চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৮

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৮
Writer Asfiya Islam Jannat
সূর্য নিমজ্জিত পশ্চিমাকাশের গহীনে। শেষ আকাশে সরু লালাভ আভার রেখা মিইয়ে যাচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্নে। রাস্তার ধারে সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোয় আবৃত রাস্তা-ঘাট। ফাঁকা রাস্তায় সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলছে। শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এক রেস্টুরেন্টে বসে আছে স্পর্শী। একদম কিনারে, দেয়াল ঘেঁষে। বা-পাশের পুরো দেয়াল স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি হওয়ায় বাহিরের রাস্তা সাচ্ছন্দ্যেই দেখতে পারছে সে। স্পর্শী একমনে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। রাস্তার অপর পাশে ফুটপাতে একটি কুকুর আর বিড়ালের সাংঘাতিক ঝগড়া চলছে, সেটাই অতি মনোযোগ সহকারে দেখছে সে। তাকে যে অতি সময় ধরে কেউ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সেদিকে বিন্দুমাত্র ধ্যাণ নেই তার। সে তো মগ্ন আপন ভাবনায়।
হঠাৎ কারো ভরাট কন্ঠে তার ধ্যান ভাঙ্গে। বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকায় সে।
“কি খাবে বল?”
স্পর্শী দৃষ্টি নত করে বলে, “আপনার যা ভালো লাগে অর্ডার দিন। আমার কোন সমস্যা নেই।”
নির্বাণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে, “এলার্জি আছে কিছুতে? বা সাইড-ইফেক্ট?”
স্পর্শী মাথা দুলিয়ে না-সূচক উত্তর বলে, “তেমন কিছুতে নেই। তবে..”
নির্বাণ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলে, ” কি?”
“মাশরুম আর বাদাম জাতীয় খাবার খেতে পারি না আমি, কিছুটা সমস্যা হয়।”
“আচ্ছা।”
নির্বাণ ওয়েটারকে ডেকে নিজ থেকেই অর্ডার দেয়। অর্ডার দেওয়া শেষে ওয়েটারকে সে সতর্ক করে দেয়,  তাদের খাবারে মাশরুম বা বাদাম জাতীয় কোন উপকরণ ব্যবহার না করা হয়। ওয়েটার টুকরো এক হাসি দিয়ে আশ্বস্ত করে নির্বাণকে। অতঃপর অর্ডার নিয়ে চলে যায় সে। এর সবটাই স্পর্শী নীরবে দেখলো। অভিব্যক্তিতে কিছু প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে সে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছে। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানবটি আজ এত কোমল। আদৌ ভাবা যায়? এ যেন তার স্বভাবের উল্টো প্রকৃতির কোন এক মানব৷ তবে নির্বাণের এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো মন্দ লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে, কেউ তো খেয়াল রাখছে তার।
ক্ষণেই সরু হাসির রেখা ফুটে উঠলো স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে। নির্বাণ সেটা খেয়াল করে বলে,
“হাসছো যে?”
স্পর্শী দ্রুত নিজের হাসিটুকু মিইয়ে নিয়ে দৃষ্টি নত করে বলে, “না! তেমন কিছু না।”
নির্বাণ ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”
“হু।”
কথাটা বলে স্পর্শী কিছুটা আঁটসাঁট হয়ে বসে। নির্বাণ তা দেখে বলে, “একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।”
স্পর্শী দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বলে, “জি বলুন।”
নির্বাণ ধীর কন্ঠে বলে, “তুমি কি বিয়েটা মানো?”
স্পর্শী কিছু প্রহর নীরব থেকে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, মানি।”
“আর আমাকে স্বামী হিসেবে?”
তৎক্ষনাৎ স্পর্শী তুলে তাকায়, বিব্রত তার দৃষ্টি। আচমকা এমন প্রশ্নের আক্রমণের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা সময় লাগে তার নিজেকে সামলে উঠতে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“মানি তবে কোথাও একটা জড়তা রয়ে যায়। আপনাকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।”
“ভেবে বল কিন্তু। একবার যদি তুমি এই সম্পর্কে কমিটেড হয়ে যাও তাহলে কিন্তু পিছ পা হওয়ার সুযোগ নেই।”
“বিয়ে তো ছেলেখেলা না, তাই না? আমি যেহেতু সম্পর্কটা ভাঙতে ইচ্ছুক নই, সেহেতু চেষ্টা আমার পক্ষে থেকে থাকবেই। সময় দিন মানিয়ে নিব সবটা আমি।”
নির্বাণ কিছু প্রহর চুপ থেকে মৃদু স্বরে বলে, “বেশ! তবে মানিয়ে নিতে না পারলেও তোমায় আমি ছাড়ছি না।”
কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুলতেই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্পর্শী। থম মেরে যায় সে। নির্বাণের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ। যা ক্ষণেই স্পর্শীকে ভাবিয়ে তুলছে। নির্বাণ কি তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জুড়ে যাওয়া সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস হচ্ছে? আগ্রহ দেখাচ্ছে তার প্রতি? নাহ! আর ভাবতে পারছে না স্পর্শী। স্পর্শী নির্বাণকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই নির্বাণের ফোন বেজে উঠে। নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। নির্বাণের ফোনালাপের মাঝেই চাপা পড়ে যায় স্পর্শীর কথা।
আনমনা হয়ে বসে আছে স্পর্শী। দৃষ্টি তার খাবারের প্লেটের দিকে হলেও মন-মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরছে অন্য চিন্তা-ভাবনা। ছুরি আর কাটা চামচ দিয়ে সাজানো-গোছানো থালির এক কোনে অনবরত আঁকিবুঁকি করেই চলেছে সে। সাত আইটেমের থালি থেকে শুধু মাত্র ফ্রাইড রাইসটুকুই মুখে তুলেছে স্পর্শী। বাকিসব আগের ন্যায় পড়ে আছে। স্পর্শীর এমন ভাবভঙ্গি দেখে নির্বাণ জিজ্ঞেস করে,
” কোন সমস্যা? খাচ্ছো না যে?”
স্পর্শী এইবার আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। অপ্রস্তুত ভাবেই কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলে, “এইতো খাচ্ছি।”
কথাটা বলেই বিফ স্টেকটা কাঁটা চামচ দিয়ে ধরে তারউপর ধারালো ছুরির ঘা বসালো। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো মাংসটির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো করার। কিন্তু হাহ! স্টেকটি যেন দুইখন্ড হতে নারাজ। কিছুটা সময় অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টার পরও যখন ফলাফল শূন্যে কোঠায় তখন বিরক্তিতে স্পর্শী মুখ ঘুচে এলো। সে ছুরি-চামচ ব্যবহারে অতো দক্ষ নয়। কিন্তু নিজের ত্রুটি না মেনে সে মনে মনেই স্টেক নামক জিনিসকে একদফা গালি দিয়ে নিল।
আরেক দফা গালমন্দ করলো রেস্টুরেন্টের মালিককে। আমরা ভাই বাঙালি মানুষ, খাব হাত দিয়ে। খামাখা ইংরেজের বংশধরদের মত কাঁটা-চামচ-ছুরি দিয়ে কেন খেতে হবে ভাই? নেহাৎ নির্বাণ পাশে না থাকলে স্পর্শী হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করে দিত। কিন্তু নির্বাণ আছে বলে সেটা পারছে না। প্রেস্টিজের ব্যাপার-স্যাপার আছে তো নাকি? স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আহত চোখে তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণ নির্দ্ধিধায় ছুরি-চামচের ব্যবহার করে মাংসের টুকরো করেই চলেছে। সেটা দেখে স্পর্শীর মনে ঈষৎ ঈর্ষা জাগলো। মানুষটাকে সবকিছুতে পটু কেন হতে হবে? একটু অপটু হলে ওর মত পাবলিকের এত সমস্যার সম্মুখীন হতে হত না। বিতৃষ্ণায় এইবার স্পর্শীর মুখ ছোট হয়ে আসে। উপায়ন্তর না পেয়ে, স্টেক বাদে অন্যসকল উপকরণ দিয়ে কাজ চালানোর পরিকল্পনা আঁটে।
হঠাৎ নির্বাণ স্পর্শীর সামনে থেকে ওর থালিটা সরিয়ে নিয়ে নিজের থালিটা এগিয়ে দেয়। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
“নাও! খাও এইবার।”
স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে নির্বাণের দেওয়া থালির দিকে তাকায়। স্টেকের ছোট ছোট টুকরো করা তাতে। বিস্ময়ে এইবার স্পর্শীর মুখ কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আসে। নির্বাণ তা দেখে বলে,
“নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতে শিখো। সামনের মানুষ মাঝে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নেই যে তুমি না বললেও সে সবসময় বুঝে যাবে।”
স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে নিজের অজান্তেই ছোট এক হাসির রেখা ফুটে উঠে। সে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় অতঃপর নীরবেই খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষে স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকাতেই দেখে  নির্বাণ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। স্পর্শী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকাতে, নির্বাণ ডান হাতের তর্জনী উঠিয়ে স্পর্শীর ঠোঁটের কিনারে নিয়ে যায়৷ খুব সপ্তপর্ণে এঁটো খাবারের ছোট দানা হাতে তুলে নেয়। ঘটনাক্রমে স্পর্শী হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের পানে। হঠাৎ সে উপলব্ধি করতে পারলো, তার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে। শরীর ঈষৎ পরিমাণ কাঁপছে।
হঠাৎ নির্বাণ বলে উঠে, “যাওয়া যাক এইবার?”
স্পর্শী হতবুদ্ধির মত শুধু মাথা দুলায়। নির্বাণ উঠে দাঁড়াতেই স্পর্শী সব গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নির্বাণ ও স্পর্শী রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির সামনে আসতেই স্পর্শীর টনক নাড়ে বিল তো দেওয়া হয়নি। সে তটস্থ সুরে বলে,
“আপনি বোধহয় বিল দিতে ভুলে গিয়েছেন।”
নির্বাণ ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে বলে, “না, ভুলি নি।”
স্পর্শী নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, “কিন্তু আপনাকে তো বিল দিতে দেখিনি আমি। সারাক্ষণ তো আমার সামনেই বসে ছিলেন।”
“নিজ রেস্টুরেন্টে টাকা দিয়ে খাব?”
“মানে?”
নির্বাণ কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “এইটা তোমার শাশুড়ি মার রেস্টুরেন্ট। মা আর আমি এইখানকার ওনার।”
মুহুর্তেই স্পর্শীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। ক্ষণেই মনে পড়ে গেল তখন স্টেক কাঁটতে না পারায় সে রেস্টুরেন্টের ওয়ানকে গালমন্দ করেছিল। নিজের কপাল এখন নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করলো স্পর্শীর। শেষে কি-না নিজের বর আর শ্বাশুড়িকেই গালমন্দ করলো? হায় খোদা! আল্লাহ মাফ করুক। স্পর্শী কোন মতে বলে উঠে, “অহ আচ্ছা।”
“হুম। চল এখন, রাত হচ্ছে।”
স্পর্শী কোনমতে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়, হাঁটা দেয় গাড়ির দিকেই।