চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ১০

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ১০
লেখনীতে- নন্দিনী নীলা

দুইদিন পর আজ আপুর আমাদের বাসায় আসবে। রাগ করে আমি আনতেও যায় নি। আমি আর আম্মু নানু ছাড়া সবাই চলে গেছে। আমি রুমে বসে মিষ্টি দের সাথে গ্ৰুপ কলে কথা বলছি। ওদেরকে ইতি মধ্যে জানানো হয়ে গেছে বিয়ে খবরটা। ওরা তখন চিল্লাচিল্লি করে বলতে লাগল,
‘ এই ভাবে লুকিয়ে দুজন বিয়ে করে নিলি। আমাদের কতো শখ ছিল বান্ধবী আর স্যারের বিয়ে খাব ইনজয় করবো। স্যারকে দেখলে এমনিতেই তো ভয় পাই। আর তিনি যা অত্যাচার করেছে তার সুদ একমাত্র বিয়ে খেতে গিয়ে করতে পারবো। তখন তিনি না থাকবে আমাদের স্যার আর না শাসন করতে পারবে। সব বানচাল করে এমন করে বিয়ে করে নিলি।’
ওদের কথার উত্তরে আমি বললাম,

‘ এই ভাবে বিয়েতে আমার ও মত ছিল না। কিন্তু আমার সাথে কিচ্ছু টি ছিল না। সবাই আমার সাথে গেইম খেলেছে।’
আমি ওদের সব বললাম।আমাকে আগে থেকে এসব কিছু না জানানো‌। স্পর্শ নাকি বাবাকে কিসব বলে রাজি করিয়েছে। সব শুনে ওরা উল্টা পাল্টা কথা বলতে লাগলো। অতিরিক্ত ভালোবাসে তাই এমন হন্তদন্ত হয়ে বিয়ে করেছে। আরো কতো কি আমি রেগে কল কেটে দিলাম। আর একটা পরিক্ষা আছে সেটা আর ও তিনদিন পর‌।
মেজাজ গরম করে আমি ছাদে চলে এলাম। মনটা একটু ভালো করার আশায় কিন্তু এখানে এসে আমায় শয়তান রিয়াদ এর সাথে দেখা হলো। রিয়াদ এবার ক্লাস সেভেনে পরে খুব পাজি আমাকে জ্বালিয়ে অতিষ্ঠ করে নিচে পাঠালো। মন ভালো হোক তোর ব্যবস্থা করবো শয়তান।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিকেল থেকে তৈরি হচ্ছে জামাইয়ের জন্য ভিন্ন ধরনের পিঠা। ভাইয়ারা সন্ধ্যার আগেই এলো ‌ এদিকে স্পর্শ এসে হাজির। আজকে আর আমার শাশুড়ি শশুর আসে নি। আর না এসেছে সীফা। স্পর্শ একাই এসেছে। দুলাভাই আব্বু স্পর্শ আর আমার বড় মামা বসে গল্প করছে। তাদের সামনে ভিন্ন ধরনের পিঠা। আপু আমার পেছনে পেছনে ঘুরেছে আসার পর থেকে আমি কথা বলছি না। এবার টেনে আমাকে নিজের রুমে নিয়ে গেল,
‘ আমার সাথে কথা বলছিস না কেন? তুই কি হয়েছে তোর?’
‘ কিছু না‌। কি আবার হবে।’
‘ তুই বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমার সাথে কেন রাগ করে আছিস এতে আমার কি দোষ। আর তুই তো স্পর্শকে পছন্দ করিস ভালো ও বাসিস তাহলে বিয়েতে সমস্যা কি?’
‘ কোন সমস্যা নাই। ‘

‘ তাহলে এমন করে আছিস কেন? মা বললো তার সাথেও নাকি রাগারাগী করেছিস। এখানে আমাদের কারো দোষ নাই। স্পর্শ বাবার সাথে কথা বলে আমার গায়ে হলুদের রাতে রাজি করিয়েছে। আমি মা বিয়ের দিন সকালে জেনেছি। তোকে জানবে বলেও জানানো হয় না। আর বিয়ে একদিন আগে পর হতো হয়ে গেছে ঝামেলা শেষ। তোকে তো এখন আর ওই বাসায় গিয়ে ব‌উ হয়ে থাকতে হবে না। ওসব হবে আরো ছয় মাস পর তোর ইন্টার পরীক্ষার পর। তাই নো চিন্তা। আর এখন স্পর্শ ও তোর সাথে টাইম স্পে করতে পারবে দুজনে প্রেম করতে পারবি। আজ মনে হয় স্পর্শ থাকবে আমি আর তোর মাহিন ভাই তো ভেবেছি তোদের বাসর সাজিয়ে ফেলবো।’
আপুর উত্তেজিত হয়ে বললো। আমি রাগে গজগজ করে আপুর সামনে থেকে চলে এলাম। উদ্দেশ্য নিজের রুমে যাওয়া। এসব কিচ্ছু করতে আমি দেব না। ওই লোকটার সাথে এক রুমে আমি থাকবোই না তার আবার বাসর। আমি এখনি দরজা আটকে ঘুমিয়ে পরবো শত ডাকলেও দরজা খুলবো না।

আমি রাগে গজগজ করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে আপুর রুমে থেকে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরলাম। তখন আমার চিন্তা চেতনা জুড়ে ছিল স্পর্শ আর আমার বাসর নিয়ে। এইভাবে বিয়েটা না হলে কতো জল্পনা কল্পনা টাই না করেছিলাম। কিন্তু এখন আমার রাগ লাগছে এসব শুনে। আমি এসব আকাশ পাতাল ভেবে হাঁটছিলাম তখন কারো সাথে জোড়ে একটা ধাক্কা খেলাম। আমি চোখে বাড়ি খেয়ে ব্যাথা পেয়ে আহ করে উঠলাম। সামনে লোকটা আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরে আছে। তার কড়া পারফিউম এর ঘ্রান আমার নাকে এসে বাড়ি খেলো। এটা তো স্পর্শের পারফিউমের গন্ধ। আমি ফট করে চোখ মেলে তাকালাম। সাথে সাথে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। আঘাত পেয়ে চোখে পানি চলে এসেছে।

স্পর্শ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আর ইউ ওকে?’
আমি কটমট করে তাকিয়ে ঝামটা মেরে স্পর্শকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর স্পর্শ এর কথার উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। স্পর্শ আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে র‌ইল।
আমি রুমের সামনে এসে চমকে উঠলাম। দরজায় তালা ঝুলানো। আমি মা মা করে চলে গেলাম। মা নাকি জানে না কে তালা দিছে। আমি নিশ্চিত আপুর কাজ এসব। আমি আপুর কাছে গেলাম।
চাবি চাইলাম। কিন্তু দিল না। তার কাছে নাকি নাই। অনেক জোর করার পর স্বীকার করল কিন্তু চাবি নাকি মাহিন ভাইয়ার কাছে। তার কাছে আমি কি করে চাইবো রাগ করে আপুর রুমে বসে রইলাম। আপু চলে গেছে আমিই বসে আছি তার রুমে। আজ এই রুমেই আমি ঘুমাবো। উঠে দরজা আটকাতে যাব তখন মাহিন ভাইয়া এলো রুমে।
আর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কি ব্যাপার শালিকা তুমি রুমে লুকিয়ে আছো কেন? দেখা করলে না কথা ও বললে না।’

‘ না মানে আসলে আমার মাথা ব্যাথা করছিল তাই‌। কিন্তু আপনি আমার রুম নাকি আটকে রেখেছেন কেন দুলাভাই‌!’
‘ চলো খেয়ে নেয় তারপর তোমার রুমের চাবি দিবো।’
‘ ওকে চলুন।’
মাহিন ভাইয়ার সাথে খেতে আসতে হলো। আপু, স্পর্শ আব্বু মামা বসে আছে। ভাইয়া গিয়ে আপুর পাশে বসে পড়ল। আমার এখন স্পর্শের পাশেই বসতে হবে। কারণ একটা চেয়ার খালি আছে তা-ও সেটা স্পর্শের পাশে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসতে হলো।
তীব্র অস্বস্তি নিয়ে খাবার খেলাম। তারপর সবার আগে খাওয়া শেষ করে পাশে দাঁড়িয়ে র‌ইলাম রুমের চাবির জন্য। কিন্তু খাওয়া শেষ করেও ভাইয়া চাবি দিল না আমাদের নিয়ে এই রাতের বেলা ছাদে আমি আপু স্পর্শ আর ভাইয়া চারজন। আমি তো আসব‌ই না। কিন্তু ভাইয়া অনেক অনুরোধ করলো না শুনেও পারলাম না। তখনো জানতাম না স্পর্শ আসবে আসার পর জানতে পারলাম।

ছাদে আসার একটু পর‌ই মাহিন ভাইয়া স্পর্শের হাতে চাবি দিয়ে বলল,
‘ যাও তোমার ব‌উকে খুব জ্বালিয়েছি চাবি নিয়ে। এবার শান্তিতে দুজন যেতে পারো।’
স্পর্শের হাতে চাবি দিতে দেখে আমার মাথাটা ঘুরে ওঠল। আমি আজ রুমে যাব‌ই না দরকার পরলো এই ছাদেই সারা রাত থাকবো। দাঁত কিড়মিড় করে আমি আপু আর মাহিন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। শক্ত হয়ে রেলিং এ হাত রেখে দাড়ালাম। সবাই মিলে আমার সাথে গেইম খেলছে।
এর মাঝে স্পর্শ ফট করেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ছাদ থেকে। টেনেই আমাকে রুমে নিয়ে এলো। আমি চিৎকার করতে গিয়ে ও পারলাম না। আব্বু আম্মু শুনতে পারবে না হলে। তাই চুপ থেকেই হাত দিয়ে খামচি দিলাম স্পর্শের হাতে।

স্পর্শ তবুও টু শব্দটি করলো না। রুমে ঢুকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিজেও ঢুকে পরলো আর দরজা ঠাস শব্দ করে আটকে দিল।
আমি হেলে পরলাম বিছানায়। স্পর্শের ব্যবহারে হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালাম। আর ক্রোধান্বিতো
গলায় বললাম,
‘ আপনার সাহস তো কম না বিয়ে হতে আমাকে আঘাত করছেন।’
স্পর্শ আমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে বললো,
‘ তোমার সমস্যা কি সত্যি করে বলো তো। আমার সাথে বিয়ে হয়েছে বলে? আমাকে কি তুমি তাহলে পছন্দ করতে না। আমি তোমার চোখে আমার জন্য যে ভালোবাসা দেখেছিলাম সেসব মিথ্যা ছিল?’
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। তাই চুপ করে আছি। স্পর্শ আমার কাঁধ চেপে ধরে বলল,
‘ প্লিজ এ্যান্সার মি। মেইন প্রবলেম কি বলো আমাকে। আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে বলে যদি তুমি অসন্তুষ্ট থাকো বলো। আমি তোমাকে এই ভাবে দেখতে পারছি না। তোমার খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। শুধু ছাড়তে পারবো না।’

আমি কাঁধে ব্যাথা পাচ্ছি উনার এমন ভাবে ধরায়। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
‘ ছাড়ুন আমাকে। ‘
স্পর্শ আগের মতো করেই বলল, ‘ বললাম তো সব করতে পারবো। শুধু তোমাকে ছেড়ে হ্যাপি করতে পারব না। আই এ্যাম সরি।’
বলেই স্পর্শ আমাকে ছেড়ে বেলকনিতে চলে গেল। আমি থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সেদিকপানে। রুমটা সত্যি বাসর ঘরে পরিণত করেছে। আমি দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে ফুল গুনছি। ফুলের গন্ধে মম করছে।
স্পর্শ পাঁচ মিনিট পরে রুমে এসে বলল,
‘ ফুলের গন্ধে আমি রুমে থাকতে থাকতে পারছি না। এগুলো পরিষ্কার করো দ্রুত।’
আমি অবাক চোখে দেখলাম স্পর্শ কে।
‘ আমি পারবো না আপনার প্রবলেম আপনি সলভ করেন।’

স্পর্শ আমার দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ বুঝতে পেরেছি তুমি কি আমার সাথে বাসর করতে চাইছো নাকি। কিন্তু আমি চাইছিলাম না এখনি এসব করতে। যা করার আমাদের বাড়ি নিয়ে করবো। কিন্তু তুমি যদি….
‘ স্টপ‌ ইট‌। আপনি আপুদের সাথে প্লান করে এসব করেছেন আমি কিছু জানি না বুঝেছেন। এখন পার্ট নিচ্ছেন। আপনার মতলবটা আমি খুব ভালো করে জানি।’
স্পর্শ আমার কথা শুনে আমার গা ঘেষে দাড়িয়ে বলল,
‘ তাই এতো চিনে গেছো আমাকে। গুড গার্ল‌। হাজবেন্ড কে চেনা ভালো। তো এখন আমার কি করা উচিত সাজানো খাট সামনে এমন সুন্দরী ব‌উ আমি কি কাজে লেগে পরবো। ‘
বলতে বলতে স্পর্শ আমার কপালে হাতের স্পর্শ করে চুল সরিয়ে আমার দিকে মুখ এগিয়ে আনতে লাগলো। আমি ভয়ে আতকে উঠলাম। দু হাত স্পর্শের বুকে রেখে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
‘ অসভ্য লোক‌‌। আমার কাছে আসতে চাইলে খুন করে ফেলবো।’

স্পর্শ হাসতে হাসতে বলল, ‘ তোমার প্রেমে আমি কবেই খুন হয়ে গেছি নতুন করে আর কি খুন করবে। এখন চুপচাপ বিছানা পরিষ্কার করো আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। শশুর বাড়ি প্রথম নাইট বলে কথা। এখন কথা না শুনলে বাসর এখনি সেরে ফেলবো কিন্তু।’
রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার কাজ করতেই হলো। আমি মর্য়লার জুড়িতে ফেলে দেখি স্পর্শ গায়ে শার্ট প্যান্ট খুলে ট্রাউজার আর ট্রি শার্ট পরে এসেছে। তারপর বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পরলো। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বললাম,
‘ আপনি বিছানায় কেন শুয়েছেন? আমি কোথায় ঘুমাবো?’
স্পর্শ চোখ বন্ধ করে ছিল। আমার কথায় চোখ খুলে বিছানার আরেকপাশে দেখিয়ে বলল,

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ৯

‘ এই যে আমি। আমি সিঙ্গেল ঘুমানোর মতো করে সম্পূর্ণ বিছানায় তো দখল করিনি। অর্ধেক জায়গা তোমার জন্য রেখেছি। দেখছো না?’
‘ আমি আপনার সাথে ঘুমাবো?’ অবাক হয়ে।
‘ ইয়েস। নাহলে আমি এই রুমে কেন আসলাম।’
‘ আপনার মতো নির্লজ্জ তো আমি না। আমি আপনার সাথে ঘুমাবো না। আপনি উঠুন আমার বিছানায় থেকে‌।’

চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব ১১