বললো সে যেন চলে যায়।’
শাওন সেদিকে খেয়াল না করে মারপিট শুরু করে দিলো হঠাৎ।
সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো শাওনকে থামাতে।মেধা পায়ের কারণে উঠে দাঁড়াতে পারছেনা।
তারা একটা পাহাড়ের চূড়াতে আছে এখন।সেটা কেউই জানতোনা।উঁচু নিচু পথে ছুটে তারা পাহাড়ের উপর চলে এসেছে।

রেদোয়ান এসে উপস্থিত হলো কিছু সময়ের ব্যবধানে।মেধাকে আহত দেখে সে বললো,’অনেক হয়েছে।রকির জন্য আর আমি অপেক্ষা করবেনা।তোমাকে তো আমি মারবোই মারবো।তাও এই মূহুর্তে।এই তোরা এই অফিসারটাকে আটকে রাখ।আমার আসল কাজটা আমি নিজেই সম্পূর্ন করছি।’
কথাটা বলে রেদোয়ান মেধার হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো পাহাড়ের কিণারার দিকে।উদ্দেশ্য ছিল ফেলে দেবে ওকে নিচে।

শাওন দেখেছে কিন্তু লোকগুলোর কারণে নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা।মেধাকে বাঁচাতে যেতেও পারছেনা।
বারবার মেধাকে বলছে শক্ত হতে।কিন্তু মেধা এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে সে তার হাতটাও ছাড়াতে পারছেনা রেদোয়ানের হাত থেকে।শেষ কিণারায় এনে রেদোয়ান মেধাকে ধাক্কা দেবে ঐ সময় তার ফোনে কল আসলো।রকির কল।সাজিদ আর মিলন ওকে দিয়ে ফোন করিয়েছে তা রেদোয়ান জানতো না।
বিরক্ত হয়ে মেধার পায়ের উপর তার এক পা রেখে ওকে আটকে মেধার হাত ছেড়ে ফোন ধরলো সে।
মেধা ব্যাথায় চিৎকার করছে।রকি জানালো সে আসছে।লোকেশান যেন বলে। রেদোয়ান তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,’তোর আর আসতে হবেনা।আমি ওকে মারবো এখন।তোকে আরও সুন্দর মেয়ে এনে দেবো।এর কথা ভুলে যা’

লোকগুলো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আজ শাওন রশ্নিকে দেখলো হঠাৎ।ঠিক তার সামনে।
সেই রুপে যে রুপে রশ্নিকে সে শেষবার দেখেছিল।ও মারা যাবার আগে।রশ্নি আজ অভিমান করে নেই।তার মুখে হাসি।অথচ চোখে পানিতে টলমল করছে।
শাওন মারামারি থামিয়ে রশ্নির দিকে তাকিয়ে থাকলো।রশ্নি এগিয়ে এসে শাওনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,’আমাকে হারিয়ে যেতে দেখেছো।মেধাকে হারিয়ে যেতে দেখোনা।আমি জানি তুমি মেধাকে বাঁচাতে পারবে যদি তুমি চাও।মেধা আজ অসহায়।ওকে আমার মতন হারাতে দিওনা শাওন!ওকে বাঁচাও।যা করতে হয় করো তাও ওকে বাঁচাও।যদি ওর কিছু হয়ে যায় তুমি আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারবেনা।ভেঙ্গে যাবে।ঐ শাওনকে আর কোনো সঞ্চারিণী এসে জোড়া লাগাতে পারবেনা।শাওন আর সময় নষ্ট করোনা!!মেধাকে বাঁচাও’

শাওন ততক্ষণে সবগুলো মেরে নিজেকে মুক্ত করে দৌড় লাগিয়েছে।মাথায় কি পরিমাণ রাগ ছিল তা শুধু সে জানে।ওর চোখের সামনে মেধাকে কষ্ট দিচ্ছে রেদোয়ান তা এতক্ষণ সহ্য করেছে সে।কি ভেবেছিল কে জানে!!
একটা বড়সড়ো ধাক্কা দিয়ে সে রেদোয়ানকে ফেলে দিলো ছুটে এসে।সঠিক সময়ে মেধাকে আঁকড়ে ধরে মাঝখানে নিয়ে আসলো।রেদোয়ান পড়ে গেছে পাহাড় থেকে।
পাহাড়ের কতটা উঁচুতে তারা তা তো কাল সকালেই জানা যাবে।

মেধা মুখে হাত দিয়ে শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।শাওন হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে বসে গেলো।রেদোয়ানের সঙ্গীরা সব অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।কেউ দেখলোনা রেদোয়ানকে কে ধাক্কা মেরেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শাওন মেধার দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হেসে বললো,’আমাদের জন্য একটি সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে মেধা’
-‘আপনি এটা কেন করলেন?’

-‘প্রথমে তুমি করলে।এরপর আমি।আমি সফল।আমাদের দুজনের জীবন বাঁচাতে ওকে যেতে হতো।ও থাকলে আমরা কখনও এক হতাম না।ও আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তারপর ছাড়তো।ভালে করলাম না?’
মেধা শাওনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বললো,’আমি রশ্নিকে দেখেছি তখন।সে বলেছে আপনাকে এমনটা করতে তাও জানি’
শাওন ও চোখ বন্ধ করে ফেললো।মেধাকে খুব শক্ত করে সে নিজেও ধরলো।কেঁদে ফেলে বললো,’একজনকে হারিয়ে যেতে দেখেছি, আরেকজনকে হারাতে দিতে পারি কি করে??তুমি যে আমার সঞ্চারিণী।’
সাজিদ আর মিলন ততক্ষণে এসে গেছে সাথে রকিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছে।
রকি এদিক সেদিক চেয়ে বললো,’সে কোথায়?’

সাজিদ আর মিলন ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখে বললো,’কে কোথায়?’
-‘না মানে কেউনা।যাকে কল করেছিলাম আর কি।মিঃA সে কোথায়?’
সাজিদ শাওনের কাছে এসে বললো,’মিঃA কে পেয়েছো?’
শাওন মাথা তুলে বললো,’মিঃA কে পেলাম না।ঐ যে তার লোকেরা আহত হয়ে পড়ে আছে।তাদের জিজ্ঞেস করে।আর হ্যাঁ রেদোয়ানের কেস সলভড্।কাল আশা আর রেদোয়ানের লাশ তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হবে।আশার পরিবার বলতে তো কেউ নেই।তার লাশের ব্যবস্থা আমরা করবো।মিডিয়াতে খবর দিয়ে দাও’
রকি বারবার রেদোয়ানকে খুঁজে যাচ্ছে।

পাহাড় থেকে নেমে সাজিদ আর মিলন ওকে ধরে গাড়ীতে ওঠালো।সাথে পাঁচ ছয়জন যত লোক ছিল তাদের ও উঠালো।ড্রাইভিং সিটে তারা বসে চললো কারাগারের দিকে।
মেধা আর শাওন রেদেয়ানের জিপে করে আসবে বলেছিল।
পথে রকি ষড়যন্ত্র করে কার থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেছে।সাজিদকে রেখে মিলন ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিল।রকি ছুটতে ছুটতে পাহাড়ে উঠে পেছনে তাকিয়ে জয়ের হাসি দিলো।হঠাৎ একটা পাথরের সঙ্গে হোচট খেয়ে সে নিজেও পড়ে গেলো পাহাড় থেকে।দুই ক্রিমিনালের শেষ পরিণতি।
মিলন অনেক খুঁজেও ওকে কোথাও না পেয়ে আবার কারের কাছে ফিরে আসলো।এই আসামীগুলোকে একা রেখে রকির খেঁজে যাওয়াও সম্ভব না।একটার জন্য সবগুলো পালাবে শেষে।

শাওন মেধাকে নিচ থেকে তুলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে জিপ অবধি এসে ওকে ভেতরে বসালো।মেধার পায়ের সঙ্গে লেগে জিপের একটা বক্স খুলে গেছিলো।তাতে একটা ছবি।এ্যামিলির ছোট বোন আর রেদোয়ানের।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মেধা ছবিটা ফেলে দিলো বাহিরে।
রেদোয়ানের এত বড় বাড়িটা শূন্য পড়ে আছে।তার কোনো বংশদর নেই।সমস্ত সম্পত্তি যদি রেদোয়ানের পরিবার এসে না নেয় তবে সরকারের আওতাধীন হয়ে যাবে।বাড়ির পেছনের জায়গায় আশার কবর।মেধা সেখানে এসে বসে আছে সবুজ ঘাসের উপর।হাতে এক তোড়া গোলাপ ফুল।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আশার কবরে হাত বুলিয়ে ফুলগুলোকে সেখানে রেখে বললো,’তোমার উপর যে অত্যাচার ওরা করেছিল তার যথাযথ প্রতিশোধ আমি নিতে পেরেছি কিনা জানিনা।হয়ত প্রথমবার যদি নকল রেদোয়ানের জায়গায় আসল রেদোয়ান থাকতো আমি আজ বেশি খুশি হতাম।তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমার বদলে শাওন নিয়েছে।

আমার সত্য সে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল আর আজ থেকে তার সত্যি আমি আজীবন লুকিয়ে রাখবো।আমি প্রতিশোধ নিই বা সে নিক কথা তো একই।
শুধু রেদোয়ান না,রকিও তার পাপের শাস্তি পেয়েছে।
আফসোস হয় তোমার জন্য, এসব তুমি দেখে গেলেনা,তোমার বাবা দেখে গেলেননা।
শুধুমাত্র নিজের পাপ গোপন রাখতে রেদোয়ান একের ওর এক কতগুলো খুন করেছিল।তোমার বাবা,এ্যামিলি,আরও কত মানুষ।সবার শেষ আমায় আর শাওনকে মারতে এসেছিল।শাওন বাধ্য হয়ে তাকে ধাক্কা দিয়েছে নাহলে আমি জানি শাওন এমনটা কখনওই করতোনা।সে নিজেই বলেছিল আমাদের জন্য একটা সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে।

যে মানুষটা আমার জীবন বাঁচাতে একটা মানুষের প্রাণ নিলো তার সেই সত্য আমি কারোর সামনে আসতে দেবো না কোনোদিন ও না।প্রয়োজনে আমি নিজের নাম নিবো।যদি তুমি থাকতে তবে আমার আনন্দ আজ একটা নাম পেতো।আমার নিজের প্রতি একটা ক্ষোভ রয়ে যাবে আমি থাকতে তোমায় মরতে হলো ঐ পশুগুলোর হাতে।তাদের খুব সহজ মৃত্যু হয়েছে।তোমাকে যে কষ্ট দিয়ে তারা মেরেছিল!!আমি যদি জানতাম রেদোয়ান বেঁচে ছিল এতদিন তো আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিতাম না ওকে’

-‘এবার ছাড়ুন ম্যাম।কেস সলভড্।এবার আর রেদোয়ানের নাম নিয়েননা।শাওনের নাম নেন।আর কতদিন এই অবলাজাতি শ্যাওলা স্যারকে তিলে তিলে মারবেন?ভালোবাসা দেবেন না নাকি?
নাকি আমি আমার ভূতুড়ে প্রেমিকার কাছে ফিরে যাব?’
মেধা মুচকি হেসে পেছনে তাকালো।ফুলগুলোকে ঠিক করে রেখে শাওনের হাত ধরে বললো,’চলুন যাই।ভালোবাসার অধ্যায় শুরু হোক’
শাওন মুখ এগিয়ে এনে মেধার কানে ফিসফিস করে বললো,’আমি কিন্তু খুনী।সাবধানে চলবেন মিসেস সঞ্চারিণী। চলুন এবার সত্যিকারের হানিমুনে চলি’

-‘প্লেস?’
-‘তুমি ঠিক করো’
-‘কাপ্তাই’
-‘হঠাৎ?।আচ্ছা তোমার ইচ্ছা যখন সেখানেই যাবো নাহয়’
——-
বাসার সবার সাথে মিলে আজ হালকা পাতলা একটা অনুষ্ঠান করা হলো।আত্নীয় স্বজনেরাও কজন এসেছেন।আনন্দের উৎসব।কেস সলভড্ তাই সবার মুখে শাওন আর মেধাকে নিয়ে প্রশংসা।
কেউ কেউ বলছে মেধা আর শাওনের ছেলে মেয়ে যেই হোক না কেন বড় হয়ে পুলিশ নয়ত গোয়েন্দা হবে।যে বুদ্ধি ওদের দুজনের।তাদের বাচ্চার তো আরও বেশি বুদ্ধি থাকবে।

সবাই চলে গেলো বিকালের দিকে।শাওন আর মেধাও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
একটা হোটেলের রুম নিয়েছে তারা।রুমে আসার পর শাওন ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছিল।বাস জার্নি তেমন একটা করা হয়না।অবস্থা টাইট হয়ে গেছে।তাড়াহুড়ো করে মুখ ধোয়ার জন্য দৌড় মেরেছে সে।
মেধা ফোন হাতে নিয়ে গোলগোল ঘুরাচ্ছে।একটা বিরাট বড় চিন্তা তাকে ভেতরে ভেতরে খাচ্ছে।এই চিন্তাকে একেবারে নিঃশেষ করে তারপর সে শান্তির ঘুম ঘুমাতে পারবে।

ফোন রেখে গিয়ে জানালার গ্লাস খুলে বাহিরেটা দেখছিল মেধা।সেখানে একটা পাহাড়।আনমনে অনেকক্ষণ ধরে পাহাড়টা দেখে যাচ্ছিল সে,হঠাৎ শাওন এসে ওর কোমড়ে হাত রেখে টেনে ধরলো।মেধা চমকে কেঁপে উঠেছে।
শাওন দুহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,’আর কিসের ভয়?’
-“নাহ।কিছুনা’
শাওন মেধাকে কোলে তুলে নিয়েছে হাসিমুখে। শাওনের হাসিমুখ মেধার মনের ভয়টাকে আরও বেশি করে নাড়া দিচ্ছে।

ওকে বিছানায় রেখে গিয়ে খোলা জানালাটা আবার বন্ধ করে আসলো শাওন।
মেধা তার ফোনটা ধরতে যেতেই শাওন ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে টেবিলে রেখে বললো, এখানে আর ফোন নয়।অফিসের কোনো কাজ নয়,প্রাক্তন ও নয়,ভিক্টিম ও নয়।শুধু আমি তুমি’
এরপর থেকে শাওন মেধাকে একবারের জন্যও ফোন ধরতে দেয়নি।সে তো জানেই না মেধা কেন বারবার ফোন ধরতে চাইছে।

রাত বাড়ার পর শাওনের চোখে ঘুম নেমে আসার পরপরই মেধা চট করে বিছানা ছেড়ে ট্রলি ব্যাগ খুলে নিজের জ্যাকেট বের করলো।এতক্ষণ ধরে শাওনের ঘুমের অপেক্ষা করছিল সে।প্রহর গুনছিল শাওনের চোখে ঘুম নেমে আসার,আর শাওন ওকে তার বদলে ভালোবাসার প্রহর উপর দিচ্ছিলো।কষ্ট হচ্ছিল শাওনকে পাগলামি করতে দেখে,কারণ মেধা আদৌ জানেনা এই পাগলামি আর কখনও সে দেখতে পাবে কিনা।
পাহাড়ি অঞ্চলে শাড়ী পরে চলাচল করা যাবেনা।যে কাজে যাচ্ছি সে কাজ শাড়ী পরে সাধন হবেনা।
চুলে ক্লিপ লাগিয়ে জ্যাকেট পরে মেধা দরজার কাছে এসে একবার পেছনে তাকালো।শাওন চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে।
ওর দিকে মলিন চাহনিতে দু মিনিট চেয়ে রইলো মেধা।আস্তে করে বললো,’আমাদের জন্য অবশ্যই একটা সুন্দর জীবন অপেক্ষা করছে শাওন।আমি সেটার সিওরিটি দিতেই এখন বের হচ্ছি’

দরজা খুলে চলে গেলো সে।তার ঠিক দশ মিনিট পরেই শাওনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ।রাত তখন এগারোটা বাজে।পাশে মেধাকে না দেখে উঠে বসলো সে।ওয়াশরুমে সে নেই।দরজা ও খোলা দেখে শাওনের আর বোঝা বাকি নেই যে মেধা কোথাও একটা গেছে।বিছানা থেকে নেমে নিজের কোট খুঁজে পরতে পরতে বের হয়ে গেলো সে রুম থেকে।ওকে ফোন করতে করতে ছুটলো হোটেল থেকে বেরিয়ে।ঠিক কোনদিকে গেছে তার কিছুই সে জানেনা।বুদ্ধি করে ফোনে মেধার ছবি খুঁজে আশেপাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করা শুরু করলো শাওন।আজ দুপুর থেকে মেধার আচরণ মোটেও ঠিক লাগছিল না।কিছু একটা হয়েছে তা সে বুঝতে পেরেছিল।কিন্তু মেধার মনের কথা জানা কত কঠিন তা মালদ্বীপের কথা মনে পড়লে সোজা বোঝা যাবে।একটা কাপল হোটেলের সামনে খোলা রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে বসেছিল।শাওন ওদের ছবি দেখাতেই ওরা চিনে বললো,’এই মেয়েটাকে ঐ পাহাড়ের দিকে ছুটে যেতে দেখেছে তারা’

শাওন ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিকে গেলো।মেধার ফোন বাজছে কিন্তু সে ধরছে না।
——-
-‘আমি জানতাম এত সহজে সুখের দেখা আমি পাবোনা।তবে আমি আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এই কারণে যে এত বড় সুযোগ আমার জন্য রয়ে গেলো।আশার খুনীকে নিজের হাতে মারবো বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।আমার জায়গায় শাওন মেরেছে বলে আফসোস করছিলাম এখন সে আফসোস আর হবেনা।আমার ইচ্ছা আজ পূরন হবেই হবে’
রেদোয়ানের হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ।সে মাটিতে বসেছিল
মেধাকে দেখে পিছোতে পিছোতে বলছিল, ‘আমাকে না মারলে আমি তোমায় টাকা দিয়ে মুড়িয়ে দেবো।’
মেধা রিভলবার ওর দিক তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল।

রেদোয়ানের সন্ধির কথা শুনে হাসলো সে।হাসতে হাসতে বললো,’তাহলে দুপুরবেলা আমাকে ফোন করে হুমকি কেন দিয়েছিলে??আসলে কি হয়েছে জানো??তুমি আজ মরতেই।মরা কাছে টেনে আনার জন্য নিজেই আমাকে ফোন করে হুমকিটা দিলে।তুমি হয়ত ভুলে গেছো আমি একজন ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার।ফোন নাম্বারের লোকেশান জানতে আমার বেশি সময় লাগেনা।তুমি ভাবছো তোমার হুমকি শুনে আমি ভয়ে চুপসে যাব??আরে বোকা আমি তখন ফোনের লোকশান যাচাই করতে ব্যস্ত ছিলাম।কাকে হুমকি দাও তুমি??তোমাকে কই ধাপে মারতে এসেছি সে খেয়াল আছে তোমার??

আজ শাওন না!আজ আমি আবার তোমায় মারবো।এবং এইবার আমি সফল হবোই।আশা ঠিক এইভাবে মিনতি করেছিল তোমার কাছে।কই তাকে তো তুমি ছেড়ে দাওনি???
আশা আমার কাছে রিকুয়েস্ট করেছিল তার জীবন যেন আমি তোমার থেকে বাঁচাই,আর আজ তুমিও রিকুয়েস্ট করছো!!আশাকে তো বাঁচাতে পারলাম না!!
তার কারণ যেহেতু একমাত্র তুমি।তোমায় আমি কেন যেতে দেবো?’
শাওন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপিয়ে গেছে।এমন দৃশ্য দেখে চিৎকার করে বললো,’মেধা স্টপ! শুট করবানা।’
মেধা শাওনের দিকে তাকালোনা।চোখ সরালে রেদোয়ান কি চাল চালতে পারে তা ওর জানা আছে।যে রাক্ষস এত উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে মরেনি।সিঁড়ি থেকে পড়ে মরেনি।সে এখন মিনতি করার নাটক করে আর কিছু করবেনা তা কি করে বিশ্বাস করা যায়??

শাওন ছুটে এসে মেধার হাত থেকে রিভলবার নিতে যেতেই ও মাটিতে পড়ে গেলো সরে দাঁড়াতে গিয়ে।শাওন নিচে হাঁটু গেড়ে বসলো হাত থেকে রিভলবারটা নেবে বলে।মেধা আঙুল তুলে বললো, ‘আপনার পায়ে পড়ি আমাকে আজ বাধা দেবেন না।এটা আমাকে করতেই হবে’
-‘একজন খুনী হয়ে বেঁচে থাকা কতটা গ্রহণযোগ্য তোমার কাছে?আশা দেখবে তোমার এই প্রাপ্তি?আমার কথা শোনো মেধা।”

মেধা শুট করে দেওয়ার আগেই শাওন ওর হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে নিলো।রেদোয়ান পালিয়ে গেছে ততক্ষণে।
মেধা উঠে দাঁড়িয়ে শাওনের হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে আবার ছুটেছে।আজ না মেরে কিছুতেই ছাড়বেনা বলে পণ করে রেখেছে।রেদোয়ান যেতে যেতে রোডের মাঝখানে চলে আসলো।একবার পেছনে তাকাচ্ছে তো আবার সামনে।
শাওন মেধাকে আটকাতে ছুটছে।
মেধাকে সে কিছুতেই খুনী হতে দেবেনা তা ভেবে ঠিক করে নিলো তাই কোনোদিকে নজর না দিয়ে মেধাকে ধরতে ছুটছে একমাত্র।মেধা থেমে গিয়ে রিভলবার সামনে ধরে রেদোয়ানকে পয়েন্ট করে শুট করতে যাবে ঠিকসেময়ে একটা ট্রাকের ধাক্কায় রেদোয়ানের এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো।

শাওন মেধার হাত থেকে ততক্ষণে রিভলবারটা নিয়ে জঙলের দিকে ছুঁড়ে মেরেছে।রেদোয়ানের স্পটডেথ।
পাহাড় থেকে পড়ার পর রেদোয়ান আহত হয়েছিল।একটা পাহাড়ী পরিবারের কাছে আশ্রয় নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে সে মেধাকে দুপুরের দিকে ফোন করে হুমকি দিয়েছিল, মালদ্বীপ চলে যাবার আগে মেধাকে আর শাওনকে মেরে তারপর যাবে।তার শরীররে প্রতিশোধের আগুন। এসব বলে ফোন কেটে দিয়েছিল।অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিল সে।এটা ছিল প্রথম ভুল।দ্বিতীয় ভুল ছিল যে
পাহাড়ীদের নাম্বার থেকে কল করেছিল বলে সিমটাকে সে নষ্ট করতে পারতোনা।মেধাকে কল করে তার পি.একে ফোন করতে সে ব্যস্ত ছিল।

সঞ্চারিণী পর্ব ৫২+৫৩+৫৪

ততটুকু সময়ে মেধা ড্রাইভ করে কল সেন্টারের অফিসে এসে ট্র্যাক করে লোকেশান বের করে ফেলেছিল। এসব কিছুই শাওনকে সে জানায়নি।সে জানতো শাওন জানলে কিছুতেই তাকে এটা করতে দেবেনা।
মেধার রাগ হলো, খুব রাগ!! নিজের হাতে মারার ইচ্ছা টুকু পূরণ করতে সে পারলোইনা।রেদোয়ানের এমন মৃত্যু হলো!!
রেগে মেগে কাছে গিয়ে ওর হাতের নাড়ি চেক করে দেখলো সত্যি সত্যি মরেছে কিনা, না মরলে আজ সে মেরে তারপর বাড়ি যাবে।

শাওন হাঁপ ছেড়ে বেঁচে মেধাকে জোর করে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসলো।রাত অনেক হয়েছে।সেখানকার পুলিশেরা এসে লাশ মর্গে নিয়ে যাচ্ছে।শাওন আর মেধাক চিনেছে তারা।কিছু আলাপ আলোচনাও করেছিল।
অফিসের বাকিদের কাছে খবর পৌঁছে গেলো আসল রেদোয়ান চট্টগ্রামে দূর্ঘটনায় মারা গেছে।এটাও প্রমাণ হলো আশার পরে যতগুলো মার্ডার হয়েছে সবগুলোতে রেদোয়ানের হাত ছিল।রকি পাহাড় থেকে পড়ে মরেছে।তার লাশ ও পুলিশ নিয়ে গেছে।
মিঃরেদোয়ানের কেস ফাইনালি এন্ড অফিসিয়ালি সলভড্।রেদোয়ানকে শাওন মারেনি,মেধাও মারেনি।