চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১০

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ১০
Writer Asfiya Islam Jannat
রঙিন ফুলের আঁকেবাঁকে সবুজ পাতাগুলো জানান দিচ্ছে চৈত্রের বিদায়ের। বসন্তের শেষবেলায় সোনাপাতি ফুলের মতো চারদিক আলোকিত করা পুষ্পরাজি সোনারঙের সৌন্দর্যের বাহার ছড়িয়ে গিয়েছে। বাতাসে ভাসছে বৈশাখের সৌরভ। বাংলা নতুন বৎসরকে বরণ করতেই মেতে উঠেছে বাঙ্গালী। জাবির প্রাঙ্গণ সজ্জিত হয়েছে আজ নতুন দমে। শুভ্র-রক্তিমের ছড়াছড়ি চারদিকে৷ স্পর্শী আজও গায়ে আটপৌরে শাড়ি জড়িয়ে নিজ কাজে মগ্ন। আশেপাশের কোনদিকে তার ধ্যান নেই।
তারই বেখেয়ালির সুযোগ নিয়ে আড়ালে থেকে নিজের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে দূরান্তে অবস্থিত প্রেমিক পুরুষের মনটি। দৃষ্টির কোনায় কোনায় ছেঁয়ে আছে তার বেহায়াপনা। তার অতি চরিত্রবান পুরুষের সার্টিফিকেটটি আজ হয়তো মেয়াদউত্তীর্ণ হয়েই গেল। বিরবির করল সে,
— এই মেয়ে দেখছি আমাকে কলঙ্কিত না করে ছাড়ছে না। চরিত্রে বুঝি এইবার আমার কলঙ্ক লেগেই গেল। এই জন্যই মানুষ বলে, মেয়েলি দোষ পুরুষজাতির অধঃপতনের মূল।
অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিল সে। অনেক কাজ বাকি।
সময় এসে মধ্যাহ্নে স্থির হয়তেই বেড়ে যায় রোদের প্রখরতা। বাতাসেও যেন কারফিউ জারি হয়ে যায়, উত্তপ্ততায় এইবার ঘেমে-নেয়ে উঠে সমস্ত নগরী। কিঞ্চিৎ আরামের আশায় বটতলার ছাউনির নিচে জড়ো হয় সকলে। তপ্ত হয়ে আসা অন্তরকে শান্ত করতে ছুট দেয় কোমল পানীয়র খোঁজে। মাহিন হাতে পাঁচটা ঠান্ডা কোকাকোলা নিয়ে হাজির হতেই সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। হাতে একটা বোতল পাওয়া মাত্রই নিজের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুটা সময় পর স্বস্তি অনুভব করতেই নিধি বলে,
“জানে জান আইলো এইবার। গরমে তো বয়েল মুরগী হয়ে গেসিলাম।”
কেয়া অবসন্ন কন্ঠে বলে, “আসলেই আজকে অনেক গরম পড়েছে রে। বুঝি না, বৈশাখের প্রথম দিনই এত গরম পড়ে কেন?”
মাহিন ক্লান্ত স্বরে বলে, “গরম তো গরম। তার উপর কাজের বাহার। আজ কাজ করতে করতে বেহাল দোষা আমার। যতসব ফাংশনের দায়িত্ব আমাদের উপর এই আসে। শালা, ঠিক মত অনুষ্ঠানও ইনজয় করতে পারি না।”
সামি হেসে বলে, “ভাগ্যিস! আমি তোদের ডিপার্টমেন্টের না। নাহলে জীবন আমার তেজপাতা থেকে কয়লার কারখানা হতে সময় নিত না।”
নিধি তিক্ত কন্ঠে বলে, “কাঁটা গায়ে নুন দিতে বলসে তোকে কেউ? মুখ বন্ধ রাখ নাইলে চাপা ভেঙে দিব আমি তোর।”
স্পর্শী বোতলে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে বলে, “পটর পটর কম কর, আগে কিছু খেয়ে নে। আবার ভলেন্টিয়ারের কাজে যেতে হবে।”
কথাটা শোনামাত্র সামি ব্যতীত সকলের মুখ কালো হয়ে যায়। তারা সম্মতি জানিয়ে নিজের মনমত খাবার অর্ডার দিল। স্পর্শী এক প্লেট খিচুড়ি অর্ডার দিয়ে নিজ জায়গায় এসে বসতেই ওর ফোনের মেসেজ রিংটোনটা বেজে উঠে। স্পর্শী মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করে। নির্বাণের মেসেজ,
“পাঁচটার দিকে গাড়িতে গিয়ে বসো।”
স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে নিজের ফোনের দিকে তাকায়। আনমনে বলে, “আবারও!”
গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দু’টি বন্ধ করে শুয়ে আছে স্পর্শী। বিতৃষ্ণায় মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে তার। ঘর্মাক্ত শরীরে আড়ষ্টভাবেই লাল পাড়ের শুভ্র শাড়িটি জড়িয়ে আছে। গরমের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতেই স্পর্শী উঠে বসে খোলা চুল গুটিয়ে নিয়ে হাতখোঁপা নেয়। সামনে রাখা বক্স থেকে টান দিয়ে পরপর দু’টা টিস্যু নিয়ে সিক্ত কপাল,নাক,গলদেশে ছোঁয়ায়।  অপেক্ষার কাটা মিনিট দশেক পেরিয়ে পনেরোর ঘর ছুঁইছুঁই। অথচ আজও নির্বাণের খোঁজ নেই। ইতিমধ্যে গরমে স্পর্শীর বেহাল দশা, দমবন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। স্পর্শী নির্বাণকে ফোন করবে বলে ফোন হাতে নিতেই নির্বাণ এসে হাজির হয়। গাড়িতে উঠে বসতেই স্পর্শী অধৈর্য্য হয়ে বলে,
“কোথায় ছিলেন? এত দেরি লাগে আসতে? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। এখন, দ্রুত এসিটা ছাড়ুন প্লিজ। গরমে আমার জান যায় যায় অবস্থা।”
অকস্মাৎ স্পর্শীর কথার আক্রমণে নির্বাণ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় তার পাণে। স্পর্শীর কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। সাথে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অধিকারবোধ৷ আজ স্পর্শী অধিকার খাটিয়েই নির্বাণকে প্রশ্ন করছে, তার কাছে কৈফিয়ত চাইছে। বিষয়টা নির্বাণের নিকট কেমন যেন ঠেকলো।
ঘটনাক্রমে বুঝতে পেরে নির্বাণ কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “আমার বউ হওয়ার প্র‍্যাকটিস কি এখন থেকেই শুরু করছো নাকি? কৈফিয়ত চাইছো আমার কাছে।”
নির্বাণের এহেন প্রশ্নে স্পর্শী ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। গোলগাল চোখে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের পানে। অতঃপর কিছুক্ষণ পূর্বেই বলা তার কথাগুলো মনে পড়তে স্পর্শী মিইয়ে গিয়ে বলে,
“না মানে.. আমি আসলে..”
“আসলে নাকি নকলে জানতে চাইনি। সরল একটা প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর চেয়েছি।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে দৃষ্টি নত করল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকেই মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, “বউ হওয়ার প্র‍্যাকটিস করবো কেন? আমি তো অলরেডি আপনার বউই।”
স্পর্শীর এমন উত্তরে নির্বাণ ভিতরে ভিতরে খানিকটা অবাক হলো। তবে অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করলো না। কিঞ্চিৎ হেসে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করলো সে। অতঃপর এসিটা ছেড়ে দিয়ে বলল,
“সামনের সপ্তাহে আমার একটা কাজিনের বিয়ে আছে সিলেটে। সেখানে আমরা সবাই যাচ্ছি। তো মা চাইচ্ছেন তুমিও যাতে আমাদের সাথে সেখানে চল।”
স্পর্শী অবাক হয়ে বলে, “আমি? আমি কিভাবে?”
“কিভাবে আবার কি? বউ তুমি আমার, সে পরিচয়ে যাবে। আর মাও চাইছেন সকলের সাথে তোমাকে একবারে পরিচয় করিয়ে দিতে।”
‘আমার বউ তুমি’ কথাটা কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হতেই স্পর্শী বুকটা ধ্বক করে উঠে। অজানা শিহরণ খেলে যায় মনের মাঝে। স্পর্শী কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকে নিজেকে ভিতরে ভিতরে গুছিয়ে নিয়ে বলে,
“বিষয় সেটা না। সামনেই তো আমাদের ক্লাস টেস্ট, সে সাথে আমার আবার ল্যাবে প্রেকটিক্যাল ক্লাসও আছে। সেগুলো রেখে আমি কিভাবে যাব?”
“সব করেই তারপর যাবে। বিয়ে এপ্রিলে ঊনত্রিশ তারিখ। মা আর নাহিদ আগেই যাবে, তবে আমি না। এক্সামের জন্য আমি দেরিতে যাব। তাই তোমার এক্সাম আর প্রেকটিক্যাল শেষ হলে আমার সাথেই যাবে তুমি।”
স্পর্শী কিছুটা সময় নীরব থেকে বলে, “আমি বাসায় না জানিয়ে কিছু বলতে পারছি না। মাকে আগে…”
স্পর্শীর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নির্বাণ বলে উঠে, “সেটা মা বুঝে নিবে। তোমাকে এই বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না।”
স্পর্শী কথা বাড়ালো না। দু’দিকে মাথা হেলিয়ে শুধু সম্মতি জানালো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কেটে যেতেই নির্বাণ ধীর গতিতে স্পর্শীর দিকে ঝুঁকলো। নির্বাণকে ঝুঁকতে দেখে স্পর্শী কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিচলিত হলো। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বেই নির্বাণ স্পর্শীর পাশ থেকে সিটবেল টেনে এনে লাগিয়ে দেয়। অতঃপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্পর্শীর পানে। মাঝে মধ্যে দৃষ্টি গিয়ে থমকায় কাজল কালো চোখে ও রক্তিমা প্রলেপে আবৃত ঠোঁট জোড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই অতিবাহিত হয়ে যেতে নির্বাণ স্পর্শীর নিকট হতে সরে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
“এই লিপস্টিকটাই তুমি সেদিন দিয়েছিলে না? স্বাধীনতা দিবসের দিন?”
স্পর্শী থতমত খেয়ে বলে, “মনে হয়।”
“তুমি আর কখনো এই লিপস্টিকটা দিবে না।”
স্পর্শী হতবিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মানে? কেন?”
“আমি বলছি তাই।”
“মানে কি?”
নির্বাণ এইবার কন্ঠস্বরে একরাশ কাঠিন্যতা মিশিয়ে বলে, “মানে এইটা তোমার এই লিপস্টিকের কালার আমার সহ্য হয় না। বেসামাল হয়ে যাই আমি।”
শেষের কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে গাড়ি স্টার্ট দিল। মুহূর্তেই গাড়িটি চলতে শুরু করলো। যার দরুন স্পর্শী শেষ উক্তিটির আংশিকও ঠিক মত শুনতে পেল না। শুধু হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নির্বাণের পানে। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। বলার মত উপযুক্ত কিছু পেলই না সে, কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া।