চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১১

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১১
Writer Asfiya Islam Jannat
 ফিনফিনে কালো রঙের ইয়ারফোনটি কানে গুঁজে, হাতে এককাপ ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে বারান্দায় এসে বসে স্পর্শী। শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় সাঁঝ আকাশে। এক ফোটা রক্তিমা ছেঁয়ে আছে শুভ্র মেঘের কোলে। উড়ন্ত পাখির দল ছুটছে নিজ গন্তব্যে। স্পর্শী সেদিকে তাকিয়েই আনমনে কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মুহূর্তেই জিহ্বা পুড়ে যায় তার কফির উত্তাপে। বিতৃষ্ণায় স্পর্শী কফি কাপের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, যেন সব দোষ কফির। কিছুক্ষণ সেই ভঙ্গিতেই তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে। পুনরায় ঠোঁট ছোঁয়ায় কফিতে। হঠাৎ তার হাতে থাকা  মুঠোফোনটি বেজে উঠে। স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। কৃত্রিম আলোকরশ্মি পর্দায় ইংরেজি অক্ষরে টাইপ করা ‘নিধি’ নামটি ভাসছে। স্পর্শী ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার পূর্বেই বলে উঠে,
— দোস্ত! আমি বিয়া করুম। এই পড়ালেখা আমার দ্বারা হচ্ছে না।
স্পর্শী বিরক্তিতে মুখ গুচে বলে, “আবার শুরু হইসে তোর ঘ্যানঘ্যানানি?”
— আরেহ দোস্ত এইবার আমি সিরিয়াস। একদম পাক্কা সিরিয়াস। শেখ হাসিনা যেমন পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সিরিয়াস তেমনই আমিও বিয়া নিয়া সিরিয়াস। বিয়া আমি এইবার কইরাই ছাড়ুম।
— কারে করবি বিয়ে শুনি?
— এখনো ঠিক করে নি তবে অতি দ্রুত করে ফেলবো। আর তোরা আছিস কি করতে? আমার জন্য এখনই ছেলে দেখা শুরু কর। জটপট!
—  পরীক্ষা আসলেই তোর বিয়ে করার ক্যারা উঠে কেন শুনি?
–শুন, পরীক্ষা দেওয়ার চেয়ে বিয়ে করে সংসার সামলানো বেশি সহজ বুঝলি। সংসার চালাতে এট লিস্ট এই বিক্রিয়ার চক্করে মস্তিষ্কের বিস্ফোরণ তো হয় না।
স্পর্শী এইবার রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “তুই আমার মাথা না খাইয়া পড়তো। পড়বি না তো কিছু না, আমার মাথাটা খাবি। রাখ ফোন!”
— আচ্ছা শুন না! পঞ্চম অধ্যায়ের লাস্ট বিক্রিয়াটা বুঝিয়ে দে না।
স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বলে, “তুই পঞ্চম অধ্যায় দিয়ে কি করবি? পরীক্ষা তো সপ্তম অধ্যায় আর ম্যামের দেওয়া নোটসের উপর।”
নিধি তটস্থ কন্ঠে বলে, “এ্যাঁহ! আমি তাইলে হুদাই এতক্ষণ লাগাইয়া এই অধ্যায় করতাম?”
স্পর্শী নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
নিধি এইবার কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে, “দোস্ত এইবার আমি সত্যি বিয়াই করুম। পড়ালেখা জাস্ট আমার দ্বারা একদমই হবে না। বিশ্বাস কর।”
স্পর্শী নিঃস্পৃহ কন্ঠে নিধিকে একটা কটুকথা শুনিয়ে ফোনটা খট করে কেটে দেয়। উগ্র মেজাজেই ঠোঁট ছোঁয়ায় কাঁপে। পরক্ষণেই বুঝতে পারে নিধির চক্করে কফি চিনির শরবত হয়ে গিয়েছে। চিনি ব্যতীত স্বাদ নেই কোন। স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, রান্নাঘরের দিকে এগোয় কফিটা গরম করতে।
রান্নাঘরে এসে চুলোয় কফি চড়াতেই সাহেলা এসে হাজির হন। একপলক চুলোর দিকে তাকিয়ে বলেন,
— কাজ শেষে রুমে আসিস তো কথা আছে।
স্পর্শী চুলোর দিকেই মনোযোগ দিয়ে বলে, “আচ্ছা।”
সাহেলা চলে যেতেই স্পৃহা আসে রান্নাঘরে। আড়চোখে একবার স্পর্শীকে দেখে এগিয়ে যায় শেল্ফের দিকে। উপরের থাক থেকে একটা প্লাস্টিকের বক্স নামিয়ে তার ভিতর থেকে এক প্যাকেট চিপস নিয়ে বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত না হতেই আবার ফিরে আসে সে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
“আপু আমার বায়োলজি প্রেকটিক্যালটা একটু করে দিবা?”
স্পর্শী কাপে কফি ঢেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় স্পৃহার দিকে। নিঃস্পৃহ কন্ঠে বলে, “নিজের কাজ নিযে কর, আমাকে বলিস কেন? বিনা বেতনের চাকর পাইছিস যে তোর সব কাজ করে দিব?”
“এমন করিস কেন? একটু দে না।”
স্পর্শী স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে, “আমি এখন ব্যস্ত। পরীক্ষা চলছে আমার। কোন রকম প্রেকটিক্যাল-মেকটিক্যাল করার টাইম নাই আমার। এখন ফুট এইখান থেকে।”
স্পৃহা কথা বাড়ালো না। ভেংচি কেটে বিরবির করতে করতেই জায়গাটি প্রস্থান করলো। স্পর্শীও কফির কাপটি হাতে নিয়ে ছুটলো সাহেলার রুমের দিকে।
“নির্বাণের মা চাইছেন তুই যেন তাদের সাথে তার আত্মীয়ের বিয়েতে যাস। তোর কি কোন আপত্তি আছে যেতে?”
সাহেলার প্রশ্নে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়। নির্বিকার কন্ঠে বলে, “সমস্যা নেই তবে আমার পরীক্ষা চলছে।  এখন যেতে পারবো না।”
সাহেলা ধাতস্থ হয়ে বলেন, “হ্যাঁ জানি। বলেছিলাম তাকে, তিনি বললেন নির্বাণও নাকি এখন যাচ্ছে না। পরে যাবে। আর যাওয়ার সময় তোকে সাথে নিয়েই যাবে বলেছে।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না, নীরবেই মাথা নাড়ালো শুধু। সাহেলা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার প্রশ্ন করলেন, “তোর নির্বাণের সাথে যেতে কোন সমস্যা আছে? আমি কি বলবো তুই যাচ্ছিস?”
স্পর্শী অনুরাগহীন কন্ঠে বলে, “না নেই। তুমি বলে দাও তাদের।”
সাহেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। অতঃপর কিঞ্চিৎ হেসে স্পর্শীর তাকিয়ে বলেন, “আচ্ছা তাহলে আমি তাদের জানিয়ে দিচ্ছি।”
শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে বের হতেই স্পর্শী অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় চারদিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে বন্ধুদের আড্ডামহলে। বাকিরা আগে ভাগেই পরীক্ষা শেষ করে ছুটেছে বটমূলের দিকে।
যাওয়ার পথেই কিঞ্চিৎ দূরবর্তী একস্থানে স্পর্শীর দৃষ্টি আঁটকায়। নিমগাছের শৈথিল্য ছাউনির নিচে দাঁড়ানো তাপসি আর নির্বাণের দিকে। কোন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে দুইজন। তাদের দুইজনকে একত্রে দেখামাত্র স্পর্শী থমকায়, প্রগাঢ় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে দুইজনকে। একমনে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের পানে৷ বেশ কিছুটা সময় এইভাবেই অতিক্রম হওয়া মাত্র কোথ থেকে কেয়া এসে হাজির হয় স্পর্শীর সামনে। ডান হাতে তুরি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কি রে এইখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
স্পর্শী একপলক কেয়ার দিকে তাকিয়ে পুনরায় নির্বাণের দিকেই তাকিয়ে বলে, “এভাবেই।”
কেয়া স্পর্শী দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে বলে, “কাকে দেখছিস তুই?”
স্পর্শী দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “কাউকে না।”
কেয়ার নজর হঠাৎ তাপসি আর নির্বাণের উপর এসে স্থির হতেই সে বলে উঠে, “এই এইটা হিটলার আর লেডি হিটলার না?”
স্পর্শী স্মিথ কন্ঠে বলে,  “হুম, হয়তো।”
“এই দুইজন এইখানে কি করে? এক্সামে বাঁশ দিয়ে মন ভরে নাই যে এখন আমার নতুন প্ল্যানিং করতে লেগে পড়সে?”
“চুপ থাক।”
“চুপ থাকলেও কি হবে? জানিস আমার পরীক্ষার অবস্থা যাচ্ছে তাই। এত হার্ড প্রশ্ন কেউ দেয়? এই দুইজনের কোন পাঁকা ধানে মই দিসিলাম আমি? এমন শুক্রামিপানা করে কে?”
“তারা সবসময়ই হার্ড কুয়েশ্চন করে। জানা কথা।”
“হুম! জীবনটাই তেজপাতা করলো এরা। দোয়া দিলাম এদের কপালে যেন দজ্জাল বা শাকচুন্নি জীবন সঙ্গী পড়ে। অথবা দুইজনের সাথে দুইজনের বিয়ে হয়ে হিটলার ময় জীবন হয়।”
কথাটা শুনে স্পর্শী চোখ পাকিয়ে তাকায় কেয়ার দিকে। কর্কশ কন্ঠে বলে, “বাজে বলা বন্ধ কর।”
“তোর গায়ে লাগে কেন এত? তোরে কিছু কইসি আমি?”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। শুধু নীরব দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো নির্বাণকে। অকস্মাৎ কেয়া বলে উঠে, “তবে দুইজনকে খারাপ মানায় না পাশাপাশি। কাপল হিসাবে ভালোই লাগবে তাদের।”
কথাটা স্পর্শী কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হওয়া মাত্র স্পর্শী ক্রোধে ফেটে পড়ে। তীব্র কন্ঠে বলে, “তুই যা তো এখন সামনে থেকে নাহলে আমার হাতে সেই কেলানি খাবি।”
“আরেহ ভাই করলামটা…. “
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই কেউ এসে জানায় কেয়াকে আফসানা মিস খুঁজছে। কেয়া সেটা শোনামাত্র স্পর্শীকে বিদায় জানিয়ে ছুটে আফসানা মিসের কেবিনের দিকে। কেয়া চলে যেতেই স্পর্শী পুনরায় প্রখর দৃষ্টিতে তাকায়। নির্বাণের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা সুক্ষ্ম হাসিটি চোখে বিঁধে তার৷ সেই সাথে তাপসির প্রসন্নচিত্তের হাসি দেখে গা জ্বলে উঠে। কেয়ার বলা কথাটা পুনরায় টনক নারতে ঈষৎ ঈর্ষা কাজ করতে শুরু করে মনের মাঝে। ক্ষণেই সে ক্রোধিত কন্ঠে বিরবির করে বলে,
“কাপল হিসাবে তাদের অতি জঘন্য দেখায়। পাশাপাশি একটুও মানায় না তাদের।”
কথাটা বলেই স্পর্শী লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় মূল সড়কে দিকে।
বাসায় এসেই স্পর্শী নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। রাগে তখনও সে ফুঁসছে। এত রাগ কেন বা কিসের প্রতি সে জানে না। তবে রাগে তার মন-মস্তিষ্ক অচল হয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতেই স্পর্শী দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রেশ হয়ে রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দাগুলো টেনে দেয়। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রাখে সে। অতঃপর কম্বল মুড়ি দিয়ে পাড়ি জমায় ঘুমরাজ্যে।
দুপুরের পর দেওয়া ভাতঘুমটা গিয়ে একবারর ভাঙ্গে সূর্যাস্তের ঠিক কিঞ্চিৎ প্রহর পরে। দরজায় কড়া আঘাতের শব্দে। স্পর্শী ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখে পিটপিটিয়ে তাকায়। আলসে দেহটাকে কোনমতে টেনে নিয়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে৷ দরজা খুলতেই সাহেলা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
“এত সময় লাগে গেট খুলতে? কি করছিলি?”
স্পর্শী পরপর দু’বার হামি তুলে বলে, “ঘুমিয়ে ছিলাম। কেন কি হয়েছে?”
সাহেলা হাতের ফোনটা স্পর্শীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নির্বাণ করেছে। তোকে চাইছে নে কথা বল।”
কথাটা কর্ণপাত হওয়ার পর মূহুর্তেই স্পর্শী কপালে ভাঁজ পড়ে। সে স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে, “কি বলছো এইসব? সে কেন আমাকে চাইবে? ভুল শুনেছ হয়তো বা।”
সাহেলা এইবার রেগে গিয়ে বলেন, “কলে আছে ওই। ধর তুই ফোন, কথা বল ওর সাথে।”
স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত রেখেই ফোনটা হাতে নেয়। কানের কাছে ফোন নিয়ে ‘হ্যালো’ বলা মাত্র নির্বাণ ভরাট কন্ঠে বলে উঠে,  “ফোন কই তোমার? কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি কোন খেয়াল আছে?”
অকস্মাৎ নির্বাণের গম্ভীর কন্ঠ শুনে স্পর্শী হকচকিয়ে যায়। চোখের কোনে লেগে থাকা অবশিষ্ট ঘুম ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় অজানার উদ্দেশ্য। সে তটস্থ চোখে তাকায় সাহেলার দিকে। সাহেলা কিছু না বলে নীরবে নিজ স্থান ত্যাগ করেন।
স্পর্শীকে নিরুত্তর দেখে নির্বাণ পুনরায় বলে, “কি হলো কথা বলছো না কেন?”
স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে, “ঘুমিয়ে ছিলাম।”
কথাটা শুনে নির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধাতস্থ হয়ে বলে, “ফ্রেশ হয়েছ?”
 নির্বাণের কন্ঠ নেমে আসতে স্পর্শী কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে, “না।”
“ফ্রেশ হয়ে আসো, তারপর কথা বলছি।”
“না! সমস্যা নেই৷ আপনি বলুন।”
“কাল রাতে আমরা সিলেটে যাব। সো তুমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।”
“আমরা সেখানে কতদিন থাকবো?”
“এক সপ্তাহ।”
স্পর্শী বেশি কিছু না বলে ছোট করে “আচ্ছা” বলল।
 নির্বাণ বলে, “আমি তোমাকে তোমার বাসা থেকে রাত এগারোটার দিকে পিক করে নিব। রেডি থেকো, লেট করবে না।”
“জি আচ্ছা।”
নির্বাণ বেশ কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে, “আচ্ছা রাখছি তাহলে।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে শুধু ‘হুম’ বলে। স্পর্শীর উত্তর পেতেই ওপর পাশ থেকে তীব্রভাবে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ সাথে। নিঃশ্বাসের শব্দ স্পর্শী উপলব্ধি করতেই তার গায়ে অজানা শিহরণ বয়ে যায়। ব্যগ্র হয়ে উঠে মন। অতঃপর অপরপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ না পাওয়া স্পর্শী কান থেকে ফোনটা নামায়। কল কেটে গিয়েছে। স্পর্শী এইবার এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। নিজের ফোনটা হাতে নিতেই পর্দায় ভেসে উঠে কাঙ্ক্ষিত মানুষের বিশটি মিসকলড।
আঁধারিয়া আকাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্রের অজস্র মেলা। এক ফালি চাঁদের অস্তিত্বে প্রসন্ন রজনী। হিম হাওয়ায় ভাসমান অজানা ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা পরিবেশ। বাতাসের বেগ পেরিয়ে গাড়ি উঠে পড়ে হাইওয়ে রোডে। সহস্র গাছ, বিস্তৃত মাঠ-আকাশ পেরিয়ে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে চলছে গাড়িটি। গাড়ির ভিতরের পরিবেশ কিছুটা ছমছমে। ইনার লাইট অফ থাকায় আকাশ হতে আঁধার নেমে এসেছে ভিতর অব্দি। এসি চালু থাকায় ভিতরকার পরিবেশ হিমায়িত। ক্ষণেই নীরবতা ঠেলে স্পর্শী বলে উঠে,
“আপনি কি সারারাত ড্রাইভ করতে পারবেন? সমস্যা হবে না আপনার?”
নির্বাণ দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখেই বলে, “হ্যাঁ পারবো। এর আগেও কয়েকবার গাড়ি দিয়েই সিলেট গিয়েছি আমি।”
স্পর্শী দৃষ্টি নুইয়ে বলে, “তাও সাবধানে চালাবেন।রাতের জার্নি সেফ না।”
নির্বাণ স্মিথ হেসে বলে, “চিন্তা নেই, তোমায় গায়ে আমি একটা আঁচড়ও লাগতে দিব না। “
কথাটা শুনে স্পর্শী থমকায়। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের দিকে। অজানা এক ভালো লাগার ঢেউ খেলে যায় মনের সমুদ্র পাড়ে। স্পর্শী কিছু বলে না, নিভৃতেই মাথা এলিয়ে দেয় সিটে। সময় গড়িয়ে প্রহরে পদার্পণ করতেই স্পর্শী অতুল ঘুমে তলিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে ঘুমের ঘোরেই এসির হিম বাতাসে তার শরীর কাঁপণ ধরে যায়। নির্বাণ আড়চোখে সেটা খেয়াল করে গাড়ি হাইওয়ের এক সাইডে দাঁড় করায়। অতঃপর সিটবেল খুলে পিছন সিট থেকে নিজের ট্রেভেল ব্যাগটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে। ব্যাগ থেকে তার একটি জ্যাকেট বের করে সপ্তপর্ণে স্পর্শীর গায়ে জড়িয়ে দেয় আর এসির পাওয়ারটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ কমিয়ে দেয়। অতঃপর ব্যাগটা পুনরায় পিছনে রেখে স্পর্শীর দিকে তাকায়। আঁধারে স্পর্শীর মুখশ্রী স্পষ্ট ফুটে না উঠায় ইনার লাইটটা জ্বালায় নির্বাণ।
একান্ত তার মানুষটির ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখার লোভে। হঠাৎ লাইটের অস্পষ্ট আলো স্পর্শীর উপর পড়তে সে ভ্রু কুঁচকে নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু পরমুহূর্তে উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। স্পর্শী মাথা এইবার বা দিকে আরেকটু হেলে যায়, মুখের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই কয়েক গাছি চুল এসে ঘাপটি মেরে বসে। ঘুমের মাঝেই স্পর্শী একটু পর পর ঠোঁট উল্টাচ্ছে। তা দেখে নির্বাণ নিঃশব্দে হাসে। ডান হাতের তর্জনী উঠিয়ে খুবই সপ্তপর্ণে স্পর্শীর মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে কানের পিছে দিয়ে দেয়৷ ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঈষৎ ফুঁ দেয় স্পর্শী ভারী পল্লবের উপর। ক্ষণেই সে খানিকটা কেঁপে উঠে। নির্বাণ পুনরায় হাসে,
— কারো চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে নির্বিঘ্নে কিভাবে ঘুমাও তুমি? ঘুমে ব্যাঘাত হয় না?
 কথাটা বলে নির্বাণ ধীর গতিতে স্পর্শীর সিটটা পিছনে দিকে হেলিয়ে দেয় যাতে স্পর্শীর ঘুমাতে অসুবিধা না হয়। অতঃপর ইনার লাইটটা অফ করে স্পর্শীর দিকে হালকা ঝুঁকে তার ললাটে নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ ছুঁয়ে দিয়ে উঠে বসে। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে মৃদুকন্ঠে বলে,
— ঘুমোও তুমি, আমি আছি পাহারা দিতে।

2 COMMENTS

Comments are closed.