চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৯

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৯
Writer Asfiya Islam Jannat
 কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথির রজনী। দেখা নেই স্নিগ্ধ চাঁদের, নেই তার কোন স্পর্শ। আঁধারে নিমজ্জিত সমস্ত নগরী। অকস্মাৎ চৈত্রের ভ্যাপসা গরমে তপ্ত হওয়া শহুরে এক বুক শীতলতা বয়ে আনলো হিম অনলের ঢেউ। প্রশান্ত হলো উগ্র মন, ছেদ করলো কারো ভাবনায়। স্পর্শীর একপলক তাকালো বাহিরের দিকে। হিম বাতাসে বারান্দার পর্দাগুলো তিরতির করে কাঁপছে।
সে সাথে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে দরজার এক কোনে রাখা আর্ট পেপারগুলো। পার্শিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে স্পর্শী আনমনেই উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল বারান্দার দরজার দিকে। দরজা, ফ্যান বন্ধ করে এসি ছেড়ে দিল। মেঝে থেকে কুড়িয়ে পেপারগুলো বিন্যস্ত করে রাখলো নিজ স্থানে। হঠাৎ মনে রং-তুলির জোয়ার উঠলো, শুভ্র ক্যানভাসকে রঙে-বেরঙে সাজিয়ে তুলার প্রবণতা বাড়লো৷ স্পর্শী আর এক মুহূর্ত ভাবলো না, রং-তুলির সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে পরলো নিজের মনের সমাদর রাখতে।
হাত চলতে থাকলো সাদা ক্যানভাসের উপর অবিশ্রান্ত। পার্শিয়া বিছানার উপর আরাম ভঙ্গিতে শুয়ে একধ্যানে দেখতে থাকলো স্পর্শীকে। মাঝে মধ্যে স্পর্শীকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো। অতঃপর একসময় স্পর্শীকে দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে অবস্থায়। স্পর্শী গিয়ে ক্ষান্ত হলো আরও ঘন্টা দুয়েক পর। রেস্টুরেন্টে বসে থাকা কোন এক যুগলের মিষ্টি মূহুর্তগুলো কাঠ পেন্সিলের সুক্ষ্ম আঁচড়ের সাথে  রং-তুলির সংমিশ্রণে ফুটিয়ে তোলার ক্ষীণ প্রচেষ্টা। তবে পোট্রের্টটা এখনো অসম্পূর্ণ। বাকি আছে আরও অনেক কাজ। যার দরুন, সম্পূর্ণ বিষয়টি ফুটে উঠতে চেয়েও উঠলো না। সম্পূর্ণতা পেলে হয়তো দারুণ কিছু হতো। স্পর্শী অবসন্ন নিঃশ্বাস ফেললো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো অসমাপ্ত ক্যানভাসে, ক্ষণেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো সে। মনের আরশিতে ভেসে উঠলো, নির্বাণের সাথে কাটানো রেস্টুরেন্টের মূহুর্তগুলো। মূলত সেই দৃশ্যের একাংশই কৃত্রিমভাবে বন্দীর করার চেষ্টা করছিল স্পর্শী, কিন্তু সফল হলো না তাতে।
স্পর্শী আনমনে ভাবতে ভাবতে একসময় নির্বাণকে নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দেয়। নির্বাণের সাথে কাটানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত মনে পড়তেই নিজের অজান্তে ভরাট গালে ছেয়ে গেল রক্তিমার দাঢ় প্রলেপ। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো লজ্জালু হাসির সরু রেখা। হঠাৎ মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো রুদ্র নামটি। মনে পড়ে গেল রুদ্রকে বলা তার শেষ উক্তিটি,
“বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার আর আমার বর আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”
বিয়ের কথা সত্যি হলেও, ভালোবাসার কথা তো সত্য নয়। রুদ্রকে উচিৎ জবাব দিতেই সে বলেছিল তার বর তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আদৌ কি এইটা সম্ভব হবে? অগোছালো, অবিন্যস্ত, অনিশ্চিত সম্পর্কটা নির্বাণ গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও আদৌ সে তাকে ভালোবাসতে পারবে কি-না কে জানে? সেই বা কি পারবে নির্বাণকে বাসতে ভালো? উফফ! তার জীবনটা এমন কমপ্লিকেট কেন হলো? স্পর্শী বিতৃষ্ণায় বিরবির করলো,
“সম্পর্কের সমীকরণটা যেখানে অনিশ্চিত, ভালোবাসা সেখানে বিলাসতা।
 আর এমনেও আমার ভালোবাসা বলে কিছু নেই, তাই এইসব নিয়ে মাথা ঘামিয়েও লাভ নেই। আমার জীবন ডুবার হলে ডুববেই, নাহলে নতুন দমে উদয় হবে।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাতের থাকা তুলি আর রঙের প্যালেটটা স্টাডি টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো স্পর্শী। ওয়াশরুমে গিয়ে রঙে মাখোমাখো হাতটি পরিষ্কার করে নিল। অতঃপর ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পূর্বেই দরজায় কেউ কড়া আঘাত করলো। স্পর্শী সেদিক অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, এগিয়ে গেল। দরজা খোলার পর মুহূর্তেই এক যুবতী নারী বিকট শব্দে বলে উঠল,
“এতক্ষণ লাগে তোর দরজা খুলতে? সেই কখন দরজা পিটাচ্ছি আমি।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে ক্ষণেই স্পর্শীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি এক হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে সে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
“তুমি আসলে কবে সামান্তা আপু? আর তুমি যে বাসায় আসবে তা আমাকে আগে জানাও নি কেন?”
সামান্তার রুক্ষ কন্ঠে বলে, “রুমবন্ধ করে বসে থাকলে দেখবি কিভাবে কখন আসছি? আর তোকে না বলে কি এই বাসায় আসা যাবে না?”
“এত রাগছ কেন আজিব?”
সামান্তা ভেংচি কেটে বলে, “রাগবো না তো কি করবো? রুম বন্ধ করে করিসটা কি?”
“পেন্টিং করছিলাম। আচ্ছা, ভাইয়া আসেনি?”
স্পর্শী দরজার কাছ থেকে সরে আসতেই সামান্তা রুমের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “এসেছিল, তবে চলে গিয়েছে। ঘন্টাখানেকের মাঝে চলে আসবে।”
স্পর্শী অসন্তোষজনক কন্ঠে বলে, “এ কি? আমাকে তুমি বা মা ডাকবা না? ভাইয়া কি মনে করলো বলতো?”
সামান্তা বিছানার এক কোণে বসে পার্শিয়ার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “সে এইসব নিয়ে এত একটা ঘামায় না। পরে আসলে দেখা করে নিস।”
স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুম গুছিয়ে নিতে থাকলো। সামান্তা ক্ষণে বলে উঠলো, “শুনলাম বিয়ে করেছিস। আমাকে ছাড়াই বিয়ে করে ফেললি? আমি ইন্ডিয়ায় ছিলাম বলে আমার কথা একবারও ভাবলি না?”
স্পর্শী একপলক তাকালো সামান্তার পানে, স্মিত কন্ঠে বলল, “তুমি কি আমার বর নাকি যে তোমাকে ছাড়া বিয়ে করা যাবে না?”
“বর না হই বোন তো নাকি?”
স্পর্শী নিজের কাজ করতে করতে বলে, “বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। নিজেই তো জানতাম না সেদিন আমার বিয়ে তোমায় কিভাবে জানাবো? আর তুমিও তো তখন নেটওয়ার্কের বাহিরেই ছিলে। জানাতাম কিভাবে?”
“হ্যাঁ মামীর কাছে শুনলাম, এনগেজমেন্ট হওয়ার বদলে তারা নাকি ডায়রেক্ট আকদ করে রেখে গিয়েছে। তবে, ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড নাকি খারাপ না।”
“হুম।”
সামান্তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “বিয়েটা কি তুই স্বেচ্ছায় করিস নাকি মামা-মামীর জোরাজুরিতে?”
“আমার উপর কি কারো জোর চলে? নিজের ইচ্ছাতেই করেছি বিয়েটা।”
সামান্তা কিছুটা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে রুদ্র? ওর সাথে না তোর প্রেম ছিল।”
‘রুদ্র’ নামটা শুনেই স্পর্শীর বিরক্তিতে মুখ ঘুচে আসে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে সে বলে,”ওর নাম নিবা না তো। ওর নাম শুনলেও এখন আমার গা ঘিন ঘিন করে।”
“কি হয়েছে? কোন ঝামেলা কি হয়েছে? বল আমায়।”
স্পর্শী কিছুটা সময় চুপ থেকে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। সব গোছানো শেষে নীরবেই গিয়ে বসলো সামান্তার কাছে। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে সব শুরু থেকে বলতে থাকলো। সবটা শুনে সামান্তা থ মেরে বসে থাকে। দৃষ্টিতে তার অপার বিস্ময়।
“তার মানে ওই ছেলে পুরো ছয়টা মাস তোর পিছে একটা বাজির জন্য ঘুরেছিল? ভালোবাসার অভিনয় করেছিল?”
স্পর্শী তিক্ত কন্ঠে বলে, “বিছানায় নেওয়ার জন্যও বটে।”
“মানুষ ঠিকই বলে, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
“হুম।”
কিছুটা সময় নিঃশব্দে কেটে যাওয়া পর সামান্তা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা! তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিলি কেন? রুদ্রের উপর রাগ করে?”
“রুদ্রের উপর রাগ ছিল তবে তার চেয়েও বেশি আমার কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে ওই রাস্কেলটার জন্য আমি দুইটা মাস প্রতিনিয়ত বাবা-মায়ের কাছে মিথ্যা বলেছি। মা বার বার বারণ করা সত্ত্বেও রিলেশনে গিয়েছি এবং তাকে জানাইওনি। প্রতারণা করেছি তাদের সাথে। অথচ তারা কত ভরসা করতো আমায়, কখনো কোন কিছুতে বাঁধা দিত না। আমি যখন যা চেয়েছি তাই দিয়েছি। নিজের মত চলতে দিয়েছে। সব ভেবেই তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল মনের ভিতর। প্রত্যেক্ষভাবে না হোক পরোক্ষ ভাবে তো বাবা-মাকে কষ্ট দিয়েছিলাম আমি।  তাই বাবা যখন বললো তিনি আমার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করেছেন তখন আমি জেনে না শুনে, না দেখেই ওই সম্বন্ধের জন্য হ্যাঁ বলে দেই। পুরো বিষয়টা ছেড়ে দেই বাবা-মায়ের সীদ্ধান্তের উপর। চাইছিলাম এর মাধ্যমেই সকল হিসাব একত্রে চুকিয়ে দিতে। সাথে নিজের মনকে শান্ত করতে। কিন্তু তাও তো শান্তি মিললো না। পোড়া কপাল আমার।”
“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছেই। তা ভেবে এত লাভ নেই। বিয়েটা তুই এখন মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর। হুট করে সব হয়ে যাওয়ায় সবকিছু হয়তো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।”
“বিষয়টা বিয়ে পর্যন্ত হলেও হতো। কিন্তু এইখানে বিষয়টা ভিন্ন।”
“শুন! বিয়ে বিষয়টা এতও সহজ না। ‘বিয়ে’ শব্দটা ক্ষুদ্র হলেও এর পরিধি কিন্তু অসীম। দায়িত্ব, কর্তব্য অনেক৷ বললেই সব হয়ে যায় না। উপরন্ত, তোর বিপরীত পাশের মানুষটি কেমন প্রকৃতির সেটাও তোকে দেখতে হবে। ধৈর্য ধরতে হয় আর অন্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। তবে আমার ভয় এইখানেই তুই নতুন কাউকে ভরসা করতে পারবি কি-না। যে ধাক্কাটা তুই খেয়েছিস।”
স্পর্শী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “ভরসা করতে পারবো কি-না জানি না তবে ওই মানুষটাকে আমার বড্ড ভরসাযোগ্য মনে হয়। কিন্তু তাও কোনকিছু ঠিক ভাবে ঠাওর করতে পারছি না আমি। সম্পর্কটা আমাদের এখনো অগোছালো।”
“তা কেন?”
“আমার বরই আমার ডিপার্টমেন্টের টিচার। মানে একদিক দিয়ে আমি তার বউও, আবার ছাত্রীও।”
সামান্তার মুখ এইবার বিস্ময়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ফাঁক হয়ে যায়। সে আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে, “মানে কি ভাই? তুই আগে খোঁজ খবর নিস নি? মামা-মামী জানে বিষয়টা?”
“নিলে কি বিয়েটা হতো? দুইজনের কেউ এই সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। একবারে বিয়ের দিনই দুইজনে দুইজনকে দেখেছি। আর বাবা-মা জানে তিনি অন্য ডিপার্টমেন্টের স্যার, আমার না। জানলে তো হয়েছিলই।”
সামান্তা হেসে বলে, “বাহ! ব্যাপারটা জোস তো৷ তা এইখানে কি সিনেমার মত টুইস্ট আছে নাকি? তোর বর আবার তোকে আগে থেকে পছন্দ করতো নাতো? বিয়ের কারসাজিই ওরই যদি হয়?”
স্পর্শী বিরক্ত হয়ে বলে, “বিয়ের প্রস্তাব ঘটক এনেছিল বইনা। এসব কারসাজি ঘটকের আর কাজী ব্যাটার।”
“আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু এখন তোর সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা এইখানেই সে আমার স্যার। তাকে আজীবন আমি স্যার চোখেই দেখেছি তাও আবার অপ্রিয় স্যার হিসাবে। হুট করে কিভাবে তাকে বর মানি? তার উপর যতবারই তার সামনে পড়ি বিব্রতবোধ করি। কি রকম এক বিশ্রী অবস্থা।”
“আচ্ছা, স্যারদের কি বিয়ে করা নিষেধ? তোর বর তুই বাদে যাকেই বিয়ে করতো সেও তো স্টুডেন্টই হতো। হয়তো তার না বা অন্য কোরো। বা সে যদি তোর ডিপার্টমেন্টের স্যার না হতো তাহলে কি তোর ভাবনা এক হতো? হতো না। কাকতালীয় ভাবে এখন তোদের ভাগ্য মিলে গিয়েছে। এতে কি করার আছে? এই একটা বিষয়ের জন্য সম্পর্কটা তো আর ঝুলিয়ে রাখা যায় না। যদি তুই সত্যি মুভ অন করতে চাস, নিজের লাইফ গুছিয়ে নিতে চাস তাহলে এইসব বিষয় নিয়ে এত ভাবিস না। মাঝে মধ্যে আমাদের ভাবনার বাহিরেও অনেক কিছু ঘটে কিন্তু আমরা ঠিকই সবকিছুর সাথে কথা ক্ষাপ খায়িয়ে ফেলি। সবটাই সময়ের ব্যাপার। একটু সময় দে, সব দেখবি ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
স্পর্শী মন দিয়েই শুনলো কথাগুলো। ভাবলোও বেশ। অতঃপর ক্লান্ত কন্ঠে বলল, “দেখা যাক কি হয়।”
“এইসব নিয়ে এত ভাবিস না। এখন বাহির চল, তোর জন্য কিছু জিনিস এনেছিলাম আমি। চল!”
এক কাপ ধোঁয়া উঠা চা নিয়ে স্পর্শী বেঞ্চিতে বসলো। গ্লাসে ছোট এক চুমুক বসিয়ে সে মাহিনের দিকে তাকালো, “সামি আর কেয়া কই রে?”
মাহিন বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, “সামির এখন ক্লাস আছে আর কেয়া মনে হয় লাইব্রেরি গিয়েছে।”
“তুই কি পড়ছিস?”
মাহিন প্রত্যুত্তর করার পূর্বেই নিধি এক প্লেট খিচুড়ি নিয়ে বসলো স্পর্শী পাশে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, “পরশু লেডি হিটলার ক্লাস টেস্ট নিবে বলছিল না? মোটু তো ওই টপিকের ক্লাস মিস করে গিয়েছিল তাই এখন নিজে নিজে পড়ে দুনিয়ায় উল্টে ফেলছে।”
স্পর্শী চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলে, “অহ আচ্ছা। তা নন্দিতার কি খবর রে? বরিশাল থেকে আসে নাই এখনো?”
মাহিন প্রত্যুত্তরে বলে, “না। পরশু ফোন দিয়েছিলাম ওকে৷ আসতে নাকি আরও এক সপ্তাহ লাগবে।”
নিধি মুখ ভর্তি খাবার নিয়েই বলে, “মাইয়া যে কি করতে গিয়েছে ওইখানে কে জানে? কিছু জিগাইলে কয়ও না। বেদ্দব একটা!”
স্পর্শী বলে, “ওর বাবা অসুস্থ জানিসই তো। তাহলে এইভাবে বলিস কেন?”
“একমাস হতে চললো ভাই, ওই লাপাত্তা। এমনে কমু না তো কেমনে কমু কো?”
মাহিন একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আগে মুখের খাবার গিলে নে, তারপর কথা বল। খাবারের ছিটা গায়ে আসে ভাই।”
নিধি তীক্ষ্ণ চোখে একবার মাহিনের তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল। মাহিনও সে দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে  বইয়ের মাঝে ডুব দেয়। স্পর্শী নিজের চা শেষ করে বলে, “তোরা থাক, আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি। কেয়ার সাথে একটু দরকার আছে আমার, আবার কিছু বইও কালেক্ট করতে হবে।”
নিধি মুখভর্তি খাবার চিবুতে চিবুতে বলে, “আচ্ছা যা।”
স্পর্শী ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় লাইব্রেরির দিকে।
লাইব্রেরিতে এসে আগে স্পর্শী কেয়ার খোঁজ করলো। কিন্তু কোথাও ওকে না দেখে নিজের বইগুলো খুঁজতেই ব্যস্ত হলো। লাইব্রেরিতে আজ এত মানুষ নেই, মধ্য দুপুর বলেই হয়তো। স্পর্শী সেদিকে এত একটা ধ্যাণ দিল না, আপন মনে নিজের কাজ করতে থাকলো। একদম লাস্ট কিনারে এসে সে থমকালো। ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালো সামনে। একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে সবচেয়ে উঁচু সেল্ফের উপরে কিছু একটা খুঁজছে নির্বাণ। ঘর্মাক্ত শরীরে ইন করা চেক শার্টটি শ্যাম বর্ণ গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মুখে কাপড়ের তৈরি কালো রঙের একটি মাস্ক। মাস্ক পরিধান করা সত্ত্বেও স্পর্শী কিভাবে যেন একপলকেই চিনে ফেললো নির্বাণকে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো তাকে, আনমনেই এগিয়ে গেল কয়েক কদম। যেতে যেতে নির্বাণের খুব নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
হঠাৎ কারো অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে নির্বাণ নিচে তাকায়। পরমুহূর্তেই স্পর্শীকে তার নিকটে দেখে ভড়কে যায় সে। যার দরুণ, টুলটা নড়েচড়ে উঠে। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে ফেলবে এমন দশা। নির্বাণকে পড়ে যেতে দেখে স্পর্শী কি করবে বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধির মত দু’হাত দিয়ে নির্বাণের পা শক্ত করে ধরে। এতে নির্বাণ আরও বেসামাল হয়ে পড়ে,  কোন মতে বইয়ের সেল্ফটা ধরে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখে। অতঃপর স্পর্শী দিকে তাকিয়ে ধমকের বলে,
“পা ধরেছ কেন ইডিয়ট? টুল ধরো।”
নির্বাণের ঝাড়িতে স্পর্শীর টনক নাড়ে। সে দ্রুত নির্বাণের পা ছেড়ে দিয়ে টুল ধরে। নির্বাণ এইবার আস্তেধীরে নিচে নেমে আসে৷ অতঃপর স্পর্শীর দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে বলে,
“কমনসেন্স নাই তোমার? তুমি টুল না ধরে আমার পা ধরেছ কোন আক্কেলে? এখনই তো পড়তাম আমি।”
স্পর্শী এইবার বিব্রতবোধ করে বলে, “না মানে..”
“আমার পদধূলি নিয়ে আমাকে সম্মান জানাতে হলে বাসায় গিয়ে নিও, এইখানে আমার হাড়-গোড় ভেঙে নিতে হবে না।”
কথাটা বলেই নির্বাণ দ্রুত পায়ে হেটে চলে যেতে থাকলো। আর স্পর্শী সেদিকেই হা করে তাকিয়ে থাকলো। সম্পূর্ণ ঘটনাই যেন তার মাথার উপর দিয়ে গেল। কিছু বুঝার উঠার আগে নির্বাণ পুনরায় ফেরত আসলো। কন্ঠস্বর নামিয়ে শানিত ভাবেই বলল,
“ভুলেও কোন টুলে উঠবা না। কোন বই যদি উপরে থাকে তাহলে লাইব্রেরিয়ানকে বলবা৷ নিজে মাতব্বরি করতে যাবে না।”
স্পর্শীকে পুরো বিষয়টা হজম করে প্রত্যুত্তর করার সুযোগ না দিয়েউ নির্বাণ আবার হাঁটা দেয়। দেখতে দেখতে দৃষ্টির আড়ালও হয়ে যায় সে। স্পর্শী কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। নিজের কপাল নিজেই চাপড়ে বলে,
“এইটা কি হলো? ওই সময় টুল না ধরে পা ধরলাম কেন আমি? কেন? এই হাঁদার মত কাজ কেন করলাম আমি? উফফ! কি এক বিশ্রী অবস্থা। আমি এখন মুখ দেখাবো কিভাবে স্যারের সামনে?”
নিজের উপর নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত হলো স্পর্শী।নিজেকে এখন কয়েকটা থাপ্পড় মারতে পারলে শান্তি পেত। কোন কুলক্ষণ সময়ে যে এসেছিল লাইব্রেরিতে আনমনে বিরবির করল,
 “মানুষের লাইব্রেরিতে প্রেমের সূচনা হয় আর আমার ইজ্জতের প্লাস্টিক সার্জারি হয়।”